আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

জাতিভিত্তিক সংরক্ষণঃ যুক্তি ও কুযুক্তি

তৌষালী রায়না


পশ্চিমবঙ্গের সমাজ জীবনে এবং রাজনীতিতে জাতপাত একটি কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় নয়। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু বা পাঞ্জাবের মতো ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এখানে জনজীবনে জাত-পাত খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে কেউ মনে করে না। ফলত কোনোরকম সামাজিক-রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক আলোচনাতে এই বিষয়টি উঠেও আসে না। জনজীবনে জাতপাতের প্রভাবের আপাত অবর্তমানে পশ্চিমবঙ্গকে বাকি ভারতের তুলনায় ব্যতিক্রমী মনে হয়।

কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে জনজীবনে বিশেষত ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলার মানুষ জাতি পরিচিতির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করে। পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপণগুলি দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে বাঙালী আসলে জাতপাত সম্পর্কে সচেতন। জনজীবনে জাতপাতের গুরুত্ব এবং প্রভাব বোঝার অনেক ধরনের সূচক আছে। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য থেকে শুরু করে জাতপাতের রাজনীতিককরণ; সবই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে জনজীবনে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের কী প্রভাব তা হয়তো কিছুটা কম আলোচিত হয়েছে। সংরক্ষণ সম্পর্কে জনমানসে ধারণা এবং তার রাজনৈতিক অভিব্যক্তি এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। গবেষণার কাজে ক্ষেত্রসমীক্ষার সময়ে নেওয়া সাক্ষাৎকারের বিশ্লেষণের সাহায্য সহকারে আমি এই প্রবন্ধটি লিখছি।

জাতিভিত্তিক সংরক্ষণঃ ক্ষেত্রসমীক্ষা কী বলছে?

ক্ষেত্রসমীক্ষার জন্য বর্ধমানের একটি গ্রাম বেছে নেওয়া হয়েছিল। মোট ২৫০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিলো যাদের মধ্যে জাতি ও ধর্ম ভিত্তিক সমান প্রতিনিধিত্ব আছে।

সাক্ষাৎকারীদের মধ্যে যারা উচ্চবর্ণের তাদের অধিকাংশ (৯৭%) জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্যই করেছেন। তাদের বক্তব্যের নির্যাস হলো এই যে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এবং বিশেষত চাকরির ক্ষেত্রে তফশিলী জাতি, উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীগুলির আসন সংরক্ষণ এর ফলে অন্যান্য ‘জেনেরাল (সাধারন)’ মানুষদের বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই বৈষম্যের ধরণ বিভিন্ন রকম। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের মনে হয়েছে যে তারা পিছিয়ে পড়ছে। যদিও সমীক্ষাতে প্রমাণিত যে তাদের মাসিক আয় এবং পারিবারিক সম্পদ অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীগুলির থেকে বেশি।

গ্রামে যেখানে দলিত পরিবারগুলির গড় মাসিক আয় ৪,৭৭৯ টাকা সেখানে উচ্চবর্ণের গড় মাসিক আয় ১৭,৩০৭ টাকা। অথচ উচ্চবর্ণের ধারণা যে পাবলিক সেক্টরে এবং শিক্ষায় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে ‘শ্রেণি’ ‘জাতিগোষ্ঠী'র থেকে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। সংরক্ষণের ইতিহাস ও লজিক বা যুক্তি বিশ্লেষণ করলেই সহজে বোঝা সম্ভব যে জাতিভিত্তিক বৈষম্যের উপস্থিতিতেই সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। অর্থনৈতিক সংরক্ষণ নিঃসন্দেহে কার্যকরী হতো যদি ভারতবর্ষে বৈষম্যের মাপকাঠি শুধুমাত্র শ্রেণিতে সীমাবদ্ধ থাকতো। কিন্তু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে শ্রেণিভিত্তিক শোষণই একমাত্র মাপকাঠি নয়। এই দেশে হাজার বছর ধরে চলে আসা জাতিপ্রথার ভিত্তিতে বৈষম্য সমাজের সমস্ত স্তরে অসমতা তৈরি করেছে।

বর্ণব্যবস্থার স্বরূপ ও সংরক্ষণ

ভারতবর্ষে জাতি পরিচিতির ভিত্তিতে অত্যাচার এবং সমস্ত ধরনের বৈষম্য বহুকাল ধরে চলে আসছে। জাতিভিত্তিক সামাজিক ভাগ জনসংখ্যার এক বিশাল অংশকে চিরকাল সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। হিন্দু বর্ণব্যবস্থায় সবথেকে নিচে থাকা দলিতরা উচ্চবর্ণের আধিপত্যের তলায় চাপা পড়ে থেকে গেছে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী এই বর্ণ ব্যবস্থা ব্রহ্মার সৃষ্টি এবং এই ব্যবস্থা অনুযায়ী ব্রাহ্মণ-রা ব্রহ্মার মাথা থেকে, ক্ষত্রিয়রা ব্রহ্মার হাত থেকে, বৈশ্যরা কোমর থেকে এবং শুদ্ররা পায়ের তলা থেকে তৈরি হয়েছে।

শুধু তাই নয়, এই ব্যবস্থা প্রজন্মান্তরেও অপরিবর্তনীয়। এই ব্যবস্থার সাথে কর্মের সুনিবিড় যোগ আছে। শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে এই কর্মের বিভাজন। শাস্ত্রমতে একজন ব্রাহ্মণ যেহেতু ঈশ্বরের মাথা থেকে সৃষ্ট তাই মস্তিষ্কের যা কাজ তারা তাই করবে অর্থাৎ মেধা এবং জ্ঞানের ওপর তাদের অধিকার থাকবে। শূদ্ররা যেহেতু পা থেকে তৈরি এবং পায়ের তলা যেহেতু সবথেকে বেশি নোংরা হয় কারণ তা মাটির ধুলোবালি এবং অন্যান্য জিনিসের সংস্পর্শে আসে তাই সমাজের যে সমস্ত কাজে নোংরা ঘাঁটতে হয় সেই সমস্ত কাজ শূদ্রদের জন্য নির্ধারিত।

