আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ত্রয়োবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

বিকাশ বনাম বিপর্যয়


অবশেষে টানটান উত্তেজনার অবসান। ২৮-শে নভেম্বর সন্ধ্যায় উত্তরকাশীর সড়ক সুড়ঙ্গে আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিককে ১৭ দিন পর সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। ১৫টি সংস্থার ৬০০ উদ্ধারকারী প্রায় ৪০০ ঘন্টা দিনরাত এক করে এই উদ্ধার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের সম্মিলিত পরিশ্রম সার্থক হয়েছে এবং দেশবাসী নিশ্চিন্ত হয়েছে।

এই সুযোগে সংবাদমাধ্যমকেও ধন্যবাদ না জানালেই নয়। টিভি ও সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা প্রতিনিয়ত দেশবাসীকে জানিয়ে গেছেন - আর কত দূর এবং আর কত দেরি। ক্রিকেটের বিশ্বকাপ সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংবাদমাধ্যম উত্তরকাশীর সড়ক সুড়ঙ্গে বিপর্যয়ের ঘটনায় প্রকৃত অর্থে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাড়াতে থাকে উত্তেজনা। প্রতিযোগিতার পরিসরে বাস্তবের সঙ্গে মিশে যায় অনেক চোখ ধাঁধানো ছবি, বিশেষজ্ঞদের বয়ান। অথচ মেঘালয়ের অবৈধ কয়লা খনিতে এমনটা প্রায়ই ঘটে। ছোটখাটো দুর্ঘটনার খবর সাধারণত প্রকাশিত হয় না। অবরুদ্ধ শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হলে কিংবা ভূগর্ভে মৃত্যু হলে কখনও কখনও খবর পাওয়া যায়। অবিশ্যি মেঘালয়ের সঙ্গে উত্তরকাশীর অনেক পার্থক্য। উত্তরকাশীর বিপর্যয় মানে সরকারের স্বপ্নের চার ধাম প্রকল্পের উপর আঘাত। এমনিতেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্রুত গতিতে উদ্ধার কাজ শুরু না করলে হাজার বিজ্ঞাপন দিয়েও সরকারের মুখ ঢেকে রাখার উপায় থাকত না।

উদ্ধার পরবর্তী পর্বে শুরু হয়েছে নানানরকমের কাটাছেঁড়া। সমগ্র উদ্ধার প্রক্রিয়ার কৃতিত্ব দাবি করে অনেকেই আসরে অবতীর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেউ পিছিয়ে নেই। সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে কীভাবে উদ্ধার প্রক্রিয়া চালানো যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য অকুস্থলে আগত বিশেষজ্ঞ অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক বলে সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর এহেন উল্লাস। আবার বিপর্যয় মোকাবিলা সংস্থাসমূহ মূলত ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন হওয়ার জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর কৃতিত্বর দাবিদার। উদ্ধার পর্বের শেষ পর্যায়ে নিয়োজিত হয়েছিলেন ছ'জন এমন শ্রমিক, ভূগর্ভস্থ কাজকর্মে যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে। তাঁদের শ্রম ও অভিজ্ঞতা সাফল্য অর্জন করায় অনেকেই মনে করছেন চূড়ান্ত বিচারে মানুষের কাছে যন্ত্র পরাস্ত। বিষয়টি সম্ভবত এতটা সরলরৈখিক নয়। সমগ্র উদ্ধার পর্বে যন্ত্রের ভূমিকা একেবারে অস্বীকার করলে সত্যের অপলাপ হবে।

এরপর শুরু হয়েছে প্রকল্পের নকশা, নির্মাণ প্রক্রিয়ার ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে খুঁটিনাটি বিচার বিশ্লেষণ। শুরু হতে চলেছে পারস্পরিক দোষারোপের পালা। কর্মী-নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার তীব্র অভাব, সমাজ-অর্থনীতির বাস্তব সমস্যাগুলির দিকে হিমালয়সমান অবজ্ঞা এ দেশে ক্রমশই যেন অবহনীয় পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমিক সংগঠনগুলি কেন এত দিন এই নিরাপত্তা নিয়ে সরব হয়নি, কেন রাজনৈতিক দলের শ্রমিক নেতারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি, এ সব প্রশ্ন উঠতে পারে। কেন মন্দির নির্মাণে যে মনোযোগ, সুড়ঙ্গ নির্মাণে তার কিয়দংশও দেখা যায় না, এমন প্রশ্নও সামনে আসতে পারে। অতঃপর চিরকালীন পরম্পরা মেনে নিয়ে গঠিত হতে পারে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি। এইভাবে কালক্ষেপণ করার পর বোঝা যাবে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ।

