আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা ● ১৬-৩১ মার্চ, ২০২৩ ● ১-১৫ চৈত্র, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

তৃণমূল ও গণতন্ত্র


অবশেষে আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীর জামিন আদালতে মঞ্জুর হয়েছে। ৪২ দিন জেলবন্দী থাকার পর বিধায়ক নিঃশর্ত জামিনে মুক্ত হয়েছেন। এই নিয়ে ইতিমধ্যেই বহু আলোচনা সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। পক্ষে বিপক্ষে বহু যুক্তি এসেছে। বিধায়কের মুক্তির দাবিতে বামপন্থী দলগুলি, এমনকি নাগরিক সমাজের একাংশও রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। এমনকি বিধানসভার অধ্যক্ষ অবধি বলে ফেলেছেন যে বিধায়কের এতদিন জেলবন্দী থাকার কোন যুক্তি নেই। মূলত যে অপরাধের কারণে রাজ্য প্রশাসন বিধায়ক সহ মোট ৮৮ জনকে গ্রেফতার করে, সেই ধারায় ৪২ দিন জেলে আটক রাখা যায় কিনা তাই-ই এক আলাদা বিতর্ক। খোদ কলকাতা হাইকোর্ট অবধি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন রাজ্য প্রশাসন তথা পুলিশের এই গ্রেফতার প্রক্রিয়াকে দেখে। রাজনৈতিক সমাবেশে উত্তেজনা আটকানোর অজুহাতে ৮৮ জনকে এক মাসের বেশী সময় ধরে জেলে আটকে রাখা ভারতবর্ষে এক আলাদা নজির সৃষ্টি করেছে। রাজ্য সরকারকে এ বিষয়ে বাহবা দিতেই হয়।

প্রশাসন যুক্তি দিয়েছে যে ওইদিন বিধায়ক সহ আইএসএফের কর্মীরা রাস্তা অবরোধ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইছিল। তাই জনসাধারণের জান মাল রক্ষা করতে পুলিশ এঁদের গ্রেফতার করে। যদি প্রশাসন এতই জনদরদী তাহলে সেদিন উত্তেজনার সূত্রপাত যেখানে অর্থাৎ বিধায়কের নির্বাচনী ক্ষেত্রে বিধায়কের গাড়ি ভাঙচুর করা দিদির তাজা নেতা, আদতে গুন্ডা, আরাবুল ইসলাম বা তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে আজ অবধি কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি কেন? কেনই বা পুলিশকে বোমা মারতে বলা 'বীর' নেতা অনুব্রত মন্ডলের দিল্লী যাত্রা ঠেকাতে পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে? রাজ্যের বুকে এ যাবৎ সবথেকে বড় নিয়োগ কেলেঙ্কারি ঘটানো মন্ত্রী, বিধায়ক, শাসকদলের বড়, মেজ, ছোট নেতারা রাজ্য পুলিশের নিরাপত্তা পান কী করে? রাজ্যের বুকে বগটুইয়ের মত নারকীয় ঘটনা ঘটে যায় অথচ এত তৎপর রাজ্য পুলিশ জানতেই পারেনা!

আসলে তৃণমূল রাজত্বে শাসকদলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকলে পুলিশ তাদের আগলে রাখে, আর মানুষের হকের দাবীতে কথা বললে পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে বিরোধী স্বর দমন করতে। তৃণমূলের তাজা ছেলেদের ভয়ে টেবিলের তলায় মাথা বাঁচানো পুলিশ সক্রিয় হয়ে ওঠে বিরোধী রাজনৈতিক দল বা মানুষের কন্ঠরোধ করতে। এ রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের এতই করুণ দশা যে খোদ বিচারককে অবধি 'গাঁজা কেস' দিয়ে জেলে ঢোকানোর হুমকি দিতে পারা যায়। হাইকোর্টের বিচারপতির রায় পছন্দ না হলে শাসকদলের অনুগামী উকিলরা বিচারপতির এজলাসের দরজা বন্ধ করে আয়েশে বিক্ষোভ করতে পারে যা একজন সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে। রাজ্যের শাসকদলের নেতানেত্রীরা সানন্দে ক্যামেরার সামনে শুয়ে বসে ঘুষ খান, বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের অত্যাচার করার নিদান দেন অথচ পুলিশ প্রশাসন তাদের দেখতেই পায়না। এটাই এই রাজ্যের প্রশাসনিক বাস্তবতা।

