আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৩ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

মানুষ ফেক নিউজ বিশ্বাস করে কেন

অশোক সরকার


ফেক নিউজ বা ভুয়ো খবরে মানুষ বিশ্বাস করে কেন? যে সময়ে দুনিয়ার সব খবর হাতের মুঠোয় এসে গেছে, দুনিয়ার সব তথ্যের সত্যি-মিথ্যা সহজে যাচাই করে নেওয়া যায়, সেই সময়ে জাতি, ধর্ম, শ্রেণী, ভাষা, অঞ্চল, শিক্ষা নির্বিশেষে মানুষ ভুয়ো খবরে বিশ্বাস করছে কেন? সবাই একই ভুয়ো খবরে বিশ্বাস করছে না, কিন্তু সবাই কোনো না কোনো ভুয়ো খবরে আস্থা রাখছে। ভুয়ো খবরের জাত বিচার করছি না। কিছু ভুয়ো খবর আছে যা স্পষ্টতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত; যেমন, পুলিশের বিবৃতিতে দিল্লির সাব-ইন্সপেক্টরের ঘাতকের নাম অনীশ রাজ, কিন্তু অনেকগুলি টেলিভিশন চ্যানেল তাকে মহম্মদ অনীশ বলে প্রায় ৮ ঘণ্টা ধরে প্রচার করে গেল। কিছু ভুয়ো খবরের পিছনে রাজনীতিটা গভীর, যেমন, গুজরাতে শিশুদের কমিক নভেল আছে যেখানে নরেন্দ্র একলা কুমির ধরছে, বা রাজস্থানের ইতিহাসের বইতে আছে মহারাণা প্রতাপ আকবরকে হলদিঘাটির যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলেন। বহু ভুয়ো খবর নিছক মজার উদ্দেশ্যে চলে, যেমন, মহাত্মা গান্ধি গুজরাতে সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন ইত্যাদি।

ভুয়ো খবরে বিশ্বাস এতটাই সারা বিশ্বে সর্বজনীন হয়ে উঠেছে যে তাকে অসাম্য, বেকারত্ব, রোজগার কমে যাওয়া, আর্থিক অনিশ্চয়তা, বা জাতি, শ্রেণী, লিঙ্গ ইত্যাদি অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বের চেনা উপাদানগুলি দিয়ে বোঝা কঠিন। এই উপাদানগুলি আমাদের শেখায় যে মানুষের সামাজিক অবস্থাগত দৃষ্টিতে সমাজকে দেখলে আলাদা লাগে; দলিত আর এলিটের বোঝার দৃষ্টি এক হয় না, গরিব মেয়েদের আর গরিব পুরুষদের বোঝার দৃষ্টিও আলাদা। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বের মূল ঊপাদানগুলি পার্থিব অবস্থা থেকে তৈরি হয়, পার্থিব অবস্থা পালটালে, বোঝার দৃষ্টিও পালটায়। আর্থিক অসাম্য, মানুষের সম্পদ বা রোজগারের তফাত থেকে বোঝা যায়, বেকারত্বের জ্বালা অভিজ্ঞতাতেই উপলব্ধি করা যায়, মানুষের মনে অনিশ্চয়তার পরিণাম কি হয়, তা ভুক্তভোগীই বলতে পারে। সামাজিক অসাম্যও কোন মন্দিরে কে যেতে পারবে না, কে কোন কুয়ো থেকে জল নিতে পারবে না, কে কাকে বিয়ে করতে পারবে না, তা দিয়ে বোঝা যায়, অথবা জনজাতি ছাত্রকে যখন মাস্টারমশাই লাস্ট বেঞ্চে বসতে বলেন, বা স্কুলে দলিত মহিলার রান্না করা মীড ডে মিল যখন উঁচু জাতের ছেলেমেয়েদের খেতে বারণ করা হয়, তখন বোঝা যায়। এমনকি ভাষাগত অসাম্য, সাঁওতাল ছেলেকে যখন বাংলায় পড়াশোনা করতে হয়, বা আপামর বাংলাভাষী মানুষ যখন দেখে সরকারি কাজকর্ম উর্দু ভাষায় হতে যাচ্ছে তখন বোঝা যায়।

এই প্রতিটি উদাহরণ পার্থিব অবস্থা থেকে উৎপন্ন। কিন্তু যখন সেই বাংলাভাষী গরিব দলিত মহিলা-পুরুষের একাংশ বিশ্বাস করে যে গণেশদেবের মুখে হাতীর শুঁড়টা প্লাস্টিক সার্জারির উদাহরণ, অথবা বাগেশ্বরবাবা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, তখন প্রশ্ন জাগে, মানুষ কোনটা কীভাবে বিশ্বাস করে, তার মধ্যে কি এমন কোন প্রক্রিয়া আছে যা অসাম্য, শ্রেণী, জাতি, লিঙ্গ ইত্যাদি আর্থসামাজিক ব্যাখ্যার বাইরে? আজকের সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি যত বই, লেখা বা বক্তৃতা জনপ্রিয় হয়েছে, সেগুলি বেশিরভাগই অর্থনীতি বা সমাজতত্ত্বের আয়নায় লেখা, অল্প কিছু রাজনীতি বিজ্ঞানের আয়নায়। মানুষের বিশ্বাসের জগতে কি ঘটছে, তাই নিয়ে তেমন কিছু চোখে পড়েনি। তাই আমি এই বিষয়ে একেবারেই নভিস হলেও চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?

