আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

অধিকার কেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় নীতিগুলি সফল হতে গেলে

অশোক সরকার


এবার কি তবে কাউকে ভালবাসতে গেলেও অধিকারের আশ্রয় নিতে হবে? প্রশ্নটা দু'দিক থেকে মাথায় আসছে। এক দিকে ১০টি রাজ্যে ভিন্ন ধর্মে বিয়ে আটকানোর জন্য প্রশাসনকে আইনত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে কেরালা ও তামিলনাড়ুতে কর্মস্থলে কর্মীদের বসতে পাওয়ার অধিকার দেওয়ার জন্য আইন আনা হয়েছে। আর বর্তমানে রাজস্থানে নাগরিকের চিকিৎসার অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য খসড়া আইন বিধানসভায় পেশ হয়েছে, তা আইন হল বলে। এর আগে রাস্তায় হকারির অধিকার, খাদ্যের অধিকার, ১০০ দিনের কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বনজ সম্পদের উপর অধিকার, তথ্যের অধিকার, হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার - সব মিলিয়ে অধিকারের সংখ্যা তো কম হল না। উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়ের সাংবিধানিক স্বপ্নকে অধিকারের মোড়কে জনগণকে উপহার দেওয়ার চেষ্টার বয়স প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেল। কাজেই কিছু দরকারি প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে, তার আগে দেখে নিই সব মিলিয়ে হাতে কী রইল।

১৬ বছর বাদে সরকারি তথ্য থেকেই এটা পরিষ্কার, যে পাঁচটি অধিকার ১০০ দিনের কাজের আইনে স্বীকৃত হয়েছিল, তার একটাও গ্যারান্টি হয়নি। চাইলে ১৫ দিনের মধ্যে কাজ দিতে হবে, কাজ করার ১৫ দিনের মধ্যে মজুরি দিতে হবে, কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা দিতে হবে, বছরে ১০০ দিন কাজ দিতে হবে, মেয়েদের কমপক্ষে ৩৩ ভাগ কাজ দিতে হবে - এর একটাও সুনিশ্চিত করা যায়নি। এখন ১০০ দিনের কাজ একটা যোজনা হয়ে গেছে, টাকা থাকলে কাজ পাবে, কাজ চাইলে নয়। শিক্ষার অধিকারের প্রায় ১২ বছর বাদে এটা পরিষ্কার যে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় ৯৫% ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, কিন্তু কি শিখছে তার চিত্র ভয়াবহ। মাপদন্ডটাই হল পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী দ্বিতীয় শ্রেণীর বই পড়তে পারে কিনা, পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রী ভাগ করতে শিখেছে কিনা - দু'ক্ষেত্রেই ২০০৮ থেকে ২০১৮ - এই দশ বছরের মধ্যে অবস্থার অবনতি হয়েছে। ২০০৮-এ সারা ভারতে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে এমন ৫৩.৮% বাচ্চা দ্বিতীয় শ্রেণীর বই পড়তে পারত, ২০১৮-তে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৪৪%-এ। এর সঙ্গে প্রাইভেট স্কুলের রমরমা, সরকারি স্কুলে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ খালি শিক্ষকপদ, সবই আছে। রেশন ব্যবস্থায় বায়মেট্রিক আসার পরে খাদ্য সুরক্ষার মূল কথাটাই ব্যর্থ হয়ে গেছে, খাদ্য সুরক্ষা আইনে অঙ্গনওয়াড়ি সম্পর্কে যা বলা আছে, তার একটাও সারা দেশে প্রায় ১০ বছর বাদেও গ্যারান্টি করা যায়নি। ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রায় ৭-৮ কোটি বনবাসী ও জঙ্গল নির্ভর পরিবারের মধ্যে মাত্র ২১ লক্ষ পরিবার ব্যক্তিগত বনপাট্টা পেয়েছেন, সামুদায়িক পাট্টার সংখ্যা মাত্র ১ লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গে তো বন অধিকার আইন মাঠে নামেনি বললেই চলে। রাস্তায় হকারির অধিকার আইনও কাগজে রয়ে গেছে, মাঠেই নামেনি। তথ্যের অধিকার গত ১৬ বছরে বার বার তার ধার হারিয়েছে, প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১০০-র কাছাকাছি মানুষ, আক্রান্ত হয়েছেন ৩০০-র বেশি। সম্প্রতি প্রকাশিত সারা দেশের তথ্য কমিশনগুলির কাজকর্মের যে রিপোর্ট কার্ড বেরিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৩ লক্ষ ১৪ হাজার আপিল সেখানে ঝুলে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি সরকার তথ্য জানার অধিকার আইনে স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে। ১৬ বছর বাদে, হিন্দু মেয়েদের সম্পত্তির মালিকানা আদৌ কিছু বেড়েছে কিনা তা বুকে হাত দিয়ে বলাই যাচ্ছে না। ২০১৩ সালের জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন আইনে গ্রাম সভাকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল, পরে ৮টি রাজ্যে রাজ্য সরকারগুলি তা আবার নানা অছিলায় কেড়ে নিয়েছে।

অধিকারের আর অপ্রাপ্তির তালিকা আরও লম্বা করা যায়, কিন্তু ছবিটা এই দাঁড়ায় যে, অধিকারের সংখ্যা ও বহর বাড়লে যে প্রাপ্তি খুব একটা বাড়বে তা নয়। তাহলে প্রশ্ন, রাষ্ট্রকে অধিকারে বাধ্য করা সত্ত্বেও আদতে বিশেষ কিছু হচ্ছে না কেন?

