আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৩ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সুপ্রিম কোর্ট ও নির্বাচন কমিশন


একটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং সংবিধান কতটা মজবুত তা বোঝা যাবে কী করে? মনে হতে পারে যে দেশের সামরিক শক্তি কতটা বিকশিত, দেশের আইন কতটা কঠোর, দেশের সরকার দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধ দমনে কতটা সিদ্ধহস্ত ইত্যাদি বিভিন্ন সূচকের দিকে তাকালে প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে শক্তিশালী দেশ যা শত্রুর মনে ভীতি এবং মিত্রের মনে সম্ভ্রমের উদ্রেক করতে পারে, সেই দেশের সংবিধানও ততটাই মজবুত।

কিন্তু এই বিষয়গুলি গণতান্ত্রিক কাঠামো বা সংবিধানের ক্ষমতার সঠিক সূচক নয়। একনায়কতন্ত্রও উপরিউক্ত সূচকে যথেষ্ট নম্বর পাবে, কিন্তু তা কোনো মতেই গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের মূল কথা হল মানুষের সম্মতি নিয়ে সরকার পরিচালনা এবং মানুষের অধিকারকে সুনিশ্চিত করা। কিন্তু একবার ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করলে তো পাঁচ বছর চলবে। এই পাঁচ বছরে কি সরকার যা খুশি তাই করতে পারে? এর উত্তর স্পষ্টতই না। কিন্তু কেন নয়? কারণ ভারতের সংবিধানে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে সরকার থাকলেও তা একমাত্র ক্ষমতার কেন্দ্র নয়। ভারতের সংবিধানে তিনটি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে - সরকার, সংসদ এবং বিচারব্যবস্থা। সংসদ আইন তৈরি করবে। সরকার সেই আইন প্রণয়ন করবে। আর বিচারব্যবস্থা কোনো আইন সংবিধানসিদ্ধ কি না তার বিচার করবে। এই তিনটি স্তম্ভের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজিকা এবং স্বাতন্ত্র থাকা প্রয়োজন। তাই সংবিধান রচয়িতারা ভারতের সংবিধানে নিরপেক্ষ এবং স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থার কথা বলেছিলেন।

কিন্তু এই কথা ভুলে গেলে চলবে না যে সরকার এবং সংসদ মানুষের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হয়। বিচারব্যবস্থার মূল শক্তি বিচারকরা নির্বাচিত নন। অতএব গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে সরকার বারংবার বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে চায়। ১৯৭০-র দশকের ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকে দেখা যাচ্ছে যে প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে যেই সরকার ক্ষমতায় আসছে তারা বিচারবিভাগকে নিজেদের মর্জি মতন চালাতে চাইছে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা ইন্দিরা গান্ধীর জমানার থেকেও বেশি। অতএব তারা যে বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করবে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিগত কয়েক মাস ধরে দেশের উপরাষ্ট্রপতি এবং আইনমন্ত্রী লাগাতার বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন। এর প্রধান কারণ হল সরকার নিজের পছন্দের বিচারপতিদের সুপ্রিম কোর্ট বা হাই কোর্টে জায়গা দিতে পারছে না কারণ বিচারপতিদের বাছার ভার বিচারপতিদের উপরেই ন্যস্ত করা আছে। তদুপরি, বিগত কয়েক মাসের বেশ কিছু রায় সরকারের বিপক্ষে গেছে। যদিও এই কথাও মানতে হবে যে পূর্বতন প্রধান বিচারপতিদের মেয়াদকালে মোদী সরকারের পক্ষেও অনেক সংখ্যক রায়দান করা হয়, যার মধ্যে রাম মন্দির বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত রায় সর্বাধিক বিতর্কিত এবং গুরুত্বপূর্ণ।

যেই প্রশ্নটি দিয়ে শুরু করা হয়েছিল এই সম্পাদকীয় তার সোজা উত্তর হল এই যে যদি সরকারের পরাক্রম এবং অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলি রুখে দাঁড়ায় তবে তা প্রমাণ করে যে গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং সংবিধানের ভিত মজবুত রয়েছে। এই নিরিখে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে।

