আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ মাঘ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

রায় বাহাদুর রামব্রহ্ম সান্যাল

গৌরব মুখার্জি


[এই প্রবন্ধটি ‘আরেক রকম’ দশম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যায় (১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২২) ইতিপূর্বে প্রকাশিত ‘কলকাতা চিড়িয়াখানার প্রাক ইতিহাস ও রায় বাহাদুর রামব্রহ্ম সান্যাল’-এর শেষাংশ। এই অংশে শুধুমাত্র রামব্রহ্ম সান্যাল-এর জীবন ও কর্মকাণ্ড বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।]

Ram Brahma Sanyal
রামব্রহ্ম সান্যালের পৈতৃক বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা থানার অন্তর্গত মহুলা গ্রামে। অবশ্য সেই সময় গ্রামের নাম ছিল 'কেদারমাটি মহুলা' যা আজকে 'নতুন মহুলা' নামে পরিচিত। ১৮৫১ খ্রীস্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর রামব্রহ্ম সান্যালের জন্ম হয় মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলায় অবস্থিত তার মামার বাড়িতে। তাঁর পিতার নাম নবকুমার সান্যাল ও মাতার নাম ভবসুন্দরী দেবী। পিতামহের নাম বৈদ্যনাথ সান্যাল। বৈদ্যনাথ সান্যাল ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার এক জমিদারের দেওয়ান। বৈদ্যনাথ সান্যালের তিন পুত্র - বড় জগবন্ধু, মেজো নবকুমার ও ছোট ব্রজকুমার। মেজো ছেলে নবকুমারের দুই পুত্র - বড় কৃষ্ণধন ও ছোট রামব্রহ্ম। রামব্রহ্ম শৈশবেই পিতৃহারা হন। পিতৃবিয়োগের পর প্রায় দশ বছরের বড় দাদা কৃষ্ণধনকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। তাঁদের মা দীর্ঘকাল বেঁচে ছিলেন ও শেষ বয়সে কাশিবাসী হন।

রামব্রহ্ম বাল্যকালে কোথা থেকে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছিলেন, তার সঠিক তথ্য জানা যায় না। তাঁর মাধ্যমিক স্কুল-জীবন কাটে বহরমপুর কলেজিয়েট স্কুলে। প্রত্যহ তিনি কেদারমাটি মহুলা থেকে বহরমপুর পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতেন। তার হেঁটে যাতায়াতের বিষয়টি সত্যিই অবাক করে দেয় তার কারণ কেদারমাটি মহুলা থেকে বহরমপুরের দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার।


তিরিশ বছর বয়সে তোলা রামব্রহ্ম সান্যাল-এর ছবি।

১৮৬৯-এ বহরমপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা বা এন্ট্রান্স (আজকের মাধ্যমিক) পাস করেন।

১৮৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষে তিনি এল. এম. এস. (Licentiate in Medicine and Surgery) পড়ার জন্য কলকাতায় এসে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। তখন মেডিকেল পড়ার পাঠ্যসূচি ছিল পাঁচ বছরের।

Calcutta Medical College
কলকাতা মেডিকেল কলেজ

সেখানে তিন বছর ডাক্তারি পড়ার পর সম্ভবত ১৮৭৪-৭৫ শিক্ষাবর্ষে মাঝপথেই তাঁকে চোখের সমস্যার কারণে চিকিৎসকদের পরামর্শে ডাক্তারি পড়ায় ইতি টানতে হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, আর্থিক কারণে তিনি পড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। যাই হোক, তাঁর মেডিকেল-এর উচ্চশিক্ষার পড়াশোনা না এগোলেও ডাক্তারির ছাত্রাবস্থায় উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণীবিদ্যা সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের পথ নির্ধারিত করে রেখেছিল। এই দুই বিষয়ের ওপর জ্ঞান তাঁর পরবর্তীকালে খুবই কাজে লেগেছিল, কেননা এই দুই বিষয়ের প্রতি দখলই তাঁকে সাহায্য করেছিল কলকাতার চিড়িয়াখানা নির্মাণের কাজে।

ইতিমধ্যে ডাক্তারি পড়ার সময়েই রামব্রহ্ম সান্যালের বিবাহ হয় নদীয়া জেলার শান্তিপুর নিবাসী আনন্দময় মৈত্রের মেজ মেয়ে কাদম্বিনী দেবীর সাথে। রামব্রহ্ম সান্যালের পুত্রসন্তান হেমন্তকুমারের জন্ম হয় ১৮৭৩ খ্রীস্টাব্দের ২০শে নভেম্বর। পরবর্তীকালে হেমন্তকুমার বিবাহের পর তাঁর পুত্রের নাম রাখেন হিরণকুমার।

