আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

সমসাময়িক

‘তারা ক্রিকেটের কী জানে, যারা শুধুই ক্রিকেট জানে!’


জগৎ জুড়ে কটা দেশ আছে? কম বেশি ১৯৫টা। কটা দেশ ক্রিকেট খেলে? আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল-এর পূর্ণ সদস্য দেশের সংখ্যা - এই মেরেকেটে ১১। অর্থাৎ সব মিলিয়ে, ছড়িয়ে বাড়িয়ে, পৃথিবীর ৬ শতাংশ দেশ ক্রিকেট নামে খেলাটা খেলে। এদের মধ্যে আবার অধিকাংশ দেশের প্রথম খেলা ক্রিকেট নয়। ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকাতে অনেক বেশি জনপ্রিয় খেলা হল 'সকার', যাকে আমরা ফুটবল বলি। অথবা রাগবি বা টেনিস।

কটা দেশ খেলে 'সকার'! প্রায় একশ শতাংশ দেশ। এই ভূমধ্যে জনপ্রিয়তম খেলা হল 'সকার’। নাইজেরিয়া থেকে রাশিয়া, ব্রাজিল থেকে জাপান, কোরিয়া থেকে ইউরোপ - ফুটবল খেলে সকলে। ওই যে আমেরিকা একদিন একটু নাক উঁচু ভাব দেখিয়েছিল তাদের আরেক জাতের ফুটবল নিয়ে, এখন কান মুলে বুঝেছে ‘সকার’ না খেললে খেলার জাতে ওঠা যায় না।

ক্রিকেট এখন মূলত দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের প্রধান খেলা। ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর শ্রীলংকা। এই খেলা ছিল ইংল্যান্ডের ভিক্টোরীয় যুগের নিতান্তই কাজকর্মহীন অভিজাতদের স্বল্প পরিশ্রমের খেলা, খেলা শেষে তারা ওড়াত শ্যাম্পেন! যে খেলা একদিন ছিল উপমহাদেশের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী অভিজাতদের অবসর বিনোদনের পন্থা, সেই খেলা তাদের ছেড়ে আসা কলোনি দেশগুলোর জনগনের মনে তৈরি করেছিল ভালোবাসা।

একদিন ক্রিকেট দক্ষিণ এশিয়ার লক্ষ কোটি কিশোরের ব্যকুলতা, বেগ আর সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ করত। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খেটে এসে বাবা দেখেন ছেলের খেলা। খেলা শেষে দু’জনা গল্পে মেতে, ঘামে শরীর ভিজিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে আশাহীন গৃহে আশার ফানুস জ্বালিয়ে ফেরে। এসব বিগত শতকের কথা। এখন যতদিন যাচ্ছে ক্রিকেট গরিব কিশোরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

সারা দেশ জুড়ে ভালো খেলোয়াড় তুলে আনবার সংগঠন দুর্বল। বিভিন্ন ক্রিকেট একাডেমিতে যুক্ত হতে প্রচুর অর্থ লাগে। আর বিশেষ একাডেমিগুলো থেকেই খেলোয়াড়দের সুযোগ আসে বেশি।

এই খেলার অনেক স্পনসরই পরবর্তী সময়ে জনগণকে প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত। মনে পরে বাঙালি-বিহারি বেসরকারি ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের কারবারি সুব্রত রায়কে? তাঁর কোম্পানি 'সাহারা ইন্ডিয়া' আসলে ছিল চিটফান্ড। বেনিয়মের টাকায় বছরের পর বছর সাহারা ভারতীয় ক্রিকেট দলের স্পন্সর ছিল - সেই ২০০২ থেকে ২০১২ সাল অব্দি। এবং এইভাবেই সাধারণ মানুষের মনে সাহারায় টাকা রাখার ব্যাপারে আস্থা অর্জন করেছিল। সেই টাকার অধিকাংশই আজ জলে গিয়েছে। আমানতকারী তার টাকা ফিরে পায়নি। টি-২০ খেলার অন্যতম জনক ললিত মোদী আজ দেশছাড়া। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট আর্থিক অনিয়মের জন্য তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার কিছু আগে তিনি পালিয়ে লন্ডনে চলে যান। এখন সেখানেই দিব্বি আছেন। ২০২১-২০২২-এর স্পনসর 'বাইজু'স'। ফেমা লঙ্ঘনের অভিযোগে ইডি 'বাইজু'স'-এর কাছে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছে৷ এবারের স্পনসর হল 'ড্রিম ১১'। এটি হল ভারতীয় ফ্যান্টাসি স্পোর্টস প্ল্যাটফর্ম। এই খেলা কি আসলে অনলাইন জুয়া এবং বাজি খেলা? অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে কোম্পানিটি দেশের আইনকে কিছুটা পাশ কাটিয়ে চলছে। আইপিএল ও ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে কেলেঙ্কারি হয়তো এখনও অনেকের মনে আছে। ক্রিকেট কর্মকর্তারা আক্ষরিক অর্থে বাধ্য হয়েছিল রাজস্থান রয়্যালস এবং চেন্নাই সুপার কিংসকে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে নিষিদ্ধ করতে।

