আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৩ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

অচেনাকে চিনে চিনে

প্রবুদ্ধ বাগচী


কোভিডের সময় আমরা যখন সবাই রোগের আশঙ্কায় ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে সেখান থেকেই নিজেদের সব কাজ-কাম করার চেষ্টা করছিলাম, ঠিক তখনই আমাদের পাশে ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’ পরিষেবা নিয়ে উঠে এসেছিল বেশ কিছু অনলাইন কোম্পানি। শৌখিন জিনিস, জামা-কাপড়, মোবাইল এসব কেনাকাটা করার অনলাইন ব্যবস্থা তো আগেই ছিল। এই সময়টায় তার সঙ্গে বেশি বেশি করে যোগ হল পরিবারের নিত্যদিনের মুদিখানার জিনিস, কাঁচা সবজি ও মাছ-মাংস কেনার অনলাইন ব্যবস্থা। এমন নয় যে এগুলি তার আগে ছিল না, ছিল - কিন্তু তাদের এমন রমরমা ছিল না। এর সঙ্গে যোগ হল, বাড়ির নানারকম দরকারে যেমন, ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি, প্লাম্বার, চিমনি বা এয়ার কন্ডিশন মেশিন সারভিসিং, চুল-দাড়ি কাটা, বিউটি পার্লারের কেশচর্চা বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, টয়লেট পরিষ্কার করা ইত্যাদি - এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই নানা ধরনের লোকের সন্ধান দিতে থাকল অ্যাপ-নির্ভর ব্যবস্থা। এঁদের কাছে সবটাই প্রোডাক্ট, তাই চুল-দাড়ি কাটার মামুলি বিষয়টার সঙ্গে জুড়ে গেল নানা বিশেষণ - আল্ট্রা শেভিং, প্রিমিয়াম হেয়ার কাট, সুপার সেভার বিউটি প্যাকেজ ইত্যাদি। বাড়ির বেসিন বা কমোড পরিষ্কার করার নামও হল গোল্ডেন ক্লিন, একজিকিউটিভ ক্লিনিং এইসব। আমাদের ঠাকুমা-দিদিমাদের আমলে বাড়িতে শৌচালয় যারা পরিষ্কার করতে আসতেন তাদের বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেওয়া হত না, বাড়ির পেছনে আলাদা দরজা দিয়ে তাঁরা ঢুকতেন, ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেন। তাঁদের স্পর্শ লাগলে স্নান করতে হত। তার তুলনায় আমরা এখন অনেক এগিয়েছি - এইসব সাফাইকর্মীদের উদ্দেশে আমরা সচরাচর ‘মেথর’ শব্দটা এখন আর ব্যবহার করি না। আর এই অ্যাপ-নির্ভর পরিষেবার যুগে এঁদের আমরা দেখতে পেলাম কোম্পানির ইউনিফর্ম পরা ও গলায় পরিচিতিপত্র ঝোলানো চেহারায়। তাঁরা কে কখন কোথা থেকে আসছেন, কখন কাজের জায়গায় পৌছাবেন, কোন সময় কাজ শুরু করবেন, কাজ শেষ হলে আপনি তার কাজের গুণমান জানিয়ে কিভাবে কোড নম্বর জানাবেন এর সবটাই প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রিত। নিশ্চয়ই এটা প্রগতি। আমরা তো জানিই পুঁজিবাদের বিস্তার নানা অনুষঙ্গে আগের পিছিয়ে পড়া সমাজের ক্ষেত্রে কিছু কিছু স্মরণীয় বদল নিয়ে আসে তার নিজেরই স্বার্থে ও কিছুটা তার বিকাশের অব্যর্থ প্রতিক্রিয়ায়।

কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। মাসখানেক আগে, নিজের ফ্ল্যাটের টয়লেট পরিষ্কার করার জন্য এমন একটি বুকিং আমি করেছিলাম। যথাসময়ে কোম্পানির লোগো লাগানো ইউনিফর্ম পরা ছেলেটি এসে কাজ শুরু করলেন। তার আগে একটা ভেরিফিকেশন কোড এল আমার মোবাইলে, সেটি জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমি মেসেজে জানতে পারলাম আমার কাজটি শুরু হয়ে গেল। এখানে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সাধারণত এই ধরনের কাজ যেসব দলিত শ্রেণির মানুষরা প্রজন্ম পরম্পরায় করে থাকেন বলে আমরা এতদিন দেখে এসেছি বা এখনো দেখতে পাই - কিন্তু অ্যাপ নির্ভর এই পরিষেবায় যারা যুক্ত তারা মোটামুটি মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের তরুণ যাদের নাম ‘দেবাশিস দাস’ বা ‘প্রবীর সেন’ কিংবা ‘মইদুল আলি’ যারা অবশ্যই মোবাইল প্রযুক্তির সঙ্গে সড়গড়, নতুবা এখানে কাজ করা সম্ভব নয়। এবার আসি সমস্যায়। কী ঘটল সেদিন? আমার থেকে কোড নিয়ে কাজ শুরু করেই সেই তরুণ আমায় বলল, আপনার টয়লেট পরিষ্কারের জন্য আপনি আমাদের যে প্যাকেজ নিয়েছেন তাতে এটা উপযুক্তভাবে পরিষ্কার করা সম্ভব হবে না, কারন ট্যাঙ্কের জলে বেশি লোহা থাকায় এইসব ক্ষেত্রে টয়লেট পরিষ্কারের অন্য প্যাকেজ নিতে হয়। অগত্যা? আমি বলি, অ্যাপের মাধ্যমে আমি যে বিবরণ পেয়েছি তাতে তো এরকম কিছু বলা ছিল না, তাহলে আমি এখন আরো দামি প্যাকেজ নেব কেন? ক্রেতা হিসেবে এই প্রশ্ন আমি করতেই পারি। ছেলেটি বলল, কিন্তু আপনার বর্তমান প্যাকেজ অনুযায়ী আমি যদি পরিষ্কার করতে যাই তা হবে না, কারণ এইসব ক্ষেত্রে যে বিশেষ রাসায়নিক লাগে তা আমার কাছে নেই - ফলে কাজের শেষে আপনি যদি ‘স্যাটিসফ্যাকশন কোড’ না দেন তাহলে আমি কোম্পানির থেকে আমার মজুরি তো পাবই না, উল্টে আমার ‘সার্ভিস রেটিং’ কমে যাবে। আমি বলি, তাহলে আমি অর্ডার ক্যান্সেল করে দিই। ছেলেটি বিপন্ন স্বরে জানায়, স্যার, সেটা আপনি করলে আরো মুশকিল! কেন? না, আমার থেকে কোড পেয়ে সে কাজ আরম্ভ করেছে এবং তার ট্র্যাকিং বলছে সে আমার বাড়িতে আছে। এখন আমি যদি ক্যান্সেল করি তাহলে কাজ শেষের কোড না পেলে কোম্পানি ধরে নেবে সে এইখানেই আছে, কাজেই তার বেরোনোর উপায় নেই। আর আমি যদি কাজ শেষের 'স্যাটিশফ্যাকশন কোড' একবার দিয়ে ফেলি তাহলে আমায় বিল মিটিয়ে দিতে হবে। একেবারে কেতাবী ভাষায় যাকে বলা যায় ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থা। কী করা যাবে তাহলে? ছেলেটি তার বস, তার ওপরের বস, তার ওপরের বস-কে ফোন করে গেল নাগাড়ে। দুজন আমার সঙ্গে কথা বলে অবস্থাটা শুনলেন। দেখতে দেখতে আধঘণ্টা কাবার। অবশেষে প্রযুক্তির প্রোটোকলের সঙ্গে মিশে গেল মানবিক সম্পর্কের পাঁচফোড়ন। রফা হল, আমি আজকের কাজের জন্য ‘স্যাটিসফ্যাকসন কোড’ দিয়ে ছেলেটিকে আজকের কাজ থেকে মুক্ত করব, আমার কাজের বিল ওই ছেলেটিই মিটিয়ে দেবে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে - বিনিময়ে অন্যদিন নতুন প্যাকেজে বুকিং করে সে এসে কাজ করে যাবে তখন আমি তাঁকে পুরো টাকা মিটিয়ে দেব। এটা ব্যক্তিগত বোঝাপড়া, এর মধ্যে কোনো অ্যাপ নেই কিন্তু। ঘটনাটা ঘটলোও তাই, দু'দিন পরে ঠিক সময়ে এসে ছেলেটি কাজ করে দিয়ে গেল। শিব্রাম থাকলে নিশ্চয়ই এই কাহিনির নাম দিতেন ‘টয়লেটে টানাটানি’!

