আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

হেরে যাচ্ছেন ফেলুদা

প্রবুদ্ধ বাগচী


১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় যখন সত্যজিৎ রায় ফেলুদা-কে নিয়ে গল্প লেখা শুরু করেন, তখন তিনি নিজে চল্লিশ পেরিয়েছেন। চলচ্চিত্রকার হিসেবে মানুষ তাঁকে চিনে গেছেন এর আগেই। ‘চল্লিশ পেরোলেই চালশে’ - এটা সাধারণভাবে গান ও বাস্তবের কথা হলেও তথ্য বলছে, সত্যজিৎ তাঁর ফেলু-কাহিনিকে বাঙালির সামনে প্রকাশ্য করেন নিজের জীবনের চার দশক পার করেই। আর ওই ‘চালশের গান’ যিনি লিখেছিলেন সেই কবীর সুমন, গিটার শেখাও শুরু করেছিলেন ওই চল্লিশ পেরিয়েই। তাই চল্লিশ মানেই স্বচ্ছতাকে বিদায় দেওয়া বা পড়তে গিয়ে হোঁচট খাওয়া এতটা দুরবস্থার আগাম পদধ্বনি সব সময় সত্যি নয়। সত্যজিতের ফেলুদা লিখিত কাহিনি হিসেবে বা ফিল্ম হিসেবে আজও সমান জনপ্রিয়। এমনকি সত্যজিতের করা ফেলুদা-কাহিনির চলচ্চিত্ররূপের অনুসরণে (কিছুটা অনুকরণেও) পরের প্রজন্মে ফেলুদা একটা ব্র্যান্ড বা আজকের মিডিয়ার ভাষায় ফ্রাঞ্চাইজিতেই পরিণত হয়েছে বলা যেতে পারে। ঠিক যেমনভাবে ফেসবুকের পর্দায় আমরা আজকাল পলিতকেশ বৃদ্ধ সুমনকে দেখতে পেলেও আদপে তিনি আজও সেই গিটার হাতে মঞ্চে দাঁড়ানো রাগী এক প্রতিবাদী যুবক, যিনি গেয়ে উঠতে পারেন, ‘যদি ভাবো কিনছ আমায় ভুল ভেবেছ’!

কিন্তু ফেলুদার ক্ষেত্রে এই স্পর্ধাটা আজ আর এতদূর নেই। নিজের করা দুটি ফেলু-কাহিনিকে সত্যজিৎ তাঁর আর পাঁচটা ছবির মতোই সর্বাঙ্গসুন্দর একটা নিটোল ও নিখুঁত ছবি হিসেবেই তৈরি করেছিলেন। সেই ছবি-জোড়ের একেকটি দৃশ্য, মিউজিক বা সংলাপ এখনো কিংবদন্তীর মতো আমাদের মনে ও মেজাজে লেপ্টে আছে। শুনতে পাই, তাঁর তৈরি করা ‘সোনার কেল্লা’ ছবির কিছু মিউজিক অনেকেরই মোবাইলে রিংটোন হিসেবে বেজে উঠছে। সত্যি সত্যি তো আর কালজয়ী বলে কিছু হয় না, একটা সময়ের মানুষ তাঁর পরের প্রজন্মের হাতে কিছু দৃষ্টান্ত তুলে দিয়ে যান - এই পরিবহন না ঘটলে সাহিত্য-শিল্প-ছবি-চলচ্চিত্র কোনোকিছুরই আর কোনো অবশেষ থাকত না। বাংলায় এমন অনেক ভাল ছবি তৈরি হয়েছে যার আর একটাও প্রিন্ট অক্ষত নেই, আমরা সেইসব ছবি দেখার সুযোগই পেলাম না - ভাল-মন্দ বিচার তো পরের কথা।

