আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৩ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সঞ্জয় উবাচ


বিচারের বাণী

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মোটামুটি বুঝলাম সঞ্জয়, তোমার প্রজাতন্ত্র বিষয়ক নতুন ধারণা। দ্যাখ, দৈবায়ত্ত ক্ষমতা কিংবা বংশানুক্রমিক ধারায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রাপ্তি, তার তুলনায় এই প্রজাতান্ত্রিক পদ্ধতি আধুনিক কালের পক্ষে অনেক বেশি মানানসই। সত্যি কথা বলতে কি, শুধু প্রজাতান্ত্রিক ধারণাই বা কেন, এই ধরনের যে-কোনো শাসন ব্যবস্থার তুলনায় বলা চলে যে, নির্দেশনামা গোছের কোনোরকম অনুশাসন বিষয়েই আধুনিক মনের কুণ্ঠার চেহারা আমি বুঝতে পারি। সেই হিসেবে গণতান্ত্রিক ধারণার সঙ্গেও এই প্রজাতান্ত্রিক ধারণার সাযুজ্যও আমার বোধগম্য হচ্ছে। আমার স্বপ্নের ভারতবর্ষের যে মহাদেশীয় বৈচিত্র্যের কথাও উঠে এল, সে প্রসঙ্গেও আমি এ কথা বুঝতে পারছি যে, প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থাই এ দেশের পক্ষে সংগত। এত বৈচিত্র্য কারো একক তর্জনী শাসনে নিয়ন্ত্রিত হওয়া সম্ভব না, তার চেয়েও বড়ো কথা তা উচিতও নয়, এ কথা আমি মানি, সঞ্জয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার মনে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে সংঘাত সম্ভাবনা নিয়ে। তুমি সংবিধানের বাঁধনের কথা বলেছ, আমি তা মানছি, কিন্তু সে সংবিধানকেও যদি সবার অমন করে শিরোধার্য করে নিতে হয়, তাহলে সেই তো এক রকমের দৈবায়ত্ত নির্দেশনামার চেহারা ফুটে উঠছে।

আপনার অন্তরের উদ্‌বেগ ও নিহিত সংশয়ের বিষয়ে আমিও সহমত, মহারাজ। তাই প্রথমেই বলতে হবে ছোটোখাটো সংঘাত তো অবশ্যই আছে। নানা স্তরেই তার চিহ্ন দেখা যায়। খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বড়ো রকমের সংঘাতও দিব্যি আছে। সেরকম এক সাম্প্রতিক বিরোধের বিবরণ শোনাই আপনাকে। রণাঙ্গনে সমরাস্ত্রের সংঘাতের চেয়ে তার তীব্রতা কিছু কম নয়।

শোনাও। রণাঙ্গনের সংবাদের জন্য আমি কান পেতেই আছি। তার বাইরের খবরও কিছু শোনাও, সঞ্জয়।

আধুনিককালেও সংঘাত ও সংঘর্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে অবশ্যই হয়। যথেষ্ট তীব্র আকারেই তা হয়। এই মুহূর্তের রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সংঘর্ষের কথা আমি আপনাকে শুনিয়েছি, মহারাজ।

হ্যাঁ, অবশ্যই।

রণাঙ্গনে এরকম সরাসরি মুখোমুখি প্রত্যক্ষ সংগ্রামের নজির এই আধুনিক কালেও যথেষ্ট আছে। এবং তার তীব্রতাও ভয়াবহ, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর বাইরেও আর এক রকমের সংগ্রাম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নতুন কালের নতুন সময়ে। তা হল মতাদর্শগত সংগ্রাম। দৃষ্টিভঙ্গি, মনোগত অবস্থান, সমাজ বিন্যাস বিষয়ে তত্ত্বদৃষ্টি, এই সবই হল নতুন কালের সংঘাতের নতুন উপাদান। বর্তমানে আমাদের ভারত ভূখণ্ডে সংবিধানকে কেন্দ্র করে সেরকম এক লড়াই দিব্যি জারি আছে, মহারাজ।