Dr. George King
ডঃ জর্জ কিং

মেডিকেল কলেজে তাঁর তিন বছরের শিক্ষা জীবনে তিনি স্বনামধন্য কয়েকজন শিক্ষকের সংস্পর্শে আসেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন ডঃ জর্জ কিং, যিনি ছিলেন তৎকালীন হাওড়ার শিবপুরে অবস্থিত রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন (বর্তমান আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান)-এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট। এছাড়াও তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রাইমারি ক্লাসে উদ্ভিদবিদ্যা পড়াতেন। পরবর্তীকালে ১৮৯০ খ্রীস্টাব্দে কলকাতার 'রয়্যাল বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (Royal Botanical Survey of India)-র অধিকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। রামব্রহ্ম সান্যাল ডঃ জর্জ কিং-এর অত্যন্ত প্রিয় ও স্নেহভাজন ছাত্র ছিলেন। ১৯০১ খ্রীস্টাব্দে ডঃ জর্জ কিং লণ্ডনের 'লিনিয়ান সোসাইটি (Linnean Society of London) থেকে 'লিনিয়ান মেডেল' পেয়েছিলেন। উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য এই পদক দেওয়া হতো।

Dr. John Anderson
ডঃ জন অ্যান্ডারসন

এছাড়াও ছিলেন ডঃ জন অ্যান্ডারসন, তিনি পড়াতেন প্রাণীবিদ্যা ও তুলনামূলক শারীরবিদ্যা (Comparative Anatomy)। ডঃ অ্যান্ডারসন মেডিকেল কলেজে যোগ দেওয়ার আগে কলকাতায় অবস্থিত ভারতীয় যাদুঘরের 'কিউরেটর' ছিলেন।

মূলতঃ এই দু'জন অধ্যাপকের কাছ থেকেই রামব্রহ্ম উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণীবিদ্যার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক (Theoretical and Practical) এই দুই বিভাগেই জ্ঞানলাভ করেছিলেন।

ঠিক এই পরিস্থিতিতে, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে না পেরে হতাশ রামব্রহ্মর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তাঁর শিক্ষক, মেডিক্যাল কলেজের বোটানির প্রফেসর ডঃ জর্জ কিং ও অ্যানাটমির প্রফেসর ডঃ জন অ্যান্ডারসন।

প্রত্যেকের জীবনে উন্নতির নেপথ্যে কোনো না কোনো মানুষের প্রভাব থাকে। রামব্রহ্ম সান্যালেরও ছিল। তাঁর জীবনে যাঁদের প্রভাব ছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শিবপুর রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন-এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ ডঃ জর্জ কিং। যিনি আবার কলকাতা মেডিকেল কলেজের অনুষদ ছিলেন। সম্ভবতঃ ১৮৭৫ সালের ২৪শে জানুয়ারি শীতকালে, ডঃ জর্জ কিং-এর সুপারিশে রামব্রহ্ম একজন অনিয়মিত কর্মী ও সাধারণ কর্মচারী হিসাবে ২৫ বছর বয়সে আলিপুর চিড়িয়াখানায় কাজে যোগদান করেছিলেন।

১৮৭৬-এর ২৪ জানুয়ারি প্রথমে অস্থায়ীভাবে কুলির সর্দার পদে রামব্রহ্মকে কাজে নেওয়া হয়। জিরাট বস্তিতে একটা তাঁবুতে থেকে তিনি কুলি ও মিস্ত্রিদের কাজের তদারকি করতেন।

পরবর্তীকালে ডঃ কিং-এর অধীনে তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। ডঃ জর্জ কিং চিড়িয়াখানার ম্যানেজিং কমিটির একজন সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। ডঃ জর্জ কিং সাহেবের অধীনে কাজ করতেন বলে সবাই রামব্রহ্মকে 'কিংসবাবু' নামে ডাকতেন। পূর্বপরিচিত হওয়ায় ডঃ কিং-এর সাথে স্বভাবতই তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে।

