আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

‘গবলিন মোড’ ও আমাদের ভালো থাকা

নীলরতন সরকার


২০২২-এর ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ারের শিরোপা পেয়েছে ‘গবলিন মোড’!

ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার! শব্দটা প্রথম শুনেছিলাম ২০১৩ সালের শেষে। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি সে'বছর যে শব্দকে এই খেতাব দিয়েছিল, তা হল সেলফি! চমকে উঠেছিলাম। কারণ সেলফি তখনও আমাদের, অন্তত আমার কাছে খুব চেনা শব্দ ছিল না! অল্প পরেই ঘটল সেলফির বিস্ফোরণ! তার বছর তিনেক পরের কথা। আমার এক ভাগ্নির মুখে তখন সবে খই ফুটতে শুরু করেছে। খেলনা হিসেবে সে পেয়েছিল ছোট একটা আয়না। সেই আয়নাকেই বলতে শিখল সেলফি! আয়নার এই প্রতিশব্দ সেদিন আবার মনে পড়েছিল তিন বছর আগের 'ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার'-এর কথা!

ফি বছর অক্সফোর্ড ডিকশনারি এমন একটা করে শব্দ জনগণের ভোটে বাছাই করে। কেমব্রিজ, ওবেবস্টারসহ আরো কয়েকটি খানদানি অভিধান প্রস্তুতকারী সংস্থা এমন একটা করে শব্দ বেছে নেয়। অক্সফোর্ড আবার UK আর USA-এর জন্য দুটো শব্দর ফর্দ দেয়। মাঝে দু-এক বছর অবশ্য হিন্দি শব্দেরও তালিকা আসছিল। যেমন ২০১৭-তে আধার, ১৮-তে নারীশক্তি, ১৯-এ সংবিধান, ২০২০-তে আত্মনির্ভর ইত্যাদি শব্দকে 'ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার' (হিন্দি) ঘোষণা করেছিল অক্সফোর্ড ডিকশনারি। ২০২১ ও ২০২২-এর হিন্দি শব্দ অবশ্য আমার চোখে পড়েনি।

অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি কোভিড বিধ্বস্ত ২০২০-তে কোনো শব্দ বাছেনি! তাঁদের মনে হয়েছিল অস্বাভাবিক এই বছরটিকে কোনো একটি শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। অন্য দু'একটা ডিকশনারি এই তকমা দিয়েছিল প্যানডেমিক, লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন জাতীয় শব্দকে। উল্লেখ্য, অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০১৫-তেও কোনো শব্দ বাছেনি। সে বছর ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ারের তখতে বসানো হয়েছিল একটা ইমোজিকে - হাসতে হাসতে চোখ থেকে জল পড়ার ইমোজি! বলা বাহুল্য ইমোজি শব্দটাও আমাদের জগতে তখন নতুন। সেবারই প্রথম নয়। ২০১২-র 'ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার'-এর মার্কিন সংস্করণে GIF-কে দেওয়া হয়েছিল শব্দর পরিচিতি ও একইসঙ্গে 'ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার'-এর গরিমা! (আশা করা যায় অচিরেই কোনো বছর এই খেতাব পাবে RIP জাতীয় শব্দ-সংক্ষেপণ)। যদিও ভাষাবিদদের একটি অংশ বিগত এক দশক ধরে বলে আসছেন ভাষার সংকটের কথা। আশঙ্কা করছেন, মানবমস্তিষ্কের যে অংশ ভাষা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে। কেননা শব্দর জগৎ দিনে দিনে চিত্রর দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে চলেছে। 'ইমোজি' যে শব্দর জগতে থাবা বসিয়েছে ২০১২ আর ২০১৫-র অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির 'ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার' তা বুঝিয়ে দেয়।

