আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৩ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

নয়া উদারনীতি আদতে শ্রমিক বিরোধী

প্রতীশ ভৌমিক


আমাদের দেশে নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই সরকারি ও বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই সংস্থার শ্রমিক কর্মচারীদের অর্জিত আইনি অধিকারগুলো যেমন অস্বীকার করা হয়েছে, পাশাপাশি ঐসব সংস্থায় ক্রমশঃ কর্মীদের উপর নজরদারির মাধ্যমে ভয়ভীতির বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে। বেশি সময় কাজ করিয়েই হয়েছে অবাধ শ্রম শোষণ ও লুন্ঠন। ঐ সময় থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের (বিশ্বায়নের নামে উদার অর্থনীতি ও বেসরকারিকরণের মডেল) বা প্রকল্পের সুযোগ নিয়ে উন্মুক্ত বানিজ্য নীতির যে ঢেউ উঠেছিল পর্যায়ক্রমে সেই নীতি এখন সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক বিজেপি ও কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সরকার বিশ্ব ব্যাঙ্কের 'Ease of doing business'-এর স্লোগানকে হাতিয়ার করে কর্পোরেটদের সহজ ঋণ, আর ব্যবসায়ীদের হাজারো সুবিধা দিতে নিয়মের সমস্ত বাধা বিপত্তি সরিয়ে শ্রম আইনকে অনেকটা শিথিল করেছিল। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষেরা এই সময়ের পর নিজেদের মতো করে প্রাইভেট রুলও চালু করেছিলো, যা শ্রম আইনকে আজ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোতে প্রাইভেট-পাবলিক পলিসির মডেল সহ Foreign Direct Investment-এর নীতি প্রনয়ণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলোর হস্তান্তর করাতে বহুক্ষেত্রেই স্থায়ী চাকরি আজ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

মার্জার, মেগা মার্জার, শেয়ার কেনাবেচা বা অধিগ্রহণ ইত্যাদি বিভিন্ন নীতির ফলে বিশ্ব ব্যাঙ্কের রেটিংয়ে খানিক বৃদ্ধি এলেও এর ফলে বড় কোম্পানিগুলো ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলোকে গিলে নিয়েছিল। ফলত যে হারে গণছাঁটাই হয়েছে তাতে হাজার হাজার পরিবারের ক্ষতি হয়েছে। সেকথা মানুষ আজও ভুলতে পারেনি। এছাড়াও VRS দিয়ে বহু মানুষের চাকরি চলে যাওয়া, বেসরকারি হাতে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাকে বিক্রি করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে ঠিকা কর্মী নিয়োগে সাহস জুগিয়েছে কেন্দ্রের সরকার। অফিস, ফ্যাক্টরী, ডিপো সর্বত্রই এই বদল ঘটেছে, তাতে মানুষের জীবন-জীবিকায় অন্ধকার নেমেছে। আরও হতাশা এসেছে যখন আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি সামনে এসেছে।

পৃথিবীজুড়ে মন্দায় আক্রান্ত শিল্পোন্নত দেশগুলোতে সমস্ত পণ্যের চাহিদা যখন ক্রমশঃ কমছে, যখন বড় বড় কোম্পানিগুলো বিশ্বজুড়ে তাদের বাজার খুঁজছে, তখন কিছু সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতা, তাদের দল ও কর্পোরেটদের লবি একত্রিত হয়ে তাত্ত্বিকভাবে দাবি করেছে বাজার খুলে দাও। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ করা দরকার। দেশের বাজার উন্মুক্ত করতে হবে। আর তারপর থেকেই একে একে আর্থিক সংস্থাগুলোর বিনিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পের বিলগ্নীকরণ ও পুনর্গঠন Restructuring প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এভাবে সবকিছুই কেমন যেন বদলে বদলে গিয়েছিল। আজ ব্যাঙ্কের টাকা লুঠ থেকে জমি, জল, আকাশ, বাতাস সব বিক্রি হচ্ছে কর্পোরেটদের কাছে, সরকারের নেতা মন্ত্রীদের ভয়ঙ্কর দুর্নীতি সামনে এসেছে। আজ দেশের শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়।

শ্রমিকের আইনি অধিকারকে খর্ব করতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সরকারি নিয়ম বদলে ১০০-র পরিবর্তে ৩০০ পর্যন্ত, শ্রমিকের সহজ ছাঁটাই নিশ্চিত করেছে এই সরকার। ব্যক্তিগত মালিকানার কোম্পানিগুলোতে ন্যূনতম মজুরি তো দেয়ই না বরঞ্চ তারা নিয়ম বদলে ৮ ঘন্টা কাজের পরিবর্তে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করাতে চায়। দেশী/বিদেশি কর্পোরেটরা অঘোষিতভাবে শ্রমসংস্কার নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর শ্রম আইন পরিবর্তন ও প্রয়োগের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে শ্রম আইনের ক্ষেত্রে ৪৪টির মধ্যে ২৯টির বদল এনে শ্রমকোড চালু করছে এই সরকার। এক্ষত্রে কারখানার শ্রমিক হোক অথবা ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট অফিসের চাকুরেই হোন, উভয়ের ক্ষেত্রেই অবাধ শোষণ, দমন, পীড়ন, হয়রানি চলছে।

