আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৩ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষির রাষ্ট্রবাদ বনাম লিনেকার

শুভময় মৈত্র


লিনেকার গোল দিচ্ছেন না। বরং শক্ত হাতে (থুড়ি পায়ে) রক্ষণ সামলাচ্ছেন। আক্রমণে টোরি প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। যে ভারতবাসী হিসেবে ছাগলের সেজো সন্তান-সন্ততি সেজে আমরা কয়েকদিন আগে নেচেছিলাম, সেই আমরা আজকেও ঋষির রাষ্ট্রবাদ দেখে ইউক্রেনের রাজপ্রাসাদের সামনে নাটু নাটু গানের তালে কোমর দোলাতে পারি। তবে সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে সপ্তাহান্ত চলে গেল, সেখানে বিবিসির অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন কয়েকজন ফুটবলার। হ্যাঁ, তারা দেশনেতা নন। কিন্তু অন্য দেশ থেকে আসা সব খোয়ানো মানুষের কষ্ট বোঝেন। আর অন্য দেশ থেকে অভিবাসী হয়ে পৌঁছে যাওয়া এবং দু-এক প্রজন্ম পরে ক্ষমতা দখল করা প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোন অসহায় রাণীর সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়লেও তিনি তাদের বিদায় করে দেবেন কয়েকদিন পরে। আসলে ভোট আসছে ব্রিটেনে। জেতার আশা কম। তাই রাষ্ট্রবাদ চাগিয়ে দেওয়া ছাড়া দক্ষিণপন্থীদের অন্য কোন পথ নেই। সব থেকে অদ্ভুত বিষয় এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে আদ্যন্ত সাহেব গ্যারি লিনেকারকে। কোন নামজাদা ভারত বা পাকিস্থানি বংশোদ্ভূতকে এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না প্রতিবাদে সামিল হতে। তবে আর কথা বাড়ানোর আগে প্রেক্ষিতে আসা যাক।

দিন কয়েক আগেই ঋষি সুনাক আর এমান্যুয়েল ম্যাকর্ন (ফরাসী রাষ্ট্রপতি) আলোচনায় বসেছিলেন। সেখানে দুই দেশনায়ক অভিবাসী সমস্যা নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন। শেষে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে অন্য দেশ থেকে আসা অসহায় মানুষদের ছোট্ট ডিঙি নৌকায় করে ইংলন্ড বা ফ্রান্সে ঢুকে পড়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। অবশ্যই নৌকাডুবিতে সেই অন্য দেশের মানুষগুলো মাঝে মাঝেই লোপাট হয়ে যান। এছাড়াও আফ্রিকা বা এশিয়া থেকে বেশি লোক ঢুকে পড়া যে কোনো প্রথম বিশ্বের দেশের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়। বিশেষ করে ঋষি আর এমান্যুয়েল-এর মত দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদদের নির্বাচনী স্বাস্থ্যের দিকেও তো নজর রাখতে হবে। সেখানে দেশভক্তি এবং বন্ধুত্বের চরম পরকাষ্ঠা হিসেবে ফ্রান্সকে পাঁচশো মিলিয়ন পাউন্ড সাহায্য দেবেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এই গরীব-গুর্বো মানুষগুলোকে রোখার জন্যে পাঁচশো পুলিশ লাগবে, তাদের তো মাইনে দিতে হবে। ডিটেনশন ক্যাম্পে সব হারানোদের খাওয়া থাকার খরচ আছে। আপাতত এই লেখায় ঘরের কাছের ডিটেনশন ক্যাম্প নিয়ে আলোচনা তোলা থাক। এখানে এখন দুর্নীতি নিয়ে সন্ধের আলোচনার দর্শক বেশি। লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি-তৃণমূল দ্বিমুখী লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সিএএ-এনআরসি নিয়ে আলোচনা জরুরি। এখনও পঞ্চায়েতেরই দিন ঠিক হয়নি, ফলে আপাতত ঋষি সুনাকের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার বেশি দরকার।

