আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪৩০

প্রবন্ধ

নভেল করোনা, নভেল টিকাপ্রযুক্তি এবং নোবেল ২০২৩

স্বপন ভট্টাচার্য


কাতালিন কারিকো ও ড্র্যু ওয়াইজম্যান।

জৈব-রসায়নে একটিমাত্র সমস্যার সমাধান খুঁজে গবেষক জীবন কাটিয়ে দেওয়া বিজ্ঞানীর সংখ্যাই বস্তুত বেশি। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেটুকু আলোকরেখার হদিশ মেলে, কালাতীতে তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কাতালিন কারিকো (Katalin Karikó) এবং ড্র্যু ওয়াইজম্যান (Drew Weissman)-এর RNA নিয়ে গবেষণার ভবিষ্যৎ, সেই ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে ২০২০ পর্যন্ত ফার্মা কোম্পানিগুলোর নজরে থাকলেও গবেষণা হিসেবে প্রথম সারির বলে মানতে চাইতো না তথাকথিত মৌলিক গবেষণায় রত মলিকিউলার বায়োলজিস্ট-এর দল। তাঁরা আগেই প্রতিষ্ঠা পাননি বলাটা অমূলক হবে, তবে তাঁরা - যাকে বলে ‘ফ্ল্যু আন্ডার দ্য রাডার’ - রাডারের তলা দিয়ে উড়েছেন এতাবৎ, ফলে জৈব-রসায়নের এলিট জগত তাদের খুঁজে পায়নি, বা পেলেও তেমন আমল দেয়নি।

তারপর এলো কোভিড-১৯। কারিকো ও ওয়াইজম্যানের RNA বেস-মডিফিকেশন টেকনোলজির প্রায়োগিক সাফল্য হাতে কলমে পরখ করার একটা সুযোগ যেন অভাবিতভাবেই এসে গেল। mRNA টিকা নিয়ে তাঁরা আশাবাদী ছিলেন কিন্তু ইঁদুর বা গিনিপিগের ওপর প্রয়োগ করে সাফল্য পাওয়া আর ব্যাপকভাবে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে সাফল্য পাওয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ রয়েছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে টিকা গবেষণার হাত পা বাঁধা। সীমাবদ্ধ পরীক্ষা এবং সেই পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অন্তত ১৫ বছরের হার্ডল পার হওয়া - টিকা গবেষণার এই হল স্বাভাবিক টাইমলাইন। কিন্তু কোভিড-১৯ তো আর স্বাভাবিক অবস্থা নয় - শতাব্দীর সেরা বিপর্যয় সেটা। এবং এটাই সময় ছিল RNA টিকা গবেষণার ‘টু স্ট্রাইক দ্য গোল্ড’। জরুরী পরিস্থিতির মোকাবিলায় জরুরী নিদান খুঁজে বেড়িয়েছে সারা বিশ্বের নানা গবেষণাগার। তাদের মধ্যে ফাইজার/বায়োএন্‌টেক (Pfizer/ BioNTech) এবং মডার্না (Moderna)-এর উৎপাদিত RNA টিকার সাফল্য নজর কেড়েছে সর্বাধিক, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি করা গেছে লক্ষ কোটি ডোজ এবং কোভিড প্রতিরোধে এই টিকার সাফল্য ৯৪-৯৫ শতাংশের কাছাকাছি বলে দাবি করা হয়েছে। তবে, কেবল কোভিডকে প্রতিরোধের জন্য নয়, mRNA ভ্যাকসিন নজর কেড়েছে ভবিষ্যতের টিকা গবেষণাকে নতুনতর দিশা দেখানোর জন্যও। এতটাই তার সম্ভাবনা যে, অন্ততপক্ষে খাতায় কলমে, ক্যান্সার প্রতিরোধী টিকাও এই প্রযুক্তির রাডারে রয়েছে। mRNA টিকার এই প্ল্যাটফর্মটি গড়ে দিয়েছিলেন কারিকো ও ওয়াইজম্যান। ২০২৩-এর মেডিসিন ও ফিজিওলজির নোবেল পুরস্কার জিতে নিলেন তাঁরা।