মানুষের বিশ্বাসের জগতে ঢুকতে গেলে হাতে থাকে মনস্তত্ত্ব। দেখা যাক এই বিষয়ে মনস্তত্ত্ব কি বলে। একটা মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার কথা শোনাই।

এক গবেষক বিভিন্ন শ্রেণী, জাতি, ভাষা ইত্যাদির মধ্যে থেকে ১০০ জন পুরুষ ও মহিলা বেছে নিলেন, শুধু একটাই শর্ত, তাঁরা টুথপেস্ট ব্যবহার করেন। তাঁদের বলা হল একটা মাসকাবারি কেনাকাটার ফর্দ বানাতে, শুধু একটা অনুরোধ, ফর্দয় যেন একটা টুথপেস্ট থাকে। দেখা গেল ১০০ জনের ৮০ জন টুথপেস্ট কথাটা লেখেননি, তারা নানা টুথপেস্টের ব্রান্ডের নাম লিখেছেন। ৯ জন একটা টুথপেস্টের নাম লিখেছেন যেটা তারা বললেন আয়ুর্বেদিক। গবেষক কিছু প্রশ্নোত্তর করে দেখলেন, ওটা যে সত্যিই আয়ুর্বেদিক এমন কোনো যুক্তি, তথ্যপ্রমাণ তাঁদের জানা নেই, তাঁরা জানা বোঝার কথা ভাবেনওনি, শুধু বিশ্বাস থেকে ওই নাম লিখেছেন। অন্য নামগুলির বেলায়ও একই ঘটনা। কোনো টুথপেস্টের নামই যুক্তি বিচার করে লেখা হয়নি।

তাহলে জাতি ধর্ম, শ্রেণী নির্বিশেষে এই মানুষগুলি কিসের থেকে টুথপেস্টের নাম লিখলেন? মনস্তাত্ত্বিকেরা তাকে বলেন স্বজ্ঞা (intuition), এবং যুক্তিগুলো (reasoning) সবই সেই স্বজ্ঞাকে সমর্থন করার জন্য। মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, ভাল-মন্দ, ঠিক-ভুল, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় বোধ কীভাবে তৈরি হয় তা নিয়ে বহু গবেষণা করেছেন নৈতিক মনস্তাত্ত্বিকেরা (moral psychologists), তাতে এই সহজ প্রতিপাদ্যটাই প্রমাণ হয়, স্বজ্ঞা আগে, যুক্তি-প্রমাণ পরে। শিশুরা এখানে কিছুটা ব্যতিক্রম। শুধু ভালো-মন্দের বেলায় নয়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক হাওয়ারড মারগলিস বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন, মানুষের রাজনৈতিক মতামত কেন বহু ক্ষেত্রেই যুক্তি-তথ্যপ্রমাণের ধার ধারে না। দেখা গেল, মানুষের মনে দুটো প্রক্রিয়া কাজ করে, এক, ‘এইটা দেখছি’ অন্যটা ‘তার কার্যকারণ কি’। মানুষের মস্তিষ্ক তার ভাবনার সঙ্গে দেখাকে মেলানোর চেষ্টা করে যাকে ইংরেজিতে বলে pattern matching এবং সে নিজেকে বলে আমি এইটা দেখছি, আর সেই অনুযায়ী যুক্তি সাজানোর চেষ্টা করে। অন্য অনেকগুলি গবেষণা থেকে জানা গেছে, মানুষের সামাজিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বজ্ঞা জনিত, যুক্তি-তথ্য আসে সেই স্বজ্ঞাকে সমর্থন করার জন্য।

মনস্তাত্ত্বিকেরা একসময় মনে করতেন স্বজ্ঞা-র মধ্যে কোনো জ্ঞান প্রক্রিয়া (cognitive process) নেই, সেটা শুধুই একটা অনুভূতি (হরমোনের নিঃসরণ)। জ্ঞান প্রক্রিয়া বলতে বোঝায় তথ্য আহরণ করে তা প্রসেস করে কোন যুক্তি বা সিদ্ধান্তে বা বোধে পৌঁছনোর ক্ষমতা। ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে যে স্বজ্ঞাও একটা জ্ঞান প্রক্রিয়া। গ্রামের চায়ের দোকানের আড্ডায় একজন বলল, “জানিস তো তপনের বিধবা কুসুম, এই তো গত বছর বিধবা হল, এই দু'দিন হল আবার বিয়ে করেছে”। শুনেই পাশে একজন বলল “ছি”, আরেকজন বলল “ভালই করেছে, একলা যুবতী মেয়ের বিপদ অনেক”। এরা দুজন যে যুক্তি সাজিয়ে সব কিছু ভেবে ওই উত্তর দিয়েছে তা নয়, দুজনের স্বজ্ঞার পিছনে যে ভাল-মন্দ উচিত-অনুচিত বোধ কাজ করেছে তা আলাদা, এবং তা একটা জ্ঞান প্রক্রিয়াতেই তৈরি।

এইখানে বলে নেওয়া দরকার যে আমি এখানে কোন নৈতিকতা মানা যায়, কোনটা নয়, কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত তা নিয়ে আলোচনা করছি না। যে ‘ছি’ বলল, আর যে ‘ভালোই করেছে’ বলল, এর মধ্যে কে নৈতিকভাবে সঠিক, কে নয়, তা নিয়ে মন্তব্য করছি না। আমি কি ঘটে থাকে তা বোঝার চেষ্টা করছি।

তাহলে প্রশ্ন ওঠে এই নৈতিকতা বা ভাল-মন্দের বোধ তৈরি হচ্ছে কি করে? এই প্রসঙ্গে রিচারড শ্বেডার-এর গবেষণা প্রায় পথিকৃৎ পর্যায়ের, তিনি এবং একজন ওড়িয়া সহগবেষক আমেরিকানদের আর ওড়িশার অধিবাসীদের একই নৈতিক প্রশ্ন করেছিলেন, এবং তিন ধরনের উত্তর পেয়েছিলেন - কিছু প্রশ্নে আমেরিকান ও ওড়িয়ারা একমত (এটা উচিত, ওটা অনুচিত - এই রকম) এবং একই কারণে একমত, কিছু বিষয়ে তাঁরা একমত কিন্তু তাদের কারণ আলাদা, কিছু বিষয়ে তাঁরা একমত নন। শেষটার একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। এক পরিবারে ২৫ বছরের ছেলে বা মেয়ে বাবাকে নাম ধরে ডাকে, এক বিধবা প্রাতঃকৃত্য করে কাপড় না বদলে রান্না করেছে - এই দুই উদাহরণে আমেরিকান আর ওড়িয়াদের মধ্যে নৈতিকতার স্পষ্ট তফাত দেখা যায়; দুটো ক্ষেত্রেই আমেরিকানরা মনে করে ঠিক আছে, ওড়িয়ারা মনে করে এটা অনুচিত। তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অন্য অনেকে বিভিন্ন দেশে এই পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।