ঋষি তো বন্ধু এমান্যুয়েলের সঙ্গে হাত-টাত মিলিয়ে হেসে ছবি তুললেন। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান হুঙ্কার দিলেন নারী শিশু নির্বিশেষে সে দেশে ডিঙি পাড়ি দিলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেরানো হবে। কিন্তু একসময়ের হিংস্র ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো গত এক শতকে অনেক পরিণত। তারা দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র দেখেছে, ফলে এখন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। তারা ইতিহাস পড়ে, শুধু সন্ধের ঝগড়া দেখে না। ফলে পশ্চিমী গণতন্ত্র বলতে যে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে কূটনীতি নয় সেটুকু তাদের মধ্যে অনেকেই বোঝেন। বিশ্বের সবথেকে পরিণত গণতন্ত্র পশ্চিম ইউরোপে। গণতন্ত্রের যে কোন সূচকে তারা অনেকটা এগিয়ে। সেই কারণেই থেমে থাকতে পারেননি গ্যারি লিনেকার। বিশ্বকাপ ফুটবল কোয়ার্টার ফাইনাল, ১৯৮৬। মারাদোনার দুটি গোল, একটি ঈশ্বরের হাত আর একটি ঈশ্বরের পা দিয়ে। উল্টোদিকে এক গোল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গ্যারি লিনেকার। সেই লিনেকার আজকে বলে বলে এক ডজন দিয়ে দিয়েছেন ঋষি সুনাককে। অভিবাসন সমস্যা নিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন ১৯৩০ সালের জার্মানীর কথা। রাষ্ট্রবাদ থেকে ফ্যাসিবাদে পৌঁছে যাওয়ার ইতিহাস লিনেকার পড়েছেন। সেদেশের ইতিহাস তো আর সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের মত এক দশকে সূচীপত্রে ঢোকা দলবদলুদের জীবনপঞ্জী নয়। লিনেকার সাহেবরা ভালোভাবে ঠেকে শিখেছেন।

এবার রাষ্ট্র এবং শাসকের চরিত্র নিয়ে আলোচনায় আসতে হবে। সেখানে দাবড়ে দেওয়ার একটা নিয়ম আছে। তাই বিবিসি চমকাতে গেল লিনেকারকে। কী ভাল একটা পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, আর তাকে কিনা তিরিশের ফ্যাসিবাদী জার্মানির কথা মনে করিয়ে ট্যুইটারে খোঁটা দেওয়া? তুলে নিতে হবে বক্তব্য। নইলে শনি রবির ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ নিয়ে 'ফুটবল ফোকাস' আর 'ফাইনাল স্কোর' বলে যে অনুষ্ঠান করেন লিনেকার, তাতে তাঁকে বাদ দেওয়া হবে। লিনেকার সহজে জব্দ হননি। তিনি তো আর আমাদের মত স্নো-পাউডারে মুখ ঢেকে ক্যামেরার সামনে বসা লোক নন। বলেছেন করব না অনুষ্ঠান! একসঙ্গে তাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছেন সে দেশের সব বিখ্যাত ফুটবলার এবং কোচেরা। সবথেকে আশার বিষয় এই যে গোটা বিতর্কটি বারবার উঠে এসেছে বিবিসির খবরে। তারা বজায় রেখেছে সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি। সপ্তাহান্তের অনুষ্ঠান গুলিয়ে গ, ঘেঁটে ঘ। বিশ্লেষক মিকা রিচার্ডস, জেরমাইন জেনাস, জারমে ডেফো, গলেন মারে, ডিওন ডাবলিন এবং উপস্থাপক অ্যালেক্স স্কট, মার্ক চ্যাপম্যান, জেসন মোহাম্মদ সবাই পাশে দাঁড়িয়েছেন লিনেকার সাহেবের। ফুটবল মাঠে প্ল্যাকার্ড হাতে এসেছেন সমর্থক, জানিয়েছেন লিনেকারকে দেখতে চাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। শাসকদলের পক্ষে গিয়ে নির্বাচনী টিকিট নয়। সোজা সরল গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই।