হ্যাঁ এ কথা বলতেই হবে যে, ১০০ দিনের কাজ গ্রামীণ মানুষের উপকারে লেগেছে, গ্রামে তার ফলে কৃষি মজুরি বেড়েছে, কোভিড মহামারি-র সময়ে এই কর্মসূচিই গ্রামীণ মানুষের প্রধান সহায় ছিল।। তবে তার জন্য অধিকারের আইনের কোন প্রয়োজন ছিল না। তেমনিভাবে রেশন ব্যবস্থার উন্নতি খাদ্য আইন আসার আগেই কয়েকটা রাজ্যে হয়েছিল, ছত্তিসগড় তার অন্যতম।

সব মিলিয়ে অবস্থা যে খুব একটা বদলায়নি, তার একটা উত্তর হতে পারে দলতন্ত্র আর আমলাতন্ত্র আসলে নাগরিক অধিকারের ধার ধারে না, লিখিত কাগজের দৌড় আমাদের শাসন ব্যবস্থায় অতি সীমিত। তাছাড়া এটা তো ঠিক যে কেরালা, তামিলনাড়ু, হিমাচলে শিক্ষা-স্বাস্থ্য, পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কার, কেরালায় গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ - এগুলো কোনোটাই আইনি অধিকারের ভিত্তিতে হয়নি, সারা দেশজুড়ে গ্রামীণ সড়কের যে বিস্তৃত ও জরুরি পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে তার জন্য তো রাস্তার অধিকার বলে কোন আইন পাশ করতে হয়নি। আর একটা উত্তর হতে পারে যে অধিকারের ভাষা এসেছিল জনসমাজ থেকে, উপরে উল্লিখিত কোন অধিকারই মূলস্রোতের রাজনীতির কোল থেকে জন্মায়নি, জন্মেছিল জনসমাজের কোল থেকে, তাই নেতা-আমলাতন্ত্র তার মোড়কটা নিয়েই ক্ষান্ত থেকেছে।

মোড়কটা গ্রহণ করার উদ্দেশ্য এই যে রাষ্ট্রকে জনহিতকামী, প্রগতিশীল দেখানো যায়, কিন্তু কাজটা রাষ্ট্রের হাত থেকে চলে আসে জনগণের উপরে। কাজ দেয়নি, মজুরি দেয়নি, বন-পাট্টা দেয়নি, তথ্য দেয়নি, শিক্ষা দেয়নি, সম্পত্তির ভাগ দেয়নি - তুমি লড়ে নাও, তোমাকে অধিকার দেওয়া আছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই, কিন্তু অধিকার আছে, শিক্ষক নেই কিন্তু শিক্ষার অধিকার আছে, বন অধিকার রূপায়ণ করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই, অধিকার আছে। তুমি কার্ড বানাও, তুমি ফর্ম জমা দাও, তুমি দাবিদারদের তালিকা বানাও, তুমি প্রমাণ জোগাড় কর, তুমি হাতের ছাপ ঠিক কর, আধার লিঙ্ক কর, তুমি মামলা কর - অধিকার তোমার, দায়িত্ব তোমার, মাথাব্যাথাও তোমার। আর এখন তো digitization-এর নামে সুপরিকল্পিতভাবে ওই অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। পঞ্চায়েতে মানুষ কাজের খোঁজ চাইলে বলা হয়, ‘ওয়েবসাইট দেখে নাও’। রেশনে নাম উঠল কিনা উত্তর দেবে ওয়েবসাইট!

একথা স্পষ্ট যে আজকের দক্ষিণপন্থী একনায়কমুখী রাজনীতি এইসব অধিকারের মতাদর্শেই বিশ্বাস করেনা, তারা মনে করে জনগণ নিজেদের অধিকার ত্যাগ করলে তবেই নাকি দেশের উন্নতি হয়। কাজেই তাদের কথা বলছি না, বলছি প্রগতিশীলদের কথা যে দলগুলি মা মাটি মানুষ, কৃষক শ্রমিক, আদিবাসীদের কথা বলে তাদের কথা।