ফেলুদা কাহিনির ফিল্মি জনপ্রিয়তা মাথায় রেখে সত্যজিৎ-পুত্র প্রথমে টিভির পর্দায়, পরে বড় পর্দায় পরপর অনেকগুলো কাহিনিচিত্র তৈরি করেছেন, এটা ঠিক। ফেলুদা চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিকল্প হিসেবে প্রথমে সব্যসাচী চক্রবর্তী পরে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত বা টোটা রায়চৌধুরী, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় দর্শকের সামনে এসেছেন, এবং একইভাবে ‘তোপসে’ ও ‘লালমোহনবাবু’ চরিত্রগুলিতে বারবার নতুন নতুন অভিনেতাকে আমরা দেখতে পেয়েছি। তবু সবকিছুর পরেও যেন সত্যজিৎ-নির্মিত ছবির কাঠামোটা আমাদের মনের পর্দা থেকে সেইভাবে সম্পূর্ণ সরে যায়নি, বারে বারে এসে গেছে তাঁর তুলনা। আর এটা মনে রেখেছেন পরিচালকরাও, তাই পরের ছবিগুলিতে ব্যবহৃত মিউজিক প্রায় বেশিটাই সত্যজিৎ-সৃষ্ট সাঙ্গীতিক টুকরোকে কাজে লাগিয়েই তৈরি। এখন একদিকে বড় পর্দা, টিভি বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সমান্তরাল খিদে মেটাতে ফেলুদার কাহিনিগুলিকেও তাঁর স্বত্বাধিকারীরা সবাইকেই ছবি করার ঢালাও অনুমতি দিচ্ছেন। সম্প্রতি ওটিটি চ্যানেলেও দুটি ফেলুদা-কাহিনি চিত্রায়িত হয়েছে, আরও কয়েকটি নির্মাণের পথে বলে খবর বেরিয়েছে।

মনে করে নেওয়া যেতে পারে, গত দশ/পনেরো বছরে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ব্যোমকেশ-কাহিনি’গুলিরও একই পরিণতি। সত্যজিৎ রায় ব্যোমকেশের মাত্র একটি কাহিনি ‘চিড়িয়াখানা’ নামে ছবি করেছিলেন, আর করেননি। চাইলে করতে পারতেন না, এমন নয়। কিন্তু একটি কাহিনির চলচ্চিত্র হিসেবে সম্ভাব্যতা কতদূর সেটা সুক্ষ্মভাবে বিচার করে নেওয়া ছিল চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর অন্যতম প্রধান স্বভাব। পরে আমরা দেখলাম, নানা পরিচালকের হাতে একেকরকম ব্যোমকেশ-কাহিনি নির্মিত হচ্ছে বড় পর্দায়, টিভিতে ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যার নায়ক চরিত্রে দেখা যাচ্ছে একেক অভিনেতাকে। এখন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, ব্যোমকেশ-কাহিনিগুলোও নাকি একরকমের ফ্র্যাঞ্চাইজি - কোনো কোনো পরিচালক তাদের ঠিকে নিচ্ছেন। অসম্ভব প্রতিভাবান অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য সাংবাদিক ডেকে ঘোষণা করেছেন, তিনি আর এই ভূমিকায় অভিনয় করবেন না। আসলে ব্যাপারটা খুব ক্লান্তিকর ও নিছকই বৈচিত্র্যহীন। একটা বিশেষ ধরনের কাহিনি নিয়ে ছবি করতে গেলে ঠিক কোথায় থামতে হয়, আজকের ফিল্ম করিয়েরা অনেকেই তা জানেন না, জানার চেষ্টা করেন বলেও মনে করেন না। ফলে যেমন-তেমন করে তৈরি করা ফেলুদা বা ব্যোমকেশ কাহিনি খুব যে একটা চলছে তাও নয়।

এর পেছনে আছে অন্য একটা বড় কারণ। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস, ছোটগল্প, আধুনিক নাটকের মতো বাংলার গোয়েন্দা-কাহিনিরও মডেল হল ইউরোপের সাহিত্য। বাংলায় গোয়েন্দা-কাহিনি লিখেছেন এমন সাহিত্যিকদের সংখ্যা কম নয়। ব্যোমকেশ বা ফেলুদার ছাপা বইয়ের জনপ্রিয়তা বাদ দিলেও হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ছিল সুবিখ্যাত বিমল-মানিক-সুন্দরবাবু জুটি, ছিল মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের গোয়েন্দা হুকাকাশি, প্রয়োজনে যিনি জাপানী জুজুৎসুর মোক্ষম প্যাঁচে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে সক্ষম - এই হুকাকাশির আদলে শিবরাম চক্রবর্তী তৈরি করেছিলেন গোয়েন্দা কল্কেকাশি। একইসূত্রে মনে করতে হবে নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটি, প্রেমেন্দ্র মিত্রের পরাশর বর্মা, বিমল করের কিকিরা, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল বাগচী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাদুড়ি মশাইকে। কিশোরদের উপযোগী গোয়েন্দা সৃষ্টি করেছেন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, তার লেখা ‘পাতালের পাকচক্র’ ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ বা ‘কালো রুমাল’ ইত্যাদি উপন্যাসে। সমরেশ বসু তৈরি করেছেন তার গোগোল চরিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর কাকাবাবুর কাহিনিতে তার ভূমিকা কিছুটা সত্যান্বেষীরই। শীর্ষেন্দুর শবর মূলত পুলিশ অফিসার হলেও আসলে গোয়েন্দা হিসেবেই কাহিনিতে তার প্রধান জায়গা।

