আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ চতুর্বিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

লোকসভায় রঙিন গ্যাস, প্রতিবাদের ধরণ ও কিছু প্রশ্ন

গৌতম হোড়


বাইশ বছর আগে ১৩ ডিসেম্বর সংসদ ভবনে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল। সশস্ত্র জঙ্গিরা ঢুকে পড়েছিল সংসদ ভবন চত্বরে। নিরাপত্তারক্ষীরা নিজেদের প্রাণ দিয়ে সংসদ ভবন বাঁচিয়েছিলেন। জঙ্গিদের ঢুকতে দেননি। মূল সংসদ ভবনে ঢোকার দরজা তারা বন্ধ করে দেন। কিছুক্ষণ গুলির লড়াই চলে। তারপর নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে পাঁচজন জঙ্গি মারা যায়। দিল্লি পুলিশের ছয়জন কর্মী, সংসদের দুইজন নিরাপত্তারক্ষী ও একজন মালি জঙ্গিদের গুলিতে প্রাণ হারান। জঙ্গিরা সেসময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও পার্লামেন্টের জাল করা কার স্টিকার নাগানো গাড়ি করে সোজা সংসদ ভবন চত্বরে ঢুকে পড়েছিল।

বাইশ বছর আগের সেই দিনটি ছিল ভয়ংকর। একবার যদি জঙ্গিরা সংসদ ভবনের ভিতরে ঢুকতে পারত, তাহলে কী হতো, সেটা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। তারপর প্রচুর নতুন নিয়মকানুন চালু হলো। নতুন প্রযুক্তি চালু হলো। বাইরে থেকে গাড়িতে জাল স্টিকার লাগিয়ে কেউ যেন ঢুকতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা হলো। বিভিন্ন ব্যারিয়ার লাগানো হলো। আর সংসদ ভবনে ঢোকার সময় সার্চ বা তল্লাশি অনেক বেশি জোরদার করা হলো। অনেকগুলি বলয় পেরিয়ে সংসদ ভবনে ঢোকার ব্যবস্থা হলো। আগের সংসদ ভবন ও এই জঙ্গি আক্রমণের পরের সংসদ ভবনের চেহারা অনেকটাই বদলে গেল।

আমি যখন ৩০ বছর আগে দিল্লিতে এসেছি, নিয়মিত সংসদ ভবনে কাজের সূত্রে যাওয়া শুরু করেছি, তখন নিরাপত্তা ছিল এখনকার তুলনায় অনেক কম। আমাদের অফিস ছিল আইএনএস বিল্ডিংয়ে, সংসদ ভবনের খুব কাছে। আমরা সেই অফিসবাড়ির পিছনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে কয়েক মিনিটের মধ্যে সংসদ ভবনে পৌঁছে যেতাম। দুই দিক দিয়েই সংসদে গাড়ি নিয়ে সংসদ ভবনে ঢোকা যেত। তার আগে তো সংসদ ভবনের একেবারে সামনে দিয়ে বাস পর্যন্ত চলত। বাস চলাচল বন্ধ হয়েছিল অনেক আগেই। জঙ্গি আক্রমণের পর সাংসদ ছাড়া অন্যরা আর গাড়ি নিয়ে প্রধান দুই প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকতে পারতেন না। এখন যেখানে নতুন সংসদ ভবন হয়েছে, তখন তার একাংশ জুড়ে পার্কিং ছিল। পাশের একটা রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে হতো।

ধীরে ধীরে নিরাপত্তা আরো জোরদার হয়েছে। একের পর এক বলয় তৈরি হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, সংসদ ভবনের নিরাপত্তা একেবারে নিশ্ছিদ্র। বস্তুত আমাদেরও তাই মনে হয়েছে। কিন্তু এই ধারণায় ধাক্কা মারলো আবার সেই ১৩ ডিসেম্বর হওয়া ঘটনাটা। দুই যুবক লোকসভার দর্শক-গ্যালারি থেকে লাফিয়ে নীচে লোকসভার অন্দরে গিয়ে পড়লো। তারপর চোর-পুলিশ খেলার মতো সাংসদদের বসার জায়গা ও টেবিল টপকে স্পিকারের আসনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করল। মোজার ভিতরে লুকিয়ে থাকা ক্যান থেকে হলুদ রঙের ধোঁয়ার গ্যাস স্প্রে করল। সংসদ ভবনের বাইরেও তাদের দুইজন সঙ্গী ছিল। তারাও রঙিন গ্যাস স্প্রে করেছে। এসবই এখন টিভি ও সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে সকলের জানা হয়ে গেছে।