হিন্দু শাস্ত্রগুলিতে কর্মের ধরনের সাথে কর্মীর দেহের এবং স্বত্ত্বার একাত্মকরণ করা হচ্ছে। যেহেতু একজন শূদ্র নোংরা ঘাঁটছে তাই তার দেহ এবং সত্ত্বাও নোংরা এবং অপবিত্র। এবং এই অপবিত্র দেহ বা সত্ত্বা যদি কোনোভাবে ব্রাহ্মণদের, যারা মেধাচর্চা অর্থাৎ পবিত্র কাজ করছে, তাদের সংস্পর্শে আসে তাহলে তাদের দেহ এবং সত্ত্বাও অপবিত্র বা নোংরা হয়ে যাবে। এই ব্যবস্থার কোনোভাবেই কোন পরিবর্তন সম্ভব নয়। অর্থাৎ যে একবার শূদ্র হয়ে জন্মেছে সে কোনোদিনই জাতিব্যবস্থার বাইরে যেতে পারবে না এবং উচ্চবর্ণীয়ও হতে পারবে না। সুতরাং এক্ষেত্রে বোঝার কোন অসুবিধা থাকার কথা নয় যে হিন্দু শাস্ত্রকে কাজে লাগিয়ে যে কর্মের ভাগ এবং কর্মীর ভাগ করে দেওয়া হয়েছে সেখানে যে কাজটা একজন দলিতকে অন্য কোনো কাজ করার অধিকার দেয় না। এবং যুগ যুগান্তর ধরে এই ব্যবস্থাই চলে এসেছে।

দলিতদেরকে মেধাচর্চা করার বা অন্য কোনো কাজ করার অধিকার দেওয়া হয়নি। মেধাচর্চার বিষয় এবং তা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে যায়। সুতরাং মেধাচর্চা যদি একটিমাত্র জাতি তাদের কুক্ষিগত করে রাখে তাহলে অন্যান্যদের সাথে বৈষম্য করা হয়। একজন দলিত যার কাজ ঠিক করে দেওয়া হয়েছে মৃতদেহ পোড়ানো বা নর্দমা পরিষ্কার করা, যার থেকে শিক্ষার সু্যোগ ছিনিয়ে নিয়েছে উচ্চবর্ণের আধিপত্য তার পক্ষে মেধাচর্চা করা সম্ভব নয়। ঠিক এই শিক্ষার প্রশ্নে বাবাসাহেব আম্বেদকার যুক্তি দিয়েছিলেন যে স্বাধীন ভারতে আগে সবাইকে শিক্ষার অধিকার দেওয়া হোক কারণ শিক্ষার অধিকার না থাকলে একজন মানুষের বিকাশ হওয়া সম্ভব নয়। উচ্চবর্ণের অত্যাচার তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। দলিতদের যদি আইন দ্বারা প্রতিস্থাপিত নিয়ম করে শিক্ষার সুযোগ না দেওয়া হয় তাহলে হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষেরা কোনওদিনই দলিতদের সেই সুযোগ দেবে না। সুতরাং আসন সংরক্ষণ সমাজের অন্যান্য মানুষদের সাথে বৈষম্য নয় এইটা হাজার বছরের ঐতিহাসিক অত্যাচার এবং বৈষম্যের প্রক্রিয়াকে বদলানোর প্রচেষ্টা।

আমেরিকান রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ জন রোলস তাঁর বিখ্যাত ন্যায়বিচার-এর তত্ত্বে বলেছেন যে কোন বিভক্ত সমাজে যেখানে কিছু মানুষ এগিয়ে থাকে এবং কিছু মানুষ পিছিয়ে থাকে। এই পিছিয়ে থাকা মানুষদের যদি এগিয়ে আনতে হয় এবং সবাইকে সমান জায়গায় আনতে হয় তাহলে পিছিয়ে রাখা মানুষদের কিছু বিশেষ অধিকার প্রয়োজন। রাজনীতিবিদ্যার ভাষায় একে ‘positive discrimination' বলা হয়। যদিও জন রোলস ভারতবর্ষের সংবিধান তৈরির সময় ছিলেন না বা তাঁর এই তত্ত্বও তখন প্রকাশিত হয়নি কিন্তু আসন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই যুক্তিই বাবাসাহেব আম্বেদকারও দিয়েছিলেন। জাতের ভিত্তিতে বিভক্ত সমাজে যদি জাতিব্যবস্থার ফলে নিপীড়িত মানুষদের সমাজের অন্যান্য এগিয়ে থাকা মানুষদের তুলনায় বিশেষাধিকার না দেওয়া হয় তাহলে তাদের পক্ষে অন্যান্যদের সমান জায়গায় আসা সম্ভব নয়।

তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে এই নিয়ম কোনো দয়াপরবশ হওয়ার জায়গা থেকে বানানো হয়নি। যেহেতু এতবছর ধরে কিছু জাতিগোষ্ঠীকে অবদমিত করে রাখা হয়েছিল এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কোনো ক্ষেত্রেই প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া হয়নি, তাই পাবলিক সেক্টরে তাদের দৃশ্যমান্যতা এবং প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ন্যায়প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো সংরক্ষণের আসল উদ্দেশ্য।

উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ বিরোধিতার কারণ শুধুমাত্র তাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়। ‘নীচু জাত’ হয়ে কেন উচ্চবর্ণের সমান বা প্রায় সমান রোজগার করবে সেই ক্ষোভ থেকেও এই বিরোধিতার জন্ম। এর সাথেই তারা যে দলিতদের সামাজিক অগ্রসরতারও বিপক্ষে তাও তাদের মন্তব্যে স্পষ্ট। অর্থনৈতিক পুঁজি স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক পুঁজির বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। সামাজিক পুঁজি যা এতদিন একচ্ছত্রভাবে উচ্চবর্ণ উপভোগ করেছে তা সংরক্ষণের ফলে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এমন মন্তব্যও বর্তমান। অর্থাৎ শাস্ত্রের জোরে যে বিশেষাধিকার উচ্চবর্ণ ঐতিহাসিকভাবে ভোগ করে এসেছে তা ‘নীচু জাত’-এর সাথে ভাগ করে নেওয়া তাদের পছন্দ নয়। “ব্রাহ্মণদের যে মর্যাদা দেওয়া আছে হিন্দুধর্মে তা যদি সব জাতকেই দেয় তাহলে কী করে ধর্মরক্ষা হবে”। এই মন্তব্যের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট যে হিন্দুধর্মের বেঁচে থাকার জন্য মর্যাদার জাতিভিত্তিক বিভাজন প্রয়োজন। বলে রাখা দরকার যে এই ধরনের মন্তব্য যেখানে শাস্ত্রমত প্রাধান্য পেয়েছে তা আরো অনেকের মুখেই উচ্চারিত হয়েছে। এই ধরণের বর্ণবাদী মন্তব্য পশ্চিমবঙ্গের মতো ‘ব্যতিক্রমী’ রাজ্য; যেখানে গণতান্ত্রিক, উদার এবং প্রগতিশীল আদর্শ এতদিন ধরে লালিত হয়েছে সেখানে শুধুমাত্র দুঃখজনকই নয় আশঙ্কাজনকও। এই ধরনের ধারণা পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীলতাকে এবং অনন্যতাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে।

‘ভদ্রলোক’ কারা?

সংরক্ষণের প্রশ্নের সাথে আরেকটা প্রশ্ন যেটা জড়িয়ে আছে বলে সমীক্ষায় দেখা গেছে তা হলো মেধা। প্রায়শই শোনা যায় যে সংরক্ষণের ফলে নিম্নমেধার বাড়বাড়ন্ত চলছে। সমীক্ষার জন্য নির্বাচিত গ্রামটিতেও মেধা সংক্রান্ত বর্ণবাদী মন্তব্য নথিভুক্ত হয়েছে। গ্রামটিতে বেশীরভাগ উচ্চবর্ণ এবং মধ্যবর্তী জাতি গোষ্ঠীভুক্ত পরিবারের সন্তানেরা বর্ধমান শহরে ইংরাজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ে। দলিত জাতিগোষ্ঠীর পরিবারের সন্তানেরা গ্রামেরই এক সরকারী স্কুলে পড়ে। অর্থনৈতিক পুঁজির অভাবে দলিত পরিবারগুলির পক্ষে প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষালাভ সম্ভব হয় না। দলিত পরিবারগুলির বাচ্চাদের শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে এই অসমতার কারণ আলোচনা প্রসঙ্গে মন্তব্য আসে যে শহরের স্কুলগুলিতে “ভদ্রলোকদের ছেলেমেয়ে পড়তে যায়, ওখানে পড়তে গেলে মাথায় কিছু থাকা দরকার”। এই মন্তব্যের বিশ্লেষণ বহুমুখী। প্রথমত, এই মন্তব্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে যে ইংরাজি মাধ্যমের স্কুলগুলিতে পড়তে গেলে ‘ভদ্রলোক’ হতে হয় যা দলিতরা নয়।

‘ভদ্রলোক’ শব্দটি পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভদ্রলোক বলতে আসলে কী বোঝায়? বাংলা অভিধান অনুযায়ী এর মানে হলো যে লোক আচার-আচরণে ভদ্র। অর্থাৎ ভালো মানুষ। কিন্তু অভিধানের বাইরে গিয়ে এই শব্দের এক ইতিহাস আছে। বাংলার ভদ্রলোক ছিল 'ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ফসল'। (তিথি ভট্টাচার্য, ২০০৫; পার্থ চ্যাটার্জি, ১৯৯৮ : ৭০)। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তারলাভের ফলে যে নতুন অর্থনৈতিক সুযোগগুলি উন্মোচিত হয়েছিল তার বেশিরভাগই উচ্চবর্ণের হিন্দুরা দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। ভূমি সম্পত্তি বা বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকার সাথে সাথে পাশ্চাত্য শিক্ষা ছিল বাংলায় ভদ্রলোক হওয়ার পূর্বশর্ত। সম্মান অর্জন করাও এই বিষয়গুলির ওপরে নির্ভরশীল ছিল। অচিরেই ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈদ্য জাতিগোষ্ঠীগুলি তাদের জমির মালিকানা, শিক্ষা এবং সামাজিক পুঁজি অর্জনের মাধ্যমে ভদ্রলোক শ্রেণিতে পরিণত হয়। যদিও ভদ্রলোক শ্রেণির এই সংজ্ঞা নিয়ে অনেক দ্বিমত আছে। জন ম্যাকগুয়ের (১৯৮৩) দেখিয়েছেন কিভাবে ঔপনিবেশিক পুঁজির আবির্ভাবের ফলে হিন্দুধর্মের জাতিগত বিভাজন খানিকটা হলেও শিথিল হচ্ছিল। এর ফলে ‘নীচু জাতের’ মানুষেরাও ভদ্রলোক শ্রেণিতে প্রবেশ করছিলেন। দীপেশ চক্রবর্তী তার ‘মনোরথের ঠিকানা’ বইটিতে আলোচনা করেছেন যে উচ্চবর্ণের তিনটি জাতি গোষ্ঠীর বাইরেও ভদ্রলোক শ্রেণির লোক ছিলেন। তিনি ভদ্রলোক শ্রেণিকে ‘aspirational category’ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এতে জাতি পরিচিতির ছাপ রয়েছে ঠিকই তবে এটি একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয় যা দিয়ে ভদ্রলোক-কে সংজ্ঞায়িত করা যায়। তিনি যুক্তি দেন যে শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে, 1) কাউকে সম্মান করার শর্তাবলী 2) কাউকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে। যখন আমরা কাউকে একজন ভদ্রলোক হিসাবে বর্ণনা করি আমরা মূলত মনে করি যে এই ব্যক্তি এমন কেউ যাকে সম্মান করা যেতে পারে। এই অনুভূতিসম্মান ব্যক্তির নম্র আচরণ, শিক্ষা এবং সাধারণ সভ্যতা থেকে উদ্ভূত হয়। কিন্তু ভদ্রলোক শ্রেণির মধ্যে তিনটি উচ্চবর্ণের শক্ত ঘাঁটি অস্বীকার করারও কোনো জায়গা নেই। তিনটি উচ্চবর্ণের জাতিগোষ্ঠী জনসংখ্যার মাত্র ১০% গঠন করেছিল। কিন্তু এই তিনটি জনগোষ্ঠী অচিরেই নবগঠিত ভদ্রলোক শ্রেণির মধ্যে এবং বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের উপর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলে।

