আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৩ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

পরীক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব

পলাশ বরন পাল


প্রথমেই বলে রাখি, পরীক্ষাপদ্ধতি কীরকম হওয়া উচিত, সে সম্বন্ধীয় কোনো প্রস্তাব আমি দিতে বসিনি। এ আলোচনা 'পরীক্ষা' শব্দটার ব্যবহার নিয়ে।

পরীক্ষা কথাটা দুটো ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয় বাংলায়। ইংরিজিতে যাকে examination বলে সেটাও ‘পরীক্ষা’, আর যাকে experiment বলে সেটাও ‘পরীক্ষা'।

পরিস্থিতিটা একটু অস্বস্তিকর, কেননা অর্থের দিক থেকে দুটো বেশ দূরবর্তী, একটাকে অন্যটার প্রায় বিপরীতার্থকও বলা যেতে পারে। examination মানে যেটা করা হয়ে গেছে সেটার মূল্যায়ন করা, আর experiment মানে যা কখনো করা হয়নি তার চেষ্টা করা।

ব্যাপারটা বিশেষ করে ঝামেলা পাকায় বিজ্ঞানের আলোচনার সময়ে। যদি লেখা হয় ‘পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে...', তাহলে ঠিক বোঝা যায় না, ‘পরীক্ষা' শব্দের কোন অর্থটি উদ্দিষ্ট। এতে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। একটু অন্যরকম কি কিছু করা যায় না, যাতে এই বিভ্রান্তির সম্ভাবনা দূর করা যায়?

একটু ভেবে দেখা যাক। ‘পরীক্ষা' শব্দটার মধ্যে দুটো অংশ। একটা হলো ‘পরি’, সেটা উপসর্গ। সেটার কথায় পরে আসছি। অন্য অংশটা হলো ‘ঈক্ষা’। সেটা সংস্কৃতর বিচারে একটা আলাদা শব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হতে পারে, বাংলায় কখনোই সেভাবে ব্যবহার হয় না। এর সঙ্গে উপসর্গ যোগ হয়ে এমন অনেক শব্দ তৈরি হয়, যেগুলোর ব্যবহার আছে বাংলায়। এরকম যত শব্দ চালু, তাদের একটা তালিকা তৈরি করা যাক -

অপ + ঈক্ষা = অপেক্ষা

নিঃ + ঈক্ষা = নিরীক্ষা

পরি + ঈক্ষা = পরীক্ষা

প্র + ঈক্ষা = প্রেক্ষা

প্রতি + ঈক্ষা = প্রতীক্ষা

বি + ঈক্ষা = বীক্ষা

সম্ + ঈক্ষা = সমীক্ষা

‘বীক্ষা' শব্দটা কারুর কারুর কাছে অপরিচিত ঠেকতে পারে, কিন্তু পেছন দিকে অন্য একটা প্রত্যয় লাগিয়ে যদি ‘বীক্ষণ' বলি, তাহলে হয়তো অচেনা লাগবে না, অন্তত ‘দূরবীক্ষণ’ বা ‘অণুবীক্ষণ যন্ত্রের কথা মনে আসবে। তেমনি, ‘প্রেক্ষা' শব্দটা অচেনা ঠেকলে ‘প্রেক্ষাগৃহ' মনে করে দেখতে পারেন। এবং এইসব উদাহরণ থেকে ভাবতে শুরু করলেই বোঝা যাবে, ‘ঈক্ষা' শব্দের অর্থ হলো ‘দেখা’। সম্যকভাবে দেখা মানে ‘সমীক্ষা’, কারুর প্রতি চেয়ে থাকা মানে ‘প্রতীক্ষা’ ইত্যাদি। যেহেতু examination এবং experiment দুটোই কোনো না কোনো রকমের দৃষ্টিপাত, তাই ধরা যাক এই ‘ঈক্ষা’ অংশটা আমরা রাখতে চাই দুটো শব্দেরই অনুবাদে।