Carl Louis Schwendler
কার্ল লুই সোয়েন্ডলার-এর স্মৃতিফলক

এই সময়ে আর একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন রামব্রহ্ম, যিনি তাঁকে চিড়িয়াখানার জীবজন্তুদের বিষয়ে প্রাথমিক কাজের হাতেখড়ি দিয়েছিলেন - কার্ল লুই সোয়েন্ডলার। মিস্টার সোয়েন্ডলার ভারতে ব্রিটিশ সরকারের 'পোস্টমাস্টার' পদে আসীন ছিলেন। কিন্তু জীবজন্তু বিষয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞান ও পান্ডিত্যের জন্য তাঁকে পরবর্তীকালে 'চিড়িয়াখানার প্রাণপুরুষ' হিসাবে মান্য করা হয়। তিনি প্রকৃত অর্থেই চিড়িয়াখানাকে তাঁর শ্রম, জ্ঞান ও আন্তরিকতা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন। আজও আলিপুর চিড়িয়াখানার ভিতরে একটি গোলাকৃতি উদ্যানের মধ্যস্থলে কার্ল লুই সোয়েন্ডলার-এর স্মৃতিস্তম্ভ (Monument) অবস্থিত যেটি ১৮৮৩ সালে স্থাপন করা হয়েছিল।

১৮৮০ খ্রীস্টাব্দে রামব্রহ্ম সান্যালকে 'সুপারিনটেন্ডেন্ট' (প্রশাসনিক অধিকর্তা) পদে নিয়োগ করা হয় ৪০ টাকা মাসিক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। অধীক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক হিসাবেও রামব্রহ্মর দায়িত্ব স্বভাবতই বেড়ে যায়।

বলা বাহুল্য, রামব্রহ্মই ছিলেন চিড়িয়াখানার প্রথম সুপারিনটেন্ডেন্ট যিনি কিনা ভারতীয়। পরাধীন ভারতে যা ভারতীয়দের ক্ষেত্রে সত্যিই বিরল। তাই, কতখানি যোগ্যতা ও জ্ঞান থাকলে তখনকার দিনে ওই পদে আসীন হতে পারা যায় তা ভাবলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। যদিও, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সব পদেই ইউরোপীয়রা বা অভারতীয়রা আসীন ছিলেন।

রামব্রহ্ম সান্যালের কর্মক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে পরিচিত ডঃ জর্জ কিং যেহেতু রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন সেহেতু তিনি প্রতি মাসে বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে নতুন গাছের চারা বা বীজ এনে পরিকল্পনা অনুযায়ী চিড়িয়াখানার মধ্যে সবুজায়নে নিমগ্ন থাকতেন। রামব্রহ্ম সান্যাল চিড়িয়াখানার সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে যোগদানের পরে এই সবুজায়নের কাজে গতি আসে। রামব্রহ্ম সান্যাল সেই যুগে পশুপাখি, জীবজন্তুর পাশাপাশি পরিবেশের বিষয়েও অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। চিড়িয়াখানা চত্বরে পশুপাখির পাশাপাশি গাছপালা যেভাবে লাগানো হয়েছিল তা থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়। পরবর্তীকালে তাঁর লেখা প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীবজগত বিষয়ক বই 'আওয়ার্স উইথ নেচার' (Hours with Nature) থেকে তাঁর এই পরিবেশচিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়।

কর্মজীবনের কঠিন সংগ্রাম

১৮৭৭ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারিতে চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনা কমিটি সেখানে একটি 'লগ বই' চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাণীদের প্রতিদিনকার অভ্যাস এবং আচরণ লক্ষ্য করে সেই লগ বইতে দৈনিক লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই কাজে কার্ল লুই স্যুয়েন্ডলার-সহ তিন জন ইউরোপীয়কে সহায়তা করার জন্য রামব্রহ্ম সান্যালকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। সান্যাল প্রচুর তথ্য ও নোট সংগ্রহ করেছিলেন সে সময়ের নানা বইপত্র থেকে যার মধ্যে টি. সি. জেরডনের 'অ্যানিম্যালস অব ইন্ডিয়া' ও 'বার্ডস অব ইন্ডিয়া' উল্লেখযোগ্য। ওই সময়ে একজন অতিরিক্ত মালী নিয়োগ করা হলে সান্যালের দায়িত্ব কিছুটা হালকা হয়েছিল।