লোকসভায় এর আগেও দর্শক গ্যালারি থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা হয়েছে। উপর থেকে লিফলেট ফেলা হয়েছে। এমনকী অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে যখন তেলেঙ্গানা রাজ্য তৈরির আইন পাস হচ্ছে, তখন কিছু সাংসদ লোকসভার ভিতরে গোলমরিচের গুঁড়ো স্প্রে করেছেন। তাদের ধরে ফেলেছেন ওয়াচ এন্ড ওয়ার্ডের কর্মীরা। দর্শক গ্যালারি থেকে সেই দৃশ্য আমরা দেখেছি। গোলমরিচের ঝাঁঝও কিঞ্চিৎ টের পেয়েছি। ফলে ঘটনাগুলো অভাবিত নয়। যেটা অভাবিত, সেটা হলো, মোজায় লুকিয়ে রঙিন গ্যাসের ক্যান নিয়ে এসে তা লোকসভার ভিতরে ছড়িয়ে দিয়েছে দুই যুবক। এবাবে রঙিন ধোঁয়ায় লোকসভা ভরে ওঠার ঘটনা এই প্রথম। আর এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, ঘটনাটা ভয়ঙ্কর। এভাবে লুকিয়ে রঙিন গ্যাস যদি আনা যায়, তাহলে আরো ভয়ঙ্কর জিনিসও আনা যেতে পারত। চিন্তাটা এখানেই।

যারা এই কাজ করেছে, তারা বিভিন্ন রাজ্যের ছেলেমেয়ে। তারা দিল্লিতে একজনের বাড়িতে রাত কাটিয়েছিল। এই চার ছেলেমেয়ে ও যার বাড়িতে তারা আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইউএপিএ-তে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। এ সবও এখন আর কারুর অজানা নয়। কিন্তু যেটা অজানা তা হলো, এই যুবক-যুবতীরা কেন এই ধরনের অপরাধ করলো। তারা ভগৎ সিংয়ের নাম সম্বলিত একটা ফেসবুক পেজের সঙ্গে সকলেই যুক্ত ছিল। ভগৎ সিং ব্রিটিশ ভারতে দর্শক গ্যালারি থেকে লিফলেট ফেলেছিলেন। স্মোক বোমা ব্যবহার করেছিলেন। সেটা করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। তার একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। সেই সময়ে তার প্রয়োজনীয়তাও ছিল। কিন্তু ৯৪ বছর আগের কাণ্ডের পুনরাবৃত্তির এখন তো কোনও প্রয়োজন নেই। যদি প্রতিবাদ জানাতে হয়, এখন তার হাজারটা গণতান্ত্রিক পন্থা আছে।

বলা হচ্ছে, তারা বেকারি, চাকরি না পাওয়া ও মণিপুর নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন বলে প্রতিবাদ দেখাতে চেয়েছিলেন। যে যুবক-যুবতীরা এই কাজ করেছেন, তারা কেউই মণিপুরের নন। দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের। এখনও পর্যন্ত কারও সঙ্গে মণিপুর যোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মণিপুরের ঘটনায় তারা এতটা ভয়ঙ্কর ক্ষুব্ধ হয়ে সংসদ ভবনে গিয়ে এরকম কাণ্ড ঘটাবেন, সেটাও যুক্তিসিদ্ধ বলে মনে হচ্ছে না। চাকরির একটা-দুটো বা বেশ কয়েকটা পরীক্ষায় ব্যর্থ হলেও তাদের সামনে সুযোগ তো শেষ হয়ে যায় না। তারা ক্ষুব্ধ হতে পারে, সাময়িক হতাশা আসতে পারে। কিন্তু তার জেরে এইরকম ঘটনা কেন ঘটালো তারা? আর তারা স্লোগান দিয়েছে, ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’। এই স্লোগান এখন সংসদ ভবনের দুই সভায় বিরোধী সাংসদদের মুখে হামেশাই শোনা যায়। বাইরেও শোনা যায়। গত তিরিশ বছরে সংসদের ভিতরে এই স্লোগান বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধে বহুবার শোনা গেছে। এই স্লোগান দেয়ার জন্য নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরকম কাজ করার দরকার হয় না।

