আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৩ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

বিচার-ব্যবস্থা সত্ত্বেও আক্রান্ত নাগরিক অধিকার

অম্বিকেশ মহাপাত্র


কিশোর শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর ১১৪তম আত্মবলিদান দিবস ১১ই আগস্ট ২০২১। করোনার অতিমারিজনিত বিধি-নিষেধ যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। এমতাবস্থায় আমার আইনজীবীর ফোন।

- চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আগামী পরশু ১৩ই আগস্ট, জরুরি কারণে, আপনার কেসের হিয়ারিং-ডেট ঠিক করেছেন। আপনি ১১টা মধ্যে কোর্টে আসুন।

- ঐ দিন তো কেসের হেয়ারিং-ডেট নেই। ডেট তো পরের দিকে আছে। কোন কিছু ঘটেছে নাকি?

- সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছে, ৬ বছর আগে বাতিল-হওয়া ধারায় কেস কেন পড়ে? সেকারণেই কেসটাকে ফাইনাল করতে এই তৎপরতা। আপনি পরশু আসুন। আশা করি, এবার কেসের একটা ফয়সালা হবে।

- ঠিক আছে, ঐ দিন আমি ১১টার মধ্যে কোর্টে আসছি।

পাঠক ভাবছেন কিসের কেস? এ যে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’! তাহলে বলি কেসের বিষয়ে, একটুখানি। আমার বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের দায়ের করা ক্রিমিনাল কেস। নিম্ন-আদালত আলিপুর ক্রিমিনাল কোর্টে। ২০১২ সাল থেকে অর্থাৎ ন’বছরের বেশি কেস চলছে। কেস দায়ের করার আগে গ্রেফতার, পুলিশ লক্-আপ, ক্রিমিনাল কোর্টে হাজির করে ক্রিমিনাল কেস দায়ের। জামিনের আবেদনে সরকারের বাধা সত্ত্বেও, সংবাদমাধ্যম সহ সাধারণ নাগরিকের সরব প্রতিবাদ হেতু জামিন পেয়েছিলাম। এরপর বিচার-ব্যবস্থার পদ্ধতি অনুযায়ী, সরকারের পক্ষে পুলিশের মাধ্যমে কোর্টে চার্জশিট দাখিল। ১লা জুন ২০১৩, কেবলমাত্র ৬৬এ ধারা-অন্তর্ভূক্ত সেই চার্জশিট কোর্ট চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করে।

