আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

জাতিভিত্তিক জনগণনার প্রাসঙ্গিকতা

প্রসেনজিৎ বসু, সমীরণ সেনগুপ্ত ও সৌম্যদীপ বিশ্বাস


আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে জাতিভিত্তিক জনগণনার বিষয়টি বিভিন্ন রাজ্যে চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ৭ নভেম্বর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ওই রাজ্যের জাতিভিত্তিক আর্থ-সামাজিক সমীক্ষার প্রতিবেদন বিধানসভায় পেশ করেন। সংসদের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী জাতিভিত্তিক জনগণনাকে সমাজের এক্স-রে রিপোর্ট হিসেবে চিহ্নিত করে কংগ্রেস শাসিত সমস্ত রাজ্যে এটা চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সম্প্রতি অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও ওই রাজ্যে ডিসেম্বর মাস থেকে জাতিভিত্তিক সমীক্ষা শুরু করার ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় সহ পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই দাবির সরাসরি বিরোধিতা করে একে হিন্দু সম্প্রদায়কে ভাগ করার কৌশল বলে অভিযোগ করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিধানসভায় প্রধান বিরোধীদল বিজেপি কিন্তু এই বিষয়ে এখনও কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। ইচ্ছাকৃত নীরবতার মাধ্যমে কি জাতিভিত্তিক জনগণনার প্রাসঙ্গিকতাকে অস্বীকার করা যায়?

জাতিগণনার প্রেক্ষিত

ব্রিটিশ আমলে ১৮৮১ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত ভারতে সমগ্র জনসংখ্যার জাতিভিত্তিক জনগণনা করা হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের সরকার তফসিলি জাতি এবং জনজাতি ব্যতীত বাকি জনসংখ্যার জাতিভিত্তিক গণনা ১৯৫১ সাল থেকে বন্ধ করে দেয় এই যুক্তিতে যে জাতিগণনা বন্ধ হলে জাতি ব্যবস্থা এবং জাতিভেদ প্রথা ক্রমে বিলুপ্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ১৯৮০-র মণ্ডল কমিশন রিপোর্ট বা ২০০৬-এর সাচার কমিটি রিপোর্ট সরকারি তথ্য দিয়েই দেখিয়েছে তফসিলি জাতি, জনজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি এবং সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও বহুবিধ বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়ন এবং শিক্ষাগত ও সামাজিক অনগ্রসরতার শিকার।

কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের আমলে ২০১১ সালের সেন্সাসের সময় সারা দেশেই জাতিভিত্তিক আর্থ-সামাজিক জনগণনা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪-তে মোদী সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর সেই জাতিভিত্তিক জনগণনার ফলাফল প্রকাশ করতে অস্বীকার করে; সরকার অজুহাত দেয় যে ২০১১-র জাতিগণনায় নাকি নানাবিধ ভুলত্রুটি হয়েছিল। পরবর্তী জনগণনা হওয়ার কথা ছিল ২০২১-এ, যা কোভিড অতিমারির কারণে স্থগিত হয়ে যায়। অতিমারির প্রকোপ কমে যাওয়ার পর যখন বিভিন্ন রাজ্য থেকে জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি ওঠে তখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সংসদে জানায় যে মোদী সরকার নীতিগত ভাবেই জাতিগণনার বিরুদ্ধে।

জাতিভিত্তিক জনগণনা নিয়ে বিজেপি-র অবস্থান জাতিব্যবস্থা নিয়ে তাদের দ্বিচারিতাকেই উন্মোচিত করছে। বিজেপি-র মতাদর্শগত জনক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) সেই গুরু হেডগেওয়ার এবং গোলওয়ালকার সময় থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং মনুবাদের প্রবল সমর্থক। বাবাসাহেব আম্বেদকরের অধ্যক্ষতায় প্রণীত ভারতের সংবিধানকে প্রথম থেকেই আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদীরা আক্রমণ করে এসেছে, কারণ এটা মনুবাদী বর্ণব্যবস্থাকে খতম করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। আরএসএস-এর বর্তমান 'সরসঙ্ঘচালক' মোহন ভাগবত তার পূর্বসূরি কেশব হেডগেওয়ার, মাধব গোলওয়ালকার-এর মতনই একজন মারাঠি ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি মাঝেমধ্যে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং সামাজিক ও শিক্ষাগত অনগ্রসর শ্রেণিদের জন্য সংবিধান প্রদত্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন। ২০১৫ সালে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মোহন ভাগবতের এই সংরক্ষণ বিরোধী অবস্থানের জন্যই বিজেপি ভোটে হেরে যায়।

