আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যা ● ১-১৫ মার্চ, ২০২৩ ● ১৬-৩০ ফাল্গুন, ১৪২৯

সমসাময়িক

স্বৈরাচারী স্পর্ধা


স্বৈরাচারী শাসকদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এই যে তারা যেকোনো সমালোচককে তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দেন। আসলে সমালোচনা বিষয়টিই তাদের অভিধানের বাইরে। স্বৈরাচার যেহেতু যুক্তি-তর্কের ঊর্ধ্বে উঠে শুধুমাত্র গায়ের জোর এবং মিথ্যা আবেগের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তাই সমালোচনার সুস্থ যুক্তিনির্ভর জবাব দেওয়া অথবা নিজের যুক্তি ও তর্কের জোরে সমালোচকের তোলা প্রশ্নকে ভুল প্রমাণ করা স্বৈরাচারীর ধাতে নেই।

উপরের যুক্তির প্রমাণ খুঁজতে খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজনয়ীতা নেই। মোদী সরকারের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। দেশের ভিতরে মিথ্যা মামলা রুজু করে বহু মানুষকে জেলে পাঠানো হয়েছে তারা মোদী সরকারের সমালোচনা করেছেন বলে। স্ট্যান স্বামীর মতন মানুষের মৃত্যু হয়েছে জেলে। সুধা ভরদ্বাজ, আনন্দ তেলটুম্বে, সিদ্দিক কাপ্পানের মতন মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের দীর্ঘদিন কারাবাস করতে হয়েছে। জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া, হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর নামিয়ে আনা হয়েছে ভয়াবহ নির্যাতন। তদুপরি, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা এবং সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখানোর জন্য লাগাতার সিবিআই, ইডি, আয়কর দপ্তরের উপর্যুপরি হানা লেগেই রয়েছে। কথা বলার যে বুনিয়াদী স্বাধীনতা ভারতের সংবিধান জনগণকে দিয়েছে তা মোদী জমানায় অনেকাংশেই ভূলুন্ঠিত।

এই সমালোচকদের বিবিধ নামকরণ করা হয়েছে সংঘ পরিবারের তরফ থেকে। কখনও একটি তৃতীয় শ্রেণির চিত্রপরিচালকের তৈরি করা লব্জ ‘আর্বান নকশাল’ ব্যবহার করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। পরিষ্কার সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে শুধুমাত্র যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তারা নকশালপন্থী নয়। তাদেরকেও যেমন কবজা করা দরকার, তেমনি যেইসব বুদ্ধিজীবিরা ‘আর্বান নকশাল’ সেজে এদের মন্ত্রণা দিচ্ছে বা মতাদর্শগতভাবে সমর্থন করছে তাদেরকেও জেলে পোরা দরকার। আবার ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ নামকরণ করা হয়েছে এই সমস্ত বিরোধীদের। এরা নাকি ভারতকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে চায়। তাই ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-কেও উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। এই নামকরণের রাজনীতি থেকেই স্পষ্ট যে বিরোধীদের বিরুদ্ধে এমন শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে যা শুনলে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। বিপুল টাকা, প্রচারমাধ্যম এবং সংঘের পক্ষে লাগাতার প্রচার দেশের একটি বড়ো অংশের মানুষের মনে এই কথাগুলি প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছে, এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

তবু বিচারব্যবস্থা শত সমস্যা সত্ত্বেও কিছু এমন রায় ঘোষণা করেছে যা সরকারের না-পসন্দ, কারণ তা মানুষের স্বাধীনতা এবং সংবিধানের পক্ষে। দীর্ঘ টালবাহানার পরে সুপ্রিম কোর্ট সিদ্দিক কাপ্পানের জামিন মঞ্জুর করেছে। জামিন দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বলেন যে কাপ্পানের কাছ থেকে যেই সাহিত্য, পুস্তিকা, হ্যান্ডবিল ইত্যাদি পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে তা প্রচার করার অধিকার কাপ্পানের আছে। বিচারপতিরা এও বলেন যে প্রতিবাদ করা কখনও খুবই জরুরি। কাপ্পানের কোনো প্ররোচনামূলক গতিবিধির প্রমাণ পেশ করতে উত্তরপ্রদেশ সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আনন্দ তেলটুম্বেকে জামিন দেওয়ার সময় বম্বে হাইকোর্ট স্পষ্ট ভাষায় বলে যে তেলটুম্বে উগ্রপন্থী গতিবিধির সঙ্গে যুক্ত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুধা ভরদ্বাজও জামিন পেয়েছেন।