তদন্ত-আলোচনা-গবেষণা ইত্যাদির পরেও কি উদ্ঘাটিত হবে এই প্রকল্পের তাৎপর্য? একবার তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করে দিলে এই প্রশ্ন আর করা যাবে না। তখন ভাসিয়ে দেওয়া হবে নির্লিপ্ত উত্তর - চুপ, তদন্ত চলছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২০১৬-য় চার ধাম প্রকল্পের বাস্তবায়নের কথা ঘোষণা করে দিলেন। অন্য সব প্রকল্পের মতোই চার ধাম সড়ক প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর ২০১৬-য় স্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী। এই প্রকল্পের মধ্যে উত্তরাখণ্ডে প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় সড়কগুলি চওড়া করার প্রস্তাব আছে যা নাকি উত্তরাখণ্ডের বিকাশের জন্য অপরিহার্য। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাই এখন যে কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। স্বাভাবিকভাবেই খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করার সুযোগ অন্তর্হিত।

চার ধাম প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নের সঙ্গে রাজনীতিও নিশ্চিত ভাবে জড়িয়ে ছিল। ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের কাছে যে চারটি তীর্থের মর্যাদা অনস্বীকার্য, সেগুলো হল উত্তরাখন্ডের বদ্রিধাম, গুজরাটের দ্বারকা, ওডিশার পুরী ও তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম। সর্বভারতীয় এই চার ধামের পাশাপাশি উত্তরাখন্ডের চারটি তীর্থস্থান কেদারনাথ, বদ্রিধাম, গঙ্গার উৎপত্তিস্থল গঙ্গোত্রী ও যমুনার উৎপত্তি যেখানে সেই যমুনোত্রী ‘ছোট চার ধাম’ বলে সুপরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় উত্তরাখন্ডের এই চার ধাম সড়কপথে সংযুক্ত করার ও রাস্তা চওড়া করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

কর্মযজ্ঞ শুরুর আগেই হোঁচট। পরিবেশবিদরা তো বটেই, স্থানীয় সচেতন জনতাও উত্তরাখন্ডে পাহাড় কেটে নির্মাণ কাজের প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশ সচেতন আন্দোলনকর্মীরা হিমালয়ে এই ধরনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞের তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বিকাশের নামে পাহাড় ভাঙা ও প্রকৃতির সামঞ্জস্য নষ্ট করা অর্থহীন ও যুক্তিহীন। পর্যটকদের সুবিধার জন্য লাগামহীন নির্মাণ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। যথেচ্ছ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরিরও প্রবল বিরোধিতা করে তাঁরা বলেছিলেন, এখনই রাশ না টানলে প্রকৃতি একদিন ঠিক শোধ নেবে।

বিকাশের ঝড় বইয়ে দেওয়ার জন্য সরকার কিন্তু সেই হুঁশিয়ারি মানেনি। সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি ছিল, চিন সীমান্ত সুরক্ষিত করতে ওই এলাকার রাস্তা চওড়া করা প্রয়োজন। রাস্তা চওড়া না হলে চিন সীমান্তে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করা সম্ভব হবে না। ২০২১-এর ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট সরকারের ‘প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যুক্তি’ মেনে প্রকল্পের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে কি না দেখার জন্য এক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে পরিবেশগত কাজগুলি সম্পাদন করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য প্রাক্তন বিচারপতি এ. কে. সিক্রির নেতৃত্বে একটি তদারকি কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত।