এই প্রসঙ্গে অধিকার কেন্দ্রিক নীতির জনপ্রিয়তার পিছনের গল্পটা বলে নিই। ৯০-এর দশকে লেবার পার্টি যখন টোনি ব্লেয়ারের হাত ধরে ব্রিটেনে ক্ষমতায় আসে তখন ব্রিটেনের থেকে দুটো তত্ত্ব জনপ্রিয় করার চেষ্টা হয়, একটা হল participatory development, আর একটা হল rights based approach. ইতিমধ্যেই কল্যাণকামী রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল - পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশে শাসকশ্রেণির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝাই যাচ্ছিল, সেই শাসকশ্রেণির হাতে কল্যাণকামী রাষ্ট্র তৈরি হওয়া সম্ভব নয়, তাই প্রশ্নটা উঠেছিল উন্নয়নশীল দেশগুলিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে নির্বাচন ছাড়া অন্য কীভাবে দায়বদ্ধ করা যেতে পারে? তার উত্তরে দুটো তত্ত্ব জনপ্রিয় হয়, এক হল জনগণ যতটা সম্ভব উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশ নিলে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ হতে পারে, আর জনকল্যাণকে যদি অধিকারের আইনি অস্ত্রে সজ্জিত করা যায়, তাহলে জনগণ সেই অধিকার প্রয়োগ করে রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ করতে পারে। এই ভাবনার অন্তর্নিহিত মতাদর্শ ছিল তা জনগণকে কল্যাণ আর উন্নয়নের নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা হিসেবে না দেখে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ও দাবীদার হিসেবে দেখে, যাতে জনগণ উন্নয়নের দিশাকে প্রভাবিত করতে পারে। এটা নিশ্চিতভাবে কাম্য।

তা হলে অধিকার কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বেশি দূর এগোনো যাচ্ছে না কেন? আমি বলতে চাইব যে দেশের আমলাতন্ত্র ও দলতন্ত্র অধিকার কেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। দলতন্ত্রকে বুঝতে গেলে নেতাদের আচরণ, ভাষণ, প্রতিশ্রুতি বিশ্লেষণ করতে হয়। এগুলির কোনটির থেকে মানুষের অধিকারের অগ্রাধিকারের কোন ছবি বেরোয় না, দলগুলি জনগণের ত্রাতা, উদ্ধারকর্তা - এই ছবি। আমলাতন্ত্রের প্রশিক্ষণ থেকে আচরণ কোনটাতেই তাঁরা যে জন-অধিকারের সেবক, জনতার শাসক নয়, এই ছবি বেরোয় না। বিডিও অফিসের সাধারণ কর্মী থেকে চিফ সেক্রেটারি - আমলাতন্ত্র প্রতি মুহূর্তে জানান দেয় তাঁরা জনগণের শাসক, সেবক নন।

অধিকারকেন্দ্রিক আইনগুলিকে মাঠে সফল হতে গেলে, সেগুলিকে নীতি ও জনসমাজের এজেন্ডা থেকে রাজনীতিতে মুখ্য জায়গা নিতে হয়, নির্বাচনী এজেন্ডার মধ্যে আসতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলির এবং তাদের সূত্রে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজনীতি সাধারণত যে ভাষায় কথা বলে তা জনতার অধিকারের ভাষা নয়, নেতাদের দয়া-কৃপার ভাষা। কোন নেতা কাকে কী দিলেন, উন্নয়নের রাজনীতি সেই পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এখন তো নেতারা ‘নিজেরা’ কী দিলেন, তার কথা বলেন, একজন নাকি রেশন দিচ্ছেন, গ্যাসের সিলিন্ডার দিচ্ছেন, আরেকজন নাকি ভাঁড়ারে টাকা দিচ্ছেন। কাজেই রাজনীতির ওই পরিসর থেকে অধিকারের রাজনীতির প্রসার হওয়া অসম্ভব। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে স্থানীয় স্তরের রাজনীতিতে যেহেতু উন্নয়নের মূল বিষয়গুলো কেন্দ্রীকতা পায়, কাজেই সেখান থেকে শুরু হতে পারে। বহু রাজ্যের স্থানীয় স্তরের অভিজ্ঞতাও তাই বলে। রাজস্থান, বিহার, কর্ণাটক, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি বহু রাজ্যে জনসমাজ যেখানে স্থানীয় স্তরের অর্থাৎ পঞ্চায়েত স্তরের রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে, সেখানেই, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজ, বন অধিকার ইত্যাদি অধিকারের ভাষা মুখ্য জায়গা পেয়েছে। এমনিতে আমাদের রাজনীতির একটা অন্যতম সীমাবদ্ধতা হল, তা জাত, ধর্ম, ভাষা, আঞ্চলিকতা-র কাঠামোয় তৈরি, যা রাজ্য বা কেন্দ্র স্তরে ক্ষমতার লড়াইতে সংখ্যার গণিতে কাজে লাগে। জনসমাজ যদি সক্রিয় হয়, তাহলে নাগরিক অধিকারের কাঠামোয় রাজনীতি তৈরি হবার সুযোগ হয়ত একমাত্র স্থানীয় স্তরেই আছে। নানা রাজ্যের উদাহরণ সেইদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

___________________________________

তথ্যসূত্রঃ

1) ASER Report 2018, page 9.
2) https://tribal.nic.in/FRA.aspx
3) Report of the Information Commissions in India, by Satark Nagarik Sanghthan 2022, page 26.