আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৩ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

সরোদ বাজাতে জানলে

সর্বানন্দ চৌধুরী




আলি আকবর, তুমি কি পড়েছো, আমাদের কবি পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছেনঃ

আমার এমন কিছু দুঃখ আছে যার নাম
    তিলককামোদ
এমন কিছু স্মৃতি যা সিন্ধুভৈরবী
জয়জয়ন্তীর মতো বহু ক্ষত রয়ে গেছে ভিতর
    দেয়ালে
কিছু কিছু অভিমান ইমনকল্যাণ।
সরোদ বাজাতে জানলে বড়ো ভালো হত
পুরুষ কীভাবে কাঁদে সেই শুধু জানে।

সেই সিন্ধুভৈরবীই তুমি বাজাচ্ছ। সরোদের তারে শুধু দু-একটা টোকা। বৃষ্টিভেজা গাছের পাতা থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে। শ্রী রাগে রেখাবটা কেটে বসাচ্ছ। দূরের আকাশে একটা নিঃসঙ্গ সন্ধ্যাতারা ফুটে উঠছে। তুমি বাজাচ্ছ। যা বাজাচ্ছ না, তাও পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছি। বাজনার ভেতরে ভেতরে, অজস্র যতিঘেরা সেই নিবিড় জায়গাগুলো। পৃথিবী কি এমন বাজনা এর আগে শুনেছে।

সেদিন তুমি যখন কিরবানি বাজাচ্ছিলে, তোমার শরীর থেকে তোমার কোলের ওপর ওটা কী নেমে এসেছিল, যার গায়ে উন্মত্তের মতো আঙুল চালাচ্ছিলে! ওটাই কি তোমার সরোদ? আমি কোনোদিন তোমার পেছনে বসে বাজনা শুনিনি। যারা শুনেছে, বলে, আওয়াজটা নাকি তোমার পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে আসে। মনে পড়ে? ঢাকুরিয়ার লেকের ধারে একটা বাড়িতে, একদিন আমি তোমার পা ছুঁয়েছিলাম। তোমার শরীরী সুরের সেই সুঘ্রাণ, আজও আমার হাতের আঙুলে লেগে আছে।

কিন্তু কেন তুমি এভাবে হয়ে ওঠ - সরোদের সর্ব আর সর্বনাশ। কিছু বাকি রাখ না, তোমার সন্তানদের জন্য। ওরা এসে যখন দাঁড়ায়, তুমি সামনে পাহাড়ের মতো। পাশকাটানো বা টপকানো দুটোই অলীক। সময় তোমাকে আত্মস্থ না করে নিলে, তুমি কি পথ ছাড়বে না? জান তো, রবীন্দ্রনাথের পরে যারা কবিতা লিখতে এসেছিল, তাদেরও এমনিই হয়েছিল। তারপর অনেক কালের সাধনায় রবীন্দ্রনাথ পথ ছেড়েছিলেন। ওরাও হয়তো একদিন সেভাবেই পথ পেয়ে যাবে।

আচ্ছা, তোমার ওই মেধাবী রাগটা - অমন দার্শনিক নির্লিপ্তি কোথা থেকে পেলে বলো তো। তোমার বাবা একবার, রবীন্দ্রমেলায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে একটা রাগের খসড়া করে শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সেটা রবীন্দ্ররাগ। আমি সেদিন সেখানে ছিলাম না। তুমি প্রবাসে ছিলে। শুনেছি, ফিরে এসে ওই রাগটা তোমার পূর্ণ করে তোলার কথা ছিল। এটাই কি মেধাবী? দেখেছ, কেমন এলোমেলো কথা আসছে। কিন্তু তুমি যে আমার বেঁচে থাকাকেই এলোমেলো করে দাও বার বার। কেন করো।

আলি আকবর, এখন গভীর রাত্রি। শুধু আমি জেগে আছি। তোমার কানাড়া-প্রকার বাজছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মা, অমৃতা, শালুক, পুরব সবাই। আমি একা তোমার সামনে - তোমার বাজনার সামনে। তুমি আমার হাত ধরে কোথায় নিয়ে চলেছো, কোন মহানিষ্ক্রমণের দরজায়। তোমার কোমল গান্ধারের টানে, আমার সবরকমের যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে উঠে আসছে। কিন্তু আমি তো সরোদ বাজাতে জানি না, আলি আকবর। তুমিই বাজাও, আরো বাজাও। আমাকে বাজাও - আমাকেও।