উপরিউক্ত মন্তব্যে এই ইতিহাসেরই ছাপ স্পষ্ট। কথাটি যেহেতু একজন উচ্চবর্ণের মানুষ বলেছেন, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে যে তিনি ভদ্রলোক এবং উচ্চবর্ণ-কে সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। ভদ্রলোক মানেই উচ্চবর্ণ এবং তাদের স্বাভাবিকভাবেই সেই সমস্ত গুণাবলী থাকবে যা শহরের ইংরাজি মাধ্যমের স্কুলগুলিতে শিক্ষালাভের জন্য প্রয়োজন। এই গুণাবলী অনেক কিছু হতে পারে, যার কোনোটাই দলিতদের নেই, সুতরাং তারা একাধারে ভদ্রলোক হওয়ারও যোগ্য নয় এবং সেই সূত্রে ভদ্রলোকদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করারও যোগ্য নয়।

দলিত ও মেধা

এই মন্তব্যেরই দ্বিতীয় ভাগে আসে দলিতদের মেধার কথা। তাদের মাথায় কিছু নেই - এই ধরণের মন্তব্য একাধারে শ্রেণি ঘৃণা ও বর্ণবাদের ফল। দলিতদের যে মেধা নেই এবং এর ফলে যে উচ্চশিক্ষার ক্ষতি হচ্ছে এই ধরনের বক্তব্য সমীক্ষায় বারংবার উঠে এসেছে। এই তর্কের উৎপত্তি হয় উচ্চশিক্ষা এবং চাকরীর ক্ষেত্রে নির্বাচন যোগ্যতা যেহেতু জাতিগোষ্ঠী ভিত্তিক আলাদা হয় তাই। আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে মেধাচর্চা কীভাবে সমাজের একটিমাত্র অংশে বছরের পর বছর ধরে কুক্ষিগত ছিল এবং অনেকাংশে এখনো আছে।

একথা ঠিকই যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে এই শিক্ষার অধিকার নিয়ে সংগ্রামও হয়েছে। পন্ডিতা রমাবাই, সাবিত্রীবাই ফুলে, জ্যোতিবা ফুলে এবং আম্বেদকার সবাই শিক্ষার অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। অনেকাংশে সফলও হয়েছেন কিন্তু দলিতদের প্রতি উচ্চবর্ণের যে ঘৃণা এবং তা থেকে উৎপন্ন যে হিংসাত্মক আচরণ তা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দলিতদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিলো যে স্বাধীনোত্তর ভারতে যে দলিত প্রথমবার শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে তার পক্ষে এতো বছর ধরে মেধাচর্চা করা উচ্চবর্ণের সাথে প্রতিযোগিতা করা সবসময়ে সম্ভব নয় কারণ সে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাচর্চার বা মেধাচর্চার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে দলিত পড়ুয়াদের বুদ্ধি বা মেধা যে কোনো অংশেই অন্য কোনো প্রিভিলেজড জাতিগোষ্ঠীর থেকে কম নয় তার প্রচুর উদাহরণ ভারতের ইতিহাসে নথিভুক্ত আছে। কিন্তু প্রশ্নটা দলিতদের মেধা আছে না নেই সেটা নিয়ে নয়।

মানুষ মাত্রেই তার কোনো না কোনো মেধা থাকবে। প্রশ্নটা তারা মেধা চর্চার সমানাধিকার পাচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে। ভারতীয় রাজনৈতিক তাত্বিক গোপাল গুরু বলেছেন যে দলিতদের যেই প্রতিকূলতার মধ্যে শিক্ষাচর্চা করতে হয় তাতে কোনোভাবেই তাদের মেধার বিচার হয় না। একজন সাফাই কর্মীর পরিবারে যখন কেউ প্রথমবার স্কুলে যায় তখন তাকে তার বাড়িতে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা করার ব্যাপারে সাহায্য করার মতো কেউ থাকে না কারণ সেই পরিবার নিজেই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারেনি। সেই জায়গায় একজন ব্রাহ্মণ পরিবারের কোনো সন্তান যখন বিদ্যালয়ে বা আরো উচ্চশিক্ষার জন্য যায় তার বাড়িতে সে সেই পরিবেশ পায়। সে শুরুই করছে কয়েক ধাপ এগিয়ে। এই কারণেই বাবাসাহেব আম্বেদকারের যুক্তি ছিলো যে দলিতদের যেহেতু ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই তাদের এগিয়ে আসার জন্য সময় দরকার। দলিতদের মেধা নেই বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তারা পিছিয়ে থাকে তা নয়। যদিও এখানে মেধা কী এবং তার বিচার কীভাবে করা সম্ভব তা নিয়ে অনেক তর্কের অবকাশ থাকে কিন্তু একথা অগ্রাহ্য করা যায় না যে পাঁচ পুরুষ ধরে যে পড়াশুনা করছে আর যে প্রথমবার সুযোগ পাচ্ছে তাদেরকে তাত্ত্বিকভাবে কখনোই সমমানের মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না। এছাড়াও একজন দলিতকে যে কোনো জন-প্রতিষ্ঠানে যে ধরনের গঠনগত বৈষম্য; যা প্রকাশ পায় দৈনন্দিন অপমান এবং মানসিক হিংসার মাধ্যমে; তার সম্মুখীন হতে হয় যে তার পক্ষে শিক্ষাচর্চা দুষ্কর হয়ে ওঠে।