পাঠকের মনে হতে পারে গ্রেফতার, লক্-আপ সহ ক্রিমিনাল কেস দায়ের করার নেপথ্যে নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট কোনো আইনসঙ্গত অপরাধ আছে। তাহলে পাঠককে অপরাধ-টি সম্পর্কে জানাই, অতি সংক্ষেপে। উল্লিখিত ‘কোলাজ কার্টুন’-টি সমকালীন সংসদীয় ঘটনাবলীর উপর তৈরি। দেশের সংবিধান মতে ‘কার্টুন’ তৈরি এবং ই-মেলে বন্ধুদের তা শেয়ার করা আইন বিরুদ্ধ নয়। তা সত্ত্বেও সংবিধানের শপথ নেওয়া মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রীর সচিবালয়ের পরিকল্পনায় কলকাতা পুলিশ, শাসদকল এবং শাসকদল আশ্রিত দুষ্কৃতিদের যৌথ অপারেশন। অবশ্যই ‘রাতের আঁধারে’। কারণ ‘রাতের আঁধারে’ অপরাধ জগতের বেশিরভাগ কাজ সম্পাদিত হয়। ‘সেই সময়’ প্রকৃতির নিয়মে সারাদিনের ক্লান্তির পর অধিকাংশ মানুষ বিশ্রামে ঘরবন্দি থাকেন, ঘুমোন। সেকারণে ‘সেই সময়’ পুলিশ প্রশাসনের উপর বাড়তি দায়িত্ব, সমাজের মানুষের নিরাপত্তার। ঘটনা তেমন কিছু না, সামান্য মাত্র। ১২ই এপ্রিল ২০‍১২, রাত ৯টা নাগাদ ৭০-৮০ জন দুষ্কৃতী নিউ গড়িয়া সমবায় আবাসন (যে আবাসনে আমি বসবাস করি এবং যে আবাসনের আমি সহ-সম্পাদক) অফিসের চেয়ারে আমাকে বসিয়ে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে। প্রিন্টেড ‘কার্টুন’-টি আমাকে দেখিয়ে, মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান করা হয়েছে শুনিয়ে দুষ্কৃতী-বাহিনী চড়, থাপ্পড়, লাথি, ঘুষি, অশ্রাব্য গালিগালাজ, প্রাণনাশের হুমকি ইত্যাদি দিতে থাকে। অসহায় অবস্থায় প্রাণরক্ষায় হাতজোড় করে দুষ্কৃতীদলের কাছে প্রাণভিক্ষা চাই। দুষ্কৃতীদলের নেতার নির্দেশিত বয়ানে মুচলেকা, তারপর অফিসে দুই সাদা পোশাকের পুলিশের প্রবেশ। মৌখিক নির্দেশে আমাকে এবং আবাসনের সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত (৭৩)-কে পুলিশ ভ্যানে চাপিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মিথ্যা বয়ানে অ্যারেস্ট মেমোতে সই করিয়ে, বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে মেডিক্যাল চেক্-আপ করিয়ে থানার লক্-আপ। প্রায় অন্ধকার লক্-আপের মধ্যে যত্রতত্র নোংরা সহ দুর্গন্ধযুক্ত খোলা শৌচালয়। ভ্যাপসা গরমে ক্লান্ত শরীর এবং মন নিয়ে বিশ্ব চরাচর থেকে বিচ্ছিন্ন আমি এবং সুব্রতদা মেঝেতে শুয়ে পড়ি।

পরে তথ্য থেকে জানা যায় - আগে গ্রেফতার, পরে অভিযোগপত্র জমা! অভিযোগকারী চক গড়িয়া ছিট নয়াবাদ তৃণমূল কংগ্রেস আঞ্চলিক কমিটির অমিত সরদার। যার সাথে আমি উল্লিখিত ‘কার্টুন’ শেয়ার করিনি। অ্যারেস্ট মেমোতে গ্রেফতারের সময় - ১৩ই এপ্রিল, ২০১২ রাত্রি ১২:৩০; স্থান - আমার বাড়ির ঠিকানা; উপস্থিত সাক্ষী - আমার স্ত্রী জলী মহাপাত্র! সব-ই সর্বৈব মিথ্যাচার! গ্রেফতারে ১১৪, ৫০০, ৫০৯ of IPC এবং ৬৬এ(বি) of IT Act ধারাগুলি ব্যবহার হয়েছিল। সবক’টি ধারাই জামিনযোগ্য। তা সত্ত্বেও থানা থেকে জামিন দেওয়া হয়নি! আবাসনের আবাসিকরা এবং আমাদের পক্ষে আইনজীবী সেই রাতে থানায় খোঁজখবর করতে গিয়ে গেটের বাইরে, পুলিশের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে দুষ্কৃতীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন!