মেডিক্যাল অথবা সেলস্-এর সঙ্গে যুক্ত (কসমেটিকস, কনফেকশনারি থেকে ইলেকট্রনিক আইটেম বা মোটর পার্টস-এর মতো হাজারো দ্রব্য) বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানির প্রতিনিধি বা ফিল্ডকর্মীদেরকে তাদের 'টার্গেট' বা বিক্রির পরিমাণকে চাকরির শর্ত হিসেবে যুক্ত করছে কর্তৃপক্ষ। চাকরির শর্তপূরণ না হলে পরে রাতের ঘুম ছুটিয়ে দেয়। বিক্রির পরিমাণ বাড়ানোর জন্য মানসিক চাপ দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এর ফলে বহুক্ষেত্রেই অবসাদ ও হতাশা যেমন তৈরি হয়, আবার কখনো হতাসা থেকে অন্যমনস্ক হয়ে বড় সড়ক দুর্ঘটনার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এই হতাশা থেকে আত্মহননের মতো ঘটনাও ঘটেছে।

করপোরেটরা শ্রমিকের আইনি অধিকারকে এড়াতে ও অস্বীকার করতে ম্যানেজার, অফিসার, পার্টনার ইত্যাদি বিভিন্ন নামে নিয়োগপত্র দিয়ে, শ্রমিক ও মালিক সম্পর্ককে লুকিয়ে রাখতে চায়। এই শ্রমিকমারা নীতির পিছনে যে শোষণ/বঞ্চনার রাজনীতি যার ফলে হাজারো ফিল্ডকর্মীকে বদলী, ছাঁটাই করে আইনি বেড়াজালে বেঁধে তাদের পথে বসিয়েছে। কারণ ম্যানেজার বা অফিসারদের জন্য শ্রমদপ্তর এই ছাঁটাই, বদলি নিয়ে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনা। 'হায়ার এ্যান্ড ফায়ার' নীতির প্রবর্তন করতে ভয়ঙ্কর অমানবিক হয়ে উঠেছে কর্তৃপক্ষগুলো। এদের মদত যোগাচ্ছে FICCI, ASOCHEM, IDMA-এর মতো মালিকদের সংগঠন।

একথা ঠিক যে, পার্মানেন্ট বা স্থায়ী কাজ যত কমেছে ততই কমেছে ইউনিয়নের স্ট্রাইকিং ক্ষমতা। ক্রমাগতভাবে চুক্তিভিত্তিক কর্মী বা ঠিকাকর্মী নিয়োগের ফলে শ্রমিক কর্মচারীরা ভয়ে আতঙ্কে অন্যায় চুক্তির সাথেও আপোস করতে বাধ্য হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়া কম বেতনেও কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এই সময়ে অফিস অথবা ফিল্ডে যে কোনও স্থানে কাজের সময় কর্তৃপক্ষ GPS-এর মাধ্যমে কর্মীদের ব্যক্তিগতভাবে নজরদারি করছে। অনলাইন কানেক্ট করার ফলে ফিল্ডকর্মীদের পোর্টাল ব্লক করে মানষিক হেনস্থা, কাজ বন্ধ ও বেতন বন্ধ করছে, এমনকি চাকরি ছাঁটাই করার জন্যও পোর্টাল ব্লক করছে। ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট অফিসের গেটে কর্মীদের বায়োমেট্রিক ম্যাচিংকে ব্লক করে অফিসে ঢুকতে বাধা দেওয়া এবং কাজ থেকে ছাঁটাই করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই এখন 'মাল্টিটাস্ক ওয়ার্কার' নিয়োগ করে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব কাজ করানো হয়। এমন করেই কর্তৃপক্ষেরা আইনি রক্ষাকবচ উপড়ে ফেলছে। আইনের খোলনলচে পালটে শোষণ শাসনের মাত্রা বাড়িয়ে যখন অসহায় শ্রমিক বাহিনী গড়ে তোলে তখন আবার যেন দাসপ্রথার পদধ্বনিই শুনতে পাই। তবে একথা ভূলে গেলে চলবে না যে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি সহ আইনি অধিকার ও সামাজিক সুরক্ষাগুলো রক্ষা হলে তার বিকশিত শক্তি অনেকটা ঠান্ডা বাতাসের মতো, যার ইতিবাচক ফল পায় সমাজের নিচের স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত সবাই।