সুপ্রিম কোর্ট নিয়োজিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি জানিয়ে দেয় হৃষিকেশ থেকে চাম্বা যাওয়ার পথে এক-দুই জায়গায় ধস আগেও নেমেছে, কিন্তু বর্তমানে তার মাত্রা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে কুঞ্জপুরী স্থায়ী ধসপ্রবণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। অলকানন্দা উপত্যকার সাকনিধর এমনই আর এক নতুন স্থায়ী ধসপ্রবণ অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়েছে। উপত্যকার যত উপরে ওঠা যায়, ততই বাড়ে ধসের মাত্রা।

সেই সময়ে সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তা মেনে চার ধাম প্রকল্পের অধীন রাস্তা ১০ মিটার চওড়া করার যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন, তার নেতৃত্বে ছিলেন এখনকার প্রধান বিচারপতি ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড়। অন্য দুই বিচারপতি ছিলেন সূর্যকান্ত ও বিক্রম নাথ। তিন বিচারপতির সুপ্রিম কোর্টের এই বেঞ্চ ওই বছরের সেপ্টেম্বরে দেওয়া অন্য তিন বিচারপতির বেঞ্চের আদেশ সংশোধন করে এই রায় ঘোষণা করে। আগে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল উত্তরাখণ্ডে চার ধাম সড়ক সংযুক্তির অংশ হিসাবে যে তিনটি জাতীয় সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, তা ৫.৫ মিটার চওড়া করতে হবে। সরকারের নতুন আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট সংশোধিত আদেশ দিয়ে জানায় যে রাস্তাগুলি ১০ মিটার চওড়া করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এ যেন অন্তহীন হোঁচট খাওয়ার আখ্যান।

চার ধাম রাস্তা এত চওড়া করার বিষয়ে নতুন করে প্ৰশ্ন উঠেছে। প্রকৃতিরও সহ্যের সীমা রয়েছে এটা ভুললে চলে না। সবকিছু সাময়িক লাভ লোকসানের নিরিখে অথবা ভোট সংগ্রহের উপকরণ হিসেবে চালানো ঠিক নয়। বছরের প্রথম সপ্তাহে জোশিমঠের বিপর্যয়ের মাত্রা আরও বেড়ে না গেলে তার অভিঘাত কতদিন টিকে থাকবে বলা মুশকিল। আর কোনো রকমে একটু সামলে নিতে পারলেই আবার নতুন করে যথেচ্ছাচার শুরু হবে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। আশঙ্কা থেকেই যায়। প্রকৃতি বনাম বিকাশের লড়াইয়ে সব সময় প্রকৃতিরই যে হার হয়। তবে মানুষের সমবেত প্রতিরোধ কিন্তু প্রকৃতি পরিবেশকে রক্ষা করতে পারে। অন্যান্য দেশে তো বটেই ভারতবর্ষে এমনকি উত্তরাখন্ডেও তার দৃষ্টান্ত রয়েছে।

২০২৩-এর সূচনা পর্ব থেকেই হিমালয় পার্বত্যাঞ্চল বারেবারেই বিপর্যস্ত। উত্তরাখণ্ডের জোশিমঠের ডুবে যাওয়া থেকে হিমাচল প্রদেশে বন্যা এবং ভূমিধস, সিকিমে একটি হিমবাহী হ্রদ বিস্ফোরণ এবং উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীর কাছে সাম্প্রতিক সুড়ঙ্গের ধস বিপর্যয়ের সাক্ষী হয়েছে। যদিও এই ঘটনাগুলি ভিন্ন মনে হতে পারে, তারা আসলে একটি সংযুক্ত আখ্যান তৈরি করেছে যা এই অঞ্চলে অপরিকল্পিত তথা অবৈজ্ঞানিক বিকাশের প্রতিক্রিয়া। হিমালয়ে বিরাজমান তথাকথিত বিকাশের রূপরেখা লাদাখ থেকে অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। এবং তা পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে প্রমাণিত।