এই প্রসঙ্গে আরও অন্যান্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তবে গোয়েন্দা কাহিনির ব্যাপারে তুলনাহীন জনপ্রিয়তায় ‘অমর’ হয়ে আছেন শ্রীস্বপনকুমার-সৃষ্ট দীপক চ্যাটার্জি চরিত্রটি যার জুটি হলেন রতনলাল। এই কাহিনিগুলির সৃজনবৃত্তান্তও শুনেছি অনবদ্য। সন্ধ্যের দিকে শিয়ালদহগামী কোনো ট্রেনে এসে শিয়ালদহ স্টেশনের ওয়েটিং রুমে এসে বসতেন শ্যামনগরের বাসিন্দা সমরেন্দ্রনাথ পান্ডে ওরফে ‘শ্রীস্বপনকুমার’ (ইনিই কিন্তু আসলে জ্যোতিষী শ্রীভৃগু ও যৌনবিজ্ঞান-সংক্রান্ত বইয়ের লেখক এস. এন. পান্ডে) সঙ্গে থাকত একদিস্তা কাগজ আর কলম। সারারাত ধরে চলত লেখা, ভোরের দিকে বৈঠকখানা এলাকার প্রেসের লোক এসে নিয়ে যেত লেখার তাড়া। পরিশ্রান্ত লেখক বাড়ি ফিরতেন ভোরের ট্রেনে। আর দুপুরের মধ্যে সেই লেখা কম্পোজ হয়ে সন্ধ্যের মধ্যে বই হয়ে ছেপে বেরিয়ে যেত! ছোটখাটো সাইজ, পড়ার বইয়ের মধ্যে রেখে দিব্যি পড়া যায়। এমনই আরেক খ্যাত সিরিজ ছিল শশধর দত্তের মোহন-সিরিজ।

ইউরোপের দেশে দেশে ‘প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর’ ব্যাপারটা কিন্তু অনেকদিন থেকে চালু আছে এবং সেখানে অপরাধের কিনারায় একসময় তাদের সাহায্যও নেওয়া হতো। কিন্তু আমাদের দেশে বা রাজ্যে কোনো সময়েই এই প্রাইভেট ডিটেক্টিভ বিষয়টা বাস্তবে ছিল না, আজও নেই। সেই উপনিবেশের কালেও পুলিশ অপরাধ-দমন বা অপরাধের কিনারা করার জন্য তাদের ‘সোর্স’ ব্যবহার করত - কিন্তু ‘সোর্স’ আর প্রাইভেট ডিটেক্টিভ এক জিনিস নয়। অপরাধ দমনে আজও পুলিশ ‘সোর্স’ ব্যবহার করে, সরকারিভাবে তার জন্য তাঁরা ‘সোর্স মানি’ হাতে পান। বাংলার পুলিশ ইতিহাসের যেসব প্রামাণ্য গ্রন্থ পাওয়া যায় বা পুলিশ-কর্মীদের স্মৃতিকথা - যেমন, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দফতর’, ধীরাজ ভট্টাচার্যের ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ ইত্যাদি - কোথাও এমন কোনো প্রাইভেট ডিটেক্টিভ চরিত্র নেই। আজও কলকাতা শহরের কিছু এলাকায় প্রাইভেট ডিটেক্টিভ এজেন্সি আছে, তাতে কিছু কিছু অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মীরা যুক্ত - কিন্তু শহরের অপরাধের কিনারা করায় তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। এঁরা মূলত কারোর ওপর নজরদারি বা পাত্র-পাত্রীর দেওয়া তথ্য যাচাই করার কাজ করেন - সাহিত্যের গোয়েন্দা চরিত্রগুলির সঙ্গে এঁদের কণামাত্র যোগ নেই। ফলে বাংলার গোয়েন্দা চরিত্রের ব্যাপারটাই আসলে ভুল ও বায়বীয়, এমন কোনো চরিত্র আদপে আমাদের চারপাশে নেই। গল্প উপন্যাস বা নাটকের ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাপারটা বিপরীত।

