আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ ফাল্গুন, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে পুলিশের সন্ত্রাস


আসামের পুলিশ বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে এখনও পর্যন্ত আড়াই হাজারের মতো মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে। বাল্য বিবাহ করেছে, এমন কমবয়সী ছেলেরা যেমন এর মধ্যে আছে, তেমনই ধরা হয়েছে তাদের পরিবার আর কাজী-পুরোহিত যারা ওইসব বিয়ে দিয়েছেন, তাঁদেরও।

যেসব জেলায় অভিযান চলছে সেগুলিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য রকমের বেশি। স্বভাবতই বন্দি ও অভিযুক্তদের মধ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। রাজ্যের একটি মুসলিম সংগঠন বাল্য বিবাহ রোধে এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে শুধু পুলিশ দিয়ে নয়, বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। তবে আসামের এক মুসলিম রাজনীতিবিদ ও সাংসদ এই ধরনের গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করছেন।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি বিয়ের বয়স এবং কম বয়সে মাতৃত্বের বিপদ নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সেই সূত্রেই তিনি ফেব্রুয়ারি মাসের সূচনালগ্নে ঘোষণা করেন যে বাল্য বিবাহের অপরাধে যুক্তদের একটা তালিকা করা হয়েছে। আসাম পুলিশ বলছে ৪,০০৪টি বাল্যবিবাহের মামলা রুজু হয়েছে। এইসব মামলায় অভিযুক্ত আট হাজারেরও বেশি মানুষ। সেইসব অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ধরপাকড় শুরু করার পর টুইট করে আসামের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে এখনও পর্যন্ত ২,২১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এবং এই অভিযান ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত চলবে।

যাদের ধরা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে বাল্য বিবাহ রোধ আইনে মামলা হয়েছে। আর যেসব ক্ষেত্রে বিয়ে হওয়া কিশোরীর বয়স ১৪-এর কম, সেইসব ক্ষেত্রে শিশুদের ওপরে যৌন নির্যাতন রোধ আইনেও (পকসো) মামলা করা হচ্ছে। আসাম পুলিশের মহা নির্দেশকের মতে ধৃতদের মধ্যে ৫২ জন হলেন কাজী এবং পুরোহিত, যারা বাল্যবিবাহ দিয়েছিলেন। যত জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার মধ্যে সবথেকে বেশি সংখ্যক ধরা হয়েছে বিশ্বনাথ, বাকসা, বরপেটা, ধুবরি, হোজাই আর কোকরাঝাড় জেলাগুলি থেকে।

ভারতে বাল্যবিবাহ রোধ আইনটি ১৯২৯ সালের। তা সংশোধন করা হয় ২০০৬ সালে। সর্বশেষ আইন অনুযায়ী ছেলেরা ২১ বছরের আগে আর মেয়েরা ১৮ বছরের আগে বিয়ে করতে পারে না। তবে ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিবছর ভারতে প্রায় দেড় লক্ষ বাল্য বিবাহ হয়ে থাকে। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষাতে, ২০২২ সালের যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে দেখা গেছে যে সদ্যজাত মৃত্যুহারের দিক থেকে আসাম তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এক হাজার শিশু জন্মালে ওই রাজ্যে ৩২টি সদ্যজাত মারা যায়।

আসামের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী বলেছেন যে শুধু যে সদ্যজাত শিশু মৃত্যুর হার আসামে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার, তা নয়, প্রসূতিকালীন জটিলতার কারণেও বাল্যবিবাহ হওয়া মায়েরা বিপুল সংখ্যায় মারা যাচ্ছেন। মূলত অশিক্ষা, সচেতনতার অভাবেই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে দৃঢ় পদক্ষেপ করা হয়েছে। এছাড়াও জন বিস্ফোরণ কমাতেই হবে। কমবয়সে বিয়ে হলেই সন্তান সন্ততির সংখ্যাও বেশি হবে, আর সেটা তো ভবিষ্যতে ভারতের জনসংখ্যাই বাড়াবে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করা আশু প্রয়োজন।

পুলিশের দেওয়া তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, যেসব জেলায় গত কয়েকদিনে সব থেকে বেশি বাল্য বিবাহের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলি এলাকাই মুসলমান অধ্যুষিত। কিছু এলাকায় আবার মুসলমান এবং জনজাতির মানুষের বেশি বসবাস। যদিও মুখ্যমন্ত্রী বারেবারেই বলেছেন যে বাল্য বিবাহ রোধ আইনে এই গ্রেপ্তারি কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে অভিযুক্তদের অধিকাংশই মুসলমান ও জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ।

আসামের মুসলমান সংগঠনগুলিও এই সরকারি অভিযানের সরাসরি বিরোধিতা করছে না। অল আসাম মুসলিম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা আমসু দীর্ঘদিন ধরেই মুসলমানদের মধ্যে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা বিকাশের লক্ষ্যে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনটির সভাপতি সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি জানান সংখ্যালঘু এলাকাগুলোতে বাল্য বিবাহের সমস্যা নিয়ে ৫ বছর আগে থেকে তাঁরা যখন সরব হয়েছিলেন তখন কিন্তু সরকার বা পুলিশ বা স্বাস্থ্য বিভাগ, কারও সাহায্য পাওয়া যায়নি। তাঁর বয়ানে, "সরকারের কাছে আমরা অনেকবার আবেদন জানিয়েছি, তখন আমাদের কথা কেউ শোনেনি। গত ৫ বছরে আমরা অন্তত সাড়ে ৩ হাজার বাল্য বিবাহ আটকেছি, তখন আমরাই কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে গালি শুনেছি, মারধর খেয়েছি বিয়ে আটকাচ্ছি বলে।"