চাকরিতে সংরক্ষণ

এইবার আসা যাক চাকরির ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষণের বিষয়ে। সরকারী চাকরি শুরু হয়েছে স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে সরকার গঠন হবার পরে। রাজতন্ত্র থাকাকালীন রাজার মন্ত্রী বা অন্যান্য পদে উচ্চবর্ণের আধিপত্য ছিলো কারণ শিক্ষায় তাদের অধিকার ছিলো। সামরিক পদগুলিতে ক্ষত্রিয়ের এবং ব্যবসায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বৈশ্যদের আধিপত্য ছিলো। এবং যেহেতু ভারতবর্ষে বেশিরভাগ রাজতন্ত্রই উচ্চবর্ণের দ্বারা পরিচালিত তাই তাদের দলিতদের প্রতি যে বিশেষ প্রীতি ছিল না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্রিটিশ আমলেও ওদের আমলার পদগুলিতে সাধারণত উচ্চবর্ণদেরই প্রাধান্য ছিলো। এই সমস্ত অধিক উপার্জনকারী পদগুলি থেকে দলিতরা চিরকালই বঞ্চিত। কিন্তু তা মেধার বা দক্ষতার অনাধিক্যের জন্য নয় বরং সেই প্রাচীনযুগ থেকে চলে আসা জাতির ভিত্তিতে কর্মের বিভাজনের জন্য। এইক্ষেত্রে বাবাসাহেব আম্বেদকারের যুক্তি ছিলো যে স্বাধীন ভারতে এই কাজের বৈষম্য থাকা কোনভাবেই মানা সম্ভব নয়। দলিতদেরকে বর্ণব্যবস্থার নামে যেভাবে অবদমন করা হয়েছে তার ফলে তারা সমাজে অনেক পিছিয়ে গেছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক বর্বরতাকে যদি ঠিক করতে হয় তাহলে তাদেরকে সরকারী চাকরির ক্ষেত্রেও সুযোগ সরকারী আইন প্রয়োগ করেই দিতে হবে। এবং চাকরি করার জন্য নূন্যতম শিক্ষা দরকার। সেই শিক্ষা পাওয়ার জন্যও সরকারী আইন দরকার।

বাবাসাহেব আম্বেদকারের মুল উদ্দেশ্য ছিল এই জাতিব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দলিতদের সমানাধিকার প্রাপ্তি। তিনি নিজে মাহাড় জাতিগোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন। তার জীবনে জাতিভিত্তিক বৈষম্য কি নিদারুণ রূপ ধারণ করেছিল তা আমরা পড়েছি। মাহাড় জাতিভুক্ত জনসংখ্যার অনেকাংশই ভারতে ব্রিটিশ আর্মিতে সৈনিক হিসাবে কাজ করতেন। ব্রিটিশদের দ্বারা নির্মিত স্কুলগুলিতে তৎকালীন অচ্ছুতদের প্রবেশের অধিকার থাকলেও সামাজিক মেলামেশার কোনো অবকাশ ছিল না। আম্বেদকার পরবর্তীকালে বিস্তারিতভাবে বিদ্যালয়ে তার সাথে ঘটা অমানবিক আচরণের কথা লিখেছেন। কিন্তু তিনি হাজার প্রতিকূলতা সত্বেও নিজে শিক্ষালাভ করেছিলেন। ফলত তিনি তার জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে পিছিয়ে রাখা অংশকে যদি সমানাধিকার পেতে হয় তাহলে প্রথম ধাপ হচ্ছে শিক্ষা। কারণ জ্ঞানলাভ নিজগুণেই ক্ষমতায়নের প্রথম ধাপ। তিনি এটাও বুঝেছিলেন যে বিশেষভাবে সুরক্ষিত আইন দ্বারা শিক্ষালাভ এবং চাকরীলাভ যদি নিশ্চিত না করা যায় তাহলে ভারতের উচ্চবর্ণ প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলিকে চিরকালই বাতিলের খাতায় ফেলে দেবে। ফলত সংরক্ষণ অতি অবশ্যই প্রয়োজনীয় ছিল। যদিও এই ব্যবস্থাকে রিভিউ করার কথা হয়েছিল।

দলিতদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা

২০১১ সালের ভারতের জনগণনার তথ্য অনুযায়ী ৭১% দলিত ভূমিহীন ক্ষেতমজুর হিসাবে অন্যের জমিতে কাজ করে। গ্রামীণ এলাকায় ৫৮% দলিত পরিবারের কোনো নিজস্ব জমি নেই। এই রিপোর্ট অনুযায়ী ভূমিহীন দলিতদের অনেকাংশই ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়। এরপরের জনগননার রিপোর্ট আর তৈরি হয়নি। কিন্তু অন্যান্য তথ্যসূত্র যেমন ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলে বর্তমান অবস্থার অনেকটাই আন্দাজ করা যায়। ২০১৮-১৯ সালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে দলিত কর্মীদের মধ্যে ৮৪% যুক্ত রয়েছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। এবং এর পুরোটাই প্রায় কোনোরকম চুক্তি ছাড়া। অর্থাৎ একটা বিরাট অংশের কর্মী যারা দলিত তারা কোনোরকম স্থায়ী ব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া কাজ করে যাচ্ছেন। দিনের মজুরির হিসাবেও দলিতরা সবথেকে শোষিত। অসংগঠিত ক্ষেত্রে যেখানে উচ্চবর্ণের দিন মজুরি গড়ে ৩৫৭ টাকা সেখানে দলিতের মজুরি ২৫৯ টাকা যা অন্যান্য সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে সবথেকে কম। বৈশ্বিক MPI অনুমান অনুসারে, ভারতে প্রতি ছয়টি বহুমাত্রিক দরিদ্রের মধ্যে পাঁচটি SC, ST বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর (OBC) পরিবারের অন্তর্গতঃ ৫০%-এর বেশি বহুমাত্রিক দরিদ্র ST, এরপর SC ৩৩.৩% এবং OBC ২৭.২% (UNDP, OPHI. Global Multidimensional Poverty Index 2021 Unmasking Disparities by Ethnicity, Caste and Gender 2021. Available from: https://ophi.org.uk/multidimensional-poverty-index/)। দারিদ্র্যের কারণে অবশ্যম্ভাবীভাবে খাদ্য এবং স্বাস্থ্যের পিছনে খরচ কমবে। দলিত জাতিগোষ্ঠীর মাসিক খরচ যেখানে ১,৭১৭ সেখানে উচ্চবর্ণের মাসিক খরচা গড়ে প্রায় ৩,০০০। এই তথ্যের দ্বারা পরোক্ষে প্রমাণ হয় যে কম উপার্জনের কারণে দলিত পরিবারগুলিতে অপুষ্টি, শিশুমৃত্যুর হার, মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতা এ'সমস্তই অনেক বেশি। উপরন্তু এত কম উপার্জনের ফলে দলিত পরিবারগুলির বার্ষিক সঞ্চয়ের পরিমান (২৪,০০০) ও জাতীয় গড় সঞ্চয়ের (৫৬,০০০) থেকে অনেক কম। উচ্চবর্ণের বার্ষিক গড় সঞ্চয় ৫৭,০৬০ টাকা।
(https://www.outlookindia.com/magazine/story/india-news-employment-and-the-dalit-equation/305415)