সত্যজিৎ বার বার স্বীকার করেছেন, শার্লক হোমস তাঁর অন্যতম প্রিয় চরিত্র আর কার্যত ফেলুদার আইডিয়া তিনি পেয়েছেন সেখান থেকেই। আর তাই হোমসের মতোই ফেলুদার মূলশক্তি তাঁর ‘মগজাস্ত্র’। ব্যোমকেশের যে শারীরিক বর্ণনা শরদিন্দু তাঁর লেখায় ফুটিয়েছেন ওইরকম ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত কোনো চরিত্র নিষ্ঠুর সশস্ত্র অপরাধীর পেছনে ধাওয়া করছে - এটা একেবারেই কল্পদৃশ্য। ফলে শ্রীস্বপনকুমারের আখ্যানে ‘এক হাতে উদ্যত পিস্তল, অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ, দীপক চ্যাটার্জি পাঁচতলা হইতে জলের পাইপ বাহিয়া বিদ্যুৎ-গতিতে নীচে নামিয়া গেল।’, আর মোহন সিরিজের সেই বিখ্যাত লাইনঃ ‘কখন কেমন করিয়া কী ঘটিল বোঝা গেল না, শৃঙ্খলবদ্ধ মোহন মাঝসমুদ্রে ভাসিয়া উঠিল।’ - এগুলো সবই আসলে আষাঢ়ে গল্প। সত্যি সত্যি এইভাবে প্রাইভেট গোয়েন্দার খুঁজে পাওয়া একটা সিগারেটের টুকরো বা ফেলে যাওয়া রুমাল কিংবা কাদার ওপর পায়ের ছাপ অথবা কারোর বক্তব্যের অসংগতি দিয়ে অপরাধের কিনারা আদৌ হয় না। পুরো বিষয়টাই আদপে বাস্তবে হয় না।

আরও ভেবে দেখতে হবে, গত তিরিশ বছরে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরন ও কিনারার পদ্ধতিও আমূল পাল্টে গেছে। আজকের অপরাধীদের ধরতে পুলিশ যেভাবে সিসি টিভির ফুটেজ, মোবাইলের কল লিস্ট, তার অবস্থানগত ট্র্যাকিং ব্যবহার করে, অপরাধস্থলে যেসব উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরা ইত্যাদি ব্যবহার করে, যেভাবে ফরেনসিক বিজ্ঞানের সাহায্য নেয় তা সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা অনেকে জানিই না, আমাদের জানার কথাও নয়। এইরকম পরিবেশে কিন্তু সিনেমার জগতে একটা নতুন চর্চা চালু হয়ে গেছে যাকে বলা হচ্ছে ‘কপ ইউনিভার্স’ অর্থাৎ পুলিশকে নিয়েই ছবি, তাতে অপরাধের কূল-কিনারা করছে পুলিশবাহিনীর গোয়েন্দারাই, প্রয়োজনে সেখানে ‘চেজ সিকোয়েন্স’ বা ‘এনকাউন্টার ফুটেজ’ তৈরি হচ্ছে বাস্তব অপরাধের রকমসকম বিচার করেই। সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু বাংলা সিনেমা ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এই ধরনের ছবি মুক্তি পেয়েছে ও জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। এর প্রতিটির কেন্দ্রেই একজন বা একাধিক পুলিশ অফিসার এবং তাদের নিজেদের অন্তর্বিরোধ পর্যন্ত এসে পড়ছে পর্দায় যা আসলে ছবির একটা পরত। এগুলো ভাল কি খারাপ সেই প্রসঙ্গ এখানে বিচার্য নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে এইসব ছবিতে যেভাবে পুলিশি জেরা ও হেফাজতে অভিযুক্তকে গালিগালাজ ও শারীরিক নির্যাতনের দৃশ্য দেখানো হয় তা খুব বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ, পর্দায় দেখানো দৃশ্যের একটা গ্রাহ্যতা তৈরি হয়। আমাদের দেশের আইন পুলিশ হেফাজতে বন্দির ওপর শারীরিক নির্যাতন অনুমোদন করে না - ওইসব দৃশ্য ঠিক বিপরীত বার্তাই দেয়। তবে স্পষ্টত সেটা ভিন্ন আলোচনার ব্যাপার।

