আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

মানুষ চিনতে ভুল হয় কেন এতো

অম্বিকেশ মহাপাত্র


কীভাবে মানুষ চিনবেন

কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন, সাহিত্য–সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান চর্চা, স্বাধীনতা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন,... সবকিছুতেই বাঙালি তথা বাংলা দেশবাসীকে পথ দেখিয়েছে; বিশ্বের দরবারে বাঙালি তথা বাংলার পরিচিতিলাভ ঘটিয়েছে। যাঁদের হাত ধরে বিশ্বের দরবারে এই পরিচিতিলাভ তাঁরা সকলেই বাংলার রত্নরাজীর এক-একটি হীরে-মাণিক। তাঁদেরই একজন হীরে-মাণিক, মাণিকবাবু অর্থাৎ বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায় ৭০ বছরে প্রয়াত হন। তাঁর পরিচালিত শেষ চলচ্চিত্র ‘আগন্তুক’। ‘আগন্তুক’-এর কাহিনিকার এবং চিত্রনাট্যকার সত্যজিৎ রায় স্বয়ং। ‘আগন্তুক’ থেকে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা উল্লেখের প্রয়োজন।

আগন্তুক - "এতে কি প্রমাণ হল? তুমি বলবে আইডেনটিটি। আমি বলবো তাও নয়।... এই বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির যুগে পাসপোর্ট জাল করবার কতরকম ফিকির আছে, তুমি জান? দিস্ পাসপোর্ট প্রুভস নাথিং। সুতরাং আমাকে অবিশ্বাস করবার পূর্ণ অধিকার তোমার আছে"।

- "তুমি করলে অন্যায়? আমি কি জানি না, কি কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলাম তোমায়? তার কারণ ছিল মা। একটা পাসপোর্ট থেকে কি জানা যায়? নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে নাও, ছবির সঙ্গে মুখ মিলিয়ে নাও। তাতে তো মানুষটাকে চেনা যায় না। তার জন্য সময় লাগে। সেই সময়টার দরকার ছিল"।

পরিণত বয়সে সত্যজিৎ রায়ের অভিজ্ঞতালব্ধ উপরোক্ত গল্প থেকে অত্যন্ত পরিষ্কার - বংশ-পরিচয়, শিক্ষাগত-যোগ্যতা, শংসা-পত্র, আইডেনটিটি কার্ড, পাসপোর্ট,... ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে, মানুষকে বিশদে জানতে হবে, তাঁর কার্যাবলী নিরীক্ষণ করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে। তারপরেই নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব।

বঙ্গবাসী কী মানুষ চিনতে ভুল করেছেন

এই প্রেক্ষাপটে আজ বাংলায় চাকুরি, রেশনের চাল, আম্ফানের ত্রাণের ত্রিপল, রেগায় ১০০ দিনের কাজের টাকা, আবাস যোজনায় বাড়ি তৈরির টাকা, স্কুলে মিড-ডে মিলের চাল,... ইত্যাদি চুরি এবং বে-আইনি কয়লা, বালি, পাথর, গোরু পাচার সহ নানান বে-আইনি কাজ আজ প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেছে। কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম এবং একাংশের বুদ্ধিজীবী ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাজে লাগিয়ে এই সকল চুরি ও দুর্নীতিকে সামাজিকীকরণের প্রাণান্তকর চেষ্টাও চলছে। এই সকল চুরি ও দুর্নীতি আদালতের নির্দেশে তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসার পরেও চুরি ও দুর্নীতি এবং তার সঙ্গে গণতন্ত্র নিধন-যজ্ঞ ও নাগরিক অধিকার হরণ সবই বেপরোয়া গতিতে চলছে! বুক ফুলিয়ে চলছে! এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচন তারই প্রকৃষ্ট ও জ্বলন্ত উদাহরণ। তাই বাংলা আজ সার্বিক নৈরাজ্যের শিকার। শিক্ষা-ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক-ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন, নীতি-নৈতিকতা সব, হ্যাঁ সবই গভীর খাদের কিনারায়। যে বাংলার গৌরবোজ্জ্বল অতীত, সেই বাংলায় কেন এমন হল? তার কারণ ২০১১ সালে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত তথাকথিত ‘মা-মাটি-মানুষ’ সরকার এবং তার নেতৃত্বে তথাকথিত ‘সততার প্রতীক’ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। যিনি শাসকদলের একমেবাদ্বিতীয়ম এবং প্রশাসনেরও একমেবাদ্বিতীয়ম। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রীর দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী তথা বিধানসভার উপাধ্যক্ষের বক্তব্য - “আমাদের দলে একটি পোস্ট বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট”।