মণ্ডল কমিশনের ১৯৮০ সালে করা হিসেব অনুযায়ী ভারতে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিদের (ওবিসি) সম্মিলিত জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ। এই হিসেব কষা হয়েছিল ১৯৩১ সালের জাতিভিত্তিক জনগণনার ভিত্তিতেই, কারণ এরপর আর জাতিভিত্তিক জনগণনা হয়নি। ২০১১ সালের সর্বশেষ সেন্সাস অনুযায়ী তফসিলি জাতিদের জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৬.৬ শতাংশ, জনজাতিদের ৮.৬ শতাংশ। অর্থাৎ ভারতে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের সুযোগ যারা পান তাদের আনুমানিক অনুপাত দেশের জনসংখ্যার ৭৭ শতাংশ। দেশের অনেক রাজ্যে এই অনুপাত আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা।

এই বাস্তবতার জন্যই বিজেপি-র পক্ষে আরএসএস-এর ব্রাহ্মণ্যবাদী অ্যাজেণ্ডা নিয়ে নির্বাচনী রাজনীতি করা আজকের ভারতে আর সম্ভব নয়। তাই বিজেপি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তেলি বা ঘাঁচি জাতের পরিচিতিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন রাজ্যে ওবিসি অংশের ভোটারদের সমর্থন আদায় করেছে। রামনাথ কোবিন্দ এবং দ্রৌপদী মুর্মুকে দেশের রাষ্ট্রপতি বানিয়ে বিজেপি তফসিলি জাতি এবং জনজাতিদের মধ্যে নিজেদের দলিত-আদিবাসী দরদি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে। কিন্তু জাতিভিত্তিক জনগণনার প্রশ্নে এসে বিজেপি-র এই ছদ্ম বহুজনপ্রীতির মুখোশ খসে পড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবিকে হিন্দুদের ভাগ করার কৌশল বলে বিরোধী দলগুলির সম্বন্ধে যে অভিযোগ করেছেন সেটা নিতান্তই বাতুলতা। সেই ঋগ্বেদ-এর সময় থেকে হিন্দু সমাজ চতুর্বর্ণ, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র বর্ণে বিভাজিত। মনুস্মৃতির বিধান অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের দাসত্ব করতেই শূদ্রদের জন্ম, তাই সমস্তরকম সম্পত্তি এবং লেখাপড়া থেকে শূদ্রদের বঞ্চিত থাকতে হবে। দুই হাজার বছর ধরে হিন্দু সমাজ শুধু এই চতুর্বর্ণে বিভাজিত হয়ে চলে আসছে তাই নয়, এই চার বর্ণের বাইরে আরেকটা বড় জনগোষ্ঠীকে 'অচ্ছুত' করেও রাখা হয়েছিল, যাদের আজ আমরা 'দলিত' বলে চিনি। বাবাসাহেব আম্বেদকর চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের দেখিয়েছেন যে এই বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা কেবল 'শ্রমের বিভাজন' নয়, এটা জন্মের ভিত্তিতে 'শ্রমিকদের বিভাজন'। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ এবং বর্ণব্যবস্থাই হিন্দু সমাজকে যুগযুগ ধরে বিভাজিত করে রেখেছে।

স্বাধীন ভারতের সংবিধান অস্পৃশ্যতাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং যুগযুগ ধরে চলে আসা, অকথ্য শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার শূদ্র, অতিশূদ্র এবং আদিবাসীদের তফসিলি জাতি এবং তফসিলি জনজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই অংশের মানুষের জন্য সমানাধিকার, সমমর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সংবিধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, সংরক্ষণ যার মধ্যে একটি। এছাড়াও সংবিধানে সামাজিক এবং শিক্ষাগত অগ্রসর শ্রেণি এবং সংখ্যালঘুদের কিছু বিশেষ অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর সংবিধানের প্রতিশ্রুত সামাজিক ন্যায়ের লক্ষ্যে আমরা কতটা অগ্রসর হতে পেরেছি সেটা জানতেই জাতিভিত্তিক আর্থসামাজিক জনগণনা প্রয়োজন। এই দাবি তাই সম্পূর্ণভাবেই সংবিধানসম্মত।