এবার অন্য একটা ঘটনা। কলকাতা শহরে অ্যাপ-ক্যাব কোম্পানিগুলির লাগামছাড়া দৌরাত্ম্যের কথা আমরা সবাই জানি। কী এক প্রযুক্তি-লালিত কৌশলে সর্বদাই তাদের ভাড়া দেখা যায় নির্ধারিত ভাড়ার থেকে বেশি - এই ‘সার্জ’ কীভাবে ঠিক হয়, কী অনুপাতে ঠিক হয় আমরা তার নাগাল পাই না। আমরা শুধু জরুরি প্রয়োজনে তাদের পরিষেবা নিতে গেলে ঘাড় পেতে সেই বাড়তি ভাড়ার হাড়িকাঠে নিজেদের বলি দিতে বাধ্য হই। এমনকি এই বাড়তি ভাড়ার কতটা ক্যাব চালকরা পান সে নিয়েও বিস্তর অসংগতি, এ নিয়ে কিছু শোরগোলও যে ওঠে না তা নয় - কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। সরকারের পরিবহন দফতরের সাধ্য নেই বহুজাতিক সংস্থা পরিচালিত এইসব ক্যাব সংস্থাগুলোকে সিধে পথে চালাবার, সম্ভবত সেই ইচ্ছেও তাদের নেই। এখন কথাটা হল, এক পরিচিত বন্ধু যিনি এইসব নিয়ে নানা ভাবনা চিন্তা করেন আমায় কিছুকাল আগে বলেছিলেন, এই ক্যাব-সংস্থাগুলিতে যেসব চালক নিজেদের নথিভুক্ত করেন তাদের দৈনন্দিন কী পরিমাণে ভাড়া দেওয়া হবে, কতগুলি ট্রিপ তাঁরা পাবেন তা নাকি প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রিত, আরও স্পষ্ট করে বললে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত প্রোগ্রামিং নাকি এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সেই হিসেবে দেখা যাচ্ছে, একজন ক্যাব-চালককে যদি ন্যূনতম চার জনের একটা পরিবার মোটামুটি ভদ্রস্থভাবে আজকের দিনে চালাতে হয় তাহলে যে পরিমাণ রোজগার তাঁকে করতে হয় সেটার জন্য তাঁকে অন্তত দিনে ১৬/১৮ ঘণ্টা ক্যাব চালাতে হবে। মানে একটা জিনিস পরিষ্কার যে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তা ইতিমধ্যেই তামাদি ঘোষিত হয়েছে।

ঘটনাটা নিয়ে আমার মধ্যে একটু সংশয় ছিল। তাই এমনই এক ক্যাব-চালকের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছিলাম বহুজাতিক অ্যাপ-ক্যাব সংস্থাগুলির ভয়াবহ শোষণের কথা। এটা প্রকৃতই সত্যি যে দিনে আঠারো ঘণ্টা শ্রম না দিলে কোম্পানির কমিশন বাদ দিয়ে যে টাকা রোজগার হয়, গাড়ির তেল, যন্ত্রাংশ বা মেনটেন্যান্স খরচ ছেড়ে হাতে যথেষ্ট অর্থ আসে না। আর এটাও ঠিক, এই যখন তখন ‘সার্জ’ বাবদ যে বাড়তি টাকা কোম্পানি আদায় করে তার খুব সামান্য অংশই ক্যাবচালকের অ্যাকাউন্টে জমে। তাছাড়াও, ওই চালক বলছিলেন, বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে তাদের কমিশন কেটে নেওয়া হয়, সব সময় যার উপযুক্ত ব্যাখ্যা কোম্পানিগুলি চালকদের দেয় না। বছর খানেক হল কলকাতায় একটি দেশি স্টার্ট-আপ সংস্থা অ্যাপ ক্যাব পরিচালনা শুরু করেছে, এক্ষেত্রে ক্রেতাকে ভাড়া জানানোর পরে তাঁকে কিছুটা দরাদরি করার সুযোগ দেওয়া হয়, কিন্তু তাও যে খুব কাজে আসছে তা নয়। প্রযুক্তি শেষ পর্যন্ত মুনাফার স্বার্থের বাইরে যেতে পারে কি?

কিন্তু ঠিক এই প্রশ্নটা নিয়ে কথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কথাটা এই যে একুশ শতকের প্রায় সিকিভাগ অতিক্রম করে এসে আমরা যে বিশ্ব-পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছি, সেখানে প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাপন এবং নিত্যদিনের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ব্যাপারটা এমন নয় যে এটা এই প্রথম ঘটল। চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’ ছবিতে (১৯৩৬) যেভাবে দেখানো হয়েছিল সেইভাবে শ্রমিক মানুষ তার উৎপাদন ব্যবস্থায় ক্রমশ প্রান্তিক হতে আরম্ভ করে গত শতকের তিনের দশক বা তারও আগে থেকেই। ইউরোপের শিল্প বিপ্লব থেকেই মানুষের দুনিয়ায় ধীরে ধীরে যন্ত্রের অগ্রগমন ঘটেছে, ক্রমশ তা নানা বিভঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে নানা মাত্রায়। হ্যান্ডলুম থেকে পাওয়ারলুম, বাষ্প থেকে বিদ্যুৎ, তাপবিদ্যুৎ থেকে পরমাণু চুল্লি, কামান থেকে গাইডেড মিসাইল অবধি তার কেবলই ছড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে শতাব্দীর শেষ দশক অবধি আমাদের দেশে যে নিবিড় কম্পিউটার-নির্ভর প্রযুক্তির উঠে আসা, যাকে বলা যেতে পারে একটা নতুন শিল্পবিপ্লব। চাকা আবিষ্কারের আগের মানুষ আর তার পরের মানুষ যেমন সম্পূর্ণ আলাদা ঠিক তেমনই এই কম্পিউটার-বিপ্লব আসলে মানুষের সভ্যতার যেন এক বিভাজিকা। পরে তার সঙ্গে যুক্ত হল ইন্টারনেট-নির্ভর প্রযুক্তি, যা যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঘটিয়ে দেয় আরেকটি বিপ্লবী ডানা। এইভাবে এগোতে এগোতে আজ মোবাইল, ইন্টারনেট পেরিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসে বসতে চাইছে চালকের আসনে - শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বললে ‘লাফ মেরে ধরে লাল মোরগের ঝুঁটি’।