বিক্ষোভের ধরণ দেখে মনে হচ্ছে, বর্তমান সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব, বলিউডি সিনেমা বা টিভি-র সিরিয়ালের প্রভাব বড় বেশি। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া, সংসদের নিরাপত্তার ইতিহাসে নিজেদের নাম তুলে ফেলা ছাড়া আর একটাই কাজ তারা করতে পেরেছে, সেটা হলো, সংসদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার গলদ তারা তুলে ধরতে পেরেছে। শুধু সংসদ নয়, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাঁরা নিরাপত্তা নীতি তৈরি করেন, তাঁদের কাছে এই ঘটনা বড় শিক্ষনীয় ঘটনা হয়ে থাকল। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি, তার আগে এই প্রতিবাদের বিষয়ে আবার আসি। এই যুবক-যুবতীদের মধ্যে একজন তাদের বাবা-মাকে বলে এসেছিল, প্রতিবাদ জানাতে দিল্লি যাচ্ছি। আমরা যদি তর্কের খাতিরে এই কথাটাকেই সত্যি বলে ধরে নিই, তাহলেও যে প্রশ্নটা ওঠে, তা হলো, এরকম প্রতিবাদ তারা কেন করতে গেল? শুধুই আবেগের বশে, প্রচারের বৃত্তে কিছুদিন থাকতে চেয়ে, নাকি তাদের অন্য উদ্দেশ্য ছিল? তারা তো জানত, ধরা পড়ে যাবে। কোনওরকমে ঢুকতে পারলেও বেরোনো সম্ভব নয়, তাহলে? নাকি, এই ঘটনা এখনকার যুবসমাজের একাংশের চিন্তাভাবনার ধরণটা সামনে এনে দিচ্ছে? তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে? সমাজতাত্ত্বিক, মনোবিশ্লেষকরা এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন।

আমরা বরং নিরাপত্তার বিষয়ে মনোনিবেশ করি। বাংলায় একটা চালু কথা আছে, সব খারাপ জিনিসের একটা ভালো দিক থাকে। এই ঘটনার ভালো দিক হলো, এবার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা সংসদের নিরাপত্তার আলগা দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হয়ে তা ঠিক করে নিতে পারবেন। দরকার হলে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবেন। সেসব নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা ঠিক করবেন। তা নিয়ে আলোচনাও চলছে। কিছু কিছু ব্যবস্থা নেওয়া শুরুও হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে নতুন বেশ কিছু নিরাপত্তাজনিত বিষয় সংসদে ও অন্য জায়গায় যুক্ত হতে পারে। সেটা হওয়া দরকারও।

এখনও পর্যন্ত যা খবর, তাতে এই যুবক-যুবতীরা কেউই পেশাদার অপরাধী নয়, এই ধরনের কাজে তাদের অতীত অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা ছিল বলেও জানা যায়নি। তারা যখন এইভাবে সংসদ ভবনে ঢুকে যেতে পারে, রঙিন ধোঁয়া ছড়িয়ে দিতে পারে, তখন সেটা নিরাপত্তার দিক থেকে খুবই চিন্তার বিষয়। এনিয়ে প্রচুর রাজনৈতিক তরজা হবে। আমরা সেসব বিষয়ের মধ্যে ঢুকব না। আমাদের শুধু একটা বিষয়ই মনে হয়, ভারতে যে জায়গায় সারা দেশের জন্য আইন বানানো হয়, বিভিন্ন নীতি নিয়ে, বিল নিয়ে বিতর্ক হয়, আলোচনা হয়, মানুষের সমস্যার কথা উঠে আসে, রাজনৈতিক উত্থান-পতন দেখা যায়, সেই জায়গায় যেন সাধারণ মানুষের প্রবেশ বন্ধ না হয়ে যায়। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় যখন স্পিকার ছিলেন, তিনি বলতেন, সংসদে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের আসা উচিত, দেখা উচিত, সংসদ কীভাবে চলে। লোকসভা ও রাজ্যসভায় দর্শক গ্যালারিতে নিয়মিত স্কুলের ছাত্রছাত্রী আসে। তারাও যেন দেখতে পারে, ভারতের রাজনীতির কেন্দ্রস্থলের চেহারা। প্রতিবাদের ধরণ। বিতর্ক ও আলোচনা। কেমন করে বিরোধীরা সরকারকে বিপাকে ফেলতে চায়, কেমন করে বিরোধীদের বাধা অতিক্রম করে সরকার। এ সবই তো সংসদে দেখা যায়। সেই জায়গা যখন আক্রান্ত হয়, তখন তা অবশ্যই খুবই চিন্তার বিষয়।