জাতিগত বৈষম্যের বাস্তবতা

জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করে প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি নির্বাচনী জনসভায় বলেছেন যে দেশে নাকি দুটি মাত্র জাত আছে, গরীব আর বড়লোক; মোদী সরকারের নীতিসমূহও নাকি গরীবদের জন্যই নিবেদিত। অর্থনৈতিক ভিত্তিতে এটা যে কতবড় মিথ্যা তা গত দশ বছরে আদানি ও আম্বানি গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান আয় এবং সম্পদের সাথে গ্রাম-শহরের শ্রমজীবীদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির তুলনা করলেই বোঝা যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের কথা বলে সামাজিক এবং জাতিভিত্তিক বৈষম্যকে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টার কোন তথ্যগত ভিত্তি নেই। বরং বিহারের জাতিভিত্তিক আর্থসামাজিক সমীক্ষা এটাই দেখায় যে তথাকথিত সবর্ণদের (সাধারণ শ্রেণী) জনসংখ্যার মধ্যে মাসে মাত্র ৬,০০০ টাকার কম উপার্জন করা পরিবারের সংখ্যা যেখানে ২৫ শতাংশ, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে সেটা ৩৩ শতাংশ, তফসিলি জাতির এবং জনজাতির প্রায় ৪৩ শতাংশ।

জাতীয় স্তরে জাতিভিত্তিক জনগণনা না হলেও নমুনার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারের যে বিভিন্ন সমীক্ষা হয় (স্যাম্পেল সার্ভে), তাতে গত কয়েক দশকে কিন্তু তফসিলি জাতি এবং জনজাতির পাশাপাশি অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই ধরণের একটি সমীক্ষা হলো জাতীয় পরিবার ভিত্তিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে)। এই সমীক্ষার ভিত্তিতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দারিদ্র এবং মানবোন্নয়ন সংক্রান্ত গবেষকদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী ভারতে ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৫-১৬ সালের মধ্যে বহুমাত্রিক দারিদ্র একদিকে যেমন কমেছে, তেমনি দরিদ্র অংশের মানুষের মধ্যে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর অনুপাত বেড়ে গেছে [Source: Examining multidimensional poverty reduction in India 2005/06 - 2015/16: Insights and oversights of the headcount ratio by Sabina Alkire, Christian Oldiges, Usha Kanagaratnam; Oxford Poverty and Human Development Initiative (OPHI), Department of International Development, University of Oxford, United Kingdom]।

দেখা গেছে যে ২০১৫-১৬ সালে দেশের সমস্ত দরিদ্র জনগণের মধ্যে প্রায় ৮৪ শতাংশ তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির। আরও দেখা গেছে যে ২০১৫-১৬ সালের সমস্ত হিন্দুদের মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ যেখানে দরিদ্র, সেখানে মুসলিমদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ৩১ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী মোদী দেশের গরীবদের চিনতেই ভুল করছেন - ভারতে অর্থনৈতিক ভাবে দরিদ্রদের বহুলাংশই তফসিলি জাতি, জনজাতি, ওবিসি এবং মুসলিম সংখ্যালঘু।