বল কি, সংবিধানই সংঘাতের উপলক্ষ, কোনো জমিজিরেত নয়।

জমিজিরেতের চেয়ে এ কিছু কম নয়, মহারাজ। আমাদের সাংবিধানিক ব্যবস্থায় একটা মৌলিক প্রত্যয় হল ক্ষমতা বিভাজনের নীতি। ইংরেজিতে বলা হয় সেপারেশন অব্‌ পাওয়ারস। যে-কোনো আধুনিক রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মূল বিভাগ তিনটি। আইন প্রণয়ন, আইন প্রয়োগ আর বিচার বিভাগ। আমাদের দেশে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব রাজ্যস্তরে বিধানসভার, কেন্দ্রীয় স্তরে সংসদের। আর আইন প্রয়োগের দায়িত্বভার বহন করে সরকারের প্রশাসন। রাজ্যের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার, কেন্দ্রের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন। এর প্রথমটি হল লেজিসলেচার, আর দ্বিতীয়টি হল এক্‌জিকিউটিভ। তৃতীয়, বিচার বিভাগ বা জুডিশিয়ারি। রাজ্যস্তরে সর্বোচ্চ আদালতের নাম হাই কোর্ট, আর সমগ্র দেশের জন্যে আছে সুপ্রিম কোর্ট। সেটাই এ দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়। হাই কোর্টের নীচে আছে নানা স্তরের নিম্ন আদালত। এখানে আর একটা ছোটো কথা আমি আপনার গোচরে নিবেদন করতে চাই।

বলো, তোমার যা বলার আছে নিঃসংকোচে বলো আমাকে, সঞ্জয়।

এই যে ক্ষমতা বিভাজনের নীতি, এর মূল লক্ষ্য হল বিভিন্ন প্রবণতার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান। প্রশাসনের কোনো এক অংশ অন্যান্য অংশকে দমন করে যেন মাথা চাড়া দিয়ে না ওঠে সেদিকে নজর রাখতে হয়। সদা সর্বদা। এ কাজ কোনো একদিনে ফুরোবার নয়। এই সামঞ্জস্যের ধারণার মধ্যেই সংবিধানে বিচার বিভাগের উপরে একটা গুরুদায়িত্ব নির্দিষ্টভাবে অর্পণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে সংবিধানের ব্যাখ্যার প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টই শেষ কথা বলার অধিকারী।

তা এতে করে কি তোমার ক্ষমতা বিভাজনের ধারণা কিছুটা টাল খেয়ে গেল না। এই একটা ব্যাপারে তাহলে আমরা শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গেলাম।

শুধু এইটুকু দেখলে তা-ই মনে হতে পারে। কিন্তু খুঁটিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে সামঞ্জস্যের ধারণা যেমন মূল্যবান, তেমনি এই এক রকমের শেষ বিন্দুর ধারণাও জরুরি। কেননা, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র ইত্যাদি ধারণার মধ্যে গণের মনোভঙ্গি কিংবা প্রজাসমূহের ইচ্ছার যেমন মর্যাদা দিতে হবে, তেমনি কাজটা, যে-কাজ করণীয় বলে মনে হবে, সেটাও তো করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহকে শুধু প্রজাবর্গের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে অন্বিত করে দেখলে চলবে না। ওই অন্বয় নীতি প্রণয়নের স্তরে একান্ত জরুরি। তার পরে আসছে প্রয়োগের স্তর। সেই স্তরে বিধিবিধান ও দস্তুর, সাধারণভাবে এরাই নিয়ামক। কিন্তু অভূতপূর্ব পরিস্থিতির উদ্‌ভব হলে, অতীত অভিজ্ঞতা ভিত্তিক পন্থার প্রয়োগে সব পরিস্থিতির মোকাবিলা করা নাই যেতে পারে। অভূতপূর্ব বলেই তার সমাধানের পথও অচিন্তিতপূর্ব হওয়া কিছু অস্বাভাবিক কেন হবে।

তুমি যা বললে তা খুবই যুক্তিযুক্ত কথা, কিন্তু এর সঙ্গে তোমার শেষ বিন্দুর ভাবনার যোগসূত্র আমি এখনো দেখতে পাচ্ছি না, সঞ্জয়। সে ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহায্য করো।

ওই অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য উচ্চতম সাংবিধানিক পদাধিকারীদের ক্ষেত্রে ঐচ্ছিক ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যবস্থা আছে। প্রায় সব গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রে এরকম ক্ষমতাপ্রয়োগের কিছুটা অবকাশ থাকে। নইলে ঠিক কাজ চলে না।

সে কথা তুমি যা বলছ তাও যথার্থ, তবে এখানে ক্ষমতার অপপ্রয়োগের অবকাশও কি অন্তর্নিহিতভাবে থেকে যাচ্ছে না?