এখানে একটি প্রশ্ন অবধারিতভাবে ওঠে, উঠবেই। ২০১১ সালে বাংলার মানুষ কি তথাকথিত ‘সততার প্রতীক’ মাননীয়াকে চিনতে পারেননি? ২০১১ সালের আগে দীর্ঘ সময়কাল রাজনীতির ময়দান সহ সংসদীয় রাজনীতিতে তথাকথিত ‘সততার প্রতীক’ মাননীয়া ছিলেন। মাননীয়ার কার্যকলাপ বাংলার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। তা সত্ত্বেও বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মানুষ চিনতে ভুল হয় কী করে? অভিজ্ঞতা থেকে প্রাসঙ্গিক কথা বলা প্রয়োজন।

হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, যে সংগঠনের স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনও অংশগ্রহণ ছিল না, বরং অন্তর্ঘাত ছিল, সেই সংগঠন আরএসএসের রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র আত্মপ্রকাশ ১৯৮২ সালে এবং সংসদীয় রাজনীতিতে সক্রিয়। বিজেপি দলের নেতৃত্বে অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবানী... প্রমুখ। রাজ্যের পাশাপাশি কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় পৌঁছানোর জন্য সব রাজনৈতিক দল চেষ্টা করবে, বিজেপিও করবে, এটাই স্বাভাবিক। সেই লক্ষ্যে রথযাত্রা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস,... ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কর্মসূচির মাধ্যমে হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে বিজেপি তার সাংগঠনিক বিস্তারলাভ ঘটাতে সক্ষম হলেও, রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবি-নজরুল-সুকান্তের বাংলায় দাগ কাটতে পারছিল না। আরএসএস বিকল্প পথের সন্ধান করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কমিটির মধ্যে উচ্চাভিলাষী, ঝুঁকি নিতে পারে, নাটক করতে পারে, মিথ্যে অনায়াসে অনর্গল বলতে পারে, সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন,... এমন একজনকে খুঁজতে থাকে। খুঁজে পেয়েও যায়। ফলশ্রুতিতে ১লা জানুয়ারি ১৯৯৮ রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবি-নজরুল-সুকান্তের বাংলায় কংগ্রেস ভেঙ্গে নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) তৈরি হয়। আত্মপ্রকাশ সময়কালে মাননীয়া দলনেত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন - "বিজেপি অছ্যুৎ নয়"। শুধু বলা নয়, কাজে করে দেখানোর পবিত্র কর্তব্য সামনে। সেই কারণেই ১৯৯৮ সালে লোকসভা নির্বাচনে টিএমসি-বিজেপি নির্বাচনী জোট। ফলশ্রুতিতে টিএমসি-র ৭টি আসনের সঙ্গে বিজেপি ১টি লোকসভা আসনে জয়লাভ করে অনায়াসে। উল্লেখ্য, যে দল ১৯৮২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বাংলায় একটি জেলা পরিষদ আসন জয়লাভের আশা করেনি এবং জয়লাভও করেনি, সেই বিজেপি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সূতিকাগারে, প্রথম পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ। পরের বছর ১৯৯৯ সালে পুনর্বার লোকসভা নির্বাচন। পুনর্বার টিএমসি-বিজেপি নির্বাচনী জোট। এবার টিএমসি-র ৮টি আসনের পাশাপাশি বিজেপি ২টি আসনে জয়লাভ। শুধু তাই নয়। কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। টিএমসি দলনেত্রী জোট সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী তথা রেলমন্ত্রী। যে দপ্তরের মন্ত্রীর স্বাধীন বাজেট পেশের ক্ষমতা। ভাবুন, টিএমসি দল গঠনের দেড় বছরের মধ্যে দলনেত্রী ক্যাবিনেট মন্ত্রী। এর আগে বাংলায় কংগ্রেস ভেঙ্গে নতুন দল হয়েছে, কিন্তু কেউ বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। তারা পরে কংগ্রেসে ফিরেছে নতুবা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আরএসএস-এর সহযোগিতায় টিএমসি প্রশ্নাতীত সফলতা অর্জন করে।অতএব আর পেছন ফিরে তাকানো নয়, কংগ্রেস দল ভেঙ্গে টিএমসি দলের বিস্তারলাভের প্রভূত সুযোগ। এই সুযোগ হাতছাড়া কেউ করে? দলনেত্রী করেননিও। প্রয়োজন মতো কখনও বিজেপি, কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে অর্থাৎ ঝোপ বুঝে কোপ মেরে, নিজের দলের সুবিধের পাশাপাশি বিজেপিকে সুবিধে করে দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন।মাননীয়া কংগ্রেসের পাশাপাশি বামশক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। ২০০১ সালে, বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনে টিএমসি বিরোধী দল, সঙ্গে বিরোধী দলনেতা। খুশি, ভীষণ খুশি হয়ে মাননীয়া গুজরাট দাঙ্গায় হাত পাকানো মোদিকে, গুজরাট বিধানসভায় নির্বাচিত হওয়ায়, ফুল পাঠিয়ে দিলেন।