জাতিগত বৈষম্যের এই চিত্র ২০১৭-১৮ সালের শিক্ষা সংক্রান্ত সরকারি তথ্যেও স্পষ্ট ভাবেই দৃশ্যমান (সারণী-১)। ভারতে সবর্ণদের (সাধারণ শ্রেণি) মধ্যে স্বাক্ষরতার হার যেখানে ৮৬ শতাংশ সেখানে জনজাতিদের মধ্যে স্বাক্ষরতা এখনো মাত্র ৭০ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে জনজাতিদের মধ্যে স্বাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ। সারা ভারতে সবর্ণদের (সাধারণ শ্রেণি) মধ্যে স্নাতক যেখানে ১২ শতাংশের বেশি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে স্নাতকদের অনুপাত ৬ শতাংশ, তফসিলি জাতিদের মধ্যে ৪ শতাংশ এবং জনজাতিদের মধ্যে ৩ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে সবর্ণ হিন্দুদের (সাধারণ শ্রেণি) মধ্যে স্নাতক ৮ শতাংশ, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির এবং তফসিলি জাতিদের মধ্যে ৪ শতাংশ এবং জনজাতিদের মধ্যে ১ শতাংশ মাত্র।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্যের এই চিত্র কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়। ২০২১-২২-এর সরকারি তথ্য অনুযায়ী ভারতে সবর্ণদের (সাধারণ শ্রেণি) মধ্যে ৩০ শতাংশ যেখানে নিয়মিত মাস মাইনের চাকরি বা কাজে নিযুক্ত, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির এবং তফসিলি জাতিদের মধ্যে এই অনুপাত ২০ শতাংশ এবং জনজাতিদের মধ্যে ১২ শতাংশ মাত্র। পশ্চিমবঙ্গে সবর্ণদের (সাধারণ শ্রেণি) মধ্যে নিয়মিত মাস মাইনের চাকরি বা কাজে নিযুক্ত ২৮ শতাংশ, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ১৬ শতাংশ, তফসিলি জাতিদের ১৩ শতাংশ এবং জনজাতিদের ১৮ শতাংশ [Source: Periodic Labour Force Survey, Annual Report (July 2021 - June 2022)]। অর্থাৎ অনিয়মিত ও অসংগঠিত শ্রমিক এবং কৃষকদের মধ্যে বহুলাংশই অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, তফসিলি জাতি এবং জনজাতি।

সারা দেশে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ক্ষেত্রের চাকরি। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের সামাজিক বিন্যাসে (সারণী-২) নজর দিলে দেখা যায় যে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে সব থেকে উঁচু সরকারি পদ অর্থাৎ গ্রুপ-এ পদের মধ্যে সবর্ণদের (সাধারণ শ্রেণি) অনুপাত ৬৪ শতাংশ, গ্রুপ-বি পদে প্রায় ৬০ শতাংশ এবং গ্রুপ-সি পদে ৫১ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ ভারতের জনসংখ্যায় যাদের অনুপাত আনুমানিক ৭৭ শতাংশ, সেই অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, তফসিলি জাতি এবং জনজাতিদের ভারত সরকারের গ্রুপ-এ পদে সম্মিলিত অংশীদারিত্ব মোটে ৩৬ শতাংশ, গ্রুপ-বি পদে ৪০ শতাংশ এবং গ্রুপ-সি পদে ৪৮ শতাংশ।



পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের স্টাফ সেন্সাস গত কয়েক বছরে প্রকাশ করেনি। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গ্রুপ-এ পদের মধ্যে সবর্ণদের (সাধারণ শ্রেণি) অনুপাত ৮১ শতাংশ, গ্রুপ-বি পদে ৭৭ শতাংশ এবং গ্রুপ-সি পদে প্রায় ৬৭ শতাংশ। ভারত সরকারের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকরিতে অনগ্রসর শ্রেণি, তফসিলি জাতি এবং জনজাতিদের অংশীদারিত্ব আরও কম। বোঝাই যায় যে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের নীতিও ঠিক মতন লাগু হয় না।

সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ

স্বাধীনোত্তর ভারতে, বিশেষত উত্তর ভারতে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন গতি পায় জরুরি অবস্থা শেষ হওয়ার পর থেকে। জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং রামমনোহর লোহিয়ার অনুগামীরা জনতা পার্টির মাধ্যমে রাজনীতিতে অনগ্রসর শ্রেণির উত্থানের যে প্রক্রিয়া শুরু করে, তারই পরিণতিতে মণ্ডল কমিশন রিপোর্টের ওবিসি সংরক্ষণের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের আমলে। অন্যদিকে ১৯৮৪ সালে আম্বেদকরের মতাদর্শকে সামনে রেখে মাননীয় কাঁসিরাম গড়ে তোলেন বহুজন সমাজ পার্টি। 'বহুজন' অর্থাৎ দেশের তফসিলি জাতি, জনজাতি, অনগ্রসর শ্রেণি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্মিলিত জনগোষ্ঠী, যা দেশের জনসংখ্যার বহুলাংশ। কাঁসিরাম একটা হিন্দি স্লোগানকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন, "জিসকি জিতনি সংখ্যা ভারি, উসকি উতনি ভাগিদারী"; বাংলা করলে দাঁড়ায় "যার যত সংখ্যা ভারী, তার তত অংশীদারি"।