পরবর্তী সময়ে ১৩ই আগস্ট, ২০১২, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের স্বতঃপ্রণোদিত অনুপুঙ্খ তদন্ত সাপেক্ষে দু’টি সুপারিশ সহ বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ এবং আমাদের সম্মানহানির জন্য জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা অর্থাৎ মোট ১ লক্ষ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণের সুপারিশ। নানান টালবাহানা পর ৩ মে, ২০১৩, মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট এবং সুপারিশ, অতি অবাস্তব (কু)যুক্তি সহকারে, সরকার বাতিল করে! ১লা জুন ২০১৩ চার্জশিট চূড়ান্তরূপে গৃহীত হলেও, কেস ডিসচার্জ বা চার্জ গঠন, কোন পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি! মাসের পর মাস, বছরের পর বছর! প্রাসঙ্গিক দু’টি ঘটনার উল্লেখ জরুরি। (১) ২৪শে মার্চ, ২০১৫, সুপ্রিম কোর্ট ৬৬এ of IT Act ধারাটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বাতিল করে। পাশাপাশি এই ধারায় বিচারাধীন সকল কেস প্রত্যাহারের নির্দেশ। (২) রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট এবং সুপারিশের উপর হাইকোর্ট শুনানির পর ১০ই মার্চ, ২০১৫ চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। সুপারিশ দু’টিকে কোর্ট অর্ডার হিসেবে ৩০ দিনের মধ্যে কার্যকর করার নির্দেশ এবং মামলার খরচ বাবদ অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। রাজ্য সরকারের তরফে ডিভিশন বেঞ্চে আপীল। সেই আপীল খারিজ হয় দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ার পর, ১২ই মার্চ ২০২০। তারপরও হাইকোর্টের অর্ডার আজও কার্যকর হয়নি! এতসবের পরও আলিপুর ক্রিমিনাল কোর্ট কেস নিষ্পত্তি না করে ফেলে রাখে! নভেম্বর ২০১৭, মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে কেসের দ্রুত নিষ্পত্তি চেয়ে সুব্রত (সেনগুপ্ত)দার হাইকোর্টে আবেদন। হাইকোর্টও কার্যত চুপচাপ! ১১ই মে, ২০১৯, দীর্ঘসময় রোগভোগের পর বিপত্নীক, ক্রিমিনাল কেসে অভিযুক্ত আসামী অবস্থায় অশীতিপর সুব্রত (সেনগুপ্ত)দা চিরনিদ্রায় ঢলে পড়লেন। সুব্রতদা’র ডেথ সার্টিফিকেট জমা দিয়ে হাইকোর্ট থেকে বেরিয়ে আসতে আরও ছ’মাস!

এই প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের সম্ভবত মার্চ মাসে, People’s Union for Civil Liberties (PUCL) সুপ্রিম কোর্টে জানতে চায় - ৬ বছর আগে বাতিল ৬৬এ of IT Act ধারায় মামলা চলে কী করে? সুপ্রিম কোর্ট নড়েচড়ে বসে। সেই তৎপরতায়, আলিপুর ক্রিমিনাল কোর্টের সিজেএম ১৩ই আগস্ট, ২০২১, তড়িঘড়ি শুনানির ব্যবস্থা করেন।

১৩ই আগস্ট (শুক্রবার) ‘আক্রান্ত আমরা’র কয়েকজন সাথী সহ সিজেএম কোর্টে উপস্থিত হলাম। সিজেএম বিচারকের আসনে। হিয়ারিং চললো ১২টা থেকে প্রায় ১টা পর্যন্ত। আমাদের আইনজীবী বেরিয়ে এসে জানালেন - "বিচারপতি ১৬ই আগস্ট সোমবার অর্ডার দেবেন।" কোর্ট চত্বরে চা খেয়ে যে যার বাড়ি ফিরলাম, এই ভেবে যে, সোমবার কেসের ফয়সালা হচ্ছেই। বিকেলে 'আনন্দবাজার পত্রিকা'র জনৈক সাংবাদিক বন্ধুর ফোন। জানতে পারলাম, মাননীয় সিজেএম মহোদয়ের ‘কোভিড-১৯’ পজিটিভ। মাননীয় সিজেএম মহোদয় আপাতত একমাস ছুটিতে। হাসপাতালে ভর্তি। শুনে বিস্মিত হলাম। ‘কোভিড-১৯’ রিপোর্ট পজিটিভ হলে, স্যাম্পেল আগে দিয়েছিলেন, স্যাম্পেল দেওয়ার আগে নিশ্চয়ই উপসর্গ ছিল, উপসর্গ সহ মাননীয় সিজেএম মহোদয়ের কোর্টে আসা উচিৎ হয়নি। পরের দিন 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় সংবাদটি প্রকাশিত হয়। অগত্যা আপাতত একমাস অপেক্ষা এবং মাননীয় সিজেএম মহোদয়ের দ্রুত আরোগ্য কামনা চললো। অপেক্ষা শেষে, মাননীয় সিজেএম মহোদয় ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, কোর্টে ফেরেন এবং প্রতিক্ষিত রায় ঘোষণা করেন। ৬৬এ of IT Act থেকে অম্বিকেশ মহাপাত্রকে অব্যাহতি দেওয়া হল, কিন্তু মামলা থেকে নয়![১] মামলার পরবর্তী শুনানি - ১৭ নভেম্বর, ২০২১! বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মহাবিস্ময়! এরপর তাহলে কী? কাকতালীয় হলেও ঘটনা - ঐদিনই রাজ্যের এ্যাডভোকেট জেনারেল মাননীয় কিশোর দত্ত পদত্যাগ করেন।