সদ্য প্রকাশিত ‘চ্যাটজিপিটি’ (Chat Generative Pre-trained Transformer) দেখা দিচ্ছে মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রবল এক প্রতিপক্ষ হিসেবে যে ব্যবস্থা নাকি নিছক চ্যাটের বাইরে গিয়েও লিখে দিতে পারে একটা আস্ত নিবন্ধ, তৈরি করে ফেলতে পারে গবেষণা-সন্দর্ভ, বানাতে পারে নতুন প্রোগ্রামিং সফটওয়ার! একে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওপেন এআই’ বা ‘মুক্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’। ‘চ্যাটজিপিটি’ লিখিত তিনটে সংবাদ প্রতিবেদন সম্পাদনা করে সম্প্রতি এক বিদেশি সাংবাদিক তৈরি করেছেন তার নিজস্ব প্রতিবেদন। মাত্র নভেম্বর ২০২২-এ আত্মপ্রকাশ করে এই ‘চ্যাটজিপিটি’র গ্রাহক সংখ্যা এত বিপুলভাবে বেড়ে গেছে যে ‘গুগল’-এর মতো সংস্থাও ভাবনা চিন্তা করছে এই ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে আসার - নয়তো যে ‘সার্চ ইঞ্জিন’ পরিষেবা ‘গুগল’-এর তুরুপের তাস তাও এবার হোঁচট খেয়ে পড়বে অচিরেই। মার্কিন দেশে স্কুলপড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরাও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করে ফেলছে তাঁদের হোমটাস্ক, কোনো বিষয়ের অ্যাসাইনমেন্ট - শিক্ষকরা ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছেন না এইসব ‘বাড়ির কাজ’ পড়ুয়াদের কে করে দিল। হতেই পারে এই প্রযুক্তি হয়তো আগামী দিনে স্কুলশিক্ষা - শিক্ষক - পরীক্ষা - হোমটাস্ক এই সাবেকি ব্যবস্থাটাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে। আসলে নতুন নতুনতর এক দুনিয়ার হাতছানি আমাদের দরজায় করাঘাত করছে নিয়ত। কোভিডের পর থেকে শুধু ‘নিউ নর্ম্যাল’ নয় এখন ওয়েব ২.০ থেকে ওয়েব ৩.০-র দিকে যাত্রা করেছি আমরা - সে এক অচেনা নতুন ভুবন।

কবির কথা ধার করে আমরা আপ্তবাক্য আওড়াতেই পারি, ‘অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে’ - ভাবতেই পারি ‘অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে’। ঠিক। কিন্তু এই অচেনা জগতের অনুসন্ধানে নেমে উঠে আসছে যেসব বিসদৃশ ঘটনা-পরম্পরায় সেগুলোর কী হবে? মনে পড়ছে, গত শতকের শেষ বছরে (১৯৯৯) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার এক অধ্যাপক একটা বক্তৃতায় বলেছিলেন, এতদিন ‘সময়’ মানুষের ওপর প্রভুত্ব করে এসেছে, এবার মানুষ ‘সময়ের ওপর’ প্রভুত্ব করবে। তখন দেশে দেশে ভারচুয়াল মিটিং ব্যবস্থা সবে শুরু হচ্ছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ধরা যাক, একটি বহুজাতিক সংস্থার ভারত, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিন অফিসের তিন জন প্রধান একটি বিজনেস মিটিং ডাকলেন। মিটিংটা যখন হচ্ছে তখন মার্কিন দেশের সময়, ভারতের সময় ও যুক্তরাজ্যের সময় কিন্তু আলাদা। তাহলে একটা মিটিং ঘোষণার সময় আমরা যেমন তার সভাস্থল ও সময় উল্লেখ করতাম এতদিন - ভারচুয়াল পৃথিবীতে তার কিন্তু আর কোনো দরকারই নেই। স্থান ও সময় অপাংক্তেয় হয়ে যেতে থাকল এইভাবেই। এই বক্তব্যের প্রায় সিকি শতাব্দী পর আজ ভারচুয়াল মিটিং সর্বস্তরে প্রায় ‘জলভাত’ হয়ে গেছে। ট্রেনে যেতে যেতে, গাড়িতে বসে, বাসে চলতে চলতে এখন ভারচুয়াল মিটিং-এ যোগ দেওয়া এবং সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। বিশেষ করে ‘লকডাউন’ পর্বে আমাদের পড়াশোনা, আলোচনা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রশাসন পরিচালনা সব ক্ষেত্রে যেভাবে উঠে এল ‘গুগল মিট’ বা ‘জুম’ কিংবা ‘স্ট্রিম ইয়ার্ড’ এইসব নামগুলো তা আমরা প্রাক-কোভিড পর্বে কোনোদিন ভাবতেই পারিনি। জরুরি কাজকর্ম, মিটিং ছাড়াও বিনোদন বা সিরিয়াস আলোচনা ‘ওয়েবমিনার’ নামক এক নতুন শব্দবন্ধেরই জন্ম দিয়ে দিল।