শ্বেডার তাঁর গবেষণার ভিত্তিতে তিন ধরনের নৈতিকতার কথা বলেছেন - স্বাধীন সত্ত্বার নৈতিকতা (Ethic of Autonomy), সামুদায়িক নৈতিকতা (Ethic of Community) এবং দেবত্বের নৈতিকতা (Ethic of Divinity)। এই তিনটে বিষয় একটু বুঝিয়ে বলা দরকার।

স্বাধীন সত্ত্বার নৈতিকতার আধার দুই মহারথীর কাজের ভিত্তিতে, একজন জন স্টুয়ারট মিল আরেকজন ইমানুয়েল কান্ট। মিল বললেন, এমন সব কাজই নৈতিক ও করা উচিত যাতে নিজের অথবা দশের কল্যান-সুখ তথা তৃপ্তি বাড়ে, তবে অন্যের ক্ষতি করে নয়। যদি ক্ষতির সম্ভাবনা এড়ানো না যায় তাহলে সবচেয়ে কম লোকের ক্ষতি এবং তুলনায় অনেক বেশি লোকের তৃপ্তি বা কল্যাণ হবে, এমন কাজ নৈতিক। মিলের ভাবনা অনুযায়ী একজন অন্যের ক্ষতি না করে যদি নিজের সর্বোচ্চ সুখ বা তৃপ্তির পিছনে দৌড়য় তা নৈতিক। সরকার যখন জমি অধিগ্রহণ করে তখন নৈতিক যুক্তিটা এই যে তাতে কিছু লোকের ক্ষতি হবে, কিন্তু বহু মানুষের কল্যাণ হবে। একজন মানুষ অন্তহীন টাকা করলে ক্ষতি কিছু নেই, যতক্ষণ সেই টাকা অন্যের ক্ষতি না করে করা হচ্ছে। সেই জন্যই সব দেশেই গরিবীরেখা আছে, কিন্তু ধনরেখা নেই, কারণ অপরিমিত ধন অনৈতিক নয়।

স্বাধীন স্বত্বার নৈতিকতার আরেকটি আধার এসেছে, কান্টের কথায়, কিছুটা মিলের বিপরীতধর্মী বলা যেতে পারে। কান্ট বললেন, কোনো কাজ তখনই নৈতিক যখন তার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটি নৈতিক। নৈতিকতা কোনো কাজের মধ্যে অন্তর্নিহিত, কাজের ফলাফলে নয়। যদি অন্তর থেকে আপনি ভিখারীকে পয়সা দেন, তা নৈতিক, কিন্তু সেই ভিখারী ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়ানো আপনার গাড়ির কাঁচ ধরে আপনাকে বিরক্ত করছে, তার থেকে বাঁচতে তাকে আপনি পয়সা দিলেন, সেটা অনৈতিক, কিন্তু দুটোতেই ভিখারী-র একটু কল্যাণ হল বৈকি। কান্টের নৈতিকতার আরেকটি দিক হল fairness বা সবাইকে সমান চোখে দেখা, মানবজাতির মধ্যে প্রয়োজন মতো কেউ লক্ষ্য, কেউ তার উপায় তা হতে পারে না। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে লক্ষ-লক্ষ মানুষের কল্যাণ তার লক্ষ্য, কিছু মানুষের ক্ষতি তার উপায়, কান্টের মতে এটা অনৈতিক। দুর্গাপুজোয় বৃহত্তর জন-তৃপ্তির উদ্দেশ্যে তারস্বরে মাইকে গান বাজবে, তার জন্য প্যান্ডেলের চারপাশের কিছু বাড়ির মানুষের ঘুমের ক্ষতি মেনে নিতে হবে, এটাও অনৈতিক। নৈতিকতার এই ভিত্তি থেকে জন্ম নেয় অধিকারের ধারণা।

মিল এবং কান্টের নৈতিকতা সর্বজনীন, দেশ-কালের নিরিখে কল্যাণ-সুখ-তৃপ্তি আর অধিকারের বৃদ্ধি-র কোনো সীমারেখা নেই। যত বাড়বে তত ভালো। শুধু সর্বজনীন তাই নয়, কান্ট-মিলের নৈতিকতা উচিত অনুচিত অর্থে তৈরি নৈতিকতা, যা কিনা সব সমাজেই গ্রহণযোগ্য হতে হবে, অন্য কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁদের নৈতিকতা কোনো সমাজের নৈতিকতার ক্যানভাসটি কী তা বোঝার অঙ্গ নয়, তাঁদের নৈতিকতা এক আদর্শের (Normative) আধার তৈরি করার লক্ষ্যে। সর্বোপরি তাঁদের নৈতিকতার ভিত্তি যুক্তি। মানুষ যুক্তি বিচার করে, নিজের এবং অন্যের কল্যাণ বা অধিকার বিচার করে, নিক্তিতে মেপে পাল্লা যেদিকে ভারী সেই রকম কাজ করবে! রাষ্ট্রও তাই করবে। মানুষ এক যুক্তি-তথ্য-সাক্ষ্য-প্রমাণবাদী জীব, অন্তত সেটাই আমাদের লক্ষ্য।