তা হয়তো কিছুটা যাচ্ছে। তবে এই ঐচ্ছিক ক্ষমতার প্রয়োগও মজবুত সংবিধানে দস্তুর দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত ঘিরে দেওয়া থাকে। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত বোধবুদ্ধি ও সুবিবেচনার কোনো বিকল্প তো হয় না, মহারাজ।

বুঝতে পারছি, মানবিক কোনো ব্যবস্থাই ওরকম বোধবুদ্ধি ও সুবিবেচনা নিরপেক্ষভাবে শুধুমাত্র তন্ত্রনির্ভর হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে আবার আর এক রকমের যান্ত্রিকতা গোটা ব্যবস্থাটাকেই গ্রাস করবে।

আপনি একেবারে ঠিক বলেছেন, মহারাজ। মানবস্পর্শ ছাড়া কোনো মানবিক ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারবে না। এই যে আমি বারবার বোধবুদ্ধি ও সুবিবেচনার দিকে আপনার দৃষ্টি ফেরাতে চাচ্ছি সেও কিন্তু ওই একই কারণে। এ কালের ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দে বোঝাতে চাইলে আমি হয়তো বলতাম, একটু রিজনেব্‌ল আচার আচরণ ছাড়া কিছু আসলে দাঁড়াবে না। দেখুন মহারাজ, আপনার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিদুর চন্দ্র বংশের শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি যা পরামর্শ দিয়েছিলেন সেও কিন্তু এই রিজনেব্‌ল আচার আচরণ ও প্রতিক্রিয়ার কথা।

থাক সঞ্জয়, ওসব কথা তুলে আর মনকে ভারাক্রান্ত করে কী হবে। জীবনের আসল ট্র্যাজেডি কোথায় জান। এইসব সুবিবেচনার সুপরামর্শ আমি যে তখনকার প্রত্যক্ষ সময়েও শুভৈষণার পরামর্শ বলে বুঝিনি তা কিন্তু নয়। বুঝেও আমি তখন যা যা করেছি বা বলেছি, তা ছাড়া যে আর কিছু করতে পারিনি বা বলতে পারিনি সেখানেই আমি বলব মূল ট্র্যাজেডির বীজ নিহিত। অর্থাৎ, আমরা কেউই সবটুকু ঠিক আমরা নই। অন্য কোনো একজনের বা একাধিকজনের ভূমিকাভিনেতা মাত্র। আমারই মধ্যে দিয়ে সেই আর কেউ প্রকাশিত হয়ে চলেছে। দেখতে আমিই, কিন্তু সে কি আমি? থাক, থাক সঞ্জয়, এসব দার্শনিকতা থাক। তুমি কথায় কথায় আমাকে এক দুর্জয় দুর্বিপাকের কিনারায় নিয়ে এসে ফেলেছ। তার চেয়ে বলো আমার ভারত নামের বর্ষের কথা বলো, তোমাদের সাংবিধানিক কালের ভারতের কথা বলো। তোমাদের সাংবিধানিক কুরুক্ষেত্রের কথা বলো।

সাংবিধানিক কুরুক্ষেত্র, ঠিকই বলেছেন, মহারাজ। আমি যে ক্ষমতা বিভাজনের নীতির কথা বললাম, আপনার প্রধান অমাত্যের নেতৃত্বাধীন শাসক দল আজ সেই বিভাজন ধারণার উপরেই আঘাত হানছেন। এরকম দুশ্চিন্তা এর আগে আর কখনো টের পাওয়া যায়নি তা নয়। সুযোগ সুবিধামতো আগেও একাধিকবার অনুরূপ সংকট দেখা দিয়েছ। কিন্তু এবার যেন অনেক তোড়জোড় করে আটঘাঁট বেঁধে আসরে নামার লক্ষণ ফুটে উঠছে।