এবারে 'পরি' উপসর্গটির দিকে তাকানো যাক। বাংলায় বহু শব্দে এর দেখা পাওয়া যায়। এতো বেশি যে, সব কটা এখানে তালিকা করে দেওয়া যাবে না। এর মধ্যে আটপৌরে ব্যবহারের শব্দ আছে, যথা ‘পরিষ্কার', 'পরিমাণ’, ‘পরিশ্রম’। আবার এমন কিছু শব্দ আছে যেগুলো মুখের কথায় ব্যবহার হলে আশ্চর্য লাগে না, যদিও অন্য কোনো বিকল্প শব্দই হয়তো বেশি ব্যবহৃত হয় যথা ‘পরিবর্তন’, ‘পরিশ্রান্ত’, ‘পরিস্থিতি’। সেই সঙ্গে এমন শব্দও আছে, যেগুলো সুপরিচিত হলেও কেবলমাত্র ভারিক্কি লেখাতে বা বক্তৃতাতেই ব্যবহার হয়, যথা ‘পরিকীর্ণ’, ‘পরিপার্শ্ব’, ‘পরিপ্রেক্ষিত'।

এই নমুনাগুলো খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, 'পরি' উপসর্গটা বাংলা শব্দে দু'ভাবে ব্যবহৃত হয়। ‘পার্শ্ব' মানে ‘পাশ’, তার সঙ্গে 'পরি' উপসর্গ যোগ করলে ‘পরিপার্শ্ব’ মানে ‘চারপাশ’। ‘সীমা’ মানে ‘প্রান্ত’, ‘পরিসীমা’ মানে ‘সবদিকের প্রান্ত'। এই সব ক্ষেত্রে 'পরি' উপসর্গের কাজ চারপাশটা বোঝানো।

অন্য অনেক ক্ষেত্রে তেমন কাজ নয়। ‘শ্রান্ত’ আর ‘পরিশ্রান্ত’, এ দুটো কথায় আমাদের মনে একই ভাবের উদয় হয়। বা হয়তো দ্বিতীয় কথাটা শুনলে ভাবি, একটু বেশিরকমের ক্লান্ত। তেমনি, ‘পরিপক্ব' বললেও বুঝি কেবলই পক্ক, বা একটু ভালোরকমের পাকা। ‘পরিতৃপ্ত' 'পরিত্যাগ' ‘পরিবর্ধন' ‘পরিমাপ’ ইত্যাদি আরো বহু শব্দ সম্পর্কেই এই একই কথা বলা যায়।

‘পরীক্ষা' শব্দটি এই দুটোর মধ্যে কোন ভাগে পড়ে? মনে হয় দ্বিতীয়টাই। শব্দটি বললে চারপাশ দিয়ে দেখা বুঝি না আমরা, বরং ভালো করে দেখার অর্থই প্রকাশ পায়। তাহলে এবারে প্রশ্ন করা যাক, আর কোনো উপসর্গ প্রয়োগ করে কি অনুরূপ অর্থ বোঝানো সম্ভব?

কী কী উপসর্গ সংস্কৃতয় আছে? সবগুলোকে প্রথমে দেখা যাক - অতি, অধি, অনু, অন্তঃ, অপ, অপি, অভি, অব, আ, উদ্, উপ, দুঃ, নি, নিঃ, পরা, পরি, প্র, প্রতি, বি, সম, সু ইত্যাদি।

এর মধ্যে কয়েকটা 'ঈক্ষা'-র সঙ্গে যোগ দিয়ে চেনা শব্দ তৈরি করে, যেগুলো আমরা আগেই লিখেছি। সেগুলো কোনো কাজে আসবে না। বাকি যা আছে, তাদের মধ্যে সন্ধান করতে হবে।

এদের মধ্যে কয়েকটা উপসর্গ বেশ জোরালো অর্থ বহন করে। ‘অনু’ বসে পশ্চাদবর্তী বোঝাতে, যেমন 'অনুসরণ' মানে ‘পেছনে পেছনে সরা’। ‘দুঃ’ বসে খারাপ বোঝাতে, যথা ‘দুঃসময়' বা 'দুর্ভাগ্য'। 'অব' উপসর্গ তলার দিকের ইঙ্গিত দেয়, যথা ‘অবনমন’। এই ধরনের উপসর্গ দিয়েও কাজ চলবে না। ‘অপি’ উপসর্গের ব্যবহার বাংলায় প্রায় নেই, সেটাকে এনে জবরদস্তি করাও ঠিক হবে না।