কাঁসিরামের বহুজন সমাজ পার্টি এক সময় সামাজিকভাবে বঞ্চিত-নিপীড়িত অংশের মানুষের মধ্যে প্রবল উৎসাহ তৈরি করতে পারলেও দেশের সব রাজ্যের বহুজন আন্দোলনকে এক ছাতার তলায় আনতে পারেনি। জনতা দলও বিভিন্ন রাজ্যে ভেঙে যায় অনেকগুলো ভাগে। এর পিছনে অনেক কারণ আছে, দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সামাজিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক পরিস্থিতির বিভিন্নতা যার মধ্যে প্রধানতম। তফসিলি জাতি, জনজাতি, অনগ্রসর শ্রেণি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অভ্যন্তরেও অনেক সামাজিক দ্বন্দ্ব রয়েছে, যার প্রতিফলন দেখা যায় সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে সামনে রেখে উঠে আসা বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলির অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে।

জনতা দলের বিভাজন বা বহুজন সমাজ পার্টির সীমাবদ্ধতা যাই থাক, জরুরি অবস্থার পরে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন ভারতের ইতিহাসের চাকাকে যেদিকে ঘুরিয়েছে তা কিন্তু আর উলটোদিকে ঘুরবে না। এর সব থেকে বড় প্রমাণ যে আরএসএস-এর বিশুদ্ধ ব্রাক্ষণ্যবাদী হিন্দুত্বকে আড়াল করে বিজেপিকেও আজকে ওবিসি নরেন্দ্র মোদী, তফসিলি জাতির রামনাথ কোবিন্দ এবং জনজাতির দ্রৌপদী মুর্মুকে সামনে রেখে ভোটের রাজনীতি করতে হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বহুজন আন্দোলনের স্লোগান তুলে জাতিভিত্তিক জনগণনার পক্ষে সওয়াল করছেন। আর তফসিলি জাতির মল্লিকার্জুন খারগে কংগ্রেসের জাতীয় সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

আসলে তফসিলি জাতি, জনজাতি, অনগ্রসর শ্রেণি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলিমদের মতন বঞ্চিত সামাজিক জনগোষ্ঠীগুলির জনসংখ্যার অনুপাতে সর্বক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব এবং অংশীদারিত্ব সুনিশ্চিত করার দাবি একটি ন্যায্য এবং যথার্থ দাবি। বাবাসাহেব আম্বেদকরের অধ্যক্ষতায় প্রণীত ভারতের সংবিধান এই বহুজনদের যে অধিকারগুলি দিয়েছে, স্বাধীনত্তোর সাত দশকে তার সম্পূর্ণ রূপায়ণ এবং বাস্তবায়ন হয়নি। ভারতের এই বঞ্চিত বহুজনদের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব এবং অংশীদারিত্ব সুনিশ্চিত করার প্রথম ধাপ তাদের জনসংখ্যার সঠিক গণনা এবং অনুপাত নির্ণয়। অর্থাৎ, জাতিভিত্তিক জনগণনা এবং আর্থ সামাজিক সমীক্ষাই আগামীদিনে সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করার প্রথম ধাপ।

সারা দেশে তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও এই জাতিভিত্তিক জনগণনার বিশেষ প্রয়োজন। সমস্ত সরকারি নমুনা সমীক্ষা এটাই দেখাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গ তফসিলি জাতি, জনজাতি, অনগ্রসর শ্রেণি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অংশীদারিত্ব সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে, বিশেষত শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। তাই কেন্দ্রীয় সরকার দেশজুড়ে জাতিভিত্তিক জনগণনা না করলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্যের স্তরে জাতিভিত্তিক আর্থ সামাজিক সমীক্ষা অবিলম্বে চালু করা উচিৎ। হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, পঞ্চানন বর্মা, বেগম রোকেয়া, সিধু-কানুর সংগ্রামের ভূমি বাংলায় বহুজনদের বঞ্চনার থেকে এটাই মুক্তির পথ।