ঋষি তাঁর শেকড় ভুলতে পারেন, ম্যাকর্নের গুনতে অসুবিধে হতে পারে তাঁর বিশ্বজয়ী জাতীয় ফুটবল দলে কতজন অভিবাসী বংশোদ্ভূত। কিন্তু শাসক শেষ কথা নয়। তাদের হারতে হয় বারবার। সেটাই গণতন্তের নিয়ম। কখনও নির্বাচনে, কখনও জনসমক্ষে বেইজ্জতিতে। ক'দিন আগেই ছড়ি ঘোরানো বিবিসির ডিরেক্টর জেনারেল টিম ডেভি সময়মত পাল্টি খেয়েছেন। গ্যারি তাদের কাছে কতটা মূল্যবান হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন তিনি। তাই সামনের সপ্তাহান্তেই বিবিসির পর্দায় আবার ফিরবেন লিনেকার, সঙ্গে তাঁর সতীর্থরা। সুযোগসন্ধানী ফরোয়ার্ড লিনেকারের সাদা থুতনি দাড়ি আর পাকা চুলের ছবিতে আজ তাই অনেক বেশি করে মহামানবের ছাপ। শিখলাম আমরা দুটো জিনিস। একটা পুরোনো - সঠিক এবং ঐকান্তিক প্রতিবাদে কাজ হয় চিরকাল। দুই - সংবাদমাধ্যম নিজের ভেতর থেকে লড়তে জানে। এই গোটা সমস্যায় যেভাবে বুক চিতিয়ে নিজেদের সব গোলমালের খবর সামনে এনেছে বিবিসি, তার জবাব নেই। আমাদের দেশ বা রাজ্যের কিছু নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যম শাসকের বিরুদ্ধে ভালোই লড়াই দেন মাঝেমধ্যে। তবে এই মাত্রায় যে পৌছনো যায় সেটাও তো জানা থাকল। কে জানে, হয়ত ছোট্ট ডিঙায় ভাসতে ভাসতে আরও কত অজানা ফুটবলার আসছেন ইউরোপের মুক্তভূমিতে - তাদের কেউ হয়ত হারিয়ে যাবেন সমুদ্রের বুকে। কিন্তু তাদেরই মধ্যে কেউ কেউ সবুজ মাঠ চিরে ছুটবেন এঁকেবেকে, কেউ উড়ে গিয়ে বাঁচাবেন গোলার মত শট। আর এঁদের পেছনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন গ্যারি লিনেকার, পাশে জুরগেন ক্লপ, অ্যালান শিয়েরার, ইয়ান রাইট। রাইট আর রঙ বুঝে নেওয়ার দিন ইতিহাসে ফিরে ফিরে আসে। পশ্চিমী গণতন্ত্র তাই ঠিক সময়েই প্রতিবাদী।

সামনের হপ্তায় ম্যাচ অফ দ্য ডে-তে দেখা হবে আমাদের প্রিয় অবসর নেওয়া ফুটবলারদের সঙ্গে। বলেছেন তিনি কাজের কথা - "কঠিন ছিল গত কয়েকটা দিন। কিন্তু তা যত কঠিনই হোক না কেন, প্রাণ বাঁচাতে নিজের ঘর ছেড়ে বহুদূরের কোন দেশে শরণার্থী হিসেবে হাজির হওয়ার অনিশ্চয়তা এবং কষ্টের সঙ্গে এর তুলনা হয় না। খুশি যে সেই সময়টা পেরিয়ে আসা গেছে। যে অভাবনীয় সমর্থন এবং একাত্ববোধ জুটেছে সহকর্মীদের কাছ থেকে, তার জন্যে সকলকে ধন্যবাদ।" আসলে বন্দুকের নল শুধু ক্ষমতার উৎস নয়। কলম থেকে লিনেকারের পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগা, সবেতেই আছে শিল্প, আছে শিক্ষা। আন্তর্জাতিকতাবাদ গানে যেমন আসে, তেমন আসে ছ-গজের বক্সে, যেখান থেকে লিনেকার-রা বলে বলে গোল করেন।