১৮৭৭ খ্রীস্টাব্দ থেকে রামব্রহ্মের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পায়। ১লা জানুয়ারী থেকে প্রতিদিন চিড়িয়াখানার সব পশুপাখির স্বাস্থ্য, অসুখবিসুখ, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি নানারকম খবর নথিবদ্ধ করার দায়িত্ব রামব্রহ্ম সান্যালের উপরে এসে পড়ে। এইসব বিষয় ছাড়াও কোন পশুপাখি দান হিসেবে এসেছে, কোনটা কেনা হয়েছে বা অন্য কোনও চিড়িয়াখানা থেকে কোন পশুপাখির বিনিময়ে এসেছে, তাও নথিবদ্ধ করে রাখার দায়িত্ব এসে পড়লো সেই রামব্রহ্মের উপর। কোনও জীবজন্তু মারা গেলে তার কারণ অনুসন্ধান করে কমিটিকে জানানোর দায়িত্বও ছিল তাঁর। এছাড়াও চিড়িয়াখানার দর্শনী হিসাবে যে অর্থ টিকিট সংগ্রাহকের কাছে জমা হয়েছে তার হিসেব, ঘোড়ার গাড়ি রাখার জন্য ও পালকি রাখার জন্য আদায় হওয়া টাকাকড়ির হিসেবও তাঁকেই লিখে রাখতে হত। এককথায় বলা যায় তাঁর ওপর কাজের পাহাড় চেপে বসলো।

বিস্ময়ের বিষয় হল এই যে রামব্রহ্ম সান্যাল জীবনে কোনওদিন কোনো চিড়িয়াখানার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থেকেও মাত্র ২৫-২৬ বছর বয়সেই এই তদারকি করার কাজটি নিখুঁতভাবে করতে পারতেন। আসলে পশুপাখিদের জীবন তাঁর অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠেছিল যে!

Deer Shade
১৮৯০-এর দশকে আলিপুর পশুশালার ডিয়ার শেড।

রামব্রহ্ম সান্যালের বিশ্বখ্যাত হয়ে ওঠার নেপথ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে কর্মকান্ডের ভূমিকা আছে তা হলো পশুপাখির উপর করা তার মূল্যবান বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা। দিনে প্রায় দু'বার তিনি পরিচারকদের সাথে চিড়িয়াখানার যাবতীয় খাঁচা ঘুরে দেখতেন। যেমন পশুদের চলাফেরা, ওঠাবসা, খাওয়া, লেজ নাড়ানো, অস্বাভাবিক ডাক, শ্বাস-প্রশ্বাস, বিষ্ঠা ইত্যাদি সব তথ্যই তিনি নথিবদ্ধ করতেন ও নিজের লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। জীবজন্তুদের সামান্য উত্তেজিত দেখলেই তিনি তার কারন খোঁজার চেষ্টা করতেন। চিড়িয়াখানার এইসব বিষয়গুলোর উপর তিনি স্বতন্ত্রভাবেই কাজ করতেন। এছাড়াও তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন পশুপাখিদের বিজ্ঞানসম্মত নামের উল্লেখ থাকা দরকার। তিনি আলিপুর পশুশালার নামকরণ করেছিলেন ‘আলিপুর জীবনিবাস’।

রামব্রহ্ম সাধ্যমতো অসুস্থ প্রাণীর চিকিৎসা করতেন, প্রয়োজনে পশুচিকিৎসককে দেখিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। অনেক সময় ছোটখাটো অপারেশনও তাঁকেই করতে হতো, সেক্ষেত্রে তাঁর ডাক্তারি বিদ্যা কাজে লাগত। কোনও পশুর মৃত্যু হলে তার ময়নাতদন্তে পশুচিকিৎসককে সাহায্য করতেন, কমিটির কাছে রিপোর্ট পাঠাতেন। সব সময় সিলভার নাইট্রেট দ্রবণ, কার্বলিক অ্যাসিড, কস্টিক সোডা, চক পাউডার ইত্যাদি হাতের কাছে রাখতেন এবং প্রয়োজনে প্রাণীদের সুস্থ করে তোলার কাজে সেগুলি ব্যবহার করতেন। পশুশালায় কোনও পশুর মৃত্যু হলে শোকে অভিভূত হতেন তিনি।

তাঁর রেজিস্টারে পশুশালার যাবতীয় ঘটনা লেখা থাকত। অনেক বিচিত্র তথ্য জানা যায় এর থেকে। যেমন, ১৮৭৭-এর ২৩ জানুয়ারি বিকেলে বর্ধমান হাউসের খাঁচা থেকে বেরিয়ে পড়েছিল দু’টি বাঘ। সারা রাত চিড়িয়াখানার মধ্যে ঘুরছিল তারা। মিস্ত্রিরা কাজ সেরে খাঁচার দরজা বন্ধ না করেই চলে যায়, তাতেই এই বিপত্তি। বেগতিক বুঝে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার গোটা চিড়িয়াখানা ঘিরে রাখার ব্যবস্থা করলেন। রামব্রহ্ম কর্মচারীদের নিয়ে দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাঘেদের গতিবিধি লক্ষ রাখছিলেন। দুর্ভাগ্যের কথা, খাঁচায় পুরতে না পেরে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পুলিশ কমিশনার পরদিন ভোরে বাঘ দুটিকে গুলি করে মেরে ফেলেন।

