আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৩ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ওল্ড পেনশন স্কীম বনাম ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম

মিহির দাসগুপ্ত


নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের সারমর্ম হল একদিকে বহুজাতিক ও বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলি এবং ধনকুবেরদের মুনাফা ও সম্পদের লাগামহীন বৃদ্ধির নিশ্চয়তা; পাশাপাশি বিপুল সংখ্যা‌গরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রাকে বিরামহীন‌ভাবে দুর্দশা ও দৈন্যের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ। এর বিষময় ফল হিসেবে পুঁজিবাদী দুনিয়া জুড়েই দেখা দিয়েছে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান কদর্য ধনবৈষম্য। এই লক্ষ্য অর্জনের পথে পুঁজিপতিদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা‌গুলি, বিশেষ করে প্রবীণ নাগরিকদের মূল্যবান সহায় পেনশন ব্যবস্থা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অগ্রগতির যুগে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে অভূতপূর্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, যার অভিঘাতে পুঁজিবাদী দেশগুলিও বাধ্য হয়েছিল কিছুটা এক‌ই ধরনের ব্যবস্থা চালু করতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা ঘটে চলেছে। অবশ্য এক‌ই সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই আন্দোলন‌ গড়ে ওঠার ছবিও দেখা যাচ্ছে। এই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সরকারি ও আধা-সরকারি ক্ষেত্রের কর্মীদের পেনশন ব্যবস্থায় যে অবস্থা বর্তমানে আছে, এই নিবন্ধে সেই সম্পর্কেই সংক্ষেপে আলোকপাত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

পেনশন নিয়ে প্রবীণ নাগরিকদের দুশ্চিন্তা বা টেনশন নতুন করে বাড়িয়ে দিয়েছে সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে ২৭ নভেম্বর, ২০২২ তারিখে দেওয়া নীতি আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যান সুমন বেরীর এক সাক্ষাৎকার। এখানে তিনি বলেছেন, পুরোনো পেনশন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য বেশ কিছু রাজ্য সরকারের মধ্যে যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা তাৎক্ষণিক‌ভাবে জনপ্রিয় হলেও দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির পক্ষে বিপজ্জনক। তাঁর এই সতর্কবার্তা‌র গুণাগুণ বিচার করতে গেলে পেনশন ব্যবস্থার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

।। ১ ।।

কেন্দ্রীয় সরকারি ও বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্য সরকারি এবং সেই সঙ্গে শিক্ষক ও বেশ কিছু সংখ্যক আধা-সরকারি সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা বহু দশক ধরে যে পেনশন পেয়ে আসছেন, বর্তমান সময়ে তাকে অভিহিত করা হচ্ছে পুরোনো পেনশন ব্যবস্থা বা ওল্ড পেনশন স্কীম (ওপিএস) নামে। অপর দিকে ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নিযুক্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের জন্য বাধ্যতামূলক‌ভাবে নতুন ধরনের যে পেনশন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকার চালু করেছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে নতুন পেনশন ব্যবস্থা বা ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম (এনপিএস)।

কর্মচারীদের আন্দোলন, কোর্টের রায় ও কেন্দ্রীয় বেতন কমিশনগুলির সুপারিশের ভিত্তিতে ওপিএস ব্যবস্থায় ক্রমশ উন্নতি হয়েছে। এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত একজন কর্মচারী তাঁর কর্মজীবনের শেষে অবসর গ্রহণ করার পর সর্বশেষ বেতনের একটি পূর্ব নির্ধারিত নির্দিষ্ট অংশ (সাধারণভাবে ৫০ শতাংশ) আজীবন মাসিক পেনশন হিসেবে পেয়ে থাকেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী বা স্বামী জীবিত থাকলে তিনিও আজীবন পারিবারিক পেনশন পান। এই মূল পেনশনের উপর নির্দিষ্ট সূত্র অনুসারে মহার্ঘ ভাতা বা ডিয়ারনেস রিলিফ‌ও দেওয়া হয়। সময়ান্তরে পেনশনের ঊর্ধ্বমুখী সংশোধন‌ও হয়ে থাকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত নিয়ম-কানুন আছে, যদিও সে সম্পর্কে বিশদে আলোচনার অবকাশ বা প্রয়োজন এখানে নেই।

