আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৩ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ভূমিকম্প নয়, বেলাগাম নগরায়নের বলি তুরস্ক

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস


পৃথিবী জুড়েই নগরায়নের ধাক্কায় শহরে জনসতির ঘনত্ব বাড়ছে। শহরের সীমিত জমিতে গায়ে গায়ে তৈরি হচ্ছে ঘর-বাড়ি। আর সেই সীমিত স্থানে অনেক বেশি মানুষের বাসস্থানের লক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে বহুতল। ফলে শহর আড়ে-বহরে যেমন বাড়ছে তেমন বেড়ে চলেছে শহরের গড় উচ্চতা, বাড়ছে শহরে জনঘনত্ব, বাড়ছে নির্মাণের ঘনত্ব। সেই নিরিখে গত কয়েক দশকে তুরস্কের বিভিন্ন প্রদেশেও নগরায়নের ধাক্কায় বহুতল বেড়েছে হৈহৈ করে। এটা অনেকেই জানেন যে তুরস্ক কিংবা সিরিয়া নির্মাণবিদ্যার প্রেক্ষিতে লাগামছাড়া বহুতল নির্মাণের আদর্শ অঞ্চল নয়। কারণ ওই অঞ্চলটি ইতিমধ্যে ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মাপকাঠিতে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত। ফলে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় লাগামছাড়া বহুতল নির্মাণের দায় কার সেটা নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে।

এই শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রায় পনেরো লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছেন। এদের কেউ কেউ অস্থায়ী তাঁবু থেকে শুরু করে ট্রেনের ফাঁকা কামরায় হাড় হিম করা ঠাণ্ডায় দিন কাটাচ্ছেন। এই মুহূর্তে এই বিপুল অংশের মানুষের পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজন পাঁচ লক্ষ পাকা বাড়ি। এই প্রেক্ষিতে উপযুক্ত নির্মাণ বিধি মেনে তুরস্কে নির্মাণ পরিকল্পনা হয়েছিল কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রবল ভূমিকম্পের দাপটে তাসের ঘরের মতো বাড়ি ভেঙে এবারে যেভাবে পঞ্চাশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাতে সেদেশে এবং সেই অঞ্চলে নগরায়নের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের মান নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। প্রায় নিয়ম করে প্রতি বছর হওয়া ভূমিকম্পের দেশ তুরস্কের স্থাপত্যবিদ এবং বাস্তুবিদদের সন্মিলিত অ্যাসোসিয়েশন ২০২২-এর শেষ দিকে ৫.৯ মাত্রার মাঝারি ভূমিকম্পের পরেই ঘোষণা করেছিল শহুরে নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমিকম্পরোধী বাড়ির নকশা, নির্মাণ প্রযুক্তি এবং নির্মাণ তদারকির ভয়াবহ অভাব রয়েছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই অভাব হাতে কলমে টের পেল সেদেশের লাখ লাখ মানুষ এই বছর ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে।

ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন ভূমিকম্পরোধী নির্মাণ ভাবনা। তেমন অঞ্চলে নির্মাণের ক্ষেত্রে বাড়ির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতার মধ্যে সামঞ্জস্য যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি উন্নতমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উচ্চতর বাড়ির ভূমিকম্পে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। আবার উচু বাড়িগুলির মূল ভারবাহী অংশ হিসাবে বিম-কলামের শক্তি এবং নমনীয়তা হওয়া উচিত কাঙ্খিত মানের। বিশেষ করে বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ইস্পাতের নমনীয়তা এবং শক্তি ভূমিকম্পে বাড়ি টিকে থাকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ইস্পাতের এই কাঙ্ক্ষিত গুন ছাড়াও বহুতলের ভারবাহী বিভিন্ন অংশের সংযোগস্থলে নমনীয়তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন হয় বিশেষ নির্মাণশৈলীর। মানুষের দেহের গোড়ালি কিংবা মালাইচাকির নমনীয়তা হ্রাস পেলে মানুষ যেমন সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না ঠিক তেমনই উঁচু বাড়ির বিম-কলামের জয়েন্ট নমনীয়ভাবে গড়ে না তুললে ভূমিকম্পের সময় আড়াআড়ি ধাক্কার ঝাঁকুনিতে গোটা বাড়ি কিংবা আংশিকভাবে বাড়ির ভারবাহি অংশ ভেঙে পড়তে পারে। এই প্রেক্ষিতে ভূমিকম্পরোধী নির্মাণের মূল মন্ত্র হল প্রয়োজনে মচকাবে কিন্তু ভেঙে পড়বে না এমন কাঠামোর নির্মাণ।