বাল্য বিবাহ সমাজ-সভ্যতার একটি জটিল সমস্যা। ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই সমস্যাটি রয়েছে। এই বিষয়ে রাজ্যের তালিকা প্রণয়ন করতে গেলে দেখা যায় সবার আগে রয়েছে বিহার। তারপর পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান ও অন্ধ্রপ্রদেশের পর আসাম। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভের পর্যবেক্ষণগুলি থেকে জানা যায় যে আসামে ১৮ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে বিয়ের হার ২০০৫-০৬-এ ছিল ৩৮.৬ শতাংশ। আর ২০১৯-২০-তে ৩১.৮ শতাংশ। একই সঙ্গে এও জানা যাচ্ছে যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে মাতৃত্বের হারও ক্রমশ কমে আসছে। ২০০৫-০৬-এ মাতৃত্বের হার ছিল ১৬.৪ শতাংশ। আর ২০১৯-২০-তে ১১.৬ শতাংশ।

কী কারণে বাল্য বিবাহ কমে যাচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা গবেষণা চলছে। তবে সকলের নজরে আসছে যে দারিদ্র ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাই বাল্য বিবাহের মূল কারণ। শিক্ষার অভাবও বাল্য বিবাহের অন্যতম কারণ। প্রান্তিক এলাকার জনজাতির মানুষ, চা-বাগানের শ্রমিক ও গ্রামের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে এই তিনটি সমস্যাই প্রকট। সমস্যার নিরসনে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা দরকার। বাস্তবে কি তা হচ্ছে?

প্রচলিত প্রবাদ, 'ভাত দেওয়ার মুরোদ নাই, কিল মারার গোঁসাই'। আসামের সাম্প্রতিক ধরপাকড়ের ঘটনা সেই প্রবাদকে মনে করিয়ে দেয়। দারিদ্র ও অশিক্ষা দূরীকরণের উদ্যোগ নেই। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে নজর নেই। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, বিশেষত মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি অবিশ্যি সর্বভারতীয় সমস্যা।

অন্যান্য রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মতো আসামের রাজ্য সরকারও সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধান করতে উৎসাহ না দেখিয়ে ধরপাকড়ের যে পদ্ধতি বেছে নিয়েছে তার ফল বহুমাত্রিক। যেসব পরিবারের পুরুষ বা কমবয়সী ছেলেদের পুলিশ নিয়ে গেছে সেইসব পরিবারের মহিলারা বিশেষত বন্দীদের কমবয়সী স্ত্রীরা বিপদে পড়েছেন। তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে নিজের বাড়ি অথবা পিত্রালয় ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিবাহিত গর্ভবতী নাবালিকারা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার কথা ভুলে গেছেন। সদাই মনে ভয়, ওই বুঝি পুলিশ আসে। ফলে গর্ভবতী মেয়েদের নিয়মিত স্বাস্থ্য যাচাইয়ের যথাযথ সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। জননী সুরক্ষা যোজনার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় আশাকর্মী ও অঙ্গনওয়াদি কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ বাড়ি বাড়ি ঘুরে গর্ভবতী মায়েদের শরীর-স্বাস্থ্যের খোঁজখবর করা তাঁদের দায়িত্ব। গ্রামবাসীদের মনে হচ্ছে যে তাঁরাই বাল্য বিবাহ ও গর্ভধারণের সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছেন। ফলে সাধারণ গ্রামবাসীদের থেকে আশাকর্মী ও অঙ্গনওয়াদি কর্মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। গ্রামাঞ্চলে যেটুকু সামান্য স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে উঠেছে তাও কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। এও এক ধরনের মেরুকরণ। ফলে গ্রামীণ সমাজে একটা অলিখিত আতঙ্কের আবহ তৈরি হয়েছে।

অভিযুক্তদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। অর্থাৎ আবারও মেরুকরণ। বাল্য বিবাহ রোধ আইন অনেক পুরোনো। এতদিন ধরে সরকার কোনও উদ্যোগ নেয়নি, কোনও প্রচার চালায়নি, এখন হঠাৎ গ্রেপ্তার করতে শুরু করেছে। এরপরে বলা হবে বাল্য বিবাহে জড়িত ৯০ শতাংশই মুসলমান।

ধর্মীয় মেরুকরণ উদ্দেশ্য না হলে যাদের ধরা হচ্ছে, তাদের বাইরে আরো কিছু মানুষকেও গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল। অনেক চিকিৎসক বয়সের ভুয়া সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, অনেক উকিল বেআইনিভাবে বাল্য বিবাহকে আইনসম্মত করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন - এঁদেরকেও গ্রেপ্তার করা দরকার ছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। সম্ভবতঃ তাঁদের অধিকাংশই মুসলমান ও জনজাতি সম্প্রদায়ের না হওয়ার জন্যেই এই বৈষম্য।

পুলিশ দিয়ে ধরপাকড় করে এত বড় সামাজিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন বাল্য বিবাহর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রচার। দারিদ্র দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিস্তার ও সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় গুরুত্ব দিলেই বাল্য বিবাহ স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে। আগ্রাসী আধিপত্যবাদ অবিলম্বে পরিহার করে ধর্মীয় মেরুকরণ বন্ধ করে সমস্যার মূল কারণগুলির দিকে নজর দেওয়া দরকার।