আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ মাঘ, ১৪২৯

সম্পাদকীয়

আদানির পতন?


ভারতের অর্থব্যবস্থার হাল অতিমারির প্রকোপে বেহাল হলেও ভারতের ধনী সম্প্রদায়ের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। ২০২০ সাল, যেই বছর লকডাউনের ফলে আমাদের আশেপাশে বহু সাধারণ মানুষের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি তলানিতে ঠেকেছে সেখানে ভারতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি সম্পত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংখ্যা বেড়েছে। এই বিপুল সম্পদবৃদ্ধির কেন্দ্রে যেই নামটি সর্বাধিক বেশি আলোচিত হয়েছে, তাঁর নাম গৌতম আদানি। ২০২২ সালে গৌতম আদানি পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তির আসনে আসীন হন। আমাজনের মালিককে সরিয়ে তাঁর এই পদোন্নতি স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় গণমাধ্যমে সাড়া ফেলে।

পুঁজিপতিদের সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল তাদের কোম্পানির শেয়ারের দাম। ধরুন আপনার হাতে একটি কোম্পানির ১০০টি শেয়ার রয়েছে যার একটির দাম ১০ টাকা। তাহলে আপনার মোট সম্পদ হবে ১০০০ টাকা। এখন শেয়ারের দাম বেড়ে যদি ১২ টাকা হয় তাহলে আপনার সম্পদের পরিমাণ হবে ১২০০ টাকা। একইভাবে আদানির বিপুল সম্পদের নেপথ্যে রয়েছে তার কোম্পানিগুলির শেয়ারের দামে বিপুল বৃদ্ধি। বিগত ১ বছরে আদানির কোম্পানিগুলির শেয়ারের দাম বেড়েছে কোনোটার ১০১%, কোনোটার ১৬৭% অথবা কোনোটার ১৪৯%। বিগত ৩ বছরে আদানির শেয়ারের দাম বেড়েছে কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে ২১২১%, কোনোটার দাম বেড়েছে ১৩৯৮%। এই বিপুল হারে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির ফলেই আদানি পৃথিবীর দ্বিতীয়তম ধনী ব্যক্তি হয়েছেন।

বেশ ভালোই চলছিল আদানি সাহেবের ব্যবসা এবং শেয়ার বাজারে শেয়ারের দাম। কিন্তু ২৪শে জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থা একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে আদানির বিরুদ্ধে। এই রিপোর্টে আদানির শেয়ার বাজারে এই বিপুল মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এই কোম্পানির মতে আদানির শেয়ারগুলি ৮৫% বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। শেয়ার বাজারের জটিল গণনা করে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে আদানির কোম্পানির শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে রাখা হয়েছে। কীভাবে এই কাজ করা হয়েছে? এই রিপোর্ট অনুযায়ী আদানির কোম্পানিগুলির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে শেয়ারের একটি বিপুল বড় অংশ আদানির পরিবারের কাছেই রয়েছে, যেগুলি বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করা হয় না। অন্যদিকে, বিভিন্ন কোম্পানির কথা রিপোর্টে বলা হয়েছে যারা মরিশাসের মতন দেশে নথিভুক্ত, কিন্তু তাদের আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। এই কোম্পানিগুলির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে টাকা ঢালা হয়েছে আদানির কোম্পানিগুলির শেয়ারে, যার মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়েছে, এমনটাই অভিযোগ মার্কিন সংস্থার। রিপোর্টের শেষে ৮৮টি প্রশ্ন করা হয়েছে আদানির কোম্পানিকে।

এই রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পরে বিগত এক সপ্তাহের মধ্যে আদানির সংস্থাগুলি শেয়ারের দামে ধস নেমেছে। খবরে প্রকাশ প্রায় ৫ লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ আদানির খাতা থেকে মুছে গেছে। সমস্যা যদি শুধু আদানিকে নিয়ে হত তাহলে এত কথা বলার প্রয়োজন থাকত না। কিন্তু আদানি দেশের শুধুমাত্র একটি বৃহৎ শিল্পসংস্থা নয়। একই সঙ্গে আদানি সংস্থা সমূহ দেশের ব্যাঙ্ক, বিশেষ করে স্টেট ব্যাঙ্কের থেকে বিপুল পরিমাণ ধার নিয়েছে। অন্যদিকে ভারতীয় জীবন বিমা নিগম বা এলআইসি কর্তৃপক্ষ বিপুল পরিমাণ টাকা আদানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে রেখেছে। স্টেট ব্যাঙ্ক আদানিকে ধার দিয়েছে ৮০,০০০ কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে, এলআইসি প্রায় ৫৬,০০০ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে আদানির। আদানির শেয়ারের দামে ধস নামার ফলে এই দুই সংস্থার ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এদের শেয়ারের দামও বিপুল হারে কমেছে। সমস্যার এখানেই শেষ নয়। বহু মানুষ বর্তমানে মিউচুয়াল ফাণ্ডে বিনিয়োগ করে থাকেন। মিউচুয়াল ফান্ড ম্যানেজার-রা বিভিন্ন শেয়ারে আপনার টাকা বিনিয়োগ করে। আদানি তাদের মধ্যে একজন। অতএব আদানির শেয়ারের দাম বিপুলভাবে কমে যাওয়ার ফলে মিউচুয়াল ফান্ডের গ্রাহকদের একটি বড় অংশ লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে।