এমন নিয়ন্ত্রিত নির্মাণ সুনিশ্চিত করার জন্য তুরস্কে অতীতে ১৯৯৮ এবং ২০১৮ সালে দু'বার সংশোধিত নির্মাণ বিধি প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের ধাক্কার পরে বোঝা গেল যে সেই নতুন নির্মাণ বিধি বাস্তবায়িত হয়নি। কার্যত দেশের বহুতলের প্রায় অর্ধেক তৈরি হয়েছে সেই নিরাপদ নতুন নির্মাণ বিধির তোয়াক্কা না করেই। তুরস্কর পরিষেবাকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে সরকারকে নতিস্বীকার করতে হয়েছে সেদেশের রিয়েল এস্টেট প্রমোটার এবং ডেভলপারদের কাছে।

দুই তিন দশক আগে তৈরি হওয়া বহু নির্মাণ কাঠামো ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তিতে তৈরি হয়নি। ফলে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে তেমন নির্মাণগুলি ভেঙে না ফেলে সেগুলিকে প্রযুক্তি-নির্ভর উপায়ে মেরামতি করে সেগুলির ভূমিকম্পরোধী করে ক্ষমতা বৃদ্ধি সম্ভব। এমন প্রযুক্তিনির্ভর মেরামতির খরচ গোটা বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি বানানোর খরচের মাত্র ১০-১২ শতাংশ। সেদেশে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে পুরনো দুর্বল বহুতলগুলিকে ভূমিকম্পরোধী করার যে সুযোগ ছিল সেটিও কাঙ্ক্ষিত সচেতনটার অভাবে গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ভূমিকম্পের ধাক্কায় এমন বাড়িগুলি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। এই ভূমিকম্পে কেবল পুরানো বাড়ি নয় এমনকি ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নির্মিত নতুন বহুতলও ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে ভূমিকম্পরোধী উপায়ে নির্মাণ না হওয়ার কারণে।

ইতিমধ্যে সংগৃহীত বিভিন্ন তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুরস্কের বাড়িগুলির ভারবাহী কাঠামোয় যে পরিমাণ ইস্পাতের ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল তার চেয়ে ঢের কম মাত্রার ইস্পাত দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল বাড়তি লাভের তাগিদে। উঁচু উঁচু বহুতলে লিকলিকে কলামের ওপর মাথাভারি স্ল্যাব কিংবা বিমের প্রয়োগ বিস্মিত করেছে নির্মাণ ক্ষেত্রের প্রযুক্তি বিশারদদের। তুরস্ক-সিরিয়ার এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের বিষয়টি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে তুরস্কের পূর্বাঞ্চল অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে অনেক বেশি পিছিয়ে সেদেশের পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায়। ফলে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ অঞ্চলে নির্মাণের মানের সাথে আপোষ ঘটার সম্ভাবনা তুলনায় বেশি হয়। আমাদের দেশেও এমন বৈষম্য চোখে পড়ার মতো। যেমন শহর কলকাতায় পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে নির্মাণ নিয়ন্ত্রণে পুরসভা যতটা তৎপর হয় সেই তৎপরতার সিকিভাগও চোখে পড়ে না কলোনি অঞ্চলে নির্মাণ ক্ষেত্রে।

এবারের ভূমিকম্পে দক্ষিণ-পশ্চিম তুরস্কের পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব সিরিয়াতেও নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়। সিরিয়ার এই বিপর্যস্ত অংশে মূলত বাস সেদেশের বিদ্রোহীদের। ফলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত এই অঞ্চলে বছরের অন্যান্য সময়জুড়ে ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কা সামলে পুনর্বাসনের যে প্রক্রিয়ায় নতুন বসতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেই অঞ্চলের নির্মাণ কাজে খরচ কমাতে কাঙ্ক্ষিত মানের ভূমিকম্প প্রতিরোধী নির্মাণ তুলনায় দুর্বল।

ভূমিকম্পের সময় ভূপৃষ্ঠের দুই ধরনের কাঁপুনি টের পাওয়া যায়। একধরনের ঝাঁকুনি আড়াআড়ি ধাক্কা মারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা নির্মাণ কাঠামোকে। উচ্চতায় লম্বা মানুষকে হঠাৎ আড়াআড়ি ধাক্কা মারলে ভারসাম্য হারিয়ে মানুষটার যেমন এক দিকে হেলে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকে ঠিক তেমনটাই ঘটে ভূমিকম্পের সময় বহুতল বাড়ির ক্ষেত্রে। পাশাপাশি নিচ থেকে ওপরের দিক বরাবর ভূপৃষ্ঠে আরেক ধরনের ঝাঁকুনি হয়। এমন ধাক্কার প্রভাবে মাটির নিচে থাকা বিপুল জলের স্তর জলোচ্ছ্বাসের মত মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। এই অবস্থায় সেই মাটির ভারবহন ক্ষমতা দ্রুত কমতে থাকে। ফলে নরম কাদার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সমস্ত নির্মাণ কাঠামোগুলি ভূমিকম্পের সময় তলিয়ে যেতে থাকে। এই অবস্থায় বাড়ির ভিত অগভীর হলে সেই বাড়ির ভারসাম্য হারিয়ে হেলে যাওয়া কিংবা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। তাই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে অগভীর ভিতের বদলে সুগভীর ভিত তুলনায় অনেকটা নিরাপদ। বহুতলের নির্মাণ খরচ কমিয়ে বাড়তি লাভের লক্ষ্যে তুরস্কে অগভীর ভিতের ওপর বহুতল নির্মাণ হয়েছে কাতারে কাতারে।