বাড়তি প্রস্তুতির কোন লক্ষণ তোমার চোখে পড়ছে তা আমায় বলো, সঞ্জয়।

দেখুন মহারাজ, প্রশাসনের তরফে বিচার বিভাগ সম্বন্ধে একটা অস্বস্তির ব্যাপার অনেক সময়ে থাকে। যে-কোনো কিছুতে আদালতের অবস্থান যদি প্রশাসনের মনঃপূত না হয়, তাহলে অনেক সময়ে এই দুই বিভাগের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশে এরকম বিরোধ বেশ প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল গত শতকের সত্তরের দশকে। তখন এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে তাঁর মসিহা সুলভ ভাবমূর্তি তখন উজ্জ্বল। আমাদের শহরে তখন দেওয়ালে দেওয়ালে তাঁর ছবি, সঙ্গে ক্যাপশন 'এশিয়ার মুক্তিসূর্য'। বিপুল গৌরবে তিনি তখন মহীয়ান। ১৯৬২-তে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে ভারত নাকাল হয়েছে। তার পরে পিতা জওহরলাল নেহরুর জমানার অবসান। ১৯৬৫-র যুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে জয়লাভ করে ভারত তার হৃতগৌরব কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করেছে। কাজেই সত্তর দশকে ইন্দিরা তখন নানা গৌরবগাথায় ভরপুর। ক্ষমতা করায়ত্ত করার লক্ষণ মাথাচাড়া দিচ্ছে। ব্যাংক জাতীয়করণ নীতি ও রাজন্য ভাতা বিলোপ প্রভৃতি নীতিগ্রহণের ফলে তাঁর প্রগতিশীল বামপন্থী ভাবমূর্তিও তখন উজ্জ্বল। ক্ষমতার এই তুঙ্গ মুহূর্তে তখন তাঁর মাথায় এসেছিল ‘দায়বদ্ধ বিচারবিভাগ’-এর ধারণা। কমিটেড্‌ জুডিশিয়ারি। ওঁর মনে হচ্ছিল বিচারবিভাগ যদি প্রশাসনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের মঙ্গলচিন্তা করে, তাহলে জনকল্যাণ সাধনের অন্তরায় সহজে দূর করা সম্ভব।

সহজ বুদ্ধিতে বলে এ বড়ো বিপজ্জনক চিন্তা। বিচার বিভাগের দায়িত্ব দেশের মঙ্গলচিন্তার পথেও দেশের আইন কোথাও লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখা। আইন লঙ্ঘন করে যে মঙ্গলচিন্তা তা দ্রুত অমঙ্গলে পর্যবসিত হতে পারে। বিচার বিভাগকে সেখানে সহযোগী হিসেবে পাওয়ার চিন্তার মধ্যে বড়ো বিপদের ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে।

সেই কথাই বলছি মহারাজ। সেরকম বিপদ একাধিকবার দেখা দিয়েছে আপনার এই ধর্মরাজ্যে।

বলো, তোমার কাহিনী শোনাও। তা দায়বদ্ধ বিচার বিভাগের ধারণা কোথায় গিয়ে পৌঁছোল?

জল অনেকদূর গড়িয়েছিল। আমরা ফিরে যাই ১৯৭৩ সালে। স্বাধীন ভারতের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই ১৯৭৩ সাল একটি বিখ্যাত মামলার রায়ের জন্য এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।

আমার অবগতির জন্য সংক্ষেপে বলো সেই রায়ের কথা।

কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য। কেশবানন্দ ভারতী একজন ধর্মীয় গুরু। তাঁর আশ্রম পরিচালনার ব্যাপারে জমিজমা সংক্রান্ত প্রশ্নে কেরালা সরকারের সঙ্গে তাঁর বিরোধ। ১৯৭৩ সালে সেই মামলায় ৭-৬ ভোটে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে “সংবিধানের মৌলিক কাঠামো” তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। বলা হয় আমাদের সংবিধানের একটা মৌলিক কাঠামো আছে এবং কিছু মৌলিক মূল্যমান সেই কাঠামোতে প্রতিফলিত। সংসদের কোনো আইনে বা কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে সেই মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা চলবে না। তদানীন্তন ইন্দিরা গান্ধী সরকার এই রায়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এই মামলায় ওই মৌলিক কাঠামো তত্ত্বে একজন বিবাদী স্বরের বিচারক ছিলেন জাস্টিস অজিত নারায়ণ রায়। ১৯৭৩-এর ২৬ এপ্রিল এই অজিত নারায়ণ রায়কে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি করা হয়। আরো তিন জন সিনিয়র বিচারককে ডিঙিয়ে। এই সেই কমিটেড জুডিশিয়ারির প্রয়োগ। এই নিয়োগ নিয়ে তখন খুব হইচই হয়। আমাদের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে প্রশাসনের ক্ষমতা বনাম বিচার বিভাগের ক্ষমতা, এই নিয়ে টানাপোড়েন তখন থেকে রীতিমতো জটিল আকার ধারণ করে।

সঞ্জয়, এ যা শোনাচ্ছ তুমি, এ তো সত্যি সত্যিই সাংবিধানিক কুরুক্ষেত্রের মতোই শোনাচ্ছে আমার কানে।

তাই তো বললাম, মহারাজ, আপনার এ বর্ণনা একেবারে যথার্থ।

তা বিচারপতি নিয়োগ সমস্যা তার পরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াল?