এই জায়গাটা ছেড়ে আমরা যাই শ্রমের জগতে। ডিসক্লেমার হিসেব বলে রাখা দরকার, সেই অর্থে আমি সনাতন অর্থনীতির ছাত্র নই। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা যে দুটো বড় পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে এটা আজকে সবাই স্বীকার করে নেবেন। প্রথম কথা হল, যত দিন যাচ্ছে বড় মাপের ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের ভূমিকা আমাদের অর্থনীতিতে কমে যাচ্ছে, যেটুকু বড় ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প হচ্ছে তাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে মুষ্টিমেয় প্রশিক্ষিত শ্রমিক-কর্মচারীর। এক সময় এই রাজ্যের অর্থনীতিতে ‘টাটার গাড়ি’ বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে বলে প্রচার করা হয়েছিল, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে টাটাগোষ্ঠী যে হলফনামা দিয়েছিলেন তাতে তাঁরা জানিয়েছিলেন তাদের গাড়ি কারখানায় হাজার জনেরও কম সরাসরি কাজ পাবেন। টাটাগোষ্ঠী বিদায় নেওয়ার পরে রাজ্যে কার্যত কোনো বড় ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প গড়ে ওঠেনি, অদূর ভবিষ্যতেও গড়ে উঠবে এমন কোনো প্রত্যাশা নেই। কারণ, ব্যক্তিগত কারোর ভাবমূর্তি বা জনপ্রিয়তা দেখে শিল্পপতিরা তার সঙ্গে একই মঞ্চে ছবি তুলতে পারেন কিন্তু নিজেদের পুঁজি বিনিয়োগ করেন না। আর, একই সঙ্গে উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থায় শিল্প-কারখানা তৈরিতে সরকারি পুঁজির ভূমিকা ক্রমশ ফিকে হয়ে গেছে - কোনো সরকারের হাতেই এখন সেই পরিমাণ পুঁজি বা সদর্থক গরজ নেই যে তাঁরা কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ নতুন করে শুরু করবেন। পরিবর্তে গত তিরিশ বছরের ভারতের অর্থনীতির ইতিহাস রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিটি সংস্থাকে বিরাষ্ট্রীয়করণের ‘রোড ম্যাপ’ নিয়ে এগিয়ে চলার ইতিহাস এমনকি এই আদানপ্রদানে নানা অন্ধকার লেনদেনও যে ঘটে চলেছে সেই ‘আর্থিক দুর্বৃত্তায়ন’-এরও ইতিকথা সামনে এসেছে অনেকবার, যার প্রকোপ বেড়ে গেছে গত প্রায় এক দশকে। ‘ভারতমাতা কি জয়’ আওয়াজ তুলে দেশের অর্থনীতিকে ‘ক্রোনি পুঁজিপতি'দের হাতে সঁপে দেওয়ার রাজসূয় যজ্ঞ চলছে এখন - এই প্রক্রিয়াকে ‘মায়ের অলঙ্কার-হরণ’ নাম দিলে কারোর কারোর গোঁসা হতে পারে, কিন্তু আদপে ব্যপারটা তাই-ই।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হল, শ্রম-নিবিড় শিল্পের বদলে মূলত পরিষেবা শিল্পের জগত এখন ক্রমবর্ধমান। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের জিডিপি-তে এই পরিষেবা শিল্পের ভূমিকাই বেশি। কিন্তু এই পরিষেবা শিল্পের চেহারায় রয়েছে নানান বৈচিত্র্য। ব্যাঙ্ক-বীমা এগুলি এখন পরিষেবা-ক্ষেত্র হিসেবে যেমন চিহ্নিত ঠিক তেমনি যে ছেলেটি ঘাড়ে প্রকান্ড বোঝা নিয়ে আমার আপনার বাড়িতে ‘আমাজন’ বা ‘ফ্লিপকার্ট’ থেকে কেনা শৌখিন জিনিস পৌঁছে দিয়ে আপনার কাছ থেকে রেটিং চায় সেও এই পরিষেবা-শিল্পের একজন শ্রমিক। একইভাবে আপনি যখন সন্ধ্যেবেলা আপনার মোবাইল অ্যাপ থেকে রেস্টুরেন্টে পছন্দসই খাবার বুক করেন এবং সময় বেঁধে আপনার কাছে খাবার পৌঁছে দেন ‘সুইগি’ বা ‘জোম্যাটো’র যে সার্ভিস বয়, তিনিও এই পরিব্যাপ্ত ‘সার্ভিস নেটওয়ার্ক’-এর প্রান্তে থাকা একজন শ্রমিক। একথা ঠিক, ব্যাঙ্ক বা বীমা শিল্পেও আজকাল প্রযুক্তির ব্যবহার তাদের স্থায়ী কর্মচারীর সংখ্যা বিপুল পরিমাণে কমিয়ে এনেছে। খুব বড় ও ব্যাস্ত একেকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যঙ্কের শাখায় আজকাল ম্যানেজার সহ তিন-চার জনেই দিব্যি কাজ চলে যায়, বেসরকারি ব্যাঙ্কেও অবস্থা একইরকম। উপরন্তু বেসরকারি ব্যাঙ্কের সাধারণ কর্মীরা যারা কাউন্টারে কাজ করেন তাদেরও ব্যাঙ্কের ব্যবসা সংগ্রহের কাজে পরোক্ষভাবে যুক্ত করা আছে - আপনি হয়তো ক্যাশ কাউন্টারে টাকা তুলতে গেলেন, সেখানকার কর্মী হাতের কাজ শেষ করে আপনার কাছে পৌঁছে দেবে কোনো বিনিয়োগের প্রস্তাব, ওই পরিমাণ বিনিয়োগ আপনার থেকে জোগাড় করতে পারলে ওই কর্মী বাড়তি ইন্সেন্টিভ পাবেন। তবু এখনো ব্যাঙ্ক বা বীমা মোটামুটিভাবে সংগঠিত শিল্পের মধ্যেই গণ্য হয়। এর বাইরে রয়েছে বিপুল একটা পরিষেবা-শিল্পের কর্মী যারা মূলত এই ‘গিগ’ অর্থনীতির চাকায় ঘুরে চলেছেন নিয়ত।