নির্মাণক্ষেত্রে আপোষের বিরুদ্ধে নির্মাণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গড়েছে জাপান। জাপানের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলিতে উপযুক্ত মানের নির্মাণ সামগ্রী এবং নির্মাণ পদ্ধতির প্রয়োগে আজ সে দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বহুতলের সারি। সংযত পরিকল্পনায় ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় ভূমিকম্পের ধাক্কা জোরালো হলেও প্রাণহানি কিংবা সম্পদ হানির পরিমাণ অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। অন্যথায় এদেশের সেই বহু চর্চিত শব্দ ‘man-made disaster’-এর বলি হতে হয় আমজনতাকে।

বিপর্যয় তুরস্কে ঘটলেও ভূমিকম্পে নগরায়নের বিপদ কয়েক দশক ধরেই এদেশের বুকেও বেড়ে চলেছে। বিশেষত সাম্প্রতিককালে উত্তরাখণ্ডে গোটা জোশিমঠ জুড়ে ভূমিধ্বসের যে ঘটনা ঘটেছে সেটা ভূমিকম্প বিধ্বস্ত পরিস্থিতির তুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানেও হিমালয়ের ভঙ্গুর শিলাস্তরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ঐ বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভূমিকম্পের নিরিখে বিপজ্জনক অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও পর্যটন কেন্দ্রিক সেই রাজ্যের অর্থনীতিতে পাহাড় জুড়ে চলছে নগরায়নের স্রোত। লাগাম ছাড়া নির্মাণের চাপে আক্রান্ত হচ্ছে সেই নরম ভঙ্গুর পাহাড়ের ঢাল। উন্নয়নের বিষম ধাক্কায় এই ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে ভূমিধ্বস বেড়ে চলেছে।

সম্প্রতি দেশের লোকসভায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রীর পেশ করা তথ্যে প্রকাশিত যে ভারতবর্ষের ভূখণ্ডের ৫৯ শতাংশ অঞ্চল ভূমিকম্পের ঝুঁকি সম্বলিত। ভূমিকম্পের ঝুঁকির নিরিখে এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে চারটি এলাকায় ভাগ করা হয়। এর মধ্যে পাঁচ নম্বর এলাকা সবচেয়ে ঝুঁকিপ্রবণ । পাঁচ নম্বর জোনে সর্বাধিক ঝুঁকির এলাকায় রয়েছে কচ্ছের রান, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, জম্মু-কাশ্মীর, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য এবং আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। উচ্চমাত্রার ঝুঁকিবহুল দেশের ১১ শতাংশ ভূখণ্ড পড়ে জোন পাঁচের মধ্যে এবং জোন চারের মধ্যে পড়ে ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড। যে দেশের মূল ভূখণ্ডের সিংহভাগ ভূমিকম্পের বিপদের মধ্যে আছে সেই দেশের নির্মাণ ক্ষেত্রের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে বেলাগাম নির্মাণ নগরায়নকে সঙ্গী করে। এরাজ্যেও পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে চলেছে বেলাগাম নির্মাণ। চলছে পাহাড়ের কোলে নদী আটকে জল বিদ্যুতের প্রকল্প। এমন সব ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ফি বছর বাড়ছে ভূমিধসের ঘটনা। পাহাড় জুড়ে এই বেলাগাম নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে না পারলে ভবিষ্যতে মাঝারি থেকে ভারি ভূমিকম্পে তুরস্কের মতই বেহাল হয়ে উঠতে পারে দেশের মানুষের জীবন। সেদিকে লক্ষ্য রেখে এখন থেকেই প্রয়োজন ভূমিকম্পপ্রবন এলাকায় নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ। পরিকল্পিত উপায়ে নির্মাণের পথে হাঁটলে বিপর্যয়ের ধাক্কায় অন্তত প্রাণহানি আর সম্পদহানি কমিয়ে আনা যাবে।