একটি বিষয় লক্ষণীয় ইমোজি বা GIF দুটোই বৈদ্যুতিন যোগাযোগের মাধ্যম। আরো স্থিরভাবে বললে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বিগত এক দশকে সামাজিক মাধ্যমের এই জগৎটি বিকল্প এক সমান্তরাল দুনিয়া বানিয়ে তুলেছে। এর বাইরে থাকা অগণিত মানুষ এই দুনিয়ার হাল-হকিকত আদব-কায়দার সঙ্গে পরিচিত নন। সামাজিক মাধ্যমে সাময়িকভাবে কোনো কোনো শব্দ ভেসে ওঠে আবার তলিয়ে যায়। হালে প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের একটি অংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় সড়গড় হয়ে উঠলেও, এই দুনিয়া-বিশেষ মুখ্যত যুবক-যুবতীদের দখলে। আর সম্ভবত সেই কারণেই ২০১৭-তে 'ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার'-এ এসেছিল 'youthquake' বলে একটা শব্দ। earthquake-এর অনুসরণে youth ও‎ quake-এর যোগে তৈরি করা একটি শব্দ! নতুন বানিয়ে তোলা এই শব্দটির অর্থ বলা হয়েছে ‘a significant cultural, political, or social change arising from the actions or influence of young people’। ভার্চুয়াল দুনিয়ার যুবক-যুবতীদের ক্রিয়াকলাপ সামাজিক-রাজনৈতিক চৌহদ্দিতে গুরুত্বপূর্ণ কী বদল আনছে বিগত দশ বছরের ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ারের তালিকা থেকে তার একটা হদিশ পাওয়া যেতে পারে! বিগত এক দশকের শব্দগুলি কোনো-না-কোনোভাবে ভার্চুয়াল দুনিয়ার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। সামাজিক-রাজনৈতিক বদলের কথা বলা হয়েছিল, তাও কি কেবল এই ভার্চুয়াল জগতেই! এ প্রসঙ্গে কেমব্রিজের ২০১৮-র ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ারের শব্দটির দিকে তাকানো যাক। সে'বছর যে শব্দটিকে কেমব্রিজ এই খেতাব দিয়েছিল তা হল 'নোমোফোবিয়া' (nomophobia)। এটা বোঝায় এমন এক মানসিক অবস্থা, যখন কারো মনকে এই রকম একটা আশঙ্কা গ্রাস করে যে তার মোবাইল ফোন সংযোগ-বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। ফোনটা সচল অবস্থায় হাতের কাছেই আছে কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই - অনেকক্ষণ কোনো মেসেজ আসছে না, ফোন আসছে না, কোনো নোটিফিকেশন পাওয়া যাচ্ছে না। এই উৎকণ্ঠাই নোমোফোবিয়া। না, কোনো গ্রিক বা লাতিন উৎস থেকে নোমোফোবিয়া শব্দর উদ্ভব নয়। এটি তৈরি হয়েছে ‘No Mobile Phone’ শব্দবন্ধর প্রথম দুটি করে বর্ণ জোড়া লাগিয়ে। সেই ধারাতেই ২০২২-এ দেখা গেল ‘গবলিন মোড’ শব্দটি ‘জনতা’র (মোট ৯৩ শতাংশ) ভোটে 'ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার'।

গবলিন মোড সম্পর্কে নানা দেশের পত্রপত্রিকায় ইতিমধ্যেই অনেক কথাই লেখা হয়েছে। জানা যাচ্ছে ২০০৯ থেকে এই শব্দর প্রয়োগ শুরু। সচরাচর এইভাবে বলা হয়, ‘আমি গবলিন মোডে আছি’, ‘আমি গবলিন মোডে চলে গেছি’, ‘ও গবলিন মোড আড়াল করছে’ ইত্যাদি। গবলিন ইউরোপীয় রূপকথার এক দৈত্যর নাম। লোককথার গবলিন এক কুৎসিতদর্শন লোভী দানব, যে গুমোট-ঘিঞ্জি কোনো জায়গায় চূড়ান্ত নোংরাভাবে বসবাসে অভ্যস্ত। বিভিন্ন গল্পে দেখা যায় গবলিন নিজের ইচ্ছেমতো রূপ বদল করতে পারে। কিন্তু গবলিন আসলে অলস ও নোংরা এক অসামাজিক দৈত্য। আর গবলিন মোড - অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী - সমাজের নিয়ম-কানুন, রীতিনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেওয়া, আলসে, অপরিচ্ছন্ন, সামাজিকতা বিরোধী হয়ে ওঠা। এবং সেই জন্য মনে কোনো গ্লানি বা কুণ্ঠাবোধ না রাখা। এক কথায় আমি আমার মতো।

বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আমি আমার মতো এই কথাটা বলবার ধক সব্বার থাকে না। প্রতি মুহূর্তে এমন এক ‘আমি’-র নির্মাণ হতে থাকে, যার সঙ্গে একান্ত আমি-টির সবসময় মিল থাকে না। বিশেষত ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে প্রায় সকলেই - হয়তো অজান্তেই - নিজেকে, নিজের পারিপার্শ্বিককে একটু মনোহর করে তুলতে চান। এমন তরিকাও সহজলভ্য, যা নিতান্ত আটপৌরে সাধারণ ছবির খোল-নলচে বদলে দিতে পারে, ছবির দৃশ্যপট পর্যন্ত বদলে ফেলা সম্ভব। কারিগরি বিদ্যার সুবাদে নর্দমাকেও নন্দনকানন বানিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়া যায়। তলিয়ে ভাবারও দরকার নেই, বিগত বছরগুলির অভিজ্ঞতা বলে এই সমস্ত কারিকুরির উদ্দেশ্য একটাইঃ আমি যা ছবিতে, বাইরের দুনিয়ায় আরো আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করা!

এই অবস্থায় গবলিন মোডের অর্থ জেনে বিষয়টা প্রথমে খুব বৈপ্লবিক মনে হতে পারে। মনে হতে পারে প্রদর্শনকামী-অসুস্থতা কাটিয়ে গবলিন মোডের ধারণা সত্যি হয়তো কোনো অন্তর্ঘাত তৈরি করছে। কবি বলেছিলেন ‘এ আমির আবরণ সহজে স্খলিত হয়ে যাক’! সামাজিক মাধ্যমে এই কাজ বোধহয় এক রকমভাবে শুরু হল! কিন্তু বিষয়টা আদপেই কি তাই!

২০২০-তে করোনা অতিমারি ও লকডাউনে গোটা ব্যবস্থাটাই হয়ে গেছে ‘আমি’-কেন্দ্রিক। সামাজিক সংহতি চুলোয় গিয়ে এসেছে সামাজিক দূরত্বর মাহাত্ম্য। এমনকি স্কুল-কলেজ-অফিসে যে সামাজিক যাতায়াত ছিল, তাও ভেঙে পড়েছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম এখনও অনেক অফিসে বহাল তবিয়তে বিরাজমান! বিশেষত যাঁরা তথ্যপ্রযুক্তির কাজের সঙ্গে যুক্ত এটাই তাদের কাছে নিও নর্মাল! নতুন স্বাভাবিকতার সামজিক রীতিনীতিও নতুন। নতুন রীতিনীতিতে আমাদের জীবন হয়ে উঠেছে আরো অনেক বেশি আত্মসর্বস্ব। সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উত্তরণ মানুষকে নিজেকে নিয়ে ভাববার অবকাশ দিয়েছিল। ব্যক্তি বিষয়টার গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছিল সমাজে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর তরুণ ওমে শিল্প-সাহিত্যর জগৎ নতুন জীবন পেয়েছিল। কিন্তু শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যে এক সময় অনিবার্যভাবেই ব্যক্তিসর্বস্বতায় পর্যবসিত বিগত দুই-তিন শতাব্দী তার অজস্র দৃষ্টান্ত দেখেছে। বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের তাগড়াই মহত্ত্বগুলি ক্রমে বিদায় নিয়ে স্থায়ী হয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বেশুমার টাকা কামাবার ফন্দিফিকির। সমাজ সংসার চুলোয় যাক শুদ্ধু নিজে ভালো থাকবার অনির্বচনীয় হুন্ডির খানাতল্লাশি।

