আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪৩০

প্রবন্ধ

গোরিলা জীবন

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়


সুলেখক অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী নানা বিষয় নিয়ে লিখে ইতিমধ্যেই নিজেকে সুলেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। সম্পাদক হিসেবেও তাঁর যোগ্যতা এবং দক্ষতা প্রশ্নাতীত। গরিলার ঘরকন্না বইটি তাঁর নিজস্ব ঘরানার গল্প-র থেকে পাঠককে এক অন্য স্বাদ এনে দেবে। যাকে আমরা ইংরেজি কেতায় 'পোস্টস্ক্রিট' বলে থাকি, এই বইটির শুরু হচ্ছে সেই পোস্টস্ক্রিপ্ট দিয়ে, বাঙালি পাঠকের পাঠ-রসনার তৃপ্তির জন্য তিনি এই অংশের এক জব্বর নাম দিছেন, 'মুখশুদ্ধি'।

রিচার্ড লিকি-র স্নেহধন্যা ওরাংওটাং-গোরিলা-শিস্পাঞ্জি গোষ্ঠী, জীববিজ্ঞানীরা এইসম স্তন্যপায়ীদের বর্গীকৃত করেছেন 'প্রাইমেট' হিসেবে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় যে এই শিম্পাঞ্জি, তাদের তুতো ভাই-বেরাদর বোনোবো, ওরাংওটাং-রা আধুনিক মানুষের ভাষায় 'বৃহৎ নরকপি' বা 'গ্রেট এপ' - তাদের প্রকাণ্ড চেহারার কারণে, অর্থাৎ অবয়ব ও আকৃতিগত কারণে এই 'গ্রেট' কথাটির আবির্ভাব ঘটেছে। এদের চলন-বলন এবং আচার-আচরণের মধ্যে আদি থেকে আধুনিক মানুষের আচরণ-প্রকরণের সঙ্গে মিল অনেক, বিশেষত বুদ্ধিমত্তার নিরিখে আমরা যদি বানর বা সমগোত্রীয় জীবেদের সঙ্গে তুলনা করি। আর তার পাশাপাশি যদি আমরা গিবন জাতীয় কপিদের সেইসব বৈশিষ্ট্যের তুলনা করি, তাহলে এই দুই গোষ্ঠীকে আলাদা না করে আমাদের উপায় নেই; সেই পার্থক্যের নিরিখে এই গিবন জাতীয় প্রাণিদের নামকরণ হয়েছে 'লেসার এপ', সাদা বাংলায় 'খাটো এপ'।

মানুষের হাব-ভাব, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এখনও বিজ্ঞানচর্চার ধোঁয়াটে অঙ্গনের যে বিরাট গবেষণাক্ষেত্রটি পড়ে আছে, সেখানে স্বভাবতই এই 'গ্রেট এপ'-দের আচার-আচরণ বিষয়ক গবেষণা সিরিয়াস গবেষকদের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। এমনই এক বিরল ব্যক্তিত্ব, ডিয়ান ফোসে-র জীবন কাহিনি নিয়ে অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী এক মনোরম কাহিনি বুনেছেন, শেষের দিকে এনেছেন এই কাহিনির সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডির কথা, চোরা শিকারিদের হাতে ফোসে-র নির্মম ও নৃশংস মৃত্যুর ভায়াবহ কাহিনিও।

এই বইটিতে শ্রী গোস্বামী যেমন ফোসে-র 'গোরিলা ইন দ্য মিস্ট' বইটির কিছু নির্বাচিত অংশের ছায়া-অনুবাদ করেছেন, তেমনি এই বিষয়ের অন্যান্য আকর গ্রন্থের সাহায্যে তিনি গোরিলা বংশ ও তাদের আদরের 'মাতামহী' শ্রীমতি ফোসে-কে জীবনবৃক্ষের আপাতত শীর্ষে অবস্থানকারী আরও এক 'প্রাইমেট' - মানুষের সঙ্গে সেই আদি যুগান্তের সাধারণ পূর্বসূরির আত্মীয়তার অমোঘ অবচেতনাকে আধুনিক অর্থে মুন্সিয়ানার সঙ্গে মূর্ত করে তুলেছেন।

১৩ বছর ধরে আফ্রিকার এক প্রত্যন্ত প্রান্তে ফোসে গভীর বনানীর গহন অভ্যন্তরে যে প্রজাতিকে 'মাউন্টেন গোরিলা' নামে অভিহিত করা হয়, তাদের নিয়ে ফোসের গভীর গবেষণা-অনুসন্ধান যে কেবল এক রোমাঞ্চ কাহিনিই নয়, তা মানুষের আদি খোঁজার আদি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর অনুসন্ধানের এক মরমী কাহিনিও। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর কলমে তুলে ধরতে হলে অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর বইটি থেকে তিনটি উদ্ধৃতি আমাদের তাঁর দরদি কলম আর স্পর্শকাতর মননের সন্ধান দিই।