সামুদায়িক নৈতিকতা ব্যক্তিকে সামুদায়িক কাঠামোর মধ্যে দেখে। সেখানে ব্যক্তি কোনো পরিবারের, সমুদায়ের, জাতি, জনজাতি, দল বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য। ব্যক্তির স্বাধীন স্বতন্ত্র কল্যাণ-সুখ-তৃপ্তি আর অধিকার এই কাঠামোয় সীমিত, সামুদায়িকতার পরিধির মধ্যে। এই নৈতিকতার স্তম্ভগুলি হল মানসম্মান (reputation বা pride), শ্রদ্ধা (respect), অনুক্রম (hierarchy), কর্তব্য (duty), দেশপ্রেম (patriotism) - ব্যক্তি ও সামুদায়িক দুই পক্ষেই। আমার সিগারেট খাবার অধিকার আছে, কিন্তু বড়োদের সামনে নয় (respect)। প্রণাম আগে দাদুকে তারপর বাবাকে তারপর মাকে করতে হয় (hierarchy), পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করতে হয় (কর্তব্য)। মাড়োয়ারি পরিবারে দেখেছি, বয়োজ্যেষ্ঠরা বসে থাকলে অল্পবয়সিরা মাথা নিচু করে যায় (respect, hierarchy)। গ্রামদেবতার জন্মতিথির অনুষ্ঠানে গ্রামের প্রত্যেকের উপস্থিতি আবশ্যিক (সমুদায়ের সম্মান ও সামুদায়িক কর্তব্য), হাউজিং সমবায়ের বাসিন্দা কয়েকটি ছেলেমেয়ে সন্ধ্যে হলেই একজোট হয়ে গাঞ্জা খায় (সমবায়ের অসম্মান)। এই ধরণের অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়, যার ভিত্তিতে নৈতিকতার ওই স্তম্ভগুলি তৈরি হয়েছে।

সামুদায়িক নৈতিকতার এই স্তম্ভগুলি কোনো সর্বজনীন, যুক্তি সাক্ষ্য নির্ভর, দেশকালমুক্ত আদর্শ নয়, এগুলি বাস্তবে দেখতে পাওয়া বিভিন্ন সমুদায়ের নৈতিকতার নিজস্ব ধারণা থেকে নেওয়া। তাই এর কম বেশি আছে, অভ্যাসের বৈচিত্র্য আছে। দেবত্বের নৈতিকতার ক্ষেত্রেও তাই।

দেবত্বের নৈতিকতা তৈরি হয় এই বিশ্বাস থেকে যে মানুষ শুধুমাত্র কিছু অণু-পরমানু, কেমিক্যাল, হরমোন আর কিছু চেতনার সমষ্টি নয়, সেটা তো অন্য কিছু প্রাণীরও আছে। মানুষের মধ্যে ঈশ্বর প্রেরিত এক আত্মা বিরাজ করে। মানুষের শরীর একটা মন্দির-মসজিদ বিশেষ এবং ওই আত্মার মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের একটা অন্তর্নিহিত যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তাই অন্য কারুর ক্ষতি না করলেও মানুষের এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে মানুষের শরীর দুষিত হয়, পতিত হয়। তাতে আত্মা কলুষিত হয়, ঈশ্বরের অবমাননা হয়, বিশ্বসংসারের অশুভ হয়। এই ভাবনা থেকে জন্ম নেয় পবিত্রতা (sanctity), শুদ্ধতা (purity), সহন (suffering), ঊর্ধ্বগমন (Elevation), অধঃপতন (Degradation) জাতীয় নৈতিকতার ধারণা। সেই জন্যেই বাড়িতে যে ঘরে ঈশ্বরের মূর্তি বা ছবি থাকে সেখানে শুদ্ধ কাপড়ে, জুতো খুলে ঢুকতে হয়। কোরান ছুঁতে গেলেও শুদ্ধ হতে হয়, যাকে উর্দুতে ঊজু (ablution) বলে, জৈন ধর্মে প্রাণী হত্যা করলে পাপ হয়, মানুষের শরীর কলুষিত হয়। উপবাস ও অনশনও (suffering) শরীরকে শুদ্ধ করে। ‘Cleanliness is equal to Godliness’ শুধু হিন্দু সমাজের নৈতিকতা নয়, অন্য বেশ কিছু সমাজে তা দেখা যায়। অনেক সমাজে একটা ঊলম্ব সামাজিক রেখা তৈরি করা হয় - সবচেয়ে উপরে আছেন ঈশ্বর, তাঁর নিচে দেবদূত (ফরিস্তা), তাঁর নিচে সাধারণ মানুষ, তারপর অন্য প্রাণী, তার নিচে রাক্ষস-দানব হয়ে সবচেয়ে নিচে শয়তান। এই ঊলম্ব সামাজিক রেখাটি একটি নৈতিক রেখাও বটে। মানুষ, তার কর্ম অনুযায়ী এই উলম্ব নৈতিক রেখায় উপর নিচে ওঠানামা করে।

ভারতীয় সমাজে যে ওই তিন ধরণের নৈতিকতার অভ্যাস প্রতিনিয়ত দেখতে পাওয়া যায়, তাতে সন্দেহের কোন কারণ নেই। আমার জমির উপর আমারই অধিকার যে একমাত্র আমারই, এই চেতনা সবাই আছে, আমি চাইলে সরকার ১০০ দিনের কাজ দিতে বাধ্য, এই চেতনারও কোন কমতি নেই; পাশাপাশি বেশিরভাগ যুবা ভারতীয়ই পরিচিত গুরুজনদের সামনে সিগারেট খাবে না, এটাও নৈতিক অভ্যাসেরই অন্তর্গত। সাম্প্রতিক জৈনদের আন্দোলনে দেখা গেল, পবিত্রতাকে তাঁরা কতটা মূল্য দেন। এটা পরিষ্কার যে বেশিরভাগ ভারতীয় বাস্তবে বহুনৈতিক। সে কিছুটা স্বতন্ত্র, কিছুটা সামুদায়িক, কিছুটা দেবত্বের পূজারি।

