আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

সমসাময়িক

নাগরিকত্ব নিয়ে মিথ্যাচার


হেমন্তের কুয়াশা জানান দেয় যে শীত আসছে। কলকাতায় অমিত শাহের আগমন জানান দেয় যে ভোট আসছে। রাজ্যের মানুষের জীবনের সমস্যা নিয়ে শেষ কবে দেশের গৃহমন্ত্রী চিন্তা ব্যক্ত করেছেন জানা নেই। রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশী বলে যখন অত্যাচার করা হয় তখন অমিত শাহেরা সুখী নিদ্রায় থাকেন। অথচ ভোট এলেই বিজেপি তথা অমিত শাহ রাজ্যে অনুপ্রবেশের জুজু দেথতে পান। কলকাতায় দলের জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে শ্রীশাহ বলেছেন যে পশ্চিমবঙ্গে নাকি প্রবল বেআইনি অনুপ্রবেশ ঘটছে শাসকদলের প্রত্যক্ষ মদতে। দেশের শিশুরাও জানে যে দেশের সীমান্ত রক্ষা করার দায়িত্ব বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স তথা কেন্দ্রীয় সরকারের। তাই বাংলাদেশ থেকে যদি বেআইনি অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে, তাহলে তার মুখ্য দায় কেন্দ্রীয় সরকারের। দেশের গৃহমন্ত্রী অনুপ্রবেশের বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন তা জানার অধিকার রাজ্য তথা দেশের মানুষের রয়েছে। তা না বলে অনুপ্রবেশ অনুপ্রবেশ বলে চিৎকার করার নেপথ্যে আসলে রয়েছে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।

অমিত শাহ এবং তাঁর দল অনুপ্রবেশকারী বলে আসলে রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়কে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে চান। দলে দলে মুসলমান বাংলাদেশ থেকে রাজ্যে ঢুকে পড়ছে এই কথা বলে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলাই শাহের আসল উদ্দেশ্য। এইসব কথার নেপথ্যে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কিছু মৌলিক তথ্য। যেমন, ভারতের গড় মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের থেকেও কম। পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় আরো নীচে। অতএব, নেহাতই মাথা খারাপ না হলে বাংলাদেশ থেকে ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের চলে আসার কোনো কারণ নেই।

তাই অনুপ্রবেশ তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গেই অমিত শাহদের শরণার্থী তথা বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের আমাদের রাজ্যে চলে আসার কথা বলতে হয়। এই কথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রায় মানুষ পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন যাদের অধিকাংশই দলিত তথা নমঃশূদ্র এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। বহু বছর ধরে এই মানুষগুলি পশ্চিমবঙ্গে রয়েছেন। এদের অধিকাংশের ভোটাধিকার রয়েছে।

২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকারের আমলে যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হয় (সিএএ ২০০৩), সেখানে পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া দেশে আগত সকলকেই "ইল্লিগ্যাল মাইগ্র্যান্ট" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই আইনের বিভিন্ন ধারা এবং তার ভিত্তিতে যে নতুন বিধি চালু হয় তার ফলে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে আসা সকল উদ্বাস্তুই আইনের চোখে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হয়ে পড়েন এবং তাদের সন্তানদের ২০০৩-এর পর ভারতে জন্মালেও জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

২০১৯-এর আইনের মাধ্যমে সরকার বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে যেই সমস্ত মানুষ ভারতে রয়েছেন, যারা ধর্মীয় অত্যাচারের দরুন বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলে, যদি তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের না হন। ভারতে প্রথমবারের জন্য ধর্মকে নাগরিকত্বের একটি শর্ত হিসেবে হাজির করা হয় যা দেশের সংবিধানের মৌলিক ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর সরাসরি বিরুদ্ধে। তাই এই আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার দাবিতে ২০০-র বেশি মামলা সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা হয়েছে।