"ডায়ান ফসির প্রসিদ্ধি তাঁর ব্যতিক্রমী জীবন এবং গোরিলাদের নিয়ে তাঁর অসাধারণ গবেষণার কারণে, তাঁর রচিত গ্রন্থটির জন্যে নয়। ...বস্তুতপক্ষে স্রষ্টার খ্যাতির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর সৃষ্টি। লেখিকার বহির্জীবন লক্ষ করে রোয়ান্ডিজরা যথার্থভাবে তাঁকে আখ্যায়িত করেছিল ‘নিয়ারামাচাবেল্লি' (যে নারী জঙ্গলে একা পুরুষবর্জিত জীবন কাটায়) অভিধায়।" (পৃষ্ঠা-১৩)

অন্যত্র গোস্বামী লিখেছেন, "...গোরিলাদের স্পষ্টভাবে দেখতে গেলে দুটি মনুষ্যনেত্র বাদেও একটি তৃতীয় নয়নের প্রয়োজন হয়। তাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এক যুগেরও বেশি সময় কাটানোর ফলে ডায়ান সেই তৃতীয় নয়ন অর্জন করেছিলেন।... ‘নিয়ারামাচাবেল্লি’ শব্দের অস্তিত্ব বাস্তবে যদি না-ই থাকে বা গোরিলা বাচ্চাদের নৃত্যবাদ্য যদি অবাস্তবও হয়, একজন সাহিত্যরসিকের বোধে তা বাস্তব হয়ে উঠতেই পারে। ...মানবসমাজের অনেকখানি আররণ নিজের মানসিকতা থেকে খসিয়ে ফেলেও ডায়ান ফসি কীভাবে সাহিত্যবোধের এই উচ্চতাকে ছুঁইয়ে ফেলতে পারলেন সেটাই আশ্চর্যের।" (পৃষ্ঠা-২১)

ডিয়ান ফসে ১৯৬০ সালে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিজ্ঞানে পি.এইচডি. ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঠিক কতটা, সেটা পণ্ডিতমহলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে বিচার্য বিষয় ছিল না কখনোই। তিনি নিজেকে সারা পৃথিবীর মধ্যে বৃহৎ নরকপি বিষয়ে অবিসংবাদিত বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ফোসি তাঁর নিজস্ব গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেখান যে পাহাড়ি গোরিলাদের সমাজবদ্ধতা আছে, তাদের সমাজ-সংগঠন উদ্ভূত কৃষ্টি আছে, মানব সমাজের আদলে স্তরভেদ আছে, আছে আগের প্রজন্মের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, মৃতদের প্রতি সম্মান।

নানাদিক বিবেচনা করে তিনি শিম্পাঞ্জি, গোরিলা এবং ওরাংওটাং-এর মধ্যে পার্থক্যর উপাদানগুলি চিহ্নিত করেন। ফোসে অনেকগুলি গোরিলার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন, যে অর্থে আমরা 'পোষ মানানো' বলে থাকি, মোটেই এই সম্পর্ক সেই জাতেরই নয়। তাঁর গোরিলাদের তিনি নাম দেন সুবিখ্যাত বৃন্দবাদন স্রষ্টাদের নামে - যেমন বার্টক, ব্রাহামস, বেটোভেন। শ্রী গোস্বামী এই বিষয়টি কিছুটা বিস্তারেই আমাদের গোচরে এনেছেন। গোরিলাদের সঙ্গে এই প্রকৃত সখ্য গড়ে তুলতে এক এক জনের বিশ্বাস ও প্রকৃত বন্ধু ও সহমর্মী হয়ে উঠতে তাঁর সময় লেগেছিল এক থেকে দেড় বছরের মতো।