অসমতার কারণ হিসাবে এই রিপোর্টেই উঠে এসেছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে মালিকদের জাতিগত বৈষম্যমূলক আচরণের কথা। যদিও অসংগঠিত ক্ষেত্রে এর কোনো মজবুত পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রাইভেট সেক্টরে বেতনসহ কাজের ক্ষেত্রে দলিতদের কম বেতনের কারণ হিসাবে উঠে এসেছে, জাতিবিদ্বেষমূলক মনোভাব। বেতনের অসামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে ৭০% দায়ী করা হয়েছে জাতিবিদ্বেষকে। গ্রামীণ এলাকায় অকৃষিমূলক কাজের জায়গায় ৫২% দলিত কর্মী রিপোর্ট করেছেন যে তারা কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে জাতিগত বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন।
(ILO report titled, “Equality at Work”, https://www.outlookindia.com/magazine/story/india-news-employment-and-the-dalit-equation/305415)

জীবনযাত্রার মান যদি বিশ্লেষণ করা হয়, ৬৬% দলিত পরিবারে আলাদা শৌচাগার নেই। মাত্র ১৯% দলিত পরিবারে খাওয়ার জলের সরবরাহ আছে। ভারতবর্ষের ৪৮% গ্রামে দলিতদের উচ্চবর্ণের সাথে একই জায়গা থেকে জল খাওয়ার অধিকার নেই (OHCHR, https://www.ohchr.org) [WaterDOC stigmatization of dalits in access to water and sanitation in india]। এরকম ঘটনাও নথিভুক্ত হয়েছে যেখানে তামিলনাড়ুর এক শহরে জলের সঙ্কটের সময় ট্যাঙ্কার শুধুমাত্র উচ্চবর্ণদের জল সরবরাহ করছিল।
(https://www.hindustantimes.com/india-news/dalits-allege-discrimination-in-water-supply-in-tamil-nadu-s-madurai/story-0Ht8ziflIiGu2YlvsRAkXL.html)

শিক্ষাক্ষেত্রে যদি নজর দেওয়া হয় সেখানেও অবস্থা ভয়াবহ। স্বাধীন ভারতে সংরক্ষণ নীতির ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও প্রাথমিক শিক্ষায় মাত্র ১৯% দলিত ছাত্র ভর্তি হয়েছে। যেখানে উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে সেই পরিসংখ্যান ২৫% এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ৪৫%। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ সালে সংরক্ষিত আসনের অধিকাংশ ভর্তি হয়নি। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর কোর্সগুলির ক্ষেত্রে সমস্ত পড়ুয়াদের মধ্যে মাত্র ১১% দলিত। গবেষণার ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ১০%। দেশের ১০ সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে মাত্র ৩টিতে ২২.৫% সংরক্ষিত আসনে পড়ুয়ারা ভর্তি হয়েছে।
(https://timesofindia.indiatimes.com/india/school-enrolment-data-indicates-45-obcs-19-dalits-in-india/articleshow/84877162.cms)

ক্ষেত্রসমীক্ষার তথ্য

আমার ক্ষেত্রসমীক্ষার গ্রামটিতে ভারতীয় চিত্রের বাইরে কোনো ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি। সমস্ত ধরনের উন্নয়নের সূচকে দলিতরা পিছিয়ে আছে। উচ্চবর্ণের যেখানে দুই-তিন মহলা পাকা বাড়ি দলিতদের বাড়িঘর সেখানে কাঁচা, অস্থায়ী। তাদের পাড়ার সামনের রাস্তাগুলো কাঁচা এবং খুবই বিপজ্জনক। এদের বেশিরভাগেরই শিক্ষার হার তলানিতে। বড় সংখ্যক দলিত মহিলারা এখনো নিরক্ষর। এরকম প্রচুর পরিবার আছে যাদের প্রথম প্রজন্ম শিক্ষালাভ করছে। প্রায় সমস্ত দলিত পরিবারের মূল আয়ের উৎস অসংগঠিত ক্ষেত্রে দিনমজুরী।

দলিত পরিবারগুলির সাথে আলোচনা করে বোঝা গেলো যে এনাদের একটা বড় অংশ সংরক্ষণ সম্পর্কে ঠিকভাবে জানেন না। তবে যারা কিছুটা জানেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে সংরক্ষণ আছে বলেই তাদের ছেলেমেয়েরা ‘সমাজে মুখ দেখাবার মতো জায়গা করতে পেরেছে।‘ তাদের বক্তব্যে এটাও স্পষ্ট যে সংরক্ষণের সুরক্ষা না থাকলে তাদের ছেলেমেয়েরা পড়তেও পারত না। পড়াশুনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে শুধু আর্থিক অনটনের কথা নয় তারা সামাজিক বঞ্চনার কথাও স্বীকার করেছেন। কিছুজনের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে পড়াশুনার জন্য যে উৎসাহ প্রয়োজন তা তারা পায় না।

রাজনৈতিক দলগুলি সংরক্ষণের বিষয়ে আলাদা কোনো দৃষ্টান্তমূলক মন্তব্য করেনি। বরং রাজনৈতিক আদর্শ ব্যতিরেকে সমস্ত দলগুলির উচ্চবর্ণের সদস্যরা জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের বিরোধিতা করে অর্থনৈতিক সংরক্ষণের গুণগান করেছেন।