অর্থাৎ বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে যাদের মোদী সরকার উগ্রপন্থী তকমা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে, তাদের অনেকেই জামিন পেয়ে যাচ্ছেন এবং মাননীয় বিচারপতিরা সরকার এবং তদন্তকারী সংস্থার বক্তব্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য পেশ করছেন। স্বাভাবিকভাবেই সংঘ পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের বিচারব্যবস্থার এহেন আচরণ পছন্দ হচ্ছে না।

অন্যদিকে, বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে সরকার মুখোমুখি সংঘর্ষে গেছে। দেশের আইনমন্ত্রী এবং উপ-রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে বয়ান দিয়েছেন, যা নিয়ে আমরা আগেই এই কলামে মন্তব্য করেছি।

নিকট অতীতে এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি গুণগত পরিবর্তন এসেছে। এখন শুধুমাত্র দেশের ভিতরের মানুষরা নন, বিদেশী বহু সংস্থা তথা ব্যক্তি মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে। হিনডেনবার্গের রিপোর্টের ধাক্কায় আদানির সাম্রাজ্যের ভিত টলমল করছে। বিবিসি-র তথ্যচিত্রে ২০০২ সালের দাঙ্গায় মোদীর ভূমিকা আবারও প্রশ্নের সম্মুখীন। জর্জ সোরোস, বিশ্বখ্যাত ধনকুবের, মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। আদানি কাণ্ডে মোদী কেন এখনও মুখ খোলেননি সেই প্রশ্ন তিনি করেছেন, এবং আশা প্রকাশ করেছেন যে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে মোদীর শক্তি কমবে এবং ভারতে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ঘটবে।

সোরোস এবং বিবিসি-র মতন বিদেশীরা যখন মোদী সরকারের বিরুদ্ধ মুখ খুলছে তখন সরকার তথা সংঘ পরিবার একদিকে বিবিসি-র দপ্তরে আয়কর হানা চালাচ্ছে, অন্যদিকে সোরোসকে প্রবলভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে। সোরোস ধোয়া তুলসী পাতা নন, তিনি অত্যন্ত বিতর্কিত চরিত্র। কিন্তু সোরোসকে আক্রমণ করার নামে সংঘ পরিবার আসল প্রশ্নটি এড়িয়ে যাচ্ছে - আদানি কাণ্ডে মোদী নিশ্চুপ কেন? বিরোধীরাও এই প্রশ্ন তুলছেন। কিন্তু তবু সরকার নিশ্চুপ।

এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের কাছে বিবিসি-র তথ্যচিত্রকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সংক্রান্ত নথি পেশ করতে বলেছে। ফলত, সংঘ পরিবার আবার সুপ্রিম কোর্টের উপর ক্ষিপ্ত। তারা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়েছে যে আরএসএস-এর পত্রিকা 'পাঞ্চজন্য'তে তারা অভিযোগ করছে যে সুপ্রিম কোর্ট নাকি বিদেশী ভারত বিরোধী শক্তির হাতে অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে! এদের স্পর্ধা দেখলে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয়।

সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তাদের কাজ দেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্দেশ দেওয়া। আইনের পথে চলতে গিয়ে তাদের রায় অনেক সময় অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে। তাই বলে 'সুপ্রিম কোর্ট ভারত বিরোধী শক্তির হাতিয়ারের মতন ব্যবহৃত হচ্ছে', এত বড়ো কথা বলে আরএসএস এই দেশে কোন রাজনীতি করছে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শাসনক্ষমতার দম্ভে তারা এতটাই মত্ত যে সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে এহেন বক্তব্য লিখতে তাদের হাত কাঁপছে না। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিলে তারা যে সুপ্রিম কোর্টকে ছেড়ে কথা বলবে না, তা তারা জলের মত পরিষ্কার করে দিচ্ছে।

এহেন পরিস্থিতিতে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং সরকার তথা সংঘ পরিবারের সর্বগ্রাসী স্বৈরাচারী রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশের জনমত সংগঠিত করা বিরোধীদের প্রধান কর্তব্য। তারা তা করতে পারছে কিনা, তার উপর নির্ভর করবে দেশের ভবিষ্যৎ।