অতঃপর কোর্টের অর্ডার, মামলার সার্টিফায়েড কপি সহ সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন সভাপতি মাননীয় অশোক কুমার গাঙ্গুলী মহাশয়ের বাড়ি। বিস্তারিত আলোচনান্তে তিনি জানালেন - এই অর্ডার unjust, improper and illegal। এই অর্ডারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। করা উচিৎ, দেখুন কী করবেন? আপনি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, সবই তো বুঝছেন, দেখছেন, কী চলছে? আপনার না বোঝার কোনো কারণ নেই। পরে প্রবীণ আইনজীবি সুশীল চক্রবর্তীর পরামর্শ এবং সহযোগিতায় ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২১ ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে আবেদন। ১০টি হিয়ারিং-ডেট পর ১৮ই জানুয়ারি, ২০২৩ চূড়ান্ত রায়দান। মাননীয় সিজেএম মহোদয় ৩৬২ CRPC অনুসরণে উদাসীন ছিলেন।[২] সেকারণে মাননীয় সিজেএম মহোদয় ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখের অর্ডার একপাশে সরিয়ে রেখে ক্রিমিনাল কেস থেকে আমায় মুক্তি দিলেন।[৩]

প্রায় ১১ বছর আগে শাসকদল, শাসকদল আশ্রিত দুষ্কৃতী এবং পুলিশ প্রশাসনের যৌথ বোঝাপড়ায় বে-আইনি পদক্ষেপ হয়েছিল, তা স্পষ্ট। কিন্তু বিচার-ব্যবস্থাও সেই কাজে যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে, ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারকের অর্ডারে তাও স্পষ্ট। পাঠক আপনি বিচার করুন, ঠিক বলছি কী না?


তথ্যসূত্রঃ

Excerpt of Court Order dated 14 September 2021 -
(১) “That the accused Ambikesh Mahapatra is discharged from the Charge under Section 66A of the Information and Technology Act, 2000, but the accused Ambikesh Mahapatra is not discharged from the case being Number C1810/2016 pending before the Court of the Chief Judicial Magistrate, Alipore.”

Excerpt of Court Order dated 18 January 2023 -
(২) “The Ld. CJM, Alipore had not taken into consideration theeffect of section 362 CrPC... to find out “as to whether any case under Section 500/509 of the IPC or any other law can be made out” against the accused petitioner. The Ld. CJM was unmindful of the fact that the rejection order by the Ld. ACJM was onmerits;... . With the effacing of section 66A of IT Act, 2000 the trial had become impossible but this did not give the Ld. CJM the legal authority to reopen the issue touching sections 500/509 IPC.”

(৩) “The impugned order passed by the Ld. CJM, Alipore on 14.09.2021 rejecting the prayer for discharge made by the accused petitioneris set aside. The discharge petition by the accused petitioner Ambikesh Mahapatra is allowed. He stands discharged from Case No. C 1810 of 2016 relating to Purba Jadavpur PS Case no. 50 dated 12.04.2012. The bail bonds are discharged accordingly.”