Hippopotamus
একজন পশু-রক্ষক একটি বাচ্চা জলহস্তিকে খাওয়াচ্ছে। ১৯০৩ সালে আলিপুর পশুশালায় তোলা ছবি।

১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দে তিন মাস বয়সের একটি বাচ্চা জলহস্তীকে কিনে আনা হয়েছিল জাঞ্জিবার থেকে। সুপার রামব্রহ্ম ঘন দুধ, জোয়ার-ভুট্টার বীজ সেদ্ধ করে খাইয়ে তাকে তাজা রেখেছিলেন। ছোট্ট একটি পুকুরও বানিয়ে দিয়েছিলেন তার জন্য। চিড়িয়াখানার দ্বিতীয় বার্ষিক বিবরণে কার্যনির্বাহী কমিটি রামব্রহ্মের প্রশংসা করে লেখে - “Great credit is also due to Baboo R. B. Sanyal, the native Superintendent of the Gardens, who has worked admirably in a difficult and novel position“। ইংরেজ সাহেবরা এদেশের লোকেদের ভাল কাজের কতখানি কদর করতেন তা এই বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়।

তবে, রামব্রহ্ম সান্যাল স্মরণীয় হয়ে আছেন পশুপাখির আচার-আচরণ নিয়ে গবেষণার জন্য। পশুপাখির জীবন, তাদের আচার-আচরণ, বাসস্থান, বৈচিত্র ইত্যাদি ছিল তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়। আর এই অন্বেষণের কাজ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সমস্ত অর্জিত বিদ্যাই তাঁকে চিড়িয়াখানা গঠনের কাজে খুবই সাহায্য করেছিল। তাঁর গবেষণার কাজের জন্য তিনি বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ স্যার জর্জ বেনেটের সাথে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলি এতটাই উন্নত ছিল যে তাঁর গবেষণার ফলেই ১৮৮৯ সালে একটি দুর্লভ সুমাত্রান গণ্ডারের (Dicerorhinus sumatrensis) প্রজনন ঘটান। বাংলাদেশের স্ত্রী গন্ডার ও সুমাত্রার পুরুষ গন্ডারের মিলনে একটি গন্ডারশাবকের জন্ম হয় পশুশালায়। এটি তখন একটি বিরল ঘটনা তো বটেই কেননা পরিবর্তিকালে ২০০১ সাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আবদ্ধ পশুদের মধ্যে এই ঘটনা দেখা যায়নি। বন্দি অবস্থায় গন্ডারের জন্ম ভারতের চিড়িয়াখানার ইতিহাসে এই প্রথম।

সুমাত্রান গণ্ডার
সুমাত্রান গণ্ডার (Dicerorhinus sumatrensis)

আলিপুর চিড়িয়াখানার সুনাম দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণী রক্ষণে সেই যুগে আলিপুর চিড়িয়াখানা খুবই সুনাম অর্জন করে। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পশুর প্রজননের বিষয়ে অভিজ্ঞ জীববিজ্ঞানী হিসেবে চিড়িয়াখানায় তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর গবেষণার কাজ তাঁকে বিশ্বের জীববিজ্ঞানী মহলে পরিচিতি লাভ করায়।

R. B. Sanyal sketch

রামব্রহ্মের নানা গবেষণার কাজে সাহায্যের জন্য চিড়িয়াখানা চত্বরে ১৮৯২ খ্রীস্টাব্দে 'বাবু জয়গোবিন্দ ল্যাবরেটরি' স্থাপিত হয়েছিল। এর জন্য শ্রী জয়গোবিন্দ লাহা পনেরো হাজার টাকা দান করেন।

David Douglas Cunningham
ডঃ ডেভিড ডগলাস কানিংহাম

রামব্রহ্ম সান্যাল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছিলেন সাপের বিষ নিয়ে। বিজ্ঞানী ডঃ কানিংহামের অধীনে কাজ করে এই ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তিনি। আলিপুরের গবেষণাগারে এই গবেষণার ফলাফল তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