বুঝতে অসুবিধা নেই, সামুদায়িক ও দেবত্বের নৈতিকতার বয়স, ব্যক্তিস্বত্ত্বার নৈতিকতা (কান্ট-মিল)-র তুলনায় কয়েকশ বছর বেশি। এই দুইয়ের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা (social legitimacy), ব্যপ্তি এবং ব্যাবহারিক জগত সমাজের পরতে পরতে জড়িয়ে। তুলনায় ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের নৈতিকতা আমাদের দেশে এসেছে সাহেবদের এবং ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতবাসীর হাত ধরে, স্বাধীনতা সংগ্রাম, সংবিধান, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তিতে। এই নৈতিকতাকে যদি সমাজ মানসের গভীরে স্থান নিতে হয়, তাহলে অনেক চেষ্টা লাগবে, অনেক লড়াই, পরিশ্রম লাগবে, সময়ও লাগবে। ভারতের এলিট যদি এই নৈতিকতার ভানগার্ড হয়, তাহলে তাদেরই সে কাজটা করতে হবে।

সংবিধান দেশকে একটি সুস্পষ্ট পথ দেখিয়েছিল। এক, কান্ট-মিলের নৈতিকতার ভিত্তিতে জাতি, শ্রেনী, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমতাকামী, অধিকার-মনস্ক নাগরিক অধ্যুষিত গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার পথ। দুই, এরই মধ্যে বিশেষ সমুদায়গুলির নিজস্ব সামুদায়িক ও দেবত্বের নৈতিকতাকে স্বীকৃতি দিয়ে, ষষ্ঠ ও পঞ্চম তপশীল এলাকার অন্তর্গত মানুষদের স্বতন্ত্রতাকে সম্মানজনক স্বীকৃতি দেবার পথ, এমনকি নানা ধর্মাবলম্বী মানুষের নিজস্ব ধর্মাশ্রিত নৈতিক আচরণের স্বাধীনতার পথ। সংবিধানের মধ্যে ভারতীয় বহুনৈতিকতার যে স্বীকৃতি দেখা যায়, তা পৃথিবীতে বিরল। সাংবিধানিক মূল্যবোধের প্রসার যদি সফল হত তাহলে আশা করা যেত একদিকে মানুষ নিজের অধিকার ও সর্বজনীন কল্যাণের বোধে জাগ্রত হয়েছে, অন্যদিকে বহু নৈতিকতার বোধ তৈরি হয়েছে। ফলে সামুদায়িকতা ও ঈশ্বর কামনার পাশাপশি অধিকার, সমতা, স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা, গনতান্ত্রিকতা, ভিন্নমত, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি আধুনিক নৈতিকতার আধারগুলি সমাজের গভীরে জায়গা নিতে পারত। সামুদায়িকতা, ঈশ্বর কামনা তাতে কমে কি কমে না, কমা উচিত কি উচিত নয়, তার চেয়ে বড়ো কথা, সমাজ সংস্কৃতি, রাজনীতির-র ব্যাপক পরিসরে এই তিন নৈতিকতার নির্দিষ্ট আসন তৈরি হয়, ঈশ্বরকামী মানুষ তার অধিকার ও অন্যের অধিকারের জগতটিকে চিনতে পারে, অধিকারকামী মানুষ বুঝতে পারে, বহুনৈতিক ঈশ্বরকামি সামুদায়িক মানুষও ভারতে সমান মর্যাদার অধিকারী।

কিন্তু ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র জোরদার হল ঠিকই, কিন্তু সামাজিক অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র জোরদার হল না। যত সময় গেল অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বেকারত্ব বাড়ল রোজগার বাড়ল না, দুর্নীতি আরও ব্যাপক ও গভীর হল, ন্যায়বিচার আরও দুর্গম হল, গণ-আন্দোলনের বা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের স্রোত গেল শুকিয়ে, শিক্ষা ব্যবস্থা সব দিক থেকে কলুষিত হল। তার সঙ্গে জাতি প্রথা, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা ও সামাজিক ও আর্থিক অসাম্যের ফলে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কেন্দ্রিক, ব্যক্তি-কল্যাণ কেন্দ্রিক, অধিকার কেন্দ্রিক নৈতিকতার সামাজিক পৃষ্ঠভূমিটাই দুর্বল হয়ে গেছে।

অধিকার, সমতা, স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা, গনতান্ত্রিকতা, ভিন্নমত, ন্যায়পরায়ণতা - আধুনিক নৈতিকতার আধার। এইগুলির সামাজিক পৃষ্ঠভূমি দুর্বল ফিকে হয়ে গেলে যা হয় তাই ঘটছে। আমরা সেই আলোচনাতেই ফেরত আসি।