তাঁর ছিলো যথাক্রমে আটজন ও চারজন গোরিলার এক প্রকৃত বন্ধুর দল, যাঁদের খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে তিনি তাঁর গবেষণাকে ক্রমশ সমৃদ্ধতর করে তুলতে থাকেন। তাঁর পর্যবেক্ষণের সময়কাল ছিল ২ হাজার ঘণ্টারও বেশি! তাঁর প্রিয় গোরিলা ছিল ডিজিট। গোরিলাদের কাজ করতে গিয়ে তিনি আফ্রিকার যে তিনটি দেশের মধ্যে পাহাড়ি গোরিলাদের বাসস্থান পড়ে, সেই অঞ্চলে গোরিলা সংরক্ষণের কাজে জড়িয়ে পড়েন এবং অচিরেই চোরা শিকারিদের বিষনজরে পড়েন। গোরিলাদের মধ্যে ব্যক্তিগত অসূয়া বা বিদ্বেষের অভাস তিনি পাননি, গোরিলা সমাজের এই বৈশিষ্ট্য তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। ডিয়ানাকে 'উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার' অভিপ্রায়ে চোরা শিকারিরা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ মদতে তাঁর প্রিয় গোরিলা, ডিজিট-কে যে কেবল বিষমাখানো তীর দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে তা-ই নয়, তার দেহটিকে কেটে ফালা ফালা করে দেয়।

চোরা শিকারিদের হাত থেকে তার বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে কোয়েলি নামের ডিয়ানের আর এক আদরের গোরিলা মৃত্যুবরণ করে। তাঁর প্রিয় গোরিলা, ডিজিট-এর মতো ডিয়ানা-ও নৃশংসভাবে চোরা শিকারিদের হাতে নিহত হন। তাঁর ক্ষতবিক্ষত এবং রক্তাক্ত দেহ তাঁর গবেষণার স্থান, যেখানে পাহাড়ি গোরিলাদের সংরক্ষণও করতেন, সেখানের কবরেই তাঁর নিহত গোরিলাদের পাশে তিনি আজও শায়িত আছেন।

অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী এই হত্যাকান্ডের এক মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন।

"সেদিন সাতসকালে কানাইয়ারাগানার বুক কেঁপে উঠেছিল, কারণ সে দেখেছিল, কেবিনের দরজা হাঁ করে খোলা। এমনটা তো ডায়ান কখনও করেন না। দরজায় পা দিয়েই সে দেখল ডায়ানের ক্ষবিক্ষত দেহ রক্তে থইথই মেঝেতে পড়ে আছে। ম্যাসেটি (অত্যন্ত ধারালো ঈষৎ ভারী ছোরার মতো অস্ত্র, স্থানীয় নাম 'পাঙ্গা') দিয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে বারবার আঘাত করে ফালাফালা করে ফেলা হয়েছে তাঁর দেহটাকে।" (পৃষ্ঠা-১২৫)

ডিয়ান যখন এই গোরিলাদের ঘরকন্নাতে, তাদের অন্দরমহলে প্রবেশ করতে যান, তখন তিনি হত্যা ও বিরংসা চরিতার্থ করার নিমিত্ত সভ্য মানুষের বিধ্বংসী উদ্ভাবন, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাইফেল বর্জন করে একাকী একদল গোরিলার সম্মুখীন হন, বুক চিতিয়ে নির্ভয়ে। সেই সুদূর অতীত থেকে আদি দিদিমার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত, ডিএনএ বিন্যাসের যে সমতা প্রাইমেটকূলের মধ্যে সতত বহমান, সেই অনাদি অতীত আর সমসাময়িক ভবিষ্যতের মধ্যে সমতা আর বিষমতার যে সূক্ষ্ম প্রভেদ, যে কারণে ডিয়ানা গিয়েছিলেন পাহাড় গোরিলাদের হালচাল অধ্যয়ন করতে, গোরিলারা মানুষকে অধ্যয়ন করতে আসেনি, সেই বাস্তবতার সামনে নতজানু হয়ে, শ্রদ্ধাবনত ভঙ্গীতে গভীর অধ্যয়ন আর অনুশীলনের মাধ্যমে ডিয়ান ফোসে আজকে বোধ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সীমানা প্রসারিত করে দিয়ে গেলেন অনেক দূর পর্যন্ত।

প্রাইমেট জিনোম আর হিউম্যান জিনোমের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক নিরূপণের বিশাল এই কর্মকাণ্ডের প্রথম দিকের এই 'লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প'-দের মঞ্চের কেন্দ্রে এনে দিয়ে অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী যে কেবল সাহিত্যপিপাসু মানুষদের তৃষ্ণার জলের তৃপ্ত চুমুকটি সরবরাহ করেছেন তা-ই নয়, বিজ্ঞানপিপাসু মানুষদেরও মনে ঝঙ্কার তুলেছেন।



গরিলার ঘরকন্না
লেখকঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
প্রকাশকঃ সুপ্রকাশ
প্রকাশকালঃ জানুয়ারি, ২০২২
মূল্যঃ ২৫০ টাকা