বিশেষ করে ভারতীয় ক্রিকেট কর্মকর্তাদের প্ররোচনায় ডিসেম্বরের শীতে ভিভ রিচার্ডসের ব্যাটিং দেখার সৌন্দর্য ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। এখন সারা বছর ধরে রকমারি ক্রিকেট খেলা হয়। এইসব খেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের হাস্যকর জাঁকজমক খেলাকে পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়ে দর্শকের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দিতে প্ররোচিত করে। এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেট ফাইনালে ছিল আরও কিছু প্রহসন। প্রথম জলপানের বিরতিতে অতি উচ্চকিত প্রদর্শনী, দ্বিতীয় জলপান বিরতিতে স্টেডিয়ামের লাইট নিভিয়ে লেজার প্রদর্শনী - এসবের ফলে যে খেলোয়াড়দের মনোসংযোগে ঘাটতি পড়তে পারে তা নিয়ে ক্রিকেট বোদ্ধাদের কোনো বক্তব্য নেই। নেই কোনো নিয়ম, নেই খেলার প্রতি শ্রদ্ধা। এই খেলার সঙ্গে হাত ও প্রাণ মিলিয়েছে দেশের ধনিক শ্রেণী, জুয়াড়ি, আর পরিমিতিবোধের পরোয়া না করা রাজনীতিবিদরা। স্রেফ অর্থের জন্য ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আর আইসিসি ক্রমাগত মেরে ফেলতে চাইছে ক্রিকেট খেলাটাকে। টাকা শুঁকে শুঁকে উপমহাদেশের কিছু সন্দেহজনক ব্যক্তিত্ব ক্রিকেট নিয়ে দিনে রাতে, নাচে, ফিল্মে, জলসায় এক খিচুড়ি বানিয়েছে। আর চেটে চেটে সেই খিচুড়ি খাচ্ছে আপামর ভারতবাসী।

ক্রিকেট এখন ভোটে জেতবার কলকাঠি - ক্ষমতায় টিকে থাকবার জন্য ব্যবহার করা হয় ক্রিকেটকে। তাই বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ডাক পান না দেশের প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতা অধিনায়ক কপিলদেব। ওই রাজনৈতিক কারণেই। ক্রিকেট মাঠের নামকরণ হয় দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নামে - চারিদিকে বলিউডি সিনেমার দেখানেপনা খেলাটাকে গ্রাস করছে।

একদিন ক্রিকেট ছিল শুধুই একটা খেলা। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ভালোবাসা তাতে মিশে গেছিল। সেই খেলা আজ চলে গেছে পিছনের সারিতে। এখন ক্রিকেট জাতীয়ববাদের প্রতীক। পয়া, অপয়া, যজ্ঞ, পূজা, নামাজ চলে ক্রিকেটের নামে। তাই অস্ট্রেলিয়া জিতবার পরে দেশের ক্রীড়াপ্রেমী জনগণ ভিনদেশি বিজয়ী ক্রিকেটারদের সম্মান জানাতে উঠে দাঁড়ায় না। বাজে পারফরম্যান্সের জন্য নিজের দলের খেলোয়াড়দের খেলা বিশ্লেষণ করবার পরিবর্তে, ভারতীয় কিছু ক্রিকেট ভক্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাটসম্যান ট্র্যাভিস হেডের স্ত্রী এবং এক বছরের মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি দেয়। আর অপরদিকে ভারতের পরাজয়ে ভ্রাতৃসম দেশের বাঁধাহীন উচ্ছাস, রোশনাই, সকল প্রজ্ঞার মুখে সপাটে এক থাপ্পড় কষিয়ে দেয়।

জীবনে মরণে, দিনে রাতে ক্রিকেট নিয়ে আমরা এখন এতই মুগ্ধ, সন্দেহজনক বিনিয়োগ এখানে এতটাই বেশি যে অন্য খেলাগুলো চলে যাচ্ছে প্রচার আলো থেকে অনেকটা দূরে। ২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের দ্বিতীয় রাউন্ডের বাছাই পর্বের ম্যাচে ভারতবর্ষ কুয়েতের মাটিতে কুয়েতকে হারিয়ে দেয়। এই খবর মিডিয়ার হেডলাইন হয়না। এই নিয়ে আমাদের আবেগ নেই, উৎসাহও নেই।

আবেগ ও উৎসাহ তৈরি করে মিডিয়া ও কর্পোরেটের এক জটিল ককটেল। সেই ককটেল খাইয়ে আমাদের বুঁদ রাখতে চায় দেশের ক্ষমতাধরেরা। আর আমরা চাইব দেশজুড়ে সঠিক ক্রীড়া নীতি। সেই নীতি বিভিন্ন খেলাকে তার যথাযোগ্য মর্যাদা দেবে। একেবারে বুনিয়াদি স্তর থেকে ভালো খেলোয়াড় তুলে আনতে সাহায্য করবে। আর ক্রিকেট আবার হবে সন্দেহজনক স্পনসর মুক্ত ভালোবাসার খেলা।