কিন্তু তারপরেও গত বিধানসভা নির্বাচনে এ রাজ্যের শাসকদল বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। দলের নেত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজেকে তখন তুলে ধরেছিলেন রাজ্যের বুকে গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসাবে। কিন্তু সত্যিই কি এ রাজ্যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ বিদ্যমান? কেবল ভোট দেওয়ার অধিকারই গণতন্ত্রের মাপকাঠি তো হতে পারেনা। তার পাশাপাশি আরও কিছু বৈশিষ্ট্য ঠিক করে সমাজে রাজনৈতিক গণতন্ত্র আদৌ আছে কিনা। সেদিক থেকে বিচার করলে এ রাজ্যের চিত্র খুব উজ্জ্বল নয়। রাজনৈতিক হিংসা এ রাজ্যে এখন প্রায় গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো বা এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী এ রাজ্যে ২০১১-২০ অবধি রাজনৈতিক খুন হয়েছে ১১৪টি, যা দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর মধ্যে যদিও ২০১৮ সালে রাজ্য কোন তথ্য এনসিআরবি-কে দেয়নি। আর এই পরিসংখ্যানও যে বিশ্বাসযোগ্য তা বলা যায়না। ২০১৮ সালে এ রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদল প্রায় ৩৪% আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় জয়ী হয়। যা এ রাজ্যের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এ রাজ্যের বিগত কোন আমলেই তৎকালীন শাসকদল ১০%-এর বেশী আসন বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় জিততে পারেনি। ২০১৯-২০ সালে জনসাধারণের সম্পত্তি নষ্টের দায়ে ৪০০-র বেশী মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বলা বাহুল্য সবক্ষেত্রেই তারা শাসকদলের বিরোধী। আজ অবধি শাসকদলের কোনো নেতা বা কর্মী ২০১১ সালের পর এই অভিযোগে গ্রেফতার হয়নি। এমনকি রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকার পরেও না। আদতে রাজ্য প্রশাসন যে দুষ্কৃতিকারীদের ত্রাতা তা সাধারণ মানুষ দৈনিক অভিজ্ঞতাতেই রোজ মালুম পাচ্ছেন। এর সূত্রপাত অবশ্য ২০১১ সালেই হয়েছিল যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হয়েই মাননীয়া ছুটেছিলেন ভবানীপুর থানায় গ্রেফতার হওয়া তৃণমূলের তাজা ছেলেদের ছাড়াতে।

বিগত ১০ বছরে রাজ্যে যে অপরাধের হার ক্রমবর্ধমান তা বরাবর কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানে ফুটে ওঠে। ২০২১-২২ সালে এ রাজ্যে মহিলাদের ওপর সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা ছিল ২৩,১৫০টি। প্রশাসন দাবী করতেই পারে যে এই সংখ্যা বেশি কারণ মহিলারা সাহস করে অভিযোগ করছেন। কিন্তু এই অপরাধে দোষী সাব্যস্তের হার এ রাজ্যে ভয়াবহ রকম কম। মাত্র ২% অপরাধীর শাস্তি হয়েছে। যা জাতীয় হারের চেয়ে অনেক কম। মনে পড়ে যায় ২০১২ সালে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য - "ওটা খদ্দের ও মহিলার ঝামেলা"। কামদুনি কাণ্ডের সময়ও মুখ্যমন্ত্রী একজন প্রতিবাদীকে 'মাওবাদী' বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন। আজকে এই রাজ্য প্রশাসন যে মহিলাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারে না তার সূত্রপাত প্রশাসনের সর্বময়ী কর্ত্রীর মনোভাব থেকেই স্পষ্ট।

পিছিয়ে পড়া জনজাতি মানুষদের প্রতি অপরাধের ঘটনাও এ রাজ্যে নেহাত কম নয়। বিগত ৫ বছরে এ রাজ্যে তফসিলি জাতি বা উপজাতি মানুষদের বিরুদ্ধে ১,৪০০-র বেশী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, বছরে গড়ে প্রায় ২৪০টি অপরাধ। একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী যিনি নাকি সবার অধিকারের কথা বলেন তার তত্ত্বাবধানে এই যদি মহিলা, জনজাতি মানুষদের নিরাপত্তার পরিসংখ্যান হয় তাহলে ওঁনার দাবি নিয়ে সন্দেহ জাগে বইকি। এ রাজ্যে অনগ্রসর জনজাতির শিশুরা স্কুলছুট হয় তাতে প্রশাসনের হেলদোল থাকে না, উল্টে সরকারি বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। মিড-ডে মিলের বরাদ্দ কমতেই থাকে। রাজ্য প্রশাসন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকে। অথচ যখনই রাজ্যে বিরোধী রাজনৈতিক স্বর মাথাচাড়া দেয় তখনই প্রশাসন ও শাসকদলের নেতারা সক্রিয় হয়ে পড়ে। সারা বছর চুরি, ডাকাতি, অপরাধ চলতে পারে কিন্তু তার বিরুদ্ধে কথা বললেই পুলিশ প্রশাসন খড়গহস্ত। আজকে রাজ্য যে দুষ্কৃতী-নিয়ন্ত্রিত এক প্রশাসনিক ব্যবস্থা সেই নিয়ে কোন সংশয় আর থাকে কি?

