আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা ● ১-১৫ এপ্রিল, ২০২৩ ● ১৬-৩০ চৈত্র, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

লটারি


খবরের কাগজের প্রচ্ছদ। কথাটা বেমানান ঠেকলেও বাস্তবে প্রায় প্রতিদিন সকালের খবরের কাগজে নজরে আসছে। প্রথম পাতায় পূর্ণ পৃষ্ঠার রঙিন বিজ্ঞাপন। বিষয় - লটারি। নম্বর মেলানোর খেলা। খেলায় জিতে গেলে সর্বোচ্চ কত টাকা পাওয়া যেতে পারে সেই সব বিষয়ে অনেকানেক চটকদার কথার শেষে ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্রতম অক্ষরে লেখা থাকে - লটারি এক বিপজ্জনক নেশা। এই খেলায় জীবন ও অর্থহানির আশঙ্কা রয়েছে।

সত্যি সত্যিই লটারি সম্ভাবনার খেলা। ক্রেতার কেনা টিকিটের নম্বর খেলার নিয়মানুযায়ী জয়ী হলে কোটি টাকার নগদ পুরস্কার। প্রথম পুরস্কারের অর্থ কখনও আবার দুই বা তিন কোটি কিংবা আরও বেশি বলে বিজ্ঞাপনে জানানো হচ্ছে এবং লোকে খেলছে। বলা ভালো, নিয়মিত খেলছে। এবং বেশি বেশি করে খেলছে। কত লোক টিকিট কাটছে সাধারণভাবে বলা মুশকিল। লটারির আয়োজক কখনও তা প্রকাশ্যে আনে কি?

আশঙ্কার কথা জেনেশুনেও লোকে লটারি খেলছে। টাকা বিনিয়োগ করতে কার্পণ্য করছে না। গাঁয়ে-গঞ্জে, শহরের পাড়ায় পাড়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো হু হু করে বেড়ে চলেছে লটারির টিকিটের দোকান। রেল স্টেশন, বাস টার্মিনাল, হকার্স কর্ণার থেকে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায় তার উপস্থিতি। চাহিদা আছে অর্থাৎ নিয়মিত ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে বলে বেড়েই চলেছে দোকানের সংখ্যা। এই সব দোকান পুরসভা বা পঞ্চায়েতের অনুমোদন পায় কি?

পাশপাশি প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের ভেতরের দিকের কোনো এক পৃষ্ঠায় ছোটো করে ছাপা হয় আত্মহত্যার খবর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় লটারির নেশায় সর্বস্বান্ত হয়ে অবসাদগ্রস্ত মানুষটি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। সত্যি সত্যিই এ এক সর্বনেশে নেশা। আপাতদৃষ্টিতে আশা পূরণের জন্য আশাব্যঞ্জক। ভাবখানা এমন, আজ পাওয়া যায়নি তো কী হয়েছে আগামীকাল তো পাওয়া যেতেই পারে। এমনি করে চলতে থাকে আদি অনন্তকাল যতক্ষণ না মানুষটি সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। আরও এক ধরনের ক্রেতা আছে যারা নেশায় জড়িয়ে পড়ার প্রথম দিকে হঠাৎ করে পাঁচ-দশ বা পঁচিশ হাজার টাকা জিতে যায়। তাদের মনে হয় আবার চেষ্টা করে দেখা যাক, যদি এক কোটি বা নিদেনপক্ষে পঞ্চাশ লক্ষ পেয়ে গেলে ক্ষতি কী! চূড়ান্ত বিচারে পুরোটাই আশাভঙ্গের নেশা।

কিছু অতি বুদ্ধিমান প্রতারক-প্রবঞ্চক আবার লটারির সুযোগে কালো টাকা সাদা করে নেয়। পুরস্কারে পাওয়া টিকিট প্রকৃত বিজয়ীর কাছ থেকে নগদ টাকায় কিনে নিয়ে টিকিটটি লটারি কর্তৃপক্ষর দপ্তরে জমা দিয়ে ব্যাঙ্ক মারফত পাওনা টাকা কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেয়। এই পদ্ধতিটা কবে থেকে চলছে জানা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের এক প্রভাবশালী নেতা ও তাঁর কন্যার গত কয়েক বছরে কয়েক বার লটারির টিকিট জিতে কয়েক কোটি টাকা পাওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হলে এমন অভিনব কৌশল সম্পর্কে জানার সুযোগ ছিল না। এই সব অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে এবং তদন্তের স্বার্থে তিনি এখন তিহাড় জেলে দিন কাটাচ্ছেন। তবে যা জানা যায়নি তা হল, এই প্যাঁচালো পদ্ধতি উদ্ভাবন করার জন্য তাঁকে কোনো পুরস্কার দেওয়ার চিন্তাভাবনা হচ্ছে কি?

এখন যে লটারিগুলি চালু রয়েছে তা আপাতদৃষ্টিতে সরকারি। তবে প্রায় কোনো রাজ্য সরকার লটারির আয়োজক নয়। এখনকার রীতি অনুযায়ী পুরো বিষয়টি আয়োজনের দায়িত্ব কোনো বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়। অর্থাৎ আউটসোর্সিং। সরকারের টেন্ডারে সাড়া দিয়ে যে ঠিকাদার সংস্থা সর্বোচ্চ টাকা দিতে রাজি হয় তাদের কাছে এক বছর বা ছয় মাস কিংবা কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য লটারি আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কত টিকিট ছাপা হল বা কত টিকিট বিক্রি হল অথবা শুধুমাত্র বিক্রি হওয়া টিকিটের মধ্যে থেকে জয়ী নির্ধারণ করা হয়েছে কিনা এইসব খুঁটিনাটি বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়ার কথা নয়। বিক্রি না হওয়া টিকিট জয়ী হলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। একেবারে নিস্ক্রিয়। শর্ত পূরণ হয়েছে কিনা অর্থাৎ টেন্ডারে স্বীকৃত অর্থ রাজস্ব খাতে জমা পড়েছে কিনা সেটা জেনেই সরকার সন্তুষ্ট।

এর সঙ্গে জুড়ে গেছে অনলাইন লটারি। সে আরও ভয়ঙ্কর। বলা ভালো, দু'মুখো তলোয়ার। টিকিটের টাকা অনলাইনে জমা দিতে হয়। জেতা-হারা সম্ভাবনার ব্যাপার। হেরে গেলে টাকাটাই জলাঞ্জলি। তার থেকেও বড়ো বিপদ সামান্য অসতর্কতার সুযোগে অনলাইনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। প্রতারকদের জাল বিছানো অনলাইন ব্যবস্থায় নিমেষে শূন্য হয়ে যেতে পারে ব্যাঙ্কের যাবতীয় সঞ্চয়। এই বিষয়ে কোনো মামলা-মোকদ্দমা করা যাবে না। বলা হবে বিজ্ঞাপনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল যে, এই খেলায় জীবন ও অর্থহানির আশঙ্কা রয়েছে।

মানুষের কাজ নেই। থাকলেও রোজগার কমে গেছে। তার উপরে রয়েছে মূল্যবৃদ্ধি। এই পরিস্থিতিতে মানুষের সামনে আশার প্রলোভন দেখিয়ে চলছে অবাধ বাণিজ্য এবং এই বাণিজ্যিক ব্যবস্থার ডালপালা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। আশার নেশায় বুঁদ হয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিদিনই আরো একটু করে এগিয়ে চলেছে এক অন্ধকার গহ্বরের দিকে। এই সামাজিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য সরকারের অবিলম্বে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। অন্যথায় লটারির ব্যবসা এবং নেশায় সমাজ তলিয়ে যাবে।