তবে এটা সত্যি যে এই ঘরানার ছবিতে প্রাইভেট ডিটেক্টিভদের কোনো জায়গা নেই, থাকার কথাও নয়। তাই ছবির নির্মাণকে কুর্নিশ করলেও আজকে যখন ভাবি, নিছক একটা গণেশের মূর্তি চুরি নিয়ে ফেলুদাকে কাশী ছুটে আসতে হল তখন বেশ হাসিই পায়। কিন্তু ফেলুদা বা ব্যোমকেশের সঙ্গে যেসব অপরাধের গল্প জড়িয়ে আছে হাল আমলের অপরাধ তার থেকে যোজন যোজন দূরে। একটা বিদেশি চিত্রকরের ছবি-পাচার বা গোপন গুপ্তধনের ধাঁধার সন্ধান বা কৈলাস মন্দিরের মূর্তির মাথা নিয়ে রহস্যের উদযাপন আজকে নেহাতই ছেলেখেলা বলে মনে হয়। দোষটা কাহিনিকারদের নিয়ে নয়। শরদিন্দুর গল্পের পটভূমি মূলত ষাট বা সত্তর দশকের কলকাতা, সত্যজিতের অনেক কাহিনিতেই ট্রাভেলগের কাঠামো থাকায় তা ঘুরেছে দেশের আনাচে কানাচে, একবার লন্ডনেও। কিন্তু অপরাধের ধরন নিতান্ত মামুলি যা ওইসময়েই সম্ভব ছিল, আজ আর নয়।

ফেলুদাকে শেষবারের মতো পত্রিকার পাতায় ছাপা হতে দেখা গিয়েছিল ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’-এ (১৯৯৬), ব্যোমকেশের শেষ প্রকাশনা ঘটেছিল ‘লোহার বিস্কুট’ (১৯৭০)-এ । এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের সময়কাল যার মধ্যে ঢুকে আছে বিপুল আর্থিক সামাজিক পরিবর্তন - অপরাধ জগৎ বা পুলিশের দুনিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। এই পরিস্থিতিতে এইসব প্রাইভেট ডিটেকটিভদের জমানা আগেও যেমন বাস্তব দুনিয়ায় ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু হাস্যকরভাবে আজকের পরিচালকরা ফেলুদা বা ব্যোমকেশকে স্মার্ট করতে গিয়ে তাদের হাতে কখনো ধরিয়ে দিচ্ছেন আধুনিক মোবাইল ফোন, কখনো ফেলুদাকে নামিয়ে দিচ্ছেন কুংফুর লড়াইয়ে, কখনো তাদের নিয়ে যাচ্ছেন সাইবার কাফে বা গুগল-এর দুনিয়ায় অথচ ‘সিধু জ্যাঠা’ নামক চরিত্রটিকেও না পারছেন ফেলতে না পারছেন যথার্থভাবে রাখতে। সমকালীন হওয়ার মৌতাতে খুড়তুতো দাদার স্যাটেলাইট ‘তোপসে’কে দেখা যাচ্ছে তার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে হোয়াটসআপে মেসেজ আদানপ্রদান করতে! কী অসামান্য রকমের মুর্খামি-মাখানো আধুনিকীকরণ, ভাবা যায়?

এমনটাই কিন্তু হওয়ার ছিল। ওইসব কাহিনিগুলিকে একেবারে আজকের অপরাধ দুনিয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে খোল নলচে বদলে ফেলে তাকে দিতে হয় নতুন চেহারা। সেই যোগ্যতা সকলের আছে কি না বা সেটা করতে গেলে ‘হাঁসজারু’ হয়ে যাবে কি না, তাও ভেবে দেখবার। ফলে কেউই নিজেদের ‘কম্ফর্ট জোন’ থেকে বেরোনোর কথা ভাবছেন না। আদপে যা হচ্ছে তা একটা অবাস্তব জগতের নির্মাণ, ভাগ্যি ভাল, এখনো বাঙালি তার ফেলু-ব্যোমকেশ আবেগ থেকে এগুলো বরদাস্ত করছেন। তবে এবার সময় হয়েছে থামবার। পরিচালকরা কবে সেটা বুঝতে পারবেন, সেটাই হাজার টাকার প্রশ্ন। আকবর বাদশার দিন গিয়েছে, দিন গিয়েছে ফেলু ব্যোমকেশেরও!