আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৩ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

গোরা - ১১২ বছর বাদে ফিরে দেখা

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়


কলকাতা শহরের পটভূমিতে ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১০ সালে লেখেন 'গোরা'। গোরা রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনব্যাপী চিন্তা, দর্শন, রাজনীতি, ধর্ম ও স্বদেশপ্রেম নিয়ে স্বগতোক্তি। গোরা এক নবতম সাহিত্যধারা। উপন্যাসের যে চিরাচরিত ছাঁদে আমরা অভ্যস্ত গোরা তার থেকে ভিন্ন। এখানে চরিত্রগুলো ছোট ছোট কথোপকথনে নিজেদের অবস্থান, অভিব্যক্তি প্রকাশ করেনি। গোরা উপন্যাসের অবয়বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিবন্ধের সম্মেলন - আসলে তা রবীন্দ্রনাথের আত্মমন্থন। সমাজ ও ধর্ম নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা বুঝতে গোরা দিগ্‌নির্দেশ করে।

সেই সময় বাঙালি সমাজ ছিল সম্পূর্ণ বিভাজিত। একদিকে ছিল মামুলি চিরাচরিত গোঁড়া হিন্দু সমাজ ও অন্যদিকে তথাকথিত উদার, আধুনিকমনস্ক ব্রাহ্ম সমাজ। সামগ্রিকভাবে আজও সেই সময়টাকে এইভাবেই আমরা মূল্যায়ন করি। সামাজিক দ্বন্দ্ব ছিল একেবারে সুস্পষ্ট। সেই সময়ের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যেও তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ওই দুই ভিন্নধর্মের সমাজবদ্ধ সাধারণ মানুষ দূর থেকে অপরিচয়ের বিচ্ছিন্নতায় অন্যদের দেখে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সন্দেহহীন হয়েছেন। আর আত্মতৃপ্ত হয়ে রোমন্থন করেছেন নিজ ধর্ম ও বর্ণের শ্রেষ্ঠত্বকে।

রবীন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত ভাববাদী ধার্মিক। "আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে।" তবে সেই সময়ে কাছ থেকে ব্রাহ্ম সমাজকে দেখে তাঁর মধ্যে নিশ্চয়ই সংগঠিত ধর্মের যে উগ্র রূপ তা নিয়ে এসেছিল দ্বিধা, দ্বন্দ্ব। যে কোনো সংগঠিত ধর্ম শেষ পর্যন্ত সমাজের নিয়মরক্ষার বকলমে ব্যক্তির নিজস্বতায় হস্তক্ষেপ করে, আঘাত হানে। সেই হস্তক্ষেপের আসল উদ্দেশ্য থাকে আপন ক্ষমতা জাহির করা, তাতে থাকে এক ধর্ষকামী মানসিকতা। সমাজের দোহাই দিয়ে নিজ ক্ষুদ্রতাকে আড়াল করা।

এই স্বতঃসিদ্ধতা ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত সুচরিতার পালকপিতা পরেশবাবু অনুভব করেছিলেন। আবার হিন্দু ধর্মের কুসংস্কার, বর্ণপ্রথা যে মানবতাবিরোধী তা নিয়েও তাঁর কোনো সংশয় ছিল না। "পাতের কাছে একটা কুকুর এসে বসলে খাবার অশুদ্ধ হয় না, কিন্তু একটি নিচু জাতের মানুষ ছুঁলে সেই খাবার ফেলে দিতে হয়।’ এই ভয়ংকর অমানবিকতা সেই বুদ্ধের সময় থেকে বারেবারে এই দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তবু হিন্দু ধর্ম আজও জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না।"

উল্টো দিকে গোরার মা, আনন্দময়ী এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। তাঁর নিজস্ব মতামত আছে; সেই মত সুচিন্তিত, কুসংস্কাররহিত ও তথাকথিত বাজার চলতি ধর্মীয় অনুশাসনের ঊর্ধে। তিনি একদিকে বিনয়কে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করতে নিষেধ করেন, আবার ললিতার দায়িত্ব নিতেও উদ্বুদ্ধ করেন। এমনকি তাঁর নিজস্ব ভালোলাগার ঊর্ধ্বে উঠে, গোরাকে ছেড়ে তিনি বিনয়-ললিতার বিবাহে উপস্থিত থাকেন।

আছেন গোরার বাবা কৃষ্ণদয়ালবাবু। তখনকার হিন্দু ধর্মের তথাকথিত উঁচু বর্ণের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সুবিধাভোগী আমলা ও পরবর্তীতে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিকগ্রস্ত হিন্দু ব্রাহ্মণের প্রতিনিধি। তিনি অবসরের পরে গঙ্গা স্নান, সন্ধ্যাহ্নিক, টিকি, খাওয়া-ছোঁয়া নিয়ে থাকেন। গোরাকে বলেন, "দেখ বাবা, হিন্দু শাস্ত্র বড়ো কঠিন জিনিস। ঋষিরা যে ধর্ম স্থাপন করে গেছেন তা বোঝা যে সে লোকের কর্ম নয়।... হিন্দু বললেই হিন্দু হওয়া যায় না। মুসলমান হওয়া সোজা, খৃষ্টান যে সে হতে পারে। কিন্তু হিন্দু! বাস রে। সে বড়ো শক্ত কথা।"

এবার আসি গোরার কথায়। প্রথমদিকে মনে হবে সে আত্মানুসন্ধানে রত, স্ববিরোধী, আত্মদ্বন্দ্বে বিক্ষত। যেন নিজের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখছে। সে ইস্পাতের মতো ধারালো ও কঠিন। তবুও সে সংবেদনশীল, স্নেহময়। আর সেই অস্থির যুবক মায়ের কাছে শিশুর মত আশ্রয়প্রার্থী।

সুচরিতা ও গোরার বাক্যালাপ, জাগতিক তুচ্ছ ব্যাপারকে উপেক্ষা করার অজাগতিক ক্ষমতা, সুচরিতার অসীম ধৈর্য তাকে গোরার সম্পূর্ণ বিপরীত কিন্তু পরিপূরক চরিত্র করে তোলে। সুচরিতা গোরাতে উদ্বেলিত হয়। গোরার বাক্য যেন সুচরিতার হৃদয়ে সরাসরি ঢুকে গিয়ে অবিরাম মোক্ষণ ঘটায়। তবুও তা এতই মধুর ও একই সঙ্গে এতই করুণ যে, আজও পাঠক সেই আলাপে সমুদ্রতটে জোয়ারের জলের মতো ভেসে যায়।

গোরার আত্মপরিচয় প্রকাশে একটু নাটকীয়তা আছে। তা থাকুক। শেষ পর্যন্ত, আত্মোপলব্ধি তো হয়। সব হারিয়ে সে নিজ অন্তঃস্থলের খোঁজ পেল। সেই যাত্রায় অমোঘভাবে সুচরিতাই হয় তার সাথী।

বাংলা সাহিত্যে ধর্মনিরপেক্ষতার কোরক উদগম এই গ্রন্থেই হয়েছে। এই কালজয়ী উপন্যাস লেখার ১১২ বছর পরেও চারিদিকে ভণ্ড, খল রাজনৈতিক ধর্মধ্বজীদের দেখে মনে হয় এখনও কত কষ্টকল্পিত সেই মানবতাবাদ।

সেই দাবি করতে পারে রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার যে গোরার মত বলতে পারবে, "আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খৃস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।"