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দলের সবচেয়ে বড় দাবি হল যে তারা নাকি বিজেপি বিরোধী। এ রাজ্যের বুকে তারা নাকি বিজেপির ফ্যাসিবাদী ও ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এমনকি মমতা ব্যানার্জী সেই প্রচারে ভরসা করে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু বাস্তব কী? এ রাজ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারি টাকায় গঙ্গা আরতির ব্যবস্থা হচ্ছে, দেশের সবচেয়ে বড় জগন্নাথ মন্দির তৈরীর ব্যবস্থা হচ্ছে, শাসকদলের নেতারা হনুমান জয়ন্তী করতে লেগে পড়ছেন, ইমাম ভাতা থেকে পুরোহিত ভাতা সবই হচ্ছে। একদা ইফতার আর রমজানে হিজাব পরে ছবি দেওয়া মুখ্যমন্ত্রী আজ নির্বাচনী সভায় হিন্দু দেবদেবীর স্তোত্র আওড়ান। যখন ভোট পাওয়ার দরকার ছিল তখন বিজেপি বিরোধিতায় উনি রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ সাজছিলেন, আর আজ যখন গোটা দেশে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত, রাজ্যে যখন তৃণমূল আর বিজেপিকে আলাদা করা যাচ্ছে না, জনমানসে যখন হিন্দুত্ববাদের প্রভাব বাড়ছে তখন উনি 'সহি হিন্দু' হওয়ার ভেক ধরেছেন। আসলে তৃণমূলের কোনো মৌলিন ধর্মনিরপেক্ষ সত্ত্বা বা আদর্শ নেই। সব ধর্মকেই রাজনীতির আঙিনায় নামিয়ে এনে ভোটের রাজনীতিতে ধর্মের সংমিশ্রণ ঘটানো তৃণমূলের রাজনীতি। তাই কবির কথা একটু পালটে বলা যায় যে, তারা ‘ধর্মেও আছে, জিরাফেও আছে’। এহেন রাজনীতির পক্ষে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলা অসম্ভব।

কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে মাননীয়া সমালোচনা করেন অগণতান্ত্রিক বলে। সে সমালোচনা ঠিক। কেন্দ্রের সরকারও বিরোধী রাজনৈতিক স্বর দমনে ইউএপিএ-র মত দানবীয় আইন ব্যবহার করে, টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং বা শহুরে নকশাল ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ব্যবহার করে হেনস্থা চালায়। কিন্তু এ রাজ্যে মাননীয়া কি একই পথ নিচ্ছেন না! ক্ষমতায় এসে উনিই বিরোধীদের চুপ থাকার নিদান দিয়েছিলেন, টিভির পর্দায় সাধারণ ছাত্রীকে 'মাওবাদী' বলে অভিযুক্ত করেছিলেন, আর আজ বিরোধী বিধায়ককে জেলে পুরে হেনস্থা করতে চাইছেন। গোটা দেশে আজ দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধের হার বেড়েছে। এ রাজ্যেও এই ধারাই বজায় রয়েছে। আজ বিজেপি নয়া শিক্ষানীতির নামে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকেই তুলে দিতে চায় আর এ রাজ্যে মাননীয়া সর্ববৃহৎ নিয়োগ কেলেঙ্কারি চালিয়ে রাজ্যের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার কোমরটাই ভেঙে দিয়েছেন। রাজ্যের তৃণমূল সরকার আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে গণতান্ত্রিক চেতনায় একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ সচেতন মানুষ মাত্রেই আজ তা বুঝতে পারছেন।

এমতাবস্থায় এ রাজ্যে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের দায়িত্ব রাজ্যের মানুষকে এই উভয় সঙ্কটের প্রতি সচেতন করে তোলা। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনেও হয়ত রাজ্যের শাসকদল প্রশাসনের মদতে গ্রামীন মানুষের মতামতকে লুঠ করতে চাইবে। ক্ষমতার নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখতে বারবার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলির ওপর আক্রমণ চালাবে। রাজনৈতিক সন্ত্রাসই আজকের তৃণমূলের মূল শক্তি। তাই সমাজ সচেতন মানুষদের আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তৃণমূল ও বিজেপির বিপদ সম্পর্কে লাগাতার প্রচার চালাতে হবে, গণতান্ত্রিক পথেই আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে যথাসম্ভব প্রাসঙ্গিক করে তুলতে। অন্যদিকে বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলিকেও প্রস্তুত হতে হবে মানুষের এই প্রত্যাশার উপযোগী হয়ে উঠতে।