২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে দেশবাসী পরাস্ত করেন। বাংলায় বিজেপির আসন সংখ্যা শূন্য, টিএমসি-র ১। মাননীয়া কৌশল পাল্টে ফেলেন। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবি-নজরুল-সুকান্তের বাংলায় প্রকাশ্যে আপাতত বিজেপি থেকে দূরে থাকতে হবে। পাশাপাশি বামবিরোধী সমস্ত (অতিবাম, বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসবাদী, সাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদী...) শক্তিকে একত্রিত করতে হবে এবং রাজ্যজুড়ে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সমস্ত উন্নয়নমূলক কাজে সরকারকে বাধা দিতে হবে। তার জন্য কর্পোরেট পুঁজি, চিটফান্ড সংস্থার সাহায্য, যা যা দরকার সবের সাহায্য নিতে হবে। এই সময়কালে রাজ্যে কী না ঘটেছে! তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়ে মাইন বিস্ফোরণ, বিধানসভা ভাঙচুর, ২১ দিন দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে বন্ধ করে রাখা, ধর্মতলায় ২৬ দিন তথাকথিত অনশন, সিঙ্গুর থেকে টাটা মোটর্স কারখানা সানন্দে পাঠানো, নন্দীগ্রামকে মুক্তাঞ্চলে পরিণত করা, নেতাইয়ে গণহত্যার ছক রূপায়ন করা, দিনের পর দিন জঙ্গলমহলে একতরফা খুন, জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস ট্রেনে নাশকতা... তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। সঙ্গে কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমের মিথ্যা, অর্ধসত্য, অতিরঞ্জিত এবং বিষাক্ত অপপ্রচার ২৪ ঘন্টা; সঙ্গে বুদ্ধিজীবিদের মদত। নৈরাজ্যের শীর্ষে ২০১১ সালের নির্বাচনে টিএমসি দলনেত্রী নেতৃত্বাধীন মহাজোটের তথাকথিত ‘মা-মাটি-মানুষ’ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