বিশেষত ভারতের মতো দেশে যেখানে সামন্ততন্ত্র অক্ষুণ্ণ রেখে পুঁজিবাদের বিকাশ হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদের হাত ধরে, যার খানিক গুড় চুইয়ে পড়েছে মধ্যবিত্ত জনপিণ্ডে, সেখানে তা ব্যাধির পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২২-এর ক্ষুধা-সূচকে ভারতের জায়গা আরো কয়েক ধাপ নেমে এখন ১০৭! দেশজোড়া বেকারত্ব যুবসমাজের সব থেকে কর্মক্ষম মুহূর্তগুলিকে আলসেমি আর হতাশায় মুড়ে ফেলছে! ফলত দেশের একটা বড় অংশ বাধ্যত গবলিন মোডের মধ্যেই রয়েছে। অপরিচ্ছন্ন, অপরিসর ঘুপচি কোনো ঘরেই নিজেদের এলোমেলো অস্তিত্ব নিয়ে সেঁধিয়ে আছে! অথচ সামাজিক মাধ্যমে একটা শ্রেণির কাছে মহার্ঘ হয়ে উঠেছে দেখনদারি গবলিন মোড! গবলিন মোডের মতো শব্দ সহজেই এই সমাজে আবেদন তৈরি করে নিতে পারে, যার মধ্যে দিয়ে এলোমেলো থাকার পাশাপাশি চলতে পারে নানা কিসিমের নীচতা, ঘৃণ্যতার বিজ্ঞাপন। ব্যক্তিসর্বস্বতার ধুয়োতেই এই সব কাজ ন্যায়সঙ্গত ভিত্তি পেতে পারে, থাকতে পারে যার একটা গালভারী নাম গবলিন মোড! সেটাই হতে পারে একটি বৎসরের পরিচয়-বাচক শব্দও!

এরপরও যে প্রশ্ন থাকে তা হলো এই জীবনযাত্রার উদ্দেশ্য কী! এমন প্রশ্নই করেছিল ভ্লাদিমির। গল্পটা পাওয়া যাবে ভিক্টর সার্জের 'মেমোরিজ অফ এ রেভলুশনারি' বইয়ে। আলাদা করে গল্পটি আমাদের চিনিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। নভেম্বর বিপ্লবের অল্প পরে ১৯২০-তে জন্ম বলে সার্জ ছেলের নাম রেখেছিলেন নভেম্বর বিপ্লবের নায়ক লেনিনের নামে। ভ্লাদিমিরের শৈশব কেটেছিল নতুন সোভিয়েতে, লেনিন-স্তালিন জমানায়, সোভিয়েত যখন এক ‘নতুন মানুষ’-এর অপেক্ষা করছে।