বিশ্বপরিচিতি

তিনি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পশুর প্রজননে একজন অগ্রদূত ছিলেন আর এই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পশুর প্রজনন সম্পর্কিত একটি পুস্তক লিখেছিলেন - ‘এ হ্যান্ডবুক অব দ্য ম্যানেজমেন্ট অব অ্যানিম্যালস ইন ক্যাপটিভিটি ইন লোয়ার বেঙ্গল (A Handbook of Management of Animals in Captivity in Lower Bengal), ১৮৯২’। এই বইটি আজও জু-ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক সারা বিশ্বে এক উল্লেখযোগ্য বই। ১৯৬৪ খ্রীস্টাব্দে লি ক্র্যান্ডল-এর ‘দ্য ম্যানেজমেন্ট অব ওয়াইল্ড ম্যামালস ইন ক্যাপটিভিটি’ প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই বইটি ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চিড়িয়াখানা রক্ষকদের জন্য 'স্ট্যান্ডার্ড হ্যান্ডবুক' বা 'মানক পুস্তিকা' হিসেবে ছিল।

১৮৯২ খ্রীস্টাব্দে তাঁর লেখা ৩৫১ পাতার বই 'A Hand-book of the Management of Animals in Captivity in Lower Bengal'-এর প্রথম ভাগে স্তন্যপায়ী প্রাণীর ও দ্বিতীয় ভাগে পাখিদের বিবরণ আছে। বিভিন্ন দেশের ২৪১ প্রজাতির বন্যপশু, ৪০২ প্রজাতির পাখি ও তাদের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে লেখা এই গ্রন্থটি আজও জীববিজ্ঞানীদের কাছে একটি মূল্যবান গ্রন্থ বলে বিবেচিত হয়।

আজও চিড়িয়াখানা পরিচালকের কাছে বইটি অনেকটা বেদ-উপনিষদ-এর মতই। চিড়িয়াখানা পরিচালনায় তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয় সমৃদ্ধ এই বইটি সেই যুগে পৃথিবীর সব জায়গার চিড়িয়াখানা তত্বাবধায়কদের কাছে ছিল একান্ত গাইড বই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তখনকার চিড়িয়াখানার দর্শনীয় জীবজন্তুর অধিকাংশই গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের। প্রসঙ্গত রামব্রহ্মের এই বইটিতে বর্ণিত অধিকাংশ প্রাণীই ছিল এই ধরনের। এই কারণে ইউরোপ, আমেরিকায় অবস্থিত অধিকাংশ শীতপ্রধান দেশের চিড়িয়াখানার জন্য তাঁর লেখা বইটি ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

Nature Magazine

রামব্রহ্ম সান্যালের এই বইটি প্রকাশের পর ৪ঠা আগস্ট, ১৮৯২ বৃটেনের 'নেচার' পত্রিকার বই সমালোচনা বিভাগ রামব্রহ্মের এই বইটিকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। 'নেচার' পত্রিকার সমালোচনার পরই রামব্রহ্মের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বন্দিদশায় পশুপাখিদের উপর রামব্রহ্মের এই বই বিশ্বের অন্যতম সেরা কাজ বলে অভিনন্দিত হয়। এখানে উল্লেখ্য, এখনও পর্যন্ত 'নেচার' পত্রিকায় খুব কম বাঙালির লেখাই প্রকাশিত হয়েছে।

Hours with Nature

১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় বই ‘আওয়ার্স উইথ নেচার’। জনসাধারণের জন্যে লেখা শিবপুর উদ্ভিদ উদ্যান, আলিপুর চিড়িয়াখানা, পশুকক্ষ, ভারতীয় জাদুঘর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য স্থানসহ বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীবজগৎ বিষয়ক একখানি তথ্যসমৃদ্ধশালী বই হল 'আওয়ার্স উইথ নেচার' (Hours with Nature)।

১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দের ৪ জুন কেমব্রিজে এক আন্তর্জাতিক প্রাণিবিজ্ঞানী সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন রামব্রহ্ম সান্যাল।