এই বিশেষ অংশটিই কিন্তু আজ কাজের বাজারে সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর এই পরিষেবা-শিল্পের বিনিয়োগকারীরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি করতে পেরেছেন এমন একটা দুনিয়া যেখানে ‘কাজ’ আছে কিন্তু ‘চাকরি’ নেই। কেমন ‘কাজ’ আছে? তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বিভিন্ন ‘কল সেন্টারে’ যারা ‘কাজ’ করেন তাঁরা জানেন, তাদের কাজের কোনো ধরাবাঁধা সময় আর নেই, নেই কোনো কাজের স্থায়িত্ব। শিফট ডিউটিতে কারোর পরিবর্তকর্মী (রিলিভার) না এলে একটানা কুড়ি-বাইশ ঘণ্টাও তাদের কাজ করতে হয়, কিন্তু এর কোনো বিকল্প নেই। ইদানিং প্রায় প্রতিটি কোম্পানি, সরকারি বেসরকারি নির্বিশেষে তাদের কল সেন্টারে বা তাদের কাস্টমার সার্ভিস সেকশনে চালু করে দিয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত ‘চ্যাট বট’ ব্যবস্থা, যার সূত্রে ক্রেতা তার জিজ্ঞাস্য অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাচ্ছেন, পেয়ে যাচ্ছেন প্রার্থিত পরিষেবা যা হয়তো বা দুটো মানুষের কাজের বিকল্প। অর্থাৎ এইসব ক্ষেত্রেও কাজের পরিসীমা কমছে। আর এই অনলাইন ই-কমার্স সংস্থাগুলির সঙ্গে যাদের আমরা সার্ভিস বয় বা ডেলিভারিম্যান হিসেবে যুক্ত থাকতে দেখি তাদেরও কিন্তু কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা আর নেই, ছুটি প্রায় অমিল, ছুটির বদলে কাজ করলে বাড়তি মজুরির হাতছানি। যেহেতু মূল পারিশ্রমিক একেবারেই শ্রমের আনুপাতিক নয় ফলে সেই বাড়তি মজুরির আকর্ষণে তাঁরা মেনে নিচ্ছেন আরও খানিকটা শারীরিক শ্রম। ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি, বিকেলের মুখোমুখি বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ‘ফুড-ডেলিভারি বয়’ রা কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দ্রুত টু-হুইলার চালিয়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে তাদের পছন্দের খাবার। যে যত তাড়াতাড়ি যেতে পারবে তত তার রেটিং বাড়ে, বাড়ে কমিশন - কিন্তু পথ দুর্ঘটনা ঘটলে তাদের পরিবারকে দেখার কেউ নেই। প্রতিদিন চোখের সামনে দেখতে পাই, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁধের ব্যাগে রাখা টিফিন কৌটো খুলে রুটি-তরকারি খেতে খেতে এইসব ‘মজুর’রা তৈরি হচ্ছে সম্পন্ন ক্রেতাদের কাছে রকমারি সুস্বাদু খাবারের প্যাকেট পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কী নিষ্ঠুর এই বৈপরীত্য! তবুও আজকে দাঁড়িয়ে এইটাই বাস্তব। হয়তো বৈকালিক এই ‘মজদুরি’ করে এঁদের সংসার চলে না, দিনের বেলা অন্য কোনো কাজে যুক্ত থাকতে হয় এঁদের। আবার দেখুন দুর্গাপুজোর সময়েও কিন্তু অনলাইন বিপণির কর্মীদের কোনো ছুটিছাটার ব্যাপার নেই। আপনি সেজেগুজে প্যান্ডাল হপিং-এ বেরোবেন সন্ধ্যেবেলা তার ঠিক আগেই কিন্তু আপনার সদ্য-কেনা নতুন পোশাক নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়াবেন ওই ডেলিভারি-কর্মী আর আপনাকে জানাবেন তার পরিষেবায় আপনি কতটা খুশি তার রেটিং জানিয়ে দিতে। ওই রেটিং ঠিক করে দেবে কাল তার এই কাজ থাকবে কি না।