হিমালয় পর্বতমালা বিশ্বের সব থেকে নবীন এবং স্বভাবতই ভঙ্গুর। অথচ আজ পর্যন্ত এখানকার ভূতাত্ত্বিক (geological) ও ভূপ্রাকৃতিক (geomorphological) সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়নি। ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষায় জমির চরিত্র থেকে শুরু করে ভূগর্ভস্থ পাথর-খনিজ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। আর ভূপ্রাকৃতিক সমীক্ষায় ভূগর্ভস্থ পাথর, জলের স্তর বিন্যাস, ভূমিকম্প প্রবণতা ইত্যাদি সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিবরণ পাওয়া যায়। তার থেকে বোঝা যায় এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে সামান্য পরিবর্তন কী কী অঘটন ঘটাতে পারে। সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্রের সম্পর্কে আগাম ধারণা বাদ দিয়েই রচিত হয় বিকাশের রূপরেখা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে আদৌ কোনো বিচার বিবেচনা করা হয় কিনা বলা মুশকিল। ভূপ্রাকৃতিক সমীক্ষার ফলাফল ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে যথাযথ অনুমান পরিকল্পনা প্রণয়নের স্তরে আলোচনা করলে ভঙ্গুর বাস্তুসংস্থানকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ বিপর্যয়ের প্রবণতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো কি? হিমালয় অঞ্চলে ধারাবাহিক বিপর্যয়, যেমন মেঘ বিস্ফোরণ বা আকস্মিক বন্যা কিংবা হড়পা বান শুধুমাত্র প্রাকৃতিক ঘটনা হিসাবে উপেক্ষা করে বিকাশের জয়ধ্বজা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে একের পর এক বিপর্যয় ঘটে চলেছে।

চার ধাম জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ এমন একটি অবৈজ্ঞানিক প্রকল্পের উজ্জ্বল উদাহরণ যা এই অঞ্চলে পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য এককভাবে দায়ী। ডিসেম্বর ২০১৬-য় শুরু করা প্রকল্পটি কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, যমুনোত্রী এবং গঙ্গোত্রীর তীর্থস্থানগুলির সঙ্গে সংযোগসূত্র হিসেবে পরিচিত। রাস্তা প্রশস্তকরণ, সুড়ঙ্গ নির্মাণ, ফ্লাইওভার এবং বাইপাস অন্তর্ভুক্ত করে ১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি হিমালয়ের মধ্য দিয়ে প্রায় ৮৮৯ কিলোমিটার পরিক্রমা করবে বলে জানানো হয়েছে। উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও, সড়ক প্রকল্পটির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে গুরুতর ত্রুটি রয়েছে যা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। প্রকল্পটির অগ্রগতির সুবিধার্থে আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। ১০০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ প্রকল্পগুলির জন্য বাধ্যতামূলক পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটিকে এড়িয়ে যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ের গায়ে সড়ক নির্মাণের জন্য 'ব্যুরো অফ্ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস্' অনুমোদিত মাপকাঠি (specification) না মেনে এখানে সমতলের সড়ক নির্মাণের মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়েছে।

বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাহাড়ের ঢাল কাটা ও ভূমিধসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক সুরক্ষা উদ্ভিজ্জ আবরণ অপসারণ শুরু করা হয়েছে, যার ফলে গত কয়েক বছরে গড়ে প্রতিদিন একটি ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। ঢালের দুর্বলতা বিশ্লেষণের অভাবের কারণে, বেশ কয়েকটি বিভাগে উল্লম্ব বা প্রায়-উল্লম্ব ঢাল কাটা হয়েছে, যা পাহাড়ের চরিত্রকে ভূমিধসের ঝুঁকিতে ফেলেছে। ইতিমধ্যে, নির্মিত বেশিরভাগ ঢাল হয় ধসে গেছে বা কখনও কার্যকর হয়নি। এতদসত্ত্বেও পরিকল্পনা সংশোধনের জন্য কিছুই করা হয়নি। সরকারের একটিই লক্ষ্য রাস্তা প্রশস্ত করতে হবে এবং তা দ্রুত!