এরপর ১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দে 'ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ জুওলজি'র চতুর্থ সভায় আমন্ত্রিত হয়ে তিনি কেমব্রিজ-এ যান। ১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দের ২২শে জুন থেকে ৪ঠা সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডনে অতিবাহিত করেন। এই সময়কালে তিনি লন্ডন জুওলজিকাল সোসাইটির চিড়িয়াখানা বেশ কয়েকবার ঘুরে দেখেন। লন্ডন যাবার ফলে তাঁকে তাঁর রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের কিচ্ছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তবে সব বাধা সফলতার সাথে অতিক্রম করতে সক্ষম হন। এই সময়ে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি লন্ডনের জুলজিক্যাল সোসাইটির 'সাম্মানিক সদস্য' মনোনীত হয়েছিলেন।

সম্মেলনের পর তিনি ইউরোপের বিভিন্ন শহরের চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করেন। লন্ডন, বার্লিন, হামবুর্গ, প্যারিস, ভিয়েনার পশুশালা দেখে এসে, আলিপুর পশুশালার উন্নতি সাধনে কী কী করতে হবে তা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। একই সঙ্গে বিদেশের পশুশালাগুলির দোষত্রুটিও উল্লেখ করেছেন, বন্দি অবস্থায় প্রাণীদের সুস্থ জীবনযাপনের বিষয়ে তাঁর প্রস্তাব পেশ করেছেন বিদেশে।

এছাড়াও তিনি শিশুদের জন্য অতি সহজ, সরল ভাষায় বিজ্ঞানের একটি পাঠ্যপুস্তকও রচনা করেছিলেন যার নাম ‛বিজ্ঞান পাঠ’। ছোটদের জন্য গল্পের আকারে বিভিন্ন প্রাণী সম্বন্ধে তথ্য পরিবেশন করেছেন, যাতে তারাও জীবজন্তুদের ভালবাসতে শেখে।

Toy Train

চিড়িয়াখানার আয় বৃদ্ধির জন্য নানা পরিকল্পনা করা হত। ১৮৮০-র ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে দর্শকদের টানতে চিড়িয়াখানার ভিতরে ইলেকট্রিক ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রামব্রহ্ম ট্রেন চালানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন বার্ন কোম্পানিকে। পশুশালায় এই ছোট ট্রেন দেখতে খুব ভিড় হয়।  পূর্বপরিচিতি থাকার দরুন স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জিকে তিনি এই এই ট্রেন তৈরির দায়িত্ব দেন। বাংলার ছোটলাট স্যর অ্যাশলে ইডেন স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন সে'দিন। চিড়িয়াখানায় টিকিট বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল হু-হু করে।

তাঁর রুটিন-বাঁধা জীবনে আনন্দের মুহূর্তও এসেছে বিশেষ বিশেষ অতিথির আগমনে। আলিপুর পশুশালায় ছোটলাট, বড়লাট যেমন বেড়াতে এসেছেন, তেমনই ভারতের রাজা-মহারাজরাও আসতেন সদলবলে। চিড়িয়াখানায় ফুলের বাগান, সবুজের সমারোহ সবাইকে মুগ্ধ করত। রামব্রহ্ম তাঁদের পশুশালা ঘুরিয়ে দেখাতেন, চায়ের আসরে আপ্যায়িত করতেন।

Wazid Ali Shah
নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ

অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ মাঝেমধ্যে চিড়িয়াখানায় আসতেন এবং তাঁর জাপানি কায়দার রিকশায় পশুশালা ঘুরতেন। রামব্রহ্মর সঙ্গে পশুপ্রেমিক নবাবের কথাও হত। নবাব তাঁর ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা থেকে একটি ভারতীয় বাঘ, এক জোড়া মালয় দেশের বাঘ ও এক জোড়া চিতাবাঘ, দুটো বাঘিনি উপহার হিসেবে পশুশালায় পাঠিয়েছিলেন। কিছু রঙিন মাছও দিয়েছিলেন। নবাবের পাঠানো একটি বাঘিনিকে এক বার হামবুর্গ চিড়িয়াখানায় পাঠানোর অনুরোধ আসে। যে সব পশুপাখি বিদেশে পাঠানো হত, তাদের জন্য বিদেশে যোগাযোগ করা, যাত্রাপথে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা - সব দায়িত্বই রামব্রহ্মকে পালন করতে হত।

১৮৯১ সালের ২৭ জানুয়ারি বড়লাটের অতিথি হয়ে আলিপুর পশুশালা দেখতে আসেন রাশিয়ার জারের জ্যেষ্ঠ পুত্র। চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখে তিনি খুশি হন। তিনি গোখরো সাপ দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চিড়িয়াখানায় 'সরীসৃপ ভবন' তখনও তৈরি হয়নি। পরে বিভিন্ন মানুষের দানে এই ভবনটি তৈরি হয়।