লিবারাল এবং বামপন্থী আলোচনায় ব্যক্তির স্বাধীন স্বত্ত্বা কেন্দ্রিক নৈতিকতার যতটা প্রভাব দেখা যায়, তুলনায় নৈতিকতার এই বৈচিত্র্যের কোন স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। মানতে দ্বিধা নেই যে নৈতিকতার কোন কাঠামোই ধোয়া তুলসীপাতা নয়। পরিবেশ আন্দোলন পশ্চিমী কল্যাণ ও অধিকারকামী নৈতিকতার বিপদটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, কীভাবে তা মানুষকে নির্লজ্জভাবে ভোগবাদী বানিয়েছে, ব্যক্তির কল্যাণ ও অধিকারের প্রসারের নামে পরিবেশের সমূহ ক্ষতি করেছে। অন্যদিকে সামুদায়িক নৈতিকতা মেয়েদের কতটা নিচে নামিয়েছে, মানুষের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা, সৃষ্টিশীলতা ও আনন্দকে কতটা দাবিয়ে রেখেছে তাও আমরা জানি, honour killing-এর কথাও জানি। আর দেবত্বের নৈতিকতা থেকে জাতি ব্যবস্থায় যে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায় তাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু এই বিপদগুলিকে মনে রাখলেও নৈতিকতার বৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তা বা তার গুরুত্বকে স্বীকার করা আমাদের আকাডেমিক, রাজনৈতিক বা গণ-আলোচনার অভ্যাসের মধ্যে ছিল না। আমরা লিবারাল ও বামপন্থীরা সামুদায়িক বা দেবত্বের নৈতিকতার আধারগুলিকে সাম্য, স্বাধীনতা, মানবাধিকার বিরোধী, পিছিয়ে পড়া এবং বিজ্ঞান বিরোধী বলে এক কথায় উড়িয়ে দিয়েছি। একই মানুষের মধ্যে যে এই তিন ধরনের নৈতিকতাই কিছুটা কিছুটা পরিমাণে থাকতে পারে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে কোন একটা প্রকাশ পেতে পারে সেটাও বুঝিনি। আমরা ভেবেছি যে সেকুলার সে শুধুই ও পুরোমাত্রায় সেকুলার, যে জনজাতি সমাজের সদস্য সে শুধুই জনজাতি, আর যে ধার্মিক সে শুধুই ধার্মিক (আচারসর্বস্ব)।

এই প্রসঙ্গে রাজনৈতিক আক্টিভিস্ট যোগেন্দ্র যাদবের কথা মনে পড়ছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরের দিন তিনি সাধারণ সব্জিওয়ালা, দুধওয়ালীদের মন বোঝার চেষ্টা করছিলেন, তাঁকে শুনতে হয়েছিল “প্রফেসর সাব, রামজি-র মন্দির অযোধ্যায় হবে নয়তো কি লন্ডনে হবে?” একদিন বাদে তিনি কোনো একটি টিভি প্রোগ্রামে শুনেছিলেন একজন অংশগ্রহণকারীর কথা, “শ্রীরাম তো পুরুষোত্তম, এই ঘটনায় তাঁর অসম্মান হয়েছে,” সেই কথাটা নিয়ে একই সব্জিওয়ালা, দুধওয়ালাদের কাছে ফেরত গেলে তাঁরা ভাবতে শুরু করেন, কেউ কেউ চিন্তিত হয়ে পড়েন। নৈতিকতার আধারটি এই যে ভগবান রামচন্দ্র ওই ধ্বংসের লীলা দেখে কষ্ট পেতেন কারণ করসেবকেরা মনুষ্যেতর কাজ করেছে, তারা মানুষের ও ঈশ্বরের অপমান করেছে।

এটা যদি লিবারাল ও বামপন্থীদের সমস্যা হয়ে থাকে, অন্যদিকে দেখি ফেক নিউজের সাপ্লাই ও চাহনেওয়ালারা কী করছে। রাজনৈতিক ফেক নিউজ চেনা খুব একটা কঠিন নয়। মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে বেশি হয়ে যাবে, তাজ মহল হিন্দু মন্দির, পানিপথের যুদ্ধে বাবর হেরেছিল, মহারানা প্রতাপ আকবরকে হারিয়েছিলেন, দিলির সাব ইন্সপেক্টরকে ছুরি মেরেছিল অনীশ রাজ নয়, মহম্মদ অনীশ - ইত্যাদি প্রচারগুলি স্পষ্টতই রাজনৈতিক। এই প্রয়াসের মধ্যে দুটি স্তর আছে। একটা স্তরে আছে মূল মেসেজ - মুসলমানেরা খারাপ লোক, তাদের থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। এই মেসেজটাই হিন্দুদের মনে গেঁথে দেওয়াটা আসল উদ্দেশ্য, কিন্তু মূল মেসেজটাই হাজারবার আউড়ে গেলে তার ধার নষ্ট হয়ে যায়, তাই তৈরি হয় দ্বিতীয় স্তর - মেসেজটাকে নানা রঙে, রূপে, নানা অপ্রত্যক্ষ উপাদানে মানুষের মনে পৌঁছে দিতে হয়। ভাষাতত্ত্ববিদদের একাধিক গবেষণা দেখায় নানা রঙে, রূপে নানা অপ্রত্যক্ষভাবে বললেও মূল মেসেজটা মানুষ বুঝে নিতে পারে। এই ধরণের গবেষণা প্রথম করেছিলেন জেলিগ হ্যারিস ও তারপরে চমস্কি ও তাঁর অনুগামীরা। একটা উদাহরণ দিই।

এখানে নভেম্বরেই পাতা ঝরতে শুরু করে’,‘ এখানে নভেম্বরেই রাতে মাঝে মাঝে হিটার জ্বালাতে হয়’,‘ আমাদের এখানে দিওয়ালীর পরেই গরম জামা বের করতে হয়’,‘ এখানে দিওয়ালীর পরেই বাড়িতে চটি পরতে হয়’, এই কথাগুলিতে কোথাও শীত বা ঠাণ্ডা কথাটা নেই, কিন্তু মানুষ বুঝে যায় কি বলা হচ্ছে। উপরের স্তরে থাকে যেটা বলা হচ্ছে, আর স্বজ্ঞার স্তরে থাকে বা তৈরি হয় মূল মেসেজটা। সব প্রোপাগান্ডারই মূল কৌশল এটি, প্রচারের নানা কৌশলে মূল মেসেজটি মানুষের স্বজ্ঞার স্তরে গেঁথে দেওয়া।

