আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৩ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৯

সমসাময়িক

এবার কি নাগাল্যান্ডে ভাঙন?


নাগাল্যান্ডে বিধানসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে 'পূর্ব-নাগাল্যান্ড' রাজ্য গড়ার দাবিকে ‘ন্যায্য’ বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তুয়েনসাং-এ আয়োজিত জনসভায় নতুন রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনকারী ‘ইস্টার্ন নাগাল্যান্ড পিপলস্ অর্গানাইজেশন’ (ইএনপিও)-কে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, বিজেপি জোট ক্ষমতায় ফিরলে সমস্যার ‘ইতিবাচক সমাধান’ হবে।

মায়ানমার সীমান্ত লাগোয়া পূর্ব নাগাল্যান্ডের ৬টি জেলা - মন, তুয়েনসাং, কিফিরে, নোকলক, লংলেং‌ এবং শামাতোরকে নিয়ে নতুন রাজ্য গড়ার দাবিতে গত কয়েক বছর ধরেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ওই এলাকায় বসবাসকারী ৭টি জনজাতি গোষ্ঠীর যুক্তমঞ্চ ইএনপিও। দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে ইএনপিও নেতৃত্ব। সম্প্রতি রাজ্য ভাগের দাবিতে ভোট বয়কটের ডাক দিলেও শেষ পর্যন্ত ইএনপিও নেতৃত্ব তা প্রত্যাহার করে নেন।

রাজ্য ভাগের প্রস্তাব নিয়ে রাজনীতি করায় গেরুয়া শিবিরের পারদর্শিতা ইতিপূর্বে প্রমাণিত। দার্জিলিং আসনটি জেতার জন্য ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকে ধারাবাহিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পৃথক ‘গোর্খাল্যান্ড' সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। ফলাফল - দার্জিলিং থেকে অশান্তি এখনও দূর হয়নি। বরং ক্রমশঃ নতুন নতুন মাত্রা বেড়ে চলেছে।

এই তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন পৃথক উত্তরবঙ্গের দাবি। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা নিয়ে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিতে কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বেশ কয়েক বছর ধরেই সক্রিয়। গেরুয়া শিবিরের কয়েকজন সাংসদ-বিধায়কও সেই দাবিতে সোচ্চার। খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের নেতাদের নিয়মিত প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন।

পিছিয়ে নেই রাজ্যের শাসক দল। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের জনসভায় উপস্থিত থাকছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে একই মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি কোন বার্তা দেয়?

বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমূলে উৎপাটনের বদলে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রতিযোগিতায় কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদল যখন ব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচারিত হয়েছে আরও উদ্বেগজনক একটি খবর - '১৭ জানুয়ারি ২০২৩ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানা যায় যে, উত্তরবঙ্গে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও)-এর প্রধান জীবন সিংহ ছ’জন অনুগামীকে নিয়ে নাগাল্যান্ডের মন জেলার মায়ানমার সীমান্ত লাগোয়া নয়াবস্তি এলাকায় আত্মসমর্পণ করেছেন।'

সংবাদে প্রকাশ আপাতত কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, জীবন ও তাঁর অনুগামীদের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী। আত্মসমর্পণকারী কেএলও নেতাদের সঙ্গে শীঘ্রই আসামে শান্তি আলোচনা শুরু হবে।

সংবাদে আরও প্রকাশ, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতরের একটি সূত্রের দাবি, জীবনরা গত কয়েকদিন নাগাল্যান্ডের মন জেলার অন্য পারে মায়ানমারের শিবির গোটাচ্ছিলেন। তাঁরা ভারতে ফিরতে তৈরি - এই বার্তা পাঠানোর পরে, আসাম রাইফেলসের দল মন জেলায় যায়। ভারত-মায়ানমারের সীমান্ত সমঝোতা অনুযায়ী, দুই দেশের মানুষই সীমান্তের দুই পারে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া যাতায়াত করতে পারেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর সূত্রের দাবি, ওই এলাকায় জীবনকে আত্মসমর্পণ করানো হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পূর্ব-নাগাল্যান্ড সংক্রান্ত প্রস্তাবে মন জেলাও ঠাঁই পেয়েছে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী গত এক বছর ধরেই শান্তি ফেরাতে কেএলও নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছেন। বাংলাকে এড়িয়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ ঘিরে প্রশ্নও উঠেছে।

পৃথক কামতাপুর গড়ার দাবিতে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরেই সন্ত্রাস ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে ১৯৯৫ সালে তৈরি কেএলওর বিরুদ্ধে। ২০০৩ সালে আলিপুরদুয়ার লাগোয়া ভুটানের জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়ে বসা কেএলও এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে ‘অপারেশন অল ক্লিয়ার’ এবং ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ চালিয়েছিল ভারত ও ভুটান সেনা। কেএলও-র শীর্ষ নেতারা আত্মসমর্পণ করলেও জীবন মায়ানমারে পালিয়ে গিয়ে নাগা জঙ্গিগোষ্ঠী এনএসসিএন (খাপলাং)-এর শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সম্প্রতি জীবন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠেরা দাবি করেছেন, ১৯৪৯ সালের একত্রীকরণ চুক্তির ভিত্তিতে পৃথক 'কামতাপুর রাজ্য' গঠনের দাবি নিয়ে শান্তি আলোচনায় রাজি হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।

ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেইসব আলোচনার ভিত্তিতে একসময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছিল নাগা জঙ্গিদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। তবে সেই চুক্তির বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়নি।

নাগাল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর তুয়েনসাং-এ এক নির্বাচনী সমাবেশে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে সমগ্র নাগাল্যান্ড থেকে সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন বা আফস্পা (AFSPA) প্রত্যাহার করা হবে বলে তিনি আশাবাদী। তিনি আরও জানিয়েছেন পূর্ব নাগাল্যান্ডের উন্নয়ন এবং অধিকার সম্পর্কিত কিছু সমস্যা রয়েছে। নির্বাচনের পরই সেই সকল সমস্যার সমাধান করা হবে। তিনি আরও বলেন, নাগাল্যান্ডে শান্তি স্থাপনে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ‘নাগা শান্তি আলোচনা’ চালাচ্ছে কেন্দ্র। তবে শুধু নাগাল্যান্ডেই নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যেগুলিতে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী যে সকল উদ্যোগ নিয়েছেন, শিগগিরই তার ফল মিলবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

নির্বাচনী প্রচারের শেষ বেলায় ডিমাপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রীও নাগাল্যান্ড থেকে আফস্পা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি অবিশ্যি 'পূর্ব-নাগাল্যান্ড' সম্পর্কে কোনো শব্দ উচ্চারণ করেননি। এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের গেরুয়া শিবিরের জনপ্রতিনিধিরা যখন পৃথক রাজ্যের দাবিতে মুখর তখন একই দলের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মুখে কুলুপ। সবমিলিয়ে এক পূর্বপরিকল্পিত দ্বিচারিতা বজায় রাখার চেষ্টা নজরে আসে। একদিকে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আপোস অথবা সমঝোতা!

শেষ পর্যন্ত কী হবে তা সময় বলবে। তবে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সুরে সুর মিলিয়ে রাজ্য ভাগের প্রস্তাব অথবা প্রতিশ্রুতি নাগাল্যান্ড এবং পশ্চিমবঙ্গ, কোনো রাজ্যের জন্য কোনো সুষ্ঠু সমাধান নয়।