নতুন দেশ যে নতুন এক মানুষ তৈরি করেছে সার্জ তা বুঝেছিলেন ১৯৩৬ সালে, যখন তিনি অনেক দেশ ঘুরে কিশোর ভ্লাদিমিরকে নিয়ে বেলজিয়ামে পৌঁছলেন। ব্রাসেলসের জমকালো বাড়ি আর দৈত্যাকার দোকানের পসরা বিমূঢ় করে তুলেছিল ষোলো বছরের কিশোর ভ্লাদিমিরকে। বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল, শহরের এই বড় বড় বাড়ি বা বাড়ির সামনে লাগোয়া একাধিক গাড়ি একজন মাত্র ব্যক্তির অধিকারে! হ্যাঁ-সূচক উত্তর শুনে বাবাকে সে বলে, সেই মালিক লোকটি কিসের জন্য বাঁচেন? কী তাঁর জীবনের লক্ষ্য? ভ্লাদিমিরের মনে হয়েছিল এইভাবে শুধু বড়লোক হওয়ার জন্য বাঁচা, নিজের ও সন্তানদের জন্য টাকা কামিয়ে চলাটা নিতান্ত আহাম্মকি ও অন্যায়! রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি-র কথা মনে পড়তে পারে। সোভিয়েতে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ‘এ-জন্মের তীর্থদর্শন’। যে বিষয়টা তাঁকে সবথেকে টেনেছিল তা হল ‘ধনগরিমার ইতরতা’ থেকে মুক্তি। এই রকমই মুক্ত এক কিশোর ভ্লাদিমির। শুধুমাত্র নিজের জন্য বাঁচা ও রোজগার করে সম্পত্তি বাড়িয়ে চলাই জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না নতুন সোভিয়েত এই শিক্ষাই দিয়েছিল তাঁকে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী সমাজব্যবস্থায় টাকা রোজগার ও সঞ্চয় ব্যাপারটাকে আমরা নীতিসিদ্ধ ও কর্তব্য বলেই চিহ্নিত করেছি। নিজের জন্য বাঁচাটাকেই অক্লেশে যুগধর্ম ও জীবনচর্যা বানিয়ে তুলেছি। নিজের পরিসরকে আগাপাছতলা নিটোল নিচ্ছিদ্র করতে পারঙ্গম হয়েছি। কিন্তু ভ্লাদিমির অন্য এক শিক্ষা পেয়েছিল, নতুন মানুষ হয়ে-ওঠার শিক্ষা। নতুন সোভিয়েতে সেই শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল চেতনায়-প্রেরণায়-পরিবেশে-অন্তরে। বিপ্লবের সেই দিনগুলিতে ভ্লাদিমিরের মতো তরুণদের চেতনায় তার সংক্রমণ ঘটেছিল!

বিপ্লবের এই সুসময় চিরদিন একরকম থাকে না! এক পা এগোনোর পরেই আসতে পারে দু-পা পিছিয়ে যাবার পালা - অবক্ষয়ের দিন, প্রতিবিপ্লবের কাল। বিপ্লবের শিক্ষা তখন মূল্য হারায়! বিগত কয়েক দশকে বিশ্বায়নের হাত ধরে পুঁজিবাদ তার ডালপালা সমাজের সমস্ত স্তরে এমনভাবে বিস্তার করেছে, যে ষোলো বছরের ভ্লাদিমিরের স্বাভাবিক বিস্ময়, আমাদের চোখেই অস্বাভাবিক ঠেকে! খোলা বাজারের দুনিয়ায় টাকা কামাবার ব্রতে সকলেই স্বাগত! ‘ধনগরিমার ইতরতা’ই হালের যুগধর্ম ও দেশাচার! সকলে নিজের আখের নিয়ে ব্যস্ত। অগাধ অর্থর প্রলোভন আর তা চরিতার্থ করবার জন্য অপরিমিত কাজ করে চলা - এই চক্রে সৃজনশীল অবকাশযাপনের আর পরিসর কোথায়! বিশু পাগলের মতো ‘আমাদের না আছে আকাশ, না আছে অবকাশ; তাই বারো ঘণ্টার সমস্ত হাসি গান সূর্যের আলো কড়া করে চুঁইয়ে নিয়েছি একচুমুকের তরল আগুনে’। সেই কারণেই আমাদের ভিতরকার নোংরা আলসে লোভী দৈত্য গবলিন সহজে জেগে উঠতে পারে। এমনকি নিজের আলসেমি, অপরিচ্ছন্নতাকেও কোনোরকম বর্মে ঢাকবার কোনো প্রয়োজন আমারা অনুভব করবো না! কিন্তু ভ্লাদিমিরের বিস্ময় কি মনেও থাকবে না আমাদের! গবলিন মোডেরই সংক্রমণ হয় শুধু, ভ্লাদিমিরের চেতনার নয়! না-হোক সেই চেতনার বিস্তার, কিন্তু ভ্লাদিমিরের সেই বিস্ময় আরক্ত এই সময়ে আমাদের চতুর্দিকে পরিকীর্ণ গবলিন মোডের ভিতর অতন্দ্রভাবে জেগে থাকুক! এই বিস্ময় চকিতে আমাদের মনে করিয়ে দিক এই পৃথিবীর মানুষ হিসেবে ঠিক কেমন হওয়ার কথা ছিল আমাদের!