কিন্তু শুধু এইটুকু বললে একটু কম বলা হবে। সাপ্লাইওয়ালাদের ছেড়ে যদি চাহনেওয়ালাদের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, সেখানেও একাধিক স্তর আছে। একটা স্তরে আছেন যারা আগে থেকেই ব্যক্তিগত, সামাজিক, ঐতিহাসিক কারণে মুসলমানদের সম্বন্ধে সন্দিহান। তাঁদের স্বজ্ঞার মধ্যেই অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের সম্পর্কে নিচু ধারণা তৈরি হয়ে আছে। দেশভাগ, ব্যবসার প্রতিযোগিতা, সাম্প্রদায়িক হিংসার বলি - কারণ অনেক হতে পারে। কিন্তু স্বজ্ঞা তৈরি হতে পার্থিব কারণ লাগে না। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী অনেক মানুষ আছেন যাদের দু'জন্ম আগে কেউ উদ্বাস্তু হয়েছিলেন তাতেই তাঁদের মধ্যে মুসলমানদের নিয়ে অস্বস্তি দেখেছি। তাঁদের স্বজ্ঞার মধ্যে ওই ধারণা আছে যে মুসলমানরা খারাপ লোক, তারা সুবিধার নয়। বহু খবর, ফেক বা সত্যি যাই হোক না কেন, সেই স্বজ্ঞাকে ট্রিগার করে। তবে সব মিলিয়ে সেই মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

আরও একটা বিষয় জুড়তে হবে। সমুদায় তৈরি-র অনেক ভিত আছে - জাতি, ভাষা, গ্রাম, দেশ ইত্যাদির সঙ্গে ধর্মও তার মধ্যে পড়ে। হিন্দু ধর্মের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যগুলি এমনই যে হিন্দু নামক মানুষগুলিকে একটা ধর্ম সম্প্রদায়ের পরিচিতি দেওয়া কঠিন, তবে কিছুটা পরিমাণে সম্ভব, যদি ব্রাহ্মন্যতন্ত্রের কিছু উপাদানকে সামাজিক পরিসরে আরও বেশি করে জায়গা দেওয়া যায়; এমন উপাদান যেগুলির সর্বজনীন আকর্ষণ আছে - সূর্য প্রণাম, যোগাসন, সন্ধ্যা আরতি, মথুরা, কাশি, অযোধ্যা, সোমনাথ, চারধাম, যজ্ঞ, সন্ধ্যা প্রদীপ ইত্যাদি আইকনগুলি সেই সামুদায়িকতা তৈরি করতে খুব কাজে লেগেছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে নৈতিকতার যোগ নিবিড়। সামুদায়িক নৈতিকতার মধ্যে মান বা গর্ব, শ্রদ্ধা এবং কর্তব্য - তিনটেই আসে। এমন কিছু যা কোনো সমুদায়ের মান বাড়ায় (অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরি হচ্ছে, উত্তরাখণ্ডের চারধাম যুক্ত করার জন্য রাস্তা তৈরি হচ্ছে) সেই খবর ওই সামুদায়িক নৈতিকতাকে ট্রিগার করে। তা সামুদায়িক মান বাড়ায়, ব্যক্তির কর্তব্যের মধ্যে সামুদায়িক শ্রদ্ধা বাড়ায়, সামুদায়িক মানরক্ষা ব্যক্তি ও সমষ্টির কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সত্য অসত্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমনিতেই পুরাণ আমাদের দেশে ইতিহাসের সত্যের মধ্যে মিশে যায়, পশ্চিমী অর্থে সাক্ষ্যপ্রমাণ ভিত্তিক নৈব্যতির্ক সত্য আমাদের লোকসমাজে গভীর জায়গা কোনদিনই পায়নি।

আমি একধরণের স্পষ্টত রাজনৈতিক ফেক নিউজের উদাহরণ নিয়ে কথাগুলি বললাম, যেহেতু খোলাখুলি রাজনৈতিক ফেক নিউজের সবচেয়ে বড়ো সাপ্লায়ার তারাই, কিন্তু অন্যরাও এই খেলায় অংশীদার। শুধু তাদের সামর্থ্য ও নেটওয়ার্ক অত বিস্তৃত নয় বলে ততটা চোখে পড়ে না।

কিন্তু অন্য একটা স্তরও আছে। রাজনৈতিক ফেক নিউজ ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ফেক নিউজের সাপ্লাইও কিছু কম নয় এবং সেরকম ফেক নিউজ আজ হাজারো মানুষ সারাক্ষণ বিশ্বাস করছেন।একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। সম্প্রতি অনেকেই একটা ভিডিও দেখেছেন যেখানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক পোঙ্গল উপলক্ষে কিছু মিলিটারি ব্যক্তিদের সঙ্গে কলাপাতায় পোঙ্গল লাঞ্চ খাচ্ছেন। ছবিটা ফেক, ওটা কানাডার ভিডিও। কিন্তু এই ভিডিওটা হাজারো লাখো মানুষ পেয়েছেন, শেয়ার করেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন। কারণ, এই ভিডিওটা আমাদের সামুদায়িক নৈতিকতার স্বজ্ঞাকে ট্রিগার করে। সামুদায়িক নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা ও তা পালন করা যে ব্যক্তির কর্তব্য তা আমরা সবাই মানি আমাদের অবচেতন মনে আমরা সেই সামুদায়িক নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করি। তাই ভারতীয় বংশদ্ভুত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সেটা পালন করছেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের স্বজ্ঞা তাই বলে (“এইটা দেখছি”) তাই আমরা বিশ্বাস করে ভিডিওটা বারবার শেয়ার করে থাকি। একইভাবে সম্প্রতি স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার অডিও লক্ষ লক্ষ মানুষ পেয়েছেন ও বিশ্বাস করেছেন, কিন্তু ১৮৯৩ সালে রেকর্ডিং আবিষ্কারই হয়নি। অডিওটা যে ফেক তার জন্যে শোনারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার বহুল প্রচারের কারণ এই যে স্বামীজির নিজস্ব গলায় সেই বক্তৃতা শোনা মনকে শুদ্ধ করার একটা প্রক্রিয়া, যা আমরা অনেকেই অবচেতন মনে করে থাকি।