আদানির সংস্থাগুলি নিয়ে যখন বহু প্রশ্ন উঠছে, যখন বহু মানুষের বিনিয়োগ লোকসানের সম্মুখীন, এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠছে, সেই সময় আমাদের মহান কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো হেলদোল নেই। কোনো তদন্ত করার কথা তারা ভাবারও চেষ্টা করেননি, কারণ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যার বিমানে চাপেন তার বিরুদ্ধে তদন্ত করার মত বুকের পাটা দেশে কারোর নেই। বিরোধীরা যথারীতি কিছু প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু তাও চাপা পড়ে যাবে দেশের দৈনিক কোলাহলে।

কিন্তু তাই বলে আদানি চুপ থাকতে পারেন না। তাঁর সংস্থা মুখ খুলেছে। তারা স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন সংস্থার সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু এখানেই তারা থামেনি। তাদের বক্তব্য মার্কিন সংস্থার এই রিপোর্টটি আদতে ভারতের বিরুদ্ধে বানানো। ভেবে দেখুন আদানি ভাবছেন যে তার সংস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা। একদিকে সরকার নিশ্চুপ, অন্যদিকে আদানি বলছেন তাকে প্রশ্ন করা মানে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা। যদি মেনে নিতে হয় যে আদানিকে প্রশ্ন করা মানে ভারতকে প্রশ্ন করা তাহলে জাতীয়তাবাদের নামে আমাদের মেনে নিতে হবে যে আদানিদের মতন ব্যক্তিরা শেয়ারবাজারে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ালেও চুপ করে থাকাই শ্রেয়। শিল্পপতি এবং দেশ যদি সমার্থক হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে দেশে ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী হচ্ছে। বেনিতো মুসোলিনি বলেছিলেন ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সেই ব্যবস্থা যেখানে কর্পোরেট এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। আমাদের দেশে আদানির প্রতি সরকারের পক্ষপাত এবং দেশের সঙ্গে সংস্থার তুলনা মুসোলিনির ধারণাকেই যেন মান্যতা দিচ্ছে।

এখানেই যদিও কথা শেষ হয় না। শেয়ার বাজারে এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যে আদানি নতুন শেয়ার বাজারে বিক্রি করলেন। অনেকে ভাবছিলেন যে এই শেয়ার হয়ত আদানি প্রচুর টাকায় বিক্রি করতে পারবেন না। কিন্তু দেখা গেল নতুন শেয়ার বেশ ভালো দামেই বিক্রি হল। দেশের উচ্চতম ধনী, বিদেশী কর্পোরেট এবং বিনিয়োগ সংস্থা নতুন করে এই শেয়ারে অর্থ বিনিয়োগ করল সেই সময় যখন কোম্পানিটি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ড, ব্যাঙ্ক বা সাধারণ খুচরো ক্রেতার মধ্যে এই শেয়ার নিয়ে বিশেষ কোনো উৎসাহ চোখে পড়ল না। অর্থাৎ মুষ্টিমেয় কিছু ধনী ব্যক্তি এবং সংস্থার হাত ধরে আদানি তার নতুন শেয়ার বিক্রি করতে সক্ষম হলেন। কিন্তু সাধারণভাবে বাজারের খুচরো ব্যবসায়ী বা মিউচুয়াল ফান্ড এই শেয়ার বেশি কিনল না। কারা এই শেয়ার কিনল, তা স্পষ্ট নয়। তবে বোঝাই যাচ্ছে দেশের একটি বড় শিল্পপতির দুর্দিনে ধনীরা টাকা লাগিয়ে তার শেয়ার বাঁচালো। সাধারণ বিনিয়োগকারীর চোখে আদানির শেয়ার এখনও খুব আকর্ষণীয় হতে পারেনি।

আদানি ভারতে পরিকাঠামো এবং গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা কায়েম করেছে। এই একচেটিয়া ব্যবসা একদিনে শেষ হবে না, অতএব আদানির শেয়ারের প্রতি এক শ্রেণির মানুষের বিশ্বাসও চট করে চলে যাবে না। কিন্তু আদানির এই একচেটিয়া ব্যবসা কায়েম করার নেপথ্যে মোদী তথা বিজেপি সরকারের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। এতবড় অভিযোগ আসার পরেও সরকারের হিরন্ময় নীরবতা প্রমাণ করে যে সরকারের স্নেহের হাত আদানির মাথার উপরে রয়েছে। তাই মানুষ জানে যে সরকার শেষমেষ আদানির পক্ষেই থাকবে। এই স্নেহের পরশ ততদিন থাকবে যতদিন মোদী সরকার থাকবে। অতএব শেয়ার বাজারে বর্তমানে আদানির শেয়ার হু-হু করে কমলেও মোদী সরকারের অলিখিত রাজনৈতিক সমর্থন রয়েছে আদানির প্রতি। নতুন শেয়ারের বিক্রির ক্ষেত্রে দেখা গেল কর্পোরেট সংস্থা এবং উচ্চতম ধনীরা আদানির শেয়ার কিনল। এই দুই শক্তি, একদিকে ধনীদের সমর্থন অন্যদিকে মোদী সরকারের আশীর্বাদ আদানির প্রধান অবলম্বন। অন্যদিকে, আদানির শেয়ারের বর্তমান পতন প্রমাণ করছে যে বাজারের বিশ্বাস অনেকটাই হারিয়েছে আদানি। এই দুই শক্তি, একদিকে বাজার এবং অন্যদিকে রাষ্ট্র তথা ধনীদের মদত, এই দুইয়ের টানাপোড়েন কোন দিকে যায়, তাই নির্ধারণ করে দেবে আদানির ভবিষ্যৎ।