রামব্রহ্ম সান্যালের কর্মজীবনের শেষের দিকে ১৮৯৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর স্বামী বিবেকান্দ, ভগিনী নিবেদিতাকে সাথে নিয়ে আলিপুর চিড়িয়াখানা পরিদর্শনে এসেছিলেন। জীবজন্তুদের পাশাপাশি চিড়িয়াখানায় মনোরম পরিবেশেরও প্রশংসা করেন তাঁরা। প্রাণীদের বিবর্তন বিষয়ে বিবেকানন্দের সঙ্গে রামব্রহ্মের আলোচনা হয়েছিল, জানা যায়। পদধূলি পড়েছিল শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবেরও। শোনা যায় ভারতীয় সিংহের খাঁচার সামনে এসে তিনি সমাধিস্থ হন। পরবর্তীকালে স্বামী যোগানন্দ চিড়িয়াখানা ভ্রমণে আসেন।

দি এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা
দি এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা।

'এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল' তাঁকে 'অ্যাসোসিয়েট মেম্বার' নির্বাচিত করে।

অন্য রাজ্যে পশুশালার কোনও সমস্যায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁর পরামর্শ চাইত। উপদেষ্টা হিসেবে তাঁকে বম্বে (মুম্বই) গিয়ে কিছুদিন থাকতে হয়েছিল। যেতে হয়েছিল তৎকালীন রেঙ্গুনেও।

তখনকার দিনের নিয়ম অনুসারে কর্মজীবন থেকে পঞ্চান্ন বছর বয়সে অবসর নিতে হতো। রামব্রহ্মের কর্মদক্ষতায় তাঁর ক্ষেত্রে এই নিয়মটি কার্যকরী হয়নি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি চিড়িয়াখানার সুপারিনটেন্ডেন্ট বা তত্ত্বাবধায়ক পদে আসীন ছিলেন।


'রায় বাহাদুর' পদক

চাকরি জীবনে তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'রায় বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এই খেতাব তাঁকে রাতারাতি স্বদেশে বিখ্যাত করে তোলে।

Sadharan Branho Samaj

ব্রাহ্মণ সন্তান রামব্রহ্ম সান্যাল ব্রাহ্মধর্মেরও অনুরাগী ছিলেন। কলকাতার ভবানীপুরস্থিত 'সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ' গৃহ স্থাপনে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।

জীবন সায়াহ্নে রামব্রহ্ম

রামব্রহ্ম সান্যালের পারিবারিক জীবন কিন্তু খুব একটা সুখের ছিল না। তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকে অপরিণত বয়সে হারাতে হয়। তাঁর পুত্রবধু ও নাতি-নাতনিকে নিয়ে তিনি শেষ জীবন অতিবাহিত করেন।

R. B. Sanyal with his grandson & granddaughter

১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দে একমাত্র পুত্র হেমন্তকুমারের অকালমৃত্যুতে এবং কিছুদিন পরে স্ত্রীর মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। পশুশালার কাজ তবু নিয়মমাফিক করতেন।

১৯০৮ খ্রীস্টাব্দের ১৩ই অক্টোবর তিনি প্রয়াত হন। আলিপুর চিড়িয়াখানায় তখন ৩৯০টি পশু, ৭৭৭টি পাখি, ২১৭টি সরীসৃপ।

Bear Cage
আলিপুর পশুশালায় ভালুকের খাঁচা।

মুর্শিদাবাদ জেলার নতুন মহুলায় রামব্রহ্ম সান্যালের পৈতৃক ভিটেয় প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রী নারায়ণ মন্দিরটি এখনও টিকে আছে। এছাড়াও তাঁর বাড়ির সামান্য অংশই অবশিষ্ট আছে। তাঁর বসতবাড়ির প্রায় সবটুকুই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, শুধুমাত্র একটি ভগ্নপ্রায় ঘর ও আনুমানিক ১৮১৯ খ্রীস্টাব্দে নির্মিত শ্রীশ্রী নারায়ণ মন্দির আজও সেই ঐতিহাসিক বাড়ির স্থাননির্দেশ করে চলেছে।

___________________________________
[‘আরেক রকম’ দশম বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যায় (১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২২) ইতিপূর্বে প্রকাশিত প্রবন্ধের প্রথম অংশটি পড়তে লিঙ্কে ক্লিক করুন - ‘কলকাতা চিড়িয়াখানার প্রাক ইতিহাস ও রায় বাহাদুর রামব্রহ্ম সান্যাল’]