চার ধাম প্রকল্পের জন্য সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিমালয়ের সমৃদ্ধ উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত। প্রকল্প নির্মাণের জন্য প্রায় ৬০০ হেক্টর বনভূমি সাফ করা হয়েছে। ৫৬ হাজারেরও বেশি গাছ কেটে ফেলার ফলে উত্তরাখণ্ডের সামগ্রিক বনাঞ্চল প্রভাবিত হয়েছে। অবিরাম গাছ কাটা গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি ভূমিধস অঞ্চল তৈরি করেছে। এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে এই প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গাছের প্রকৃত সংখ্যা অনুমোদিত পরিমাণের অন্তত দ্বিগুণ। কারণ নির্মাণ কার্যকলাপ এবং ঢাল কাটার ফলে সৃষ্ট নতুন ভূমিধসের ফলে উপড়ে পড়া গাছের হিসাব বিবেচনা করতে হবে। ৯০০ কিলোমিটার প্রসারিত দেবদারু, চিরহরিত পাইন, খয়ের, বেল এবং অন্যান্য গাছের বনভূমির পরিবর্তে পরিবেশ মন্ত্রকের নির্দেশিকা অনুযায়ী রোপন করা চারাগাছ কোনো বিকল্প হিসেবে গণ্য করা যায় কি? কত শত বছরের পুরোনো গাছের জায়গায় নতুন চারাগাছ লাগালেই কি বনভূমি সৃষ্টি করা যায়? খেয়াল থাকে না যে চারাগাছ রাতারাতি বনস্পতি হয়ে যেতে পারে না।

নদী এবং বনে অবিরাম ধ্বংসাবশেষ ডাম্পিং এই প্রকল্পের আরেকটি পরিবেশগত বিপদ; উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির প্রতিবেদনে এ বিষয়ে সতর্কতা নিতে বলা হয়েছে। এই অঞ্চল থেকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি নদী, গঙ্গা এবং যমুনা, যাত্রা শুরু করে সমতলের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। উত্তর ভারতের জল নির্ভরতার বেশিরভাগই এই দুটি নদীর উপর হওয়া সত্ত্বেও তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে চার ধাম প্রকল্প সম্পূর্ণরূপে উদাসীন। অথবা বলা যায় বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্নের প্রকল্পের সমান্তরাল আরেকটি প্রকল্প এই অঞ্চলের দুর্যোগ সম্ভাবনার পরিপূরকঃ ৩৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ চার ধাম রেলওয়ে প্রকল্প। আনুমানিক ৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে, এখানকার ভূতত্ত্ব উপেক্ষা করে অনেকগুলি সুড়ঙ্গ সমৃদ্ধ এই রেলপ্রকল্পটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে উত্তরাখন্ডের সামগ্রিক বিপর্যয়ের জন্য সুড়ঙ্গ খনন, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সর্বোপরি সড়ক প্রশস্তকরণের ফলে অবিরাম পাহাড় লুণ্ঠন দায়ী।

বারকোটের কাছে সাম্প্রতিক সুড়ঙ্গ ধসের ঘটনা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এটি একটি আরও ব্যাপক সমস্যার লক্ষণঃ হিমালয়ে অপরিকল্পিত উন্নয়ন। মানব ক্রিয়াকলাপ বা, আরও স্পষ্টভাবে, রেল এবং সড়ক নেটওয়ার্ক, বৃহৎ আকারের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং এর মাধ্যমে হিমালয় অঞ্চলের 'বিকাশ' করার সরকারের পরিকল্পনা, জলবায়ু-সংরক্ষিত হিমালয়ে দুর্যোগের সংখ্যা এবং তীব্রতা বাড়িয়েছে। তীর্থযাত্রার সংযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে চার ধাম জাতীয় মহাসড়ক প্রকল্প, বন উজাড়, ভূমিধস এবং এই অঞ্চলের নমনীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি সহ পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। একটি পার্বত্য রাজ্য হিসাবে, উত্তরাখণ্ড এই উদ্ভাসিত পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকার।

যে রাজনৈতিক দল ভোটের জন্য ধর্ম ফেরি করে বলতে পারে - নির্বাচনে জয়ী হলে সরকারের আনুকূল্যে বিনামূল্যে রাম মন্দির দর্শনের ব্যবস্থা করা হবে, তারা আর যাই করুক চার ধাম প্রকল্প বাতিল করতে পারে না। তবে দেশের প্রকৃতি-পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্রে সুরক্ষিত রাখতে, বিশেষত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেশকে বাসযোগ্য করে তোলার তাগিদে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ একজোট হয়ে রুখে দাঁড়াতে পারলে নিশ্চিতরূপে স্তব্ধ হতে পারে এই অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিত (তথাকথিত) স্বপ্নের প্রকল্প।