১৯৭৩-এর রায়ের পরে 'বিচারপতি মামলা' নামে পরিচিত আরো তিনটি মামলার কথা বলতে হবে।

বলো তবে।

প্রথম মামলা - ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বনাম এস পি গুপ্তা (১৯৮১)। দ্বিতীয় মামলা - ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বনাম সুপ্রিম কোর্ট এড্‌ভোকেটস অন রেকর্ড (১৯৯৩)। তৃতীয় মামলা - বিশেষ রেফারেন্স (১৯৯৮)। এই লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বিবর্তিত হয়ে এসেছে বর্তমানের কলেজিয়াম প্রথা। ধারণা হিসেবে বিচার বিভাগীয় স্বাতন্ত্র্যের নীতি প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৯৩-এর দ্বিতীয় মামলা থেকে আর বিচারপতি নিয়োগের জন্য মেমরাণ্ডাম অব্‌ প্রসিডিওরস (এম.ও.পি.) তৈরি হয় তৃতীয় মামলার ফলে।

তোমার বর্ণনা অনুসারে বিচারবিভাগীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য ধীরে ধীরে একটা ব্যক্তিনিরপেক্ষ প্রথার দিকে তো ব্যাপারটা এগোচ্ছিল। তাহলে সমস্যা দেখা দিল কোথায়?

এগোচ্ছিল, কিন্তু বিচার বিভাগের এতটা স্বাতন্ত্র্য বর্তমান প্রশাসনের পছন্দ না। প্রশাসন আপন ক্ষমতার উপরে নজরদারি কবে আর পছন্দ করেছে, বলুন মহারাজ। রাজকর্মের ইতিবৃত্তে আপনি কারো চেয়ে কম অভিজ্ঞ নন। বিচারবিভাগকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন রাখার সেই পুরোনো ঝোঁক আবার মাথা চাড়া দিয়েছে। ওই নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা প্রাণিত এক নতুন কেন্দ্রীয় আইন প্রণীত হল ২০১৪ সালে। ওই বছরেই মহারাজের প্রধান অমাত্যের নেতৃত্বাধীন সরকার ভারত ভূখণ্ডে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়। ৯৯-তম সংবিধান সংশোধনী আইন অনুসারে লোকসভা (১৩ অগস্ট, ২০১৪) এবং রাজ্যসভা (১৪ অগস্ট' ২০১৪) ন্যাশনাল জুডিশিয়াল এপয়েন্টমেন্টস কমিশন গঠন করার আইন পাশ করে। পাব্লিক সারভিস কমিশনের অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করার চিন্তা। ২০১৫ সালের ১৬ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট ৪-১ ভোটে এই আইন খারিজ করে। ফলে এখনো পর্যন্ত দু-দশক পুরোনো কলেজিয়াম প্রথা বহাল আছে। বিচারকদের নিয়ে গঠিত কলেজিয়াম উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য নামের তালিকা তৈরি করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠায়। সরকারি অনুমোদন পাওয়া গেলে রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ করেন।

হুঁ, বুঝলাম সঞ্জয়। সেই ক্ষমতার দড়ি টানাটানি। কিন্তু এই কাহিনী শুনতে শুনতে আমার কি ভয় হয় জান? এই টানাটানির খেলায় যদি বিচার বিভাগও কোনোদিন মেতে ওঠে, তাহলে আরো দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির আশঙ্কা। এমনিতে সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যত ভেঙে পড়বে তত চাপ পড়বে বিচার বিভাগের উপরে। সেই চাপে সেও যদি কোনোদিন ভেঙে পড়ে তখন জানি না... সত্যিই জানি না...

আপনার এই ব্যাকুল অবস্থার জন্যে আমি দুঃখিত মহারাজ। তবে আপনি যে আশঙ্কার কথা বললেন তার লক্ষণ ইতিমধ্যেই কিছু কিছু দেখা দিয়েছে। কখনো বিচার বিভাগের অতি তৎপরতা আবার কখনো প্রশাসনের মুখ-চাওয়া অতি নমনীয়তা। আবার এমন নজিরও তৈরি হয়ে গেছে যে, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের তৈরি করা নামের প্যানেল সরকার দীর্ঘদিন ফেলে রেখেছে। প্রধান বিচারপতি সম্প্রতি সরকারের দিকে তাকিয়ে এতদূর বলেছেন, খুব অস্বস্তিকর কোনো পদক্ষেপ নিতে আমাদের বাধ্য করবেন না। তার পরের দিনই আটকে রাখা নামের প্যানেলে সরকারি অনুমোদন পাওয়া গেছে।

হুঁ, সত্যিই দুর্লক্ষণ ফুটে উঠছে। এই কি তবে আমাদের বিদায় বেলার ইঙ্গিত, সঞ্জয়।