সংরক্ষণ ও সুপ্রিম কোর্ট

কিছুদিন আগে ৭ নভেম্বর, ২০২২ সুপ্রীম কোর্ট ভারতের সংবিধানের ১০৩তম সংশোধনে উল্লিখিত অর্থনৈতিক সংরক্ষণ-এর বৈধতা তুলে ধরার জন্য ঘোষণা করে যে ‘কোটা’ ব্যবস্থা অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। জাত-পাতবিহীন এবং শ্রেণিবিহীন সমাজ গড়ে তোলার জন্য সামাজিক সংরক্ষণের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি যারা অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠী ভিত্তিক সংরক্ষণের আওতায় পড়ে না তারা সংরক্ষিত হবে। আইনগতভাবে তাদের জন্য ১০% আসন সংরক্ষিত থাকবে উচ্চশিক্ষা এবং চাকরির ক্ষেত্রে।

সুপ্রীম কোর্টের মন্তব্যের মূল নির্যাস হলো এই যে সংরক্ষণের ফলে দলিতদের মধ্যে একটা অংশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে গেছে, তাই এই অংশকে আর সংরক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই জাতিগত সংরক্ষণ ব্যাপারটাকে আর বেশিদিন না রেখে এবার অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়াদেরকে সংরক্ষণ দেওয়া হোক।

প্রথমত, যে ‘creamy layer’-এর কথা বলা হচ্ছে তারা সংখ্যায় নগণ্য। ভারতবর্ষের বিশাল সংখ্যক দলিতদের কী অবস্থা তা উপরে আলোচিত পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট। দ্বিতীয়ত, এই ধারণাটাই ভুল যে সংরক্ষণ করা হয়েছিলো শুধুমাত্র দারিদ্র্য দূর করার জন্য। একথা ঠিক যে ভারতবর্ষে শ্রেণি এবং জাতি পরিচিতির ছেদ খুব স্পষ্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যারা দলিত তারা দরিদ্রও। কিন্তু সংরক্ষণ শুধু অর্থনৈতিক শোষণ নয় বরং সামাজিক শোষণ দূরীকরন করার জন্য প্রবর্তন করা হয়েছিলো। যে পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য যেমন স্পষ্ট, তেমনই তার কারণ হিসাবে সামাজিক শোষণও স্পষ্ট। কাজের ক্ষেত্রে দলিতদের (বেতনসহ প্রাইভেট সেক্টর বা অসংগঠিত ক্ষেত্র বা দিনমজুরী) বেতনের অসমতা, কাজ না পাওয়া, পেলেও দলিতদের প্রথাগতভাবে জাতিব্যবস্থার কর্মের বিভাজন মেনে কাজ দেওয়া (মড়া পোড়ানো, নর্দমা পরিষ্কার করা, ময়লা কুড়ানো, জমাদারের কাজ বা অন্যান্য menial labour সংক্রান্ত কাজ), কাজের জায়গায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিংসার শিকার হওয়া এবং তার উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া, ফলস্বরূপ কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়া; শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অবস্থান দায়ী নয়। এই ঘটনাগুলি প্রমাণ করে যে তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এই কারণে নয় যে তারা শুধু দরিদ্র বরং এই কারণে যে তারা দলিত। তাদের সামাজিক পরিচিতি তাদের শোষণের এবং বৈষম্য, অপমান, অমর্যাদার কারণ। এই কারণেই দলিতদের মধ্যে যে অংশ সংরক্ষণের আওতায় থেকে ক্ষমতায়ন করেছে, তাদের শ্রেণি পরিচিতি পাল্টালেও জাতি পরিচিতির জন্য কোন সামাজিক মর্যাদার জায়গা বা সামাজিক পুঁজি সে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তৈরি করতে পারেনি। ফলতঃ যে শিক্ষক বা ডাক্তার দলিত তার প্রধান পরিচিতি তার পেশা বা শ্রেণি নয় তার জাতি। সেজন্য উচ্চবর্ণের ন্যায় একই শিক্ষাগত যোগ্যতা বা দক্ষতা থাকলেও তাকে শুনতে হয় যে সে ‘কোটার প্রোডাক্ট’ অতএব তার কোনো মেধা নেই। এই কারণেই রোহিত ভেমুলা গবেষণা করলেও তাকে দিনের পর দিন তার জাতি পরিচিতির জন্য অপমান সহ্য করতে হয়। শ্রেণিগত গতিশীলতা এলেও সামাজিক গতিশীলতা না থাকার কারণে এখনো ভারতে জাতের ভিত্তিতে বিবাহ প্রেম সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয়। কিছুদিন আগে ঘোড়ায় চড়ার অপরাধে মহারাষ্ট্রে এক দলিত ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলা থেকে দলিত মহিলাদের ওপর উচ্চবর্ণের পুরুষের অকথ্য অত্যাচার সবই জাতিবিদ্বেষমূলক শোষণের দিকে ইঙ্গিত করে। জাতিব্যবস্থা যতদিন থাকবে ততদিন জাতিভিত্তিক শোষণও থাকবে। সেই শোষণ থেকে মুক্তি এবং সাম্যের প্রতিষ্ঠার জন্য সংরক্ষণের মাধ্যমে সার্বিক উন্নয়ন এবং সর্বস্তরে প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন।