অন্যদিকে, অসম থেকে বিদেশী বিতাড়নের তাগিদে সেখানে যেই নাগরিকপঞ্জি তৈরি হয় তাতে ১৯ লক্ষ মানুষকে ভারতের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। বিজেপি ভেবেছিল যে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করলে মুসলমানদের নাম সেই পঞ্জি থেকে বাদ যাবে। কিন্তু দেখা যায় যে ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় ১৪ লক্ষ আদতে হিন্দু। এই হিন্দুদের নাগরিকত্ব ফেরত দেওয়ার উদ্দেশ্যে নতুন নাগরিকত্ব আইন পাশ করা হয়। কিন্তু আজ অবধি এই আইনের বিধিলিপি তৈরি করতে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

অবশ্য ব্যর্থ কথাটি সঠিক নয়। আসলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই আইনের বিধিলিপি সরকার তৈরি করেনি। পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষকে বোঝানো হয়েছে যে নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বিধিলিপি তৈরি করলে সরকারকে লিখতে হবে কীভাবে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ২০১৯-এর আইনে কোনো নিঃশর্ত নাগরিকত্বের কথা বলা হয়নি। সিএএ ২০১৯-র ৩ নম্বর ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে যে "Certificate of Registration" অথবা "Certificate of Naturalisation", অর্থাৎ নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে হবে। শুধু তাই নয়, নিঃশর্তভাবে নয়, বরং কিছু শর্ত মেনেই এইরকম সার্টিফিকেট দেওয়া হবেঃ "subject to such conditions, restrictions and manner as may be prescribed, on an application made in this behalf..."। শুধু তাই নয়, সিএএ ২০১৯-এর ৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী নাগরিকত্বের আবেদন করার আগে আবেদনকারীকে ন্যূনতম ৬ বছর ভারতে বসবাসকারী অথবা ভারত সরকারের অধীনে কর্মরত হতে হবে। অর্থাৎ, মতুয়া সম্প্রদায়ের যে প্রাথমিক দাবি যে নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দিতে হবে, সেই দাবি ২০১৯-এর আইনে মানা হয়নি।

তাই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া এবং নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে নিঃশর্ত নাগরিকত্বের যে আশ্বাস দিয়েছে তা ভ্রান্ত। নাগরিকত্ব আইন মেনে বিধি তৈরি করতে গেলেই এই কথাগুলি জলের মতন পরিষ্কার হয়ে যাবে। অতএব, কেন্দ্রীয় সরকার এই বিধি বানাচ্ছে না। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে এসে নানান হম্বিতম্বি করে তারা নাগরিকত্ব আইন লাগু করবেন, এই কথা বিগত ৩-৪ বছর ধরে বলে চলেছেন।

বিজেপি-র ভোটের জন্য লোভ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রীর ডেপুটি অজয় কুমার মিশ্র পশ্চিমবঙ্গে এসে মতুয়া মহাসঙ্ঘের বাড়িতে বসে ঘোষণা করেছেন যে ২০২৪ সালের মার্চ মাসের মধ্যে নাকি নাগরিকত্ব আইনের বিধি তৈরি হয়ে যাবে। এরপরে তিনি বলেন যে মতুয়া মহাসঙ্ঘ যেই পরিচয়পত্র তাদের সদস্যদের দেয় তাই নাকি সরকারী নাগরিকত্বের দলিল বলে স্বীকৃত হবে। এহেন হাস্যকর এবং সম্পূর্ণ বেআইনি দাবি একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজ্যে এসে করছেন! এমনকি বিজেপি-র বিধায়ক অসীম সরকারও এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে মতুয়া ভোট পেতে মরিয়া বিজেপি সম্পূর্ণ বেআইনি কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।

কিছু ভোটের আশায় বিজেপি মতুয়া তথা অন্যান্য উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নির্মম ঠাট্টা করছে। তাদের নানান অছিলায় বোঝানো হচ্ছে যে নাগরিকত্ব আইন লাগু করা হবে। আসলে নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে ভারতের নাগরিক হওয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে, বিশেষ করে উদ্বাস্তু মানুষদের পক্ষে। তাই ভোটের আগে বিজেপি-র বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে সোচ্চারে বলতে হবে যে সিএএ-২০০৩ এবং সিএএ-২০১৯ ভারতের সংবিধান এবং উদ্বাস্তু বিরোধী আইন। এই দুটি আইনকেই বাতিল করে সমস্ত মানুষের নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত করতে হবে।