আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ব্রেখট তাঁর নাট্যদর্শন ও বাঙালি

সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়




বিপ্লব বাঙালির রক্তে। রাজনীতি ও কবিতা বাঙালির শ্বাস-প্রশ্বাসে। শিল্পে ও জীবনে প্রতিবাদে মুখর হতে চাওয়া বাঙালির স্বাভাবিক ধর্ম। এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে যদি প্রবল রসবোধ এবং দ্বন্দ্ব সংঘাতময় নাট্যমুহূর্ত নাটকের মধ্যে কোনো মহান প্রতিভা সৃষ্টি করতে পারেন তিনি তো বাঙালির মন জয় করে নেবেনই। এই প্রতিভাধর হলেন জার্মান কবি, দার্শনিক, নির্দেশক ও নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখট।

নাটকের ঘটনার মধ্যে দিয়ে দর্শককে শুধু মজিয়ে রাখা নয়, বিনোদনের পাশাপাশি দর্শককে ভাবিয়ে তোলাও নাট্যকারের কাজ বলে মনে করতেন বার্টোল্ট ব্রেখট। তাই অচিরেই তাঁর জার্মান ভাষায় লেখা নাটকগুলো হয়ে উঠেছে বাঙালির নাটক। তিনি বাঙালির প্রাণের নাট্যকার, বাংলার নাট্যকার।

নাট্য শিল্পের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দু' ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন বার্টোল্ট ব্রেখট। এই দৃষ্টান্ত সারা-বিশ্বে বিরল। নাট্য শিল্পের উপস্থাপনা কী রকম হবে তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেন ব্রেখট। সেই প্রশ্নের প্রতিফলন ধরা আছে তাঁর কবিতায়। কবি শঙ্খ ঘোষ তার ভাষান্তর করেছেন। 'ড্যানিশ শ্রমিক অভিনেতাদের কাছে দেখার শিল্প বিষয়ে' কবিতায় ব্রেখট এক জায়গায় লিখছেন -
"কিছু ভঙ্গি কিছু মুদ্রা নিয়ে নিরন্তর এই প্রদর্শনায়
লাভটা ঠিক কী?
যা তোমরা শেখাও আমাদের সেই শুধু ভাগ্যের বলি। বাইরের ক্ষমতার হাতে
আর ভিতরের প্রবৃত্তির হাতে অসহায় বলিদের মূর্তি দেখাও শুধু...
"

এই কয়েকটা লাইনের মধ্যে দিয়েই ব্রেখটের সামগ্রিক চিন্তাভাবনার নির্যাস প্রকাশিত হয়। মগজকে সক্রিয় রাখতে চাইছেন, দর্শক যা দিচ্ছেন বা তাকে যা দেখান হচ্ছে সেই বিষয়বস্তুকে তিনি নিয়ে আসতে চাইছেন প্রশ্নের আঙ্গিনায়। এই প্রশ্নের উত্তরও আবার যেন কোথাও ওই কবিতাটিরই আরেক জায়গায় লুকিয়ে আছে।

"কিন্তু কিভাবে ঘটবে সেটা? মানুষের এই দল বেঁধে বেঁচে থাকা ছবি কিভাবে আঁকবে যাতে আরো বোঝা যায় আরো বেশি অধিকার করা যায় তাকে? কিভাবে নিজেকেই না দেখিয়ে
কিংবা জালে ভাঙা অন্যদেরই আচরণ না দেখিয়ে শুধু
পারা যায়? কিভাবে দেখানো যায় আজ
নিয়তির জাল বোনা, জাল ছুঁড়ে দেওয়া?
আসলে যা মানুষেরই বোনা মানুষেরই হাতে ছুঁড়ে দেওয়া? প্রথমেই তোমাকে জানতে হবে দেখার শিল্পকে।
তুমি, অভিনেতা
অন্য সব শিল্পের আগে তোমাকে আয়ত্তে পেতে হবে
দেখার শিল্পকে।
কেননা, দেখতে কেমন তুমি, সেটা নয়
জরুরী কেবল আজ কী তুমি দেখছ, আর কী তুমি দেখাতে পারো ঠিক।
"