ওপিএস-এর জন্য কর্মচারীদের দৃশ্যত কোনো চাঁদা বা কন্ট্রিবিউশন দিতে হয়না, সেই কন্ট্রিবিউশন সুপ্ত থাকে তুলনামূলকভাবে কম বেতন নির্ধারণের মধ্যেই। কিন্তু পেনশনের হার থাকে পূর্ব নির্ধারিত। তাই একে বলা হয় 'ডিফাইন্ড বেনিফিট' পেনশন'। পেনশনের টাকা মেটানো হয় সরকারের কনসলিডেটেড ফান্ড থেকে। তবে পেনশন কানুনে 'কন্ট্রিবিউশনের হার' নামে একটি বিধি লিপিবদ্ধ আছে, তা হল প্রতি মাসে বেতনের ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ ওপিএস-ভুক্ত লক্ষ লক্ষ কর্মচারীর বেতন থেকে প্রতিমাসে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পেনশন খাতে কনসলিডেটেড ফান্ডে প্রচ্ছন্নভাবে জমা হয়, যদিও তার পৃথক হিসাব রাখা হয় না বা তহবিল (করপাস) হিসেবেও গণ্য করা হয় না। পেনশন মেটাতে সরকারি কোষাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের হিসাব প্রতিনিয়তই উদ্দেশ্য‌প্রণোদিত‌ভাবে সরকার ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়। এই প্রচার ভিত্তিহীন, কারণ পূর্বোক্ত পেনশন কন্ট্রিবিউশনের পুঞ্জিভূত অর্থকে যদি প্রথমাবধি তহবিল হিসেবে রক্ষা করা হত তাহলে স্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি সহ তার পরিমাণ বর্তমানের পেনশন দায় মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট হত বলে সঙ্গতভাবে মনে করা যেতে পারে। পাশাপাশি, উদার অর্থনীতির জমানায় বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা ও ধনকুবেরদের স্বার্থে ব্যাপক হারে কর ছাড়, ঋণ মকুব, বেল-আউট, ইনসেনটিভ ইত্যাদির ফলে সরকারের কোষাগারের বৃদ্ধি শ্লথ হয়ে পড়েছে, যাকে সামাল দিতে জিএসটি সহ নানান পরোক্ষ কর বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় ভরতুকি ছাঁটাই, স্বল্প সঞ্চয়ের সুদের হার হ্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান বোঝা চাপানো হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাঁধে। পেনশনের দায় ঝেড়ে ফেলার প্রচেষ্টাও যে তার‌ই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এবিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।

।। ২ ।।

অপরদিকে এনপিএস-র প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এই সুবিধা অর্জন করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারী‌কে সমগ্র চাকরি‌কাল জুড়ে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে (বর্তমানে বেতনের ১০ শতাংশ) কন্ট্রিবিউশন দিয়ে যেতে হয়, অবসরকালে কী হারে বা কত পরিমাণে পেনশন পাবেন তা না জেনেই। তাই এই ব্যবস্থাকে বলা হয় 'ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউশন' ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে সরকার বা নিয়োগকর্তা প্রতি মাসে কর্মচারীর বেতনের ১৪ শতাংশ হারে পরিপূরক কন্ট্রিবিউশন দিয়ে দায়মুক্ত হয়। উভয় কন্ট্রিবিউশনের সম্মিলিত অর্থ জমা দেওয়া হয় এই উদ্দেশ্যে স্থাপিত আধা-সরকারি বা বেসরকারি স্বতন্ত্র ফান্ড ম্যানেজার‌ সংস্থার হেফাজতে। ফান্ড ম্যানেজার‌রা এই অর্থ শেয়ার বাজার সহ নানান বিনিয়োগে খাটিয়ে যে মুনাফা অর্জন করে তা থেকে নিজেদের লভ্যাংশ সরিয়ে নিয়ে একটি অংশ কর্মচারীর খাতায় জমা করে। এইভাবে গোটা চাকরি‌কাল জুড়ে পুঞ্জিভূত অর্থ (উভয় কন্ট্রিবিউশন ও বৃদ্ধি) দিয়ে অবসর গ্রহণকালে কর্মচারী উপযুক্ত এন্যুইটি প্ল্যান খরিদ করবেন এবং তা থেকে মাসে মাসে যে অর্থ পাবেন তাকেই নয়া ব্যবস্থায় 'পেনশন' নাম দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, এনপিএস-এর আওতায় ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জমা অর্থের মোট অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৮,৪৩,৬৪০.৫৪ কোটি টাকা (সূত্রঃ কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী ডঃ ভগবত কাড়াড কর্তৃক রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তরে প্রদত্ত তথ্য) এই বিপুল পরিমাণ অর্থকে কাজে লাগিয়ে শেয়ার বাজারকে সতত উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা চলছে। এর ফলে দীর্ঘ চাকরিকালে পুঁজিবাদী আর্থিক বাজারে‌র ঝুঁকি কিংবা ফান্ড ম্যানেজারের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ক্ষয়ক্ষতিও কর্মচারী‌কেই বহন করতে হবে, সরকার বা নিয়োগকর্তা কোনো দায় নেবে না।

বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে মার্কিন অর্থনীতি‌তে মেল্ট-ডাউনের সময় সেই মর্মান্তিক চিত্র আমরা দেখেছি। ইতিমধ্যে লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা তাই কন্ট্রিবিউটরি পেনশন ব্যবস্থা অর্থাৎ এনপিএস-কে অভিহিত করতে শুরু করেছেন 'নো পেনশন স্কীম' নামে।

।। ৩ ।।

প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রে‌র এনডিএ সরকার ২০০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর জারি করা এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে নয়া পেনশন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের কনফেডারেশন, সারা ভারত রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন সহ বৃহৎ কর্মচারী সংগঠনগুলি, সিআইটিইউ-সহ বামপন্থী কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ, সিপিআই(এম)-সহ বামপন্থী দলগুলি প্রথম থেকেই এই ব্যবস্থা‌ রদের দাবি করে আসছেন। কর্মচারী ও কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন‌গুলির ডাকা দেশব্যাপী ধর্মঘটগুলির‌ও অন্যতম প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে এই বিষয়টি। মূলত বামপন্থী দলগুলির বিরোধিতা‌র ফলে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় এক দশক ধরে পেনশন ফান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (পিএফ‌আরডিএ) বিল সংসদে পাশ করাতে পারেনি। কংগ্রেস ও বিজেপি সহমতের ভিত্তিতে বামপন্থী সাংসদদের সমস্ত সংশোধনী সংখ্যাগরিষ্ঠ‌তার জোরে খারিজ করে দিয়ে অবশেষে তা পাশ হয় ২০১৩ সালে। অবশ্য পরবর্তী প্রায় এক দশকের অভিজ্ঞতায় কংগ্রেস তার অবস্থান বদল করেছে।

।। ৪ ।।

পেনশন নিয়োগকর্তা‌র কোনো দয়ার দান নয়। এই সুবিধা ১৯৭২ সালের বিধি অনুসারে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের একটি মূল্যবান ন্যায়সঙ্গত অধিকার। কর্মচারীরা কর্মজীবনে যে সেবা দিয়েছেন, পেনশন তার‌ বিনিময়ে প্রাপ্য একটি বিলম্বিত প্রদান। একজন কর্মী তাঁর নিয়োগকর্তার জন্য জীবনের উজ্জ্বল সময়ে কাজ করে গেছেন এই আশ্বাসের ভিত্তিতে যে বৃদ্ধ বয়সে তাঁর সহায় হবে পেনশন।

ওপরের কথাগুলি কোনো ট্রেড ইউনিয়ন কিংবা বামপন্থী রাজনৈতিক নেতার ভাষণ নয়। সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওয়াই. ভি. চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ডি. এস. নাকাড়া বনাম ভারত সরকারের পেনশন সম্পর্কিত মামলায় ১৯৮২ সালের ১৭ ডিসেম্বর যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন - কথাগুলি সেখানেই লিপিবদ্ধ আছে। এই রায়ের তাৎপর্য অপরিসীম, তাই তাকে অবসরপ্রাপ্ত‌দের সপক্ষে 'ম্যাগনা কারটা' বলেই অভিহিত করা হয়ে থাকে। এখন সরকার এই নীতি-নির্দেশকেই উপেক্ষা করেছে এনপিএস প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে। কেবলমাত্র নবনিযুক্ত কর্মীদের জন্যই যে নতুন ব্যবস্থা, একথা মনে করারও বিশ্বাস‌যোগ্য ভিত্তি নেই - পিএফ‌আরডিএ আইনের একটি ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, সরকার কেবলমাত্র প্রশাসনিক আদেশনামা জারি করেই পুরোনো পেনশন ব্যবস্থার প্রাপকদেরকেও নতুন ব্যবস্থায় টেনে আনতে পারে। এই ধারাটি‌ উদ্বেগজনক এবং আপত্তি‌কর।

এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ২০১৫ সালে অনুমোদিত 'সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল' (এসডিজি) এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএল‌ও) রচিত 'ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল প্রোটেকশন রিপোর্ট ২০১৭-১৯' ও তার আগে ২০১২ সালের 'সোশ্যাল প্রোটেকশন রেকমেনডেশন নং ২০২'-এর ঘোষণা‌গুলিও গুরুত্ব সহকারে স্মরণ করতে হবে। বয়স্ক নারী-পুরুষ তথা অবসরপ্রাপ্তদের জন্য এক মর্যাদা‌পূর্ণ জীবন সুনিশ্চিত করতে এইসব সনদে পেনশনের গুরুত্ব সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে যে পেনশন‌ই হল বিশ্বের সবচাইতে সুবিস্তৃত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পেনশন ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ কাজে আসেনি এবং অনেক দেশ সরকারি ব্যবস্থা‌য় ফিরে আসছে বলেও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভারত সরকার নিজেকে রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং আইএল‌ও-র এক গৌরবান্বিত অংশীদার বলে ঘোষণা করলেও এবং পূর্বোক্ত ঘোষণাগুলির অন্যতম স্বাক্ষর‌কারী হলেও দেশে বেপরোয়াভাবে তার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকেই এগিয়ে চলেছে।

।। ৫ ।।

ইতিহাস শিক্ষা দেয়, অধিকারকে - তা সে যত‌ই কষ্টার্জিত, ন্যায়সঙ্গত এমনকি জন্মগত‌ হোক, পরিচর্যা করেই রক্ষা করতে হয়; অন্যথায় বিপন্ন হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা। পেনশনের ক্ষেত্রে‌ও তা সমভাবে প্রযোজ্য।

এই শিক্ষা‌কে চেতনায় রেখে বিরামহীন লড়াই চলছে গোটা বিশ্বে এবং আমাদের দেশেও। এর কিছু উল্লেখ শুরুতে‌ই করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের কনফেডারেশন এবং সারা ভারত রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের আহ্বানে গত ৮ ডিসেম্বর ২০২২ দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত যৌথ জাতীয় কনভেনশন থেকে যে বর্ষব্যাপী আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে, তার দাবিসনদের প্রথম দাবি‌ই হল, এনপিএস বাতিল করো - ওপিএস ফিরিয়ে আনো।

সিআইটিইউ, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং শিল্পগত ইউনিয়ন‌গুলির আহ্বানে গত ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক কনভেনশন থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী নীতিসমূহ বদলের দাবিতে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচার অভিযানের শীর্ষে সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এখানেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি‌, এনপিএস বাতিল করো - ওপিএস ফিরিয়ে আনো।

২০১৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায় অনুষ্ঠিত এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের দ্বিতীয় কংগ্রেস থেকে অবসরপ্রাপ্তদের জন্য এক মর্যাদাপূর্ণ জীবন সুনিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে প্রতি বছর ১ অক্টোবর 'আন্তর্জাতিক পেনশনার দিবস' পালনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। ভারতের ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেশন কমিটি অব পেনশনারস এসোসিয়েশন‌স, অল ইন্ডিয়া বিএস‌এন‌এল অ্যান্ড ডিওটি পেনশনারস এসোসিয়েশন এবং অল ইন্ডিয়া পোস্টাল অ্যান্ড আর‌এম‌এস পেনশনারস এসোসিয়েশন এই আন্তর্জাতিকের অন্তর্ভুক্ত। এই সংগঠনগুলি এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি পেনশনারদের দুটি কোঅর্ডিনেশন কমিটি এবং পেনশনার সংগঠনগুলি‌র যুক্ত মঞ্চও এই লড়াইয়ে শামিল।

'এনপিএস বাতিল করো - ওপিএস ফিরিয়ে আনো' দাবির লড়াই আজ এক নির্ণায়ক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে বলে মনে করা যেতে পারে। তবে এই লড়াই কেবলমাত্র বিধিবদ্ধ পেনশনপ্রাপকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না - সমস্ত অংশের প্রবীণ নাগরিকদের জন্য এক মর্যাদা‌পূর্ণ জীবন সুনিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েই তাকে অগ্রসর হতে হবে। আর পেনশন নিয়ে যাবতীয় উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার উৎস নয়া উদারবাদী অর্থনীতিকে পরিবর্তনের লক্ষে পরিচালিত ঐক্যবদ্ধ যৌথ সংগ্রামে পেনশনারদের সর্বশক্তি নিয়ে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে‌ই রক্ষা করতে হবে পূর্বসূরিদের কষ্টার্জিত পেনশনের অধিকার।