সুপ্রীম কোর্টের মন্তব্য অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেয়। তাই আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে সংরক্ষণের ইউনিট হিসাবে শ্রেণি জাতিগোষ্ঠীর থেকে অনেক প্রগতিশীল এবং সর্বজনগ্রাহ্য একটি ইউনিট। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে এই অর্থনৈতিক সংরক্ষণ আসলে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণই। ভারতে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের আওতায় প্রায় সমস্ত প্রান্তিক জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু ভারতে দরিদ্রদের মধ্যে প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর পরিমাণই সবথেকে বেশি সুতরাং এটা বলা যেতেই পারে যে অধিকাংশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ বর্তমান সংরক্ষণের আওতায় চলে আসে। তাহলে বাকি থাকে শুধু উচ্চবর্ণ এবং অন্য কোনো সংরক্ষণের আওতায় না আসা ‘জেনেরাল’ অংশ। তাদের জন্য বাকি ৫০% আসন আছে। তার মধ্যে ১০% আসন সংরক্ষিত করা হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলদের জন্য। কিন্তু এই দুর্বল বিভাগে ভারতের কোনো জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ এর সুফল ভোগ করবে দরিদ্র উচ্চবর্ণ জনসংখ্যা। ভারতে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ চালু হয়েছিলো ঐতিহাসিক বৈষম্যকে compensatory discrimination দিয়ে দূর করার জন্য। দারিদ্র দূর করার জন্য নয়। ফলত দার্শনিকভাবেও এই নতুন সংরক্ষণ অর্থহীন কারণ উচ্চবর্ণ কোনো জাতিভিত্তিক বৈষম্যের মুখোমুখি হয়নি ভারতবর্ষে।

অর্থনৈতিক সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যে নির্ণায়কগুলি ঠিক করা হয়েছে তার বিশ্লেষণ করলেও স্পষ্ট হয়ে যাবে যে এই সংরক্ষণ আসলে দরিদ্রের জন্য নয়। বার্ষিক আয়ের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারিত হয়েছে ৮ লক্ষ টাকা। এই ঊর্ধ্বসীমার আওতায় অসংখ্য পরিবার আসতে পারে। ফলত সংরক্ষিত আসনে প্রতিযোগিতার পরিমাণও সাঙ্ঘাতিক বাড়বে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে এই ঊর্ধ্বসীমার জন্য যারা অত্যন্ত দরিদ্র তারা বাদ পড়ে যাবে না তো? তাছাড়া দারিদ্র ভারতবর্ষে বহুমাত্রিক এক অক্ষমতায় পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দরিদ্রদের সংরক্ষণ দিয়ে এই অক্ষমতা দূর করা সম্ভব কি না তাও ভেবে দেখার দরকার আছে। তার জন্য সরকারী স্তরে বিভিন্ন দারিদ্র দূরীকরণ নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় সর্বসম্মতিতে হয়নি। পাঁচজনের মধ্যে দুইজন মাননীয় বিচারক রায় দিয়েছিলেন যে ১০৩তম সংবিধান সংশোধনটি অসাংবিধানিক। অনেক তর্কের মধ্যে এই বিচারপতিরা উল্লেখ করেন যে এই আইনে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের সংরক্ষণের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে এসসি-এসটি-ওবিসি শ্রেণিভুক্ত মানুষদের। অর্থাৎ, এই সংরক্ষণ শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের জন্যই প্রযোজ্য, তাই এই বিচারপতিরা মনে করেছেন যে আইনটি সংবিধানে বর্ণিত সমতার ধারণার বিরুদ্ধে যায়। অতএব তা অসাংবিধানিক। দুর্ভাগ্যবশত বাকি তিন বিচারপতি তা মনে করেননি।

অর্থনৈতিকভাবে সংরক্ষিত আসনগুলিতে নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রাপ্ত নম্বরের যা পরিমাণ রাখা হয়েছে তা প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী আলাদা হলেও মোটের ওপর জেনারেল বিভাগের থেকে কম। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলির থেকেও কম। সাধারণত প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণের অন্যতম বড় সমালোচনার জায়গা হলো এই যে তা আসলে নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রাপ্ত নম্বরের যে পরিমাণ রাখে তাতে অমেধাবী লোকজন সুযোগ পায়। প্রাতিষ্ঠানিক মেধাচর্চার অধিকার যে দলিত ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সেই ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার প্রবল প্রচেষ্টা এই বিতর্কে স্পষ্ট। জাতি পরিচিতি যে মেধাচর্চার পথে গঠনগত অন্তরায় ছিল তা অস্বীকার করা হয় এতে। অথচ একইভাবে দরিদ্র অংশের জন্য ‘কাট-অফ’ নাম্বার কম থাকলে তা অনেক বেশি গ্রাহ্য হয় কারণ দারিদ্র্য একজন মানুষের বিকাশের পথে গঠনগত অন্তরায় হিসাবে অনেক বেশি গৃহীত একটি ধারণা। সুতরাং জনমানসে সমস্যাটা মেধা কম না বেশি তা নিয়ে নয়, জাতি পরিচিতির ভিত্তিতে আনুমানিক ‘কম মেধাবী’ মানুষ কেন সুযোগ পাবে তা নিয়ে।

অর্থনৈতিক সংরক্ষণ ‘শ্রেণিহীন এবং জাত-পাতহীন’ সমাজ গড়ার পথে এক সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বলে সুপ্রীম কোর্ট জানিয়েছে। কিন্তু যেহেতু জাতিভিত্তিক বৈষম্যকে একপ্রকার অস্বীকার করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে একে মান্যতা যাতে না দেওয়া হয় তার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে, সুতরাং এই সংরক্ষণ কোনোভাবেই জাত-পাতহীন সমাজের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারবে না। Caste blindeness দিয়ে casteless সমাজ গড়া সম্ভব নয়। ভারতে শ্রেণিহীন সমাজ গড়তে গেলেও জাতি পরিচিতিকে বাদ দিয়ে ভাবনা সম্ভব নয়। কারণ ভারতে শ্রেণি শোষণ জাতিভিত্তিক শোষণের সাথে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত।

অর্থনৈতিক সংরক্ষণকে আসলে নিক্ষেপ করা হচ্ছে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের বিকল্প হিসাবে। একদিকে যেখানে কেন্দ্রীয় তথা রাজ্য সরকারগুলি পর্যাপ্ত পরিমাণে চাকরি মানুষকে দিতে পারছে না, সেখানে অর্থনৈতিক সংরক্ষণের নামে ভারতে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণকে দুর্বল করার কথা সরকার বলছে এবং সুপ্রিম কোর্ট তার মান্যতা দিচ্ছে। অতএব, আগামীদিনে জাতিহীন ভারত গড়ার লড়াই আরো কঠিন হবে। দলিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার রক্ষা করতে হলে সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে আরো জোরদার করতে হবে।