এখন শিল্পের এই যে প্রচলিত কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করা, অভিনেতা ও শিল্পীদের সময় ও সমাজকে দেখতে শেখা, এবং দর্শককে দেখানোর বিষয়ে ভাবতে বলা - এই গভীর জীবনবোধ ব্রেখটের রাতারাতি আসেনি। কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রেই তা হয় না। এই নতুন চেতনা উন্মেষিত হওয়ার পেছনে ব্রেখটিয় সময় ও সমাজকে বোঝাটা জরুরী।

১৮৯৮ খ্রীঃ জার্মানির বাটাভিয়াতে জন্ম হয় বার্টোল্ট ব্রেখট-এর। কুড়ি-বাইশ বছর বয়স থেকেই তিনি প্রথাগত পড়াশোনার বাইরে গিয়ে, লেখালেখিকে তাঁর সর্বক্ষণের কাজ হিসেবে বেছে নেন এবং নাটক রচনায় হাত পাকাতে শুরু করেন। পাশাপাশি সমান্তরালভাবে চলতে থাকে তার রাজনৈতিক বোধের বিকাশ ও দার্শনিক জ্ঞানচর্চা। মার্কসবাদ চর্চার বিশ্লেষণ ও প্রতিফলন আসতে শুরু করে তাঁর নাটকের মধ্যে।

১৯৩০-এর পর থেকে হিটলারের অভ্যুত্থান এবং নাৎসিদের বাড়-বাড়ন্ত আরও বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ক্ষমতাবানদের স্বৈরাচার ও রাষ্ট্রক্ষমতার অপপ্রয়োগের ফলে কীভাবে, দুর্যোগ নেমে আসে সাধারণ মানুষের জীবনে। অত্যাচারের হাত থেকে প্রাণ বাঁচতে বহুবার দেশ বদল করতে হয়। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই সংগ্রামী মানুষ যেমন তার বেঁচে থাকাকে বিপন্ন করেছেন, অপরদিকে তিনি আরও বেশি করে স্থিতধি হয়েছেন তাঁর নাট্য দর্শনে, নাট্য নির্মাণে। আবার একই সঙ্গে ক্ষমতাকে ঠাট্টা করা, পরিহাস করা, মজা করার ক্ষমতা তাঁর নাটককে শুধু তত্ত্বকথা না বানিয়ে, করে তুলেছে তুমুলভাবে দর্শকের কাছে আকর্ষণীয়।

গত শতাব্দীর স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে, জাতিগতভাবে খণ্ডিত ও পর্যদুস্থ হয়েছে বাঙালি। বাঙালির শিল্প ও সংস্কৃতি, অর্থনীতির যে সুদৃঢ় ভিত্তি ছিল দেশভাগের ফলে তা রাতারাতি ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। স্বাধীন ভারতবর্ষে নতুন করে আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে ছিন্নমূল বাঙালিদের। দিল্লির ক্ষমতা-কেন্দ্রের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে তাঁর অবলম্বন হয়ে উঠেছে বামপন্থা ও বাম রাজনীতি। উদ্বাস্তু হওয়ার যন্ত্রণা ও বামপন্থার প্রতি আস্থা বাংলার নাট্য সমাজকে করে তুলেছে ব্রেখটমুখী। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা থিয়েটারের ঘরের মানুষ।

তবে, রাজনৈতিক দর্শনের ঘেরাটোপে ব্রেখটকে বেঁধে ফেললে, তার প্রতিভা ও সৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হবে। তিনি আসলে ক্ষমতা-কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধী কণ্ঠস্বর। সত্যের গভীরে ডুব দিয়ে দেখতে চাওয়া ডুবুরি। সর্বোপরি মানবতার কথা বলা, মনুষ্যত্বের কথা বলা, থিয়েটারের মানুষ। বাংলা থিয়েটারের আপনজন। তাই ব্রেখটের ১২৫তম জন্ম বছরে তাঁর নাটকগুলো আবার নতুন করে চর্চা হচ্ছে অভিনয় হচ্ছে - আজকের এই জটিল কর্পোরেট পুঁজিবাদী বিশ্বে তিনি নতুন করে বাঙালির কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।