এটা যদি একদিকে হতে থাকে অন্যদিকে রাজনীতিও ক্রমশ স্বাধীন স্বত্বার নৈতিকতা (অন্যের ক্ষতি নয়, সবাই সমান, সবার অধিকার ও কল্যাণের হক সমান, অন্যের ক্ষতি না করে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব ব্যক্তির অধিকার সুনিশ্চিত করা ইত্যাদি) ছেড়ে সামুদায়িকতা ও দেবত্বের প্রতি মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়েছে, তাই রাজনীতিতে আজ সামুদায়িক উপাদানের ছড়াছড়ি। এটা শুধু হিন্দুত্বের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য নয়, মমতার রাজনীতিতেও একই উপাদান দেখতে পাওয়া যায়, তাই এত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আইকনগুলি রাজনীতি আর রাষ্ট্রনীতিতে ব্যবহার হচ্ছে। শুধু মোদী নয়, মমতার রাজনীতিতেও প্রতিবাদকে 'বিশৃঙ্খলা' বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, ব্যক্তি কল্যাণকে রাষ্ট্রিক অধিকারের বদলে 'রাজা-রানীর দয়া' হিসেবে দেখানো হচ্ছে। উদাহরণের অভাব নেই।

শেষ করার আগে লিবারাল ও বামপন্থীদের জন্য দু'একটি কথা। আমি নিজেও সাধারণভাবে ওই বর্গের মধ্যে পড়ি বলে সে কথা আমারও জন্যে। ফেক নিউজের আসল সত্য প্রচার করা দরকার, এই নিয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। একই সঙ্গে ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীন কল্যাণ ও অধিকারের রাজনীতি থেকেও নজর সরানো যাবে না। কিন্তু আজকের লড়াইটা শুধু সেখানে নয়। প্রথমত, আমাদের আলোচনায় স্বীকার করতে হবে যে মানুষ বহুনৈতিক, একনৈতিক নয়, এবং মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বজ্ঞা জনিত ভাব প্রকাশ করে, তার জন্য যুক্তি সাজায় এবং সেই স্বজ্ঞা আসে কিছুটা স্বাধীন সত্ত্বা, কিছুটা সামুদায়িক ও কিছুটা দেবত্বের নৈতিকতা থেকে। আমাদের লড়াইতেও এই বহুনৈতিকতাকে সম্মান জানাতে হবে। সামুদায়িক ও দেবত্বের নৈতিকতার কোন উপাদানগুলি কীভাবে গঠনমূলক স্বজ্ঞা তৈরি করতে পারে, তা গণ-আলোচনায় আনতে হবে, আন্দোলনের ভাষায় আনতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেনের মধ্যে গঠনমূলক স্বজ্ঞার প্রয়োগ বাড়াতে হবে। যে লক্ষ-কোটি মানুষ অত কষ্ট করে গঙ্গাসাগর বা প্রয়াগে পুণ্যের খোঁজে যান, তাঁদের মনের নৈতিক ক্যানভাসকে অন্তর থেকে বুঝতে হবে এবং সেইমতো কথা সাজাতে হবে। কীভাবে তা হবে, তার উদাহরণ দেশে ইতিমধ্যেই আছে, তা নিয়ে আরও কথাবার্তা দরকার, তার জন্য থাক আরেকটা লেখা।

______________________________
1) এই ভাবনার শুরু দার্শনিক হিঊম-এর থেকে। তিনি বলেছিলেন, "Reason has to be the servant of passion". অর্থাৎ প্যাশন আগে, যুক্তি আসে তার পিছু পিছু। মনস্তত্ত্ব যত এগিয়েছে, প্যাশন কথাটা থেকে আমরা এসে পৌঁছেছি স্বজ্ঞায়, যদিও মূল ভাবনার খুব কাছাকাছি।

2) Lawrence Kohlberg ১৯৬০-এর দশকে নৈতিক মনস্তত্ত্বের একটি মৌলিক আবিষ্কার করেছিলেন যা শিশুদের নৈতিক বোধ ও তার যুক্তি পালটাতে পালটাতে যায়।

3) Howard Margolis, Patterns, Thinking and Cognition, Chicago University Press, 1987.

4) Shweder, Much, Mahapatra, and Park, 1997, The Big Three of Morality (Autonomy, Community, Divinity), in Morality and Health, Edited by A. Brandt and P. Rozin, 119-69, Routledge, New York.

5) ইংরেজিতে কথাটা 'utility', তবে নৈতিকতার প্রসঙ্গে তার বাংলা 'উপযোগিতা' নয়।

6) নৈতিক মনস্তাত্ত্বিকেরা একটা উদাহরণ দিয়ে থাকেন। দুই ভাই-বোন ঠিক করল যে তারা যৌন সংসর্গে লিপ্ত হবে। তারা সে কাজটি গোপনে করল, তারপর ঠিক করল এটাই শেষ এবং এই ঘটনা কেউ জানবে না, তারা আর কোনওদিন এই বিষয়ে কথা বলবে না। স্বাধীন স্বত্বার নৈতিকতায় এতে দোষের কিছু নেই, কারণ কারুর ক্ষতি হয়নি এবং নিজেদের সুখ বেড়েছে, কিন্তু দেবত্বের নৈতিকতায় এতে দুজনের শরীর ও আত্মা কলুষিত হয়েছে, অশুদ্ধ হয়েছে।

7) Zellig S. Haris, Discourse Analysis, published in Language, Volume 28, (pages 1-30), 1952, published by Linguistic Society of America.

8) https://www.altnews.in/media-outlets-use-pongal-video-from-canada-to-claim-rishi-sunak-celebrated-festival-in-london/