মানুষ চিনতে ভুল কেন

যে নেত্রী প্রথম সংসদীয় নির্বাচনে ভুয়ো 'ডক্টরেট' ডিগ্রি ব্যবহার করে নির্বাচকমন্ডলীকে প্রতারিত করতে পারেন; যিনি উচ্চাশা পূরণে নিজের দল ভেঙ্গে নতুন দল গড়ে আরএসএসের সঙ্গে অনায়াসে হাত মেলাতে পারেন; যিনি দাঙ্গায় ধিক্কৃত ব্যক্তিকে ফুল পাঠাতে পারেন; যিনি সংবিধানের বই হাতে নিজদলের জনপ্রতিনিধিদের উত্তেজিত করে গণতন্ত্রের পীঠস্থান বিধানসভা ভাঙচুর করাতে পারেন; যিনি রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে কবরস্থ করতে দ্বিধা করেন না; যিনি নাশকতায় মদত দিতে পারেন; যিনি যেকোনো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে অনায়াসে হাতে মেলাতে পারেন (উল্লেখ্য, কাজের সময় কাজী কাজ ফুরোলে কিষাণজী); তিনি যখন শাসকদলের একমেবাদ্বিতীয়ম পাশাপাশি সাধারণ প্রশাসন সহ পুলিশ প্রশাসনের একমেবাদ্বিতীয়ম তখন সমাজের সকল সমাজবিরোধী এবং দুষ্কৃতকারী আশ্বস্ত হবে, উল্লসিত হবে। শাসকদলের ছাতার তলায় নিরাপদ আশ্রয় খুঁজবে, সমাজবিরোধী এবং দুষ্কৃতকারীরা শাসকদলের মধ্যে নিজেদের গুরুত্ব বাড়াবে। এবং সরকারকে যেনতেন প্রকারে টিকিয়ে রাখতে প্রাণপাত করবে। এটাই প্রকৃতি বিজ্ঞানের নিদান ও বিধান, এটাই স্বাভাবিক। সেই কারণে মুখ্যমন্ত্রী দুষ্কৃতকারীদের থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে সশরীরে থানায় উপস্থিত হয়ে যাবেন; বলবেন - "আমি গুন্ডা কন্ট্রোল করি" এবং বলবেন - "বিরোধীরা চুপ থাকুন", স্বাভাবিক। রাজ্যব্যাপী জুলুম, চোখ-রাঙানি, ঘুষ, চুরি, দুর্নীতি, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ, বোমা-পিস্তলের যথেচ্ছ ব্যবহার বাড়বে, এও স্বাভাবিক। চাকুরি-চাল-ত্রিপল... প্রভৃতি চুরি এবং কয়লা-বালি-পাথর-গরু পাচার, নিয়োগ-দুর্নীতি, রেশন-দুর্নীতি, পুর-দুর্নীতি... সবই, হ্যাঁ সবই প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করবে, সামাজিকীকরণের চেষ্টা হবে, অবাক হওয়ার কি আছে? দিনের পর দিন নৈরাজ্য, দুর্নীতি, গণতন্ত্র নিধন, নাগরিক অধিকার হরণ, ভোটলুট বল্গাহীনভাবে বাড়বে, অবাক হওয়ার কি আছে?

