আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩০

সমসাময়িক

মায়ানমারে গণহত্যা


মায়ানমার ভারতের নিকট প্রতিবেশী দেশ। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে সুদীর্ঘ সীমান্ত। ১৮৮৬ থেকে এখনকার মায়ানমার অর্থাৎ তখনকার বার্মা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কাজেই ভারত ও বার্মায় একই প্রশাসনিক ব্যবস্থা কার্যকর করা হত। ব্রিটিশ শাসন থেকে দুই দেশই ১৯৪৭ (ভারত) ও ১৯৪৮-এ (বার্মা) মুক্তি পেয়েছে। ১৯৮৯ থেকে বার্মার নাম হয়ে যায় মায়ানমার।

ভারত ও তখনকার বার্মা বা এখনকার মায়ানমারের মধ্যে প্ৰগাঢ় মৈত্রী না থাকলেও প্রবল বৈরিতা কখনও বিরাজ করেনি। এমনকি সাম্প্রতিক অতীতে মায়ানমার থেকে উৎখাত হওয়া রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে মায়ানমার কোনোদিন উষ্মা প্রকাশ করেনি। অনেক সময়েই ভারতের জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা মায়ানমারের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে ভারত বিরোধী ক্রিয়াকর্মাদি চালিয়ে গেছে। আবার ভারতের অনুরোধে মায়ানমার সরকার জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে বা সে দেশ থেকে বিতাড়নের কাজে গাফিলতি দেখায়নি।

বর্তমানে মায়ানমারে ফৌজি প্ৰশাসন দেশ চালাচ্ছে। ২০২১-এর ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখলের পর থেকে ফৌজি প্ৰশাসকরা কোনো রকমের আন্দোলন বরদাস্ত করতে রাজি নয়। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্তব্ধ করতে বলপ্রয়োগ করা হয়। লাঠি-জলকামান-কাঁদানে গ্যাস দিয়ে শুরু করে সরাসরি গুলিবর্ষণ করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমিয়ে রাখতে ফৌজি সরকার সিদ্ধহস্ত। আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য চলতে থাকা সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ফৌজি প্রশাসন সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত।

তবে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের উপর ফৌজি সরকারের সাম্প্রতিক আক্রমণ এতদিনের সমস্ত হানাদারিকে ছাপিয়ে গেছে। মঙ্গলবার ১১ এপ্রিল সকালে সাগাইং এলাকার কানবালু টাউনশিপের পাজিগাই গ্রামে জড়ো হয়েছিলেন শতাধিক মানুষ। উপলক্ষ ছিল বিরোধী আন্দোলনের স্থানীয় দপ্তরের উদ্বোধন। সেখানেই সকাল ৮টা নাগাদ আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ শুরু হয়। সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)-কে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, শ’দেড়েক মানুষের জমায়েত হয়েছিল। তার মধ্যে ২০ থেকে ৩০টি শিশু এবং অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা ছিলেন। ফৌজি জুন্টা সরকারের যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা বোমার ঘায়ে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। বেঁচে নেই বিরোধী আন্দোলনের স্থানীয় নেতৃত্বও। মূলত তাঁদের উদ্যোগেই দলীয় দপ্তরটির উদ্বোধনের অনুষ্ঠান চলছিল।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, প্রথম বোমাবর্ষণ পর্ব শেষ হওয়ার আধ ঘণ্টা বাদে একটি হেলিকপ্টার আকাশে চক্কর কাটতে থাকে। সেখান থেকেও গুলি ছুটে আসছিল। তাতেও অনেকের মৃত্যু হয়েছে। ঠিক কত জনের মৃত্যু হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে প্রাথমিক হিসাব বলছে ২০ থেকে ৩০টি শিশু-সহ মহিলা, অন্তঃসত্ত্বা এবং পুরুষ মিলিয়ে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মায়ানমারের ফৌজি জুন্টা সরকারও বিমান হামলা চালানোর কথা স্বীকার করে নিয়েছে।

ফৌজি সরকারের মুখপাত্র জানিয়েছেন, "ওই এলাকায় পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিপি)-এর একটি কার্যালয় উদ্বোধনের অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানেই হামলা করা হয়েছে।" পিডিপি মায়ানমারের ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (জাতীয় সরকার)-এর সশস্ত্র শাখা। জাতীয় সরকার নিজেদের দেশের 'আইনি সরকার' বলে দাবি করে। ফৌজি সরকারের মূল বিরোধী হিসাবেও গোটা দেশে কাজ করে তারা।

ফৌজি সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, উর্দি পরিহিত বিদ্রোহীদের নিশানা করে মারা হয়েছে। সেই সঙ্গে কিছু সাধারণ মানুষেরও মৃত্যু হতে পারে বলেও জানানো হয়েছে। যদিও কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা জানায়নি। রাষ্ট্রপুঞ্জ নিজের দেশের নাগরিকদের উপর ফৌজি জুন্টা সরকারের বিমানহানার তীব্র নিন্দা করেছে। আমেরিকাও এই ঘটনায় কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

মায়ানমারের নাগরিকদের উপর ফৌজি জুন্টা সরকারের বিমানহানার ঘটনা পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষের জন্য চিন্তার বিষয়। যেসব সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা আছে, যে সমস্ত সরকার আধিপত্য বিস্তারের জন্য আগ্রাসী রাজনীতি করতে অভ্যস্ত তারা মায়ানমারের ঘটনা প্রয়োজনে নিজের দেশে ঘটাবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? সবমিলিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এই ঘটনা নিঃসন্দেহে এক চিন্তার বিষয়। এবং সতর্ক থাকার সময়।