কাতালিন কারিকোর জন্ম হাঙ্গেরির সোলনক (Szolnok) শহরে ১৯৫৫ সালে। স্‌সজেড্ ‌(Szeged) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরাল ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮২-তে এবং স্‌সেজড্‌ হাঙ্গেরিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্স-এ পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা চালান ১৯৮৫ পর্যন্ত। পোস্ট-ডক ফেলোশিপ নিয়ে এরপর চলে আসেন ফিলাডেলফিয়ার টেম্প্‌ল ইউনিভার্সিটিতে এবং বেথেসডার ইউনিভার্সিটি অফ হেলথ সায়েন্সে। পেনসিলভ্যানিয়া ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদে বৃত হন ১৯৮৯-এ এবং সেখানেই থেকে যান ২০১৩ পর্যন্ত তেমন কোনো পদন্নোতি ছাড়াই। ২০১৩-তে বায়ো-এন-টেক RNA ফার্মাসিউটিক্যালস্ তাঁকে অ্যাকাডেমিয়া থেকে বাণিজ্যে নিয়ে যায় প্রথমে ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং পরে সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদ দিয়ে। ২০২১ থেকে তিনি প্রফেসর পদ নিয়ে ফিরে আসেন স্‌সজেড্‌ ইউনিভার্সিটিতে এবং একই সঙ্গে পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়য়ের পেরেলম্যান স্কুল অফ মেডিসিনের অ্যাডজাংক্ট প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন।

ড্র্যু ওয়াইজম্যানের জন্ম ম্যাসাচুসেটস-এর লেক্সিংটনে ১৯৫৯-এ। বস্টন ইউনিভার্সিটির এম. ডি. তিনি এবং সেখান থেকেই ডক্টরেট হন ১৯৮৭-এ। ইমিউনোলজিতে ক্লিনিক্যাল ট্রেনিং হার্ভার্ড স্কুল অফ মেডিসিনে এবং পরে অ্যান্টনি ফচি-র (Antony Fauci, স্মরণে থাকতে পারে ইনি কোভিডকালে ট্রাম্পের প্রধান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ছিলেন) তত্ত্বাবধানে ন্যাশানাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ-এ গবেষণা করেন। ১৯৯৭ থেকে পেরেলম্যান স্কুল অফ মেডিসিনে তাঁর নিজের গবেষনা গ্রুপ নিয়ে RNA টিকা প্রযুক্তির উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছেন এবং বর্তমানে পেন ইনস্টিটিউট অফ আর. এন. এ. ইনোভেশনস-এ ভ্যাকসিন রিসার্চের প্রফেসর পদে আসীন রয়েছেন।

সেন্ট্রাল ডগমা ও বার্তাবহ আর. এন. এ.

ওল্ড টেস্টামেন্টের 'বুক অফ ইসাইয়া'তে বলা হয়েছে ‘অল ফ্লেশ ইজ গ্রাস’ - অর্থাৎ এটাই ভাবা স্বাভাবিক যে প্রাণের প্রবাহকে ধরে রেখেছে উদ্ভিদ, কিন্তু বিটুইন দ্য লাইনস পড়লে অন্য একটি অর্থেরও প্রতিভাস ঘটে - তা হল জীবনের বহুমুখী বহতা ধারা যে নিয়মে চলে তা একই এবং একটি ঘাসের শীষ ও মানুষের শরীর কোনোকিছুই তার ব্যতিক্রম নয়। জীবনের প্রকাশ 'কোষে' - সজীব কোষে। সজীব থাকতে গেলে এবং দেহটিকে সজীব রাখতে গেলে কোষগুলোকে কিছু ‘জরুরি উপাদান’ তৈরি করতে হয়। এই উপাদানগুলো তৈরি করার বার্তা বংশানুক্রমিকভাবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় যে অমোঘ অনুর দ্বারা তাকে আমরা ডি.এন.এ. বলে জেনেছি গত শতাব্দীর চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক থেকেই। কোষের সক্রিয়তার প্রথম শর্ত হল ডি.এন.এ. বাহিত বার্তাকে প্রয়োজনমাফিক কাজে লাগিয়ে উল্লেখিত ‘জরুরি উপাদান’গুলো তৈরি করতে পারা। এই জরুরি উপাদান, যার বার্তা ডি.এন.এ. বয়ে নিয়ে চলে, তা হল প্রোটিন। আমরা পিতামাতার কাছ থেকে বস্তুত যা পেয়ে থাকি বংশানুক্রমে, বা তাঁরাও যা পেয়েছিলেন তাঁদের পিতামাতার কাছ থেকে তা গড়নে, মননে, মেধা ও মেজাজে মানুষ হিসেবে চেনবার যে একটা উপায় দিয়েছে আমাদের তার মূলে আছে প্রোটিন। ঠিক একই নিয়মে গরু-ছাগল-মাছ-গিরিগিটি-পতঙ্গকে পরিচয় দান করে তাদের ডি.এন.এ.-তে বয়ে চলা তাদের তাদের মতো প্রোটিন গঠনের ক্ষমতা। একই কথা গাছপালা, ছত্রাক বা ব্যকটেরিয়ার জন্যও প্রযোজ্য - অল ফ্লেশ ইজ গ্রাস। তবে কথা হল এই যে, ডি.এন.এ. বার্তাটি বহন করে ঠিকই কিন্তু তা কোষের প্রোটিন তৈরির সূত্র মাত্র, মেশিনারি নয়।