বিশ্বাস করি - রাজতন্ত্রে রাজা যদি প্রজা-বৎসল হয়, সেই রাজ্যে প্রজারা সুখে-শান্তিতে থাকেন। আবার প্রজাতন্ত্র তথা সাধারণতান্ত্রিক দেশে প্রশাসনিক প্রধান যদি 'গুন্ডা কন্ট্রোলার' হন, 'অসৎ' হন, 'মিথ্যাচারী' হন,... সেই দেশের নাগরিকের নাগরিক অধিকার দিনের পর দিন আক্রান্ত হবে এবং জীবন-জীবিকা বিপন্ন হবে; এ এমন নতুন কথা কি? মানুষ চিনতে সাধারণ মানুষের সাময়িক ভুল হতে পারে, হয়ও। কিন্তু উচ্চমেধাসম্পন্ন সুশীল সমাজ এবং বুদ্ধিজীবীদের ভুল হয় কী করে? ব্যক্তিস্বার্থ পূরণে এই ভুল যে ইচ্ছাকৃত ছিল, তা তথাকথিত ‘মা-মাটি-মানুষ’ সরকারের ১২ বছর কার্যকালের ঘটনাবলীতে প্রমাণিত। পাশাপাশি এও প্রমাণিত - রাজ্যজুড়ে দুর্নীতি, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী রাজ্য প্রশাসন কাজ করছে না। শাসকদলের একমেবাদ্বিতীয়মের নিদান ও বিধানে কাজ হচ্ছে; যা গণতান্ত্রিক সংসদীয় রাজনীতির বিপরীতে। ফলে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পথে এই সরকারকে সরানো সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, সিআইডি, সিবিআই, ইডি, বিডিও, এসডিও, ডিএম, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার, নেতা, বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী, মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ, এসএসসি-র চেয়ারম্যান, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি,... সকলের কাজকর্ম বিচার-ব্যবস্থার পর্যবেক্ষণে প্রতিভাত। শিক্ষক-নিয়োগ, পুর-নিয়োগ, বনসহায়ক-নিয়োগ, রেশন-বন্টন, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, আবাস যোজনায় বাড়ি তৈরি,... সর্বত্র প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। এমনকি পুর নির্বাচন, পঞ্চায়েত নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করতে সবেতেই দুর্নীতি। প্রচুর মানুষের প্রাণহানি। অন্যান্য প্রসঙ্গ নাই বা বললাম।

মস্তিষ্ক প্রক্ষালণ যন্ত্র

আরএসএসের পরিকল্পনায় এবং কর্পোরেট পুঁজির ব্যবহারে, আজ বাংলায় মাননীয়ার নেতৃত্বে টিএমসি শাসকদল এবং বিজেপি বিরোধী দল। বাম এবং কংগ্রেস দলের বিধায়ক সংখ্যা যথাক্রমে শূন্য এবং শূন্য। টিএমসি-র বিশ্বস্ত সেনাপতি এখন বিরোধী দলনেতা। টিএমসি এবং বিজেপি দলের মধ্যে অনায়াস যাতায়াত। বাম এবং কংগ্রেস দল ভাঙাতে এবং পঞ্চায়েত সদস্য, পঞ্চায়েত সমিতি সদস্য, জেলা পরিষদ সদস্য, বিধায়ক কিনতে ভয়ভীতি-অর্থ-প্রশাসন-অধ্যক্ষের প্রয়োগ যথেচ্ছ, এবং তা প্রমাণিত। প্রকৃষ্ট উদাহরণ দিপালী বিশ্বাস, বায়রণ বিশ্বাস,...। এই পরিস্থিতিতে প্রতিদিন কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেলের প্রাইম টাইমে সান্ধ্যবাসরে টিএমসি-বিজেপি মধ্যে ছায়াযুদ্ধ। বিপন্ন মানুষের জীবন-জীবিকা, কর্মসংস্থান, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যমূল্য, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, নাগরিক অধিকার মায় সংবিধান সবই সান্ধ্যবাসরে আলোচনার বাহিরে।

তবুও সাধারণ মানুষ তার অভিজ্ঞতায় প্রতিদিন শিখছেন। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে সামিল হচ্ছেন, বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে শাসকদল ও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। গণতন্ত্রে জনগণের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ বিদ্রোহে পরিণত হবেই। ইতিহাস তার স্বাক্ষী। তখন সকল সম্প্রদায়ের মানুষ, সকল পেশার মেহনতি মানুষ জোটবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র তথা নাগরিক অধিকার তথা সংবিধান রক্ষা করবেন। সেদিন আসবেই, আজ হোক, কাল না হয় পরশু।