২ মার্চ মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন। এই রায়টির বিষয় দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান - নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মূল কাণ্ডারী নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে নির্বাচন কমিশনকে যেভাবে নিযুক্ত করা হয়েছে এবং নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা মানুষের মনে বহু প্রশ্নের উদ্রেক করে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েলের নিযুক্তিকরণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গুরুতর প্রশ্ন তোলে। ২০২২ সালের মে মাস থেকে 'নির্বাচন কমিশনার' পদটি খালি ছিল। হঠাৎ নভেম্বর মাসে ২৪ ঘন্টার কম সময়ের মধ্যে অরুণ গোয়েল, যিনি কেন্দ্রীয় সরকারী সচিব ছিলেন, তিনি হয়ে গেলেন নির্বাচন কমিশনার। যেই দেশে কেরানীর চাকরি পেতেও কয়েক মাস সময় লাগে, সেখানে নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করতে সরকার সময় নিয়েছে ২৪ ঘন্টার কম! কিন্তু কেন? কারণটি সোজা। সুপ্রিম কোর্ট যেই সময় নির্বাচন কমিশনার নিযুক্তিকরণ সম্পর্কিত মামলার শুনানি শুরু করে তার ঠিক একদিন আগে অরুণ গোয়েল নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হন। এর কারণ শিশুও বুঝবে।

অবশেষে মার্চ মাসের ২ তারিখে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করে যে দেশের রাষ্ট্রপতি মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের নিযুক্ত করবেন একটি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে - যেই কমিটিতে থাকবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধী দলনেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। বিচারপতিরা এই ঐতিহাসিক রায়ে বলেন যে নির্বাচন কমিশনের স্বতন্ত্র এবং নিরপেক্ষতা যে-কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। তারা বলেন যে দেশের মানুষ নির্বাচন কমিশনের দিকে অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। যেই ব্যক্তি ক্ষমতার সামনে ইতিমধ্যেই হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছেন, যিনি সরকারের থেকে আগে কোনো সুবিধা পাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতায় নিমগ্ন, এমন ব্যক্তি দেশের নির্বাচন কমিশনার হতে পারেন না। অথচ স্বাধীনতার ৭৫ বছরে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনার নিযুক্তিকরণের নিয়মকানুন নিয়ে ভাবেনি। দেশের প্রধানমন্ত্রীই মোটামুটি ঠিক করে দিতেন নির্বাচন কমিশনার কারা হবেন। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় প্রথমবার নির্বাচন কমিশনার নিযুক্তিকরণের একটি প্রক্রিয়া তৈরি করার দিকে পদক্ষেপ নিচ্ছে, যেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির মতামত ব্যতিরেকে নির্বাচন কমিশনার বেছে নেওয়া সম্ভব নয়। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নির্বাচন কমিশনের স্বাতন্ত্র রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু তাহলে কি প্রগতিশীল শক্তিসমূহের আপাতত সুপ্রিম কোর্টের ভরসাতেই থাকা উচিত যে কখনও না কখনও সুপ্রিম কোর্ট মোদী সরকারকে উচিত শিক্ষা দেবে। এই ধারণাটি পোষণ করা অত্যন্ত ভুল হবে। গণতন্ত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল জনগণ। জনগণকে সচেতন করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করানো সংবিধানের পক্ষে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। দেশের মানুষ যদি মনে করেন যে গণতন্ত্রের প্রয়োজন নেই, তাহলে কোনো কোর্ট গণতন্ত্রকে বাঁচাতে পারবে না। আবার দেশের জনগণ যদি রাস্তায় নেমে সব ধরনের অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেন, তাহলে গণতন্ত্র ধ্বংস করাও কোনো কোর্টের পক্ষে সম্ভব নয়। সুপ্রিম কোর্টের ইতিবাচক মনোভাবের সমর্থন অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের দায় নেই দিন বদল ঘটানোর, সরকারকে উৎখাত করার। সেই দায়িত্ব প্রগতিশীল শক্তিকেই নিতে হবে।