মেশিনারিটির কাজ হল ডি.এন.এ. বাহিত এই বার্তাটিকে প্রোটিনের ভাষায় রূপ দেওয়া, তবে ডি.এন.এ.-র ভাষা সরাসরি পড়ে ফেলা এই মেশিনারির পক্ষে অসম্ভব, সে বার্তা তার কাছে কিছুটা ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজই হল! ফলে যেটা হওয়া দরকার তা হল, ওই ডি.এন.এ.-র বার্তাকে কোষের প্রোটিন তৈরির কারখানার কাছে একটা চেনা ল্যাঙ্গুয়েজে পেশ করা - এক কথায় ভাষান্তরিত করা। সক্রিয় কোষে এই কারণে ডি.এন.এ.-বাহিত বার্তা প্রথমে ভাষান্তরিত হয় আর.এন.এ.-র ভাষায়। মূল পুস্তকের এই ভাষান্তরিত পাঠটিই হল বার্তাবহ আর.এন.এ. বা মেসেঞ্জার আর.এন.এ. বা সংক্ষেপে mRNA। এই ভাষান্তরিত বার্তা অতঃপর ‘অনূদিত’ হয় প্রোটিনে এবং এভাবেই সক্রিয়তা বজায় রাখার জন্য সজীব কোষ ‘কাজ’ করে চলে আজীবন। জীবনজ্যোতিটি প্রজ্জ্বলিত রাখার এই অমোঘ সূত্রকে গত শতাব্দীর মধ্যভাগেই অভিহিত করা হয়েছিল ‘সেন্ট্রাল ডগমা অফ লাইফ’ বা জীবনের কেন্দ্রীয় প্রত্যয়-রূপে। প্রত্যয়টি এই যে ডি.এন.এ.-র বার্তা কোষের মধ্যে ভাষান্তরিত হতে হবে বার্তাবহ আর.এন.এ.-এর ভাষায় এবং তার পরে সেই ভাষান্তরিত বার্তা অনূদিত হবে প্রোটিনে। প্রথম ধাপটি ‘ট্রান্সক্রিপশন’ এবং দ্বিতীয়টি ‘ট্রান্সশ্লেশন’ নামে পরিচিত। ছকে দিতে গেলে সেটা দাঁড়াবে যেমনঃ
DNA > ট্রান্সক্রিপশন > mRNA > ট্রান্সশ্লেসন > প্রোটিন

এই যে বলছি ভাষা, তার বর্ণমালা মাত্র চারটে বেস - ডি.এন.এ.-র ক্ষেত্রে তারা A, T, G এবং C (এগুলি রাসায়নিক সংকেতমাত্র, প্রতিটির নাম স্কুলে পড়া বাচ্চারাও জানে)। আর.এন.এ.-র জন্য বর্ণমালায় সামান্য বদল রয়েছে এবং সেখানে বেসগুলি হল A, U, G এবং C। বেসগুলো রাসায়নিক প্রকৃতি অনুযায়ী 'নিউক্লিওসাইড' নামে পরিচিত। এই চারটে মাত্র নিউক্লিওসাইড খরচ করে এই লক্ষ কোটি জীবনের অনন্ত প্রবাহ প্রকৃতিদেবী এত অকৃপণভাবে যে চালিয়ে নিচ্ছেন তার পেছনেও ওই সেন্ট্রাল ডগমা। প্রশ্ন যেটা জাগে মনে তা হল এই যে, বার্তাবহ আর.এন.এ.-ই যদি কোষের প্রোটিন তৈরির মেশিনারিটির জন্য জরুরি হয়, তাহলে সেটাকে সরাসরি কোষে চালান করেই তো দরকারী প্রোটিন শরীরে তৈরি করানোর ব্যবস্থা করা যায়, তার জন্য ডি.এন.এ. বাহিত সংবাদ বংশধারায় থাকা এত জরুরি বিবেচিত হবে কেন? প্রযুক্তি সহায়ক হলে ট্রান্সক্রিপশন ধাপটিকে তো বাদ দিয়েই এগোনো যেতে পারে!