এইভাবে বাদ দিতে বসলে শেষ পর্যন্ত যা পড়ে থাকে, তাদের মধ্যে চোখ আটকে যায় ‘অভি' উপসর্গের দিকে। 'পরি' উপসর্গের দ্বিতীয় রকমের যে ব্যবহারের কথা বলছিলাম, এই ‘অভি' উপসর্গটির ব্যবহার অনেকটাই সেই রকম। ‘শাপ’ আর ‘অভিশাপ' অর্থ একই, শুধু মনে হয় পরেরটায় একটু বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। 'অভিনব' আর 'নব' শব্দের অর্থও একই। ‘অভিযাত্রী’ মানে ‘যাত্রী’, হয়তো একটু লম্বা পথের যাত্রী। ‘অভিমত’, ‘অভিভাষণ’, ‘অভিরুচি' ইত্যাদি অনেক শব্দের ‘অভি' অংশটা বাদ দিলে অর্থের খুব তারতম্য হয় না। তাহলে ‘ঈক্ষা'-র আগে এই উপসর্গটিকে যোগ করে যদি ‘অভীক্ষা' বলে একটা শব্দের কথা ভাবি, তা দিয়ে কি কাজ চলবে? অর্থাৎ কিনা, 'পরীক্ষা' শব্দের যে দুটো অর্থ আগে উল্লেখ করা হয়েছিলো, তার একটি অর্থে এই শব্দটিকেই রেখে দিয়ে অন্য অর্থে কি 'অভীক্ষা' শব্দটা চালানো যাবে?

কোন অর্থে পুরোনো শব্দটাই রাখবো? এর উত্তর নিয়ে বোধহয় দ্বিমত হবে না। ইংরিজির ‘examination' অর্থে 'পরীক্ষা' শব্দটাই রেখে দেওয়া বাঞ্ছনীয়, কেননা এর প্রয়োগ অত্যন্ত ব্যাপক, এটিকে বদলানোর চেষ্টা করা উচিত হবে না। কিন্তু ‘experiment' অর্থে যেখানে 'পরীক্ষা' কথাটা ব্যবহৃত হয়, তার পরিধি অতো ব্যাপক নয়, সেখানে ‘অভীক্ষা' শব্দটা চললে মন্দ হয় না। এইটাই হলো প্রস্তাব।

প্রস্তাবটাকে আর একটু খুঁটিয়ে ভাবা যাক। চিন্তা করা যাক, ‘পরীক্ষা' শব্দের শেষে যে ‘আ’ প্রত্যয় আছে, তার পরিবর্তে অন্য লেজুড় দিয়ে তৈরি কোন কোন শব্দ বাংলায় প্রচলিত। এরকম শব্দের একটা তালিকা বানানো যাক - পরীক্ষক, পরীক্ষণ, পরীক্ষণীয়, পরীক্ষিত, পরীক্ষার্থী, পরীক্ষাধীন, পরীক্ষোত্তীর্ণ ইত্যাদি।

তালিকা অবশ্যই সম্পূর্ণ নয়, কেননা আমি শেষকালে শুধু অন্য প্রত্যয়ই বসাইনি, অন্য শব্দের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ শব্দও দেখিয়েছি। এরকম আরো শব্দ বানানো যায়, তবে তালিকা দীর্ঘ করার দরকার নেই। আসল যে কথাটা বলার তা হলো, এই সবগুলো শব্দেই যদি 'পরি' উপসর্গের জায়গায় ‘অভি' উপসর্গ বসানো যায়, কোনোটাই শুনতে খুব বেখাপ্পা লাগে না। যিনি বিজ্ঞানের কোনো রহস্য উন্মোচনের জন্য হাতেনাতে কিছু করছেন, তাঁকে 'অভীক্ষক' বলতেই পারা যায়, এবং তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তুটাকে ‘অভীক্ষাধীন' আখ্যা দেওয়া যায়। যে বিষয় নিয়ে এরকম গবেষণা হয়েছে সেটিকে 'অভীক্ষিত' বলা যেতেই পারে। একমাত্র ‘অভীক্ষার্থী' শব্দটার হয়তো কোনো অর্থ হবে না, কেননা প্রকৃতির কোনো রহস্যই আমাদের কাছে অভীক্ষিত হওয়ার জন্য আবেদন করবে না।

এ প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বলার আছে। আমরা কখনো কখনো একসঙ্গে 'পরীক্ষানিরীক্ষা' বলি। এখানে 'পরীক্ষা' শব্দের ব্যবহার ‘experiment' অর্থে। এর জায়গায় ‘অভীক্ষানিরীক্ষা' ব্যবহার করতে কোনো বাধা নেই।