নিত্য-নিয়ত এই কর্মীরা বাঁধা আছেন প্রযুক্তির নিবিড় শৃঙ্খলে - এই ‘শৃঙ্খল’ থেকে তাদের সত্য অর্থে মুক্ত করা খুব সহজ কাজ নয় আর। তার থেকে ঢের সহজিয়া পথে নিয়োগকারী তাঁদের মুক্তি দিয়ে দিতে পারে তাঁদের ‘শৃঙ্খল’ থেকে - ‘কাজ’ আজ আছে, কাল নেই। আমরা সদ্য দেখতে পেলাম না, কীভাবে বিশ্বের প্রথম সারির বহুজাতিক সংস্থাগুলি কেমন অনায়াসে নিজেদের কয়েক হাজার কর্মীকে প্রায় তুড়ি দেওয়ার মতো আয়াসে ছেঁটে ফেলে দিল? কোভিড-কালে সংস্থার বিপণন বৃদ্ধির সময় এঁদের নেওয়া হয়েছিল, আজ ‘নিউ নর্ম্যাল’ জমানায় এই কর্মীরাই সংস্থার কাছে ‘বাড়তি বোঝা’ - তাই তাঁদের ‘কাজ’ চলে যেতে পারে নিছক এক ‘টুইট’-এর কোপেই। এইটাই আজকের বাস্তবতা, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর পুঁজির এইরকমই চাল-চলন। আদিকাল থেকেই শ্রমের ব্যয়কে যতটা সম্ভব কমিয়ে এনে মুনাফার ব্যাগকে ভারি করে তোলা তার উদ্দেশ্য, আজকের প্রযুক্তি, আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার সেই সুযোগকে শত-সহস্রগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। খবর এসেছে, ‘আমাজন’, ‘ফ্লিপকার্ট’-এর মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলি ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলক ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ‘ড্রোন’-এর সাহায্যে সীমাবদ্ধ কিছু জায়গায় তাঁদের পণ্য পৌঁছিয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি চালু করতে চলেছে - আমাদের চেনা ডেলিভারি-বয়দের দিনও বোধহয় এবার ফুরিয়ে এলো!

সবশেষে এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। দিনকাল যা পড়েছে, আমাদের দেশে কী রাজ্যে, তাতে মানুষের এই সমস্যা নিয়ে কারোরই তেমন কোনো দুর্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। যেটুকু যা ভাবা বা করা তার দায় এসে পড়েছে বামশক্তির উপাসকদের ওপর। তাঁরা যে পিছিয়ে পড়েছেন এমন নয়। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে পলিটিক্যাল ইকোনমির যে রকমফের তার সঙ্গে কি মানানসই হয়ে উঠতে পারছে তাঁদের ভাবনা ও কাজ? এটা ঠিক, বামপন্থীরা বহুকাল ধরে সারা দুনিয়াতেই প্রচার করে এসেছেন পুঁজিবাদ নিজেই তার সংকট ডেকে আনে আর তার ভিতরেই নিহিত থাকে তার বিনাশের বীজ। সাবেকি মার্ক্সবাদের আলোয় এই থিওরি নিশ্চয়ই অনুমোদিত। কিন্তু এটাও সমানভাবে ঠিক যে, গত দু-আড়াইশো বছর ধরে পুঁজিবাদ নানাভাবে সংকটে পড়লেও তার থেকে উত্তরণের রাস্তাও কিন্তু সে বার করে নিতে পেরেছে। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ভিতর থেকে কার্ল মার্ক্স যে পুঁজিবাদের চরিত্র নির্ধারণ করতে পেরেছিলেন, আজকে তার গতিপথ ও চরিত্র এক নয়। বিশেষত, উন্নত প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিজেদের মুনাফা বাড়ানোর অন্যতম নিয়ামক হিসেবে তৈরি করে সে কিন্তু শ্রমিকের সনাতনী চরিত্রেরও বদল ঘটিয়ে দিতে পেরেছে - যাকে ঠিক আট ঘণ্টা কাজের সীমানায় আর প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয় - পরিবর্তে, ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর যুগে সে এখন চব্বিশ ক্রস সাতের শ্রমিক। এই শ্রমিকের মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনও আর আগের রীতিতে করা যায় না আর তাতে মজুরিও বাড়ে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত ‘অ্যালগরিদম’ তাঁকে এমন এক শৃঙ্খলে যুক্ত করে দিয়েছে যাতে ‘উবের’-এর চালক বাড়তি মজুরির চাহিদায় আঠারো ঘণ্টা শ্রম করতে বাধ্য হয়, ‘আরবান’ কোম্পানির পরিষেবা - শ্রমিকের প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রিত হয় প্রযুক্তির নিগড়ে। সাবেকী ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের সংগঠিত শ্রমিকের মতো তার সস্তার ক্যান্টিন আর নেই, কারখানায় দুর্ঘটনা হলে তার নিরাপত্তা বীমা উধাও, চাকরি শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটির অর্থ তার কাছে অলৌকিক কল্পনা। ব্যাগে বেঁধে আনা রুটি-তরকারিই তার ‘সস্তার টিফিন’, ক্রেতার সন্তুষ্টির জন্য বিদ্যুৎবেগে বাইক চালিয়ে যদি তার দুর্ঘটনা ঘটে, বড়জোর তার জন্য বরাদ্দ হতে পারে একটি ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ ছাপ দেওয়া একটি সরকারি কার্ড, যে কার্ড তার বা তার পরিবারের জঠরের খিদে মেটাতে পারে না।