আনলিশিং দ্য পাওয়ার অফ আর. এন. এ.

নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই কাতালিন কারিকো এই একটি লক্ষ্যেই কাজ করে এসেছেন - আর.এন.এ.-র শক্তিকে জ্যামুক্ত করা। রোগ নিরাময় বা রোগ প্রতিরোধে দরকারি প্রোটিনগুলো যদি শরীরে বাইরে থেকে চালান করে দেওয়া mRNA দিয়েই তৈরি হতে থাকে তাহলে যে অমিত সম্ভাবনার জানালা উন্মুক্ত হয় তা কারিকো অনুমান করতে পেরেছিলেন অনেক আগেই, কিন্তু ফান্ডিং এজেন্সিগুলো তাঁর ওপর আস্থা রাখতে পারেনি। ফলে, শুরুর দিকে কারিকোকে রীতিমতো যুঝতে হয়েছে প্রতিকূলতার সঙ্গে। কোষকে এড়িয়ে কোষের বাইরে, ল্যাবরেটারিতে নির্দিষ্ট ডি.এন.এ.-র জন্য নির্দিষ্ট পরিপূরক আর.এন.এ. তৈরির প্রযুক্তি আশির দশকেই এসে গেছে, কিন্তু সেটাকে ওষুধ-বিষুধের মত ব্যবহার করার পথে বাধা ছিল দুটো - কোষে চালান করার জন্য নির্দিষ্ট আর.এন.এ.-কে ক্যাপসুলের মতো কিছু একটার মধ্যে প্যাকেজ করতে হবে অবশ্যই আর দ্বিতীয়টা একেবারে আত্মবিশ্বাস তলানিতে ফেলে দেওয়ার মতো এই সত্য যে, কোষে বাইরে থেকে চালান করা mRNA হল অতি ক্ষণস্থায়ী এবং নিরাময় তো দূরের কথা সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী। কারিকো চেষ্টা চালাচ্ছিলেন যে লক্ষ্যে তা হল কোনওভাবে বাইরে থেকে পাঠানো নিরাময়কারী আর.এন.এ.-কে কোষের মধ্যে অক্ষত রাখা এবং সেটার উপস্থিতিজনিত বিপরীত প্রতিক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাঁর বিশ্বাসের নীতিগত ভিত্তি থাকলেও অর্থ মিলছিল না গবেষণাটি চালিয়ে নিয়ে যাবার মতো।

এই সময়, ১৯৯৭ সালে কারিকোর সঙ্গে নেহাতই আকস্মিকভাবে পরিচয় হয় ওয়াইজম্যানের। ওয়াইজম্যান তখন পেন মেডিক্যাল স্কুলের ইমিউনোলজি বিভাগে সদ্য যোগ দিয়েছেন। ইউনিভার্সিটির ফোটোকপি মেশিনে দুজনেই নিজের নিজের রিসার্চ পেপার কপি করতে গিয়েছেন । কথায় কথায় কারিকোর আগ্রহের কথা জেনে ওয়াইজম্যান জানালেন তিনিও আর.এন.এ.-র ক্ষমতা ‘আনলীশ’ করার কথা ভাবেন বটে তবে তা টিকা তৈরির জন্য আধুনিক প্রযুক্তি হিসেবে - অন্য কিছু নয়। এই আলাপ এবং তার পরবর্তীতে তাঁদের যৌথ গবেষণার প্রত্যাশিত ফল মিলবে কিনা তা নিয়ে যতটা না সংশয় ছিল তার থেকে বেশি ছিল প্রায়োগিক সাফল্য দেখানোর সুযোগ মিলবে কিনা সেটা নিয়ে - মানুষ তো আর গিনিপিগ নয়! কোভিড-১৯ নিয়ে এসেছে এই সুযোগ অপ্রত্যাশিতভাবে এবং গোদাভাবে বলতে গেলে মানুষকে