এখন কথাটা হল, এগুলিকে বামপন্থীরা কীভাবে দেখছেন? তাঁদের অভিধানে ‘শ্রমিক’ শব্দের যে অর্থ আর ব্যঞ্জনা এতকাল ধরা পড়েছে, এই অবস্থার সঙ্গে তার যোগ প্রায় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। তাহলে? অথচ, আজও দেশের বা রাজ্যের বামপন্থী দলগুলি তাঁদের কাজে-কর্মে-প্রচারে-ভাষণে সচারচর যেসব কথা বারবার বলছেন বলে চোখে পড়ে বা কানে আসে তাতে এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক অর্থনীতির স্বাক্ষর আছে বলে মনে হয় না। এখনও তাঁরা মনে করেন, তাঁরা যদি রাজ্যে বা দেশের ক্ষমতাভার হাতে পান তাহলে শিল্প-কারখানা তৈরি করে মানুষের কর্মসংস্থান করবেন, সরকারি উদ্যোগে কারখানা গড়বেন ইত্যাদি ইত্যাদি - কোথাও যেন সেই সাবেকিয়ানার প্রতি অমোঘ পেছুটান! এছাড়া আরও একটা বলার কথা আছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক অর্থনীতি আজ যে ‘গিগ’ অর্থনীতিকে পুষ্ট করে চলেছে, তাতে সর্বত্রই ‘দান-খয়রাতির অর্থনীতি’ পাশাপাশি একটা জায়গা করে ফেলছে। কারণটা খুব স্পষ্ট। রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকদের প্রতি মৌলিক দায়-দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে তখন বিপন্ন মানুষ ক্রমশ বিপন্নতর হয়ে পড়ছে - তার হাতে স্থায়ী কাজ নেই, কাজ থাকলে তার নিরাপত্তা নেই, নিরাপত্তা থাকলেও উপযুক্ত মজুরি নেই, সে শুধু দিনরাত শ্রম করে চলেছে অস্তিত্বের স্বার্থে। এই তো সেই অভিসন্ধিময় ‘অমৃতকাল’ যখন রাষ্ট্র এসে বলে, এই নাও তোমায় কিছু মাসকাবারি অর্থ দিলাম, এই নাও তোমার মৌলিক স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকে চোখ বুজে থেকে একটা ছোটমাপের স্বাস্থ্যবীমা করিয়ে দিলাম - এর বেশি কীই বা বাপু আমরা করতে পারি? কিন্তু বিপন্ন মানুষের কাছে এইটাই তো পরম ‘কৃপার’ বিষয় আর এই কৃপাধন্যতার সূত্রেই তো নির্মিত হতে থাকে একেকজন ‘মসিহা’ অথবা কোনো ‘জনদরদী’র পাবলিক ইমেজ, ‘পোষ্য মিডিয়া’ এই ইমেজকেই তো ‘লারজার দ্যান লাইফ’ প্রতিষ্ঠার বরাত নিয়ে নেয় কোনো গোপন অ্যাজেন্ডার অংশ হিসেবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবঞ্চনা আছে সন্দেহ নেই, তেমনি আবার একটা সত্যও তো রয়েছে সমানভাবেই। এই প্রবণতাগুলিকেই বা কেমনভাবে মোকাবিলা করবে আজকের বামপন্থা? অস্বীকার করবে? না কি নতুন নতুনতর ভাবনায় সিঞ্চিত করবে নিজেদের চেতনার বৃত্ত? আমরা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করি ভবিষ্যৎ বামপন্থার, কিন্তু কোন পথে সেই ভবিষ্যতের আকাশগঙ্গা আবার মাটির পৃথিবীতে নেমে আসবে তা চিনে চিনে খুঁজে নেওয়ার দায়ও কি আমরা এড়িয়ে যেতে পারি?

(ভাবনা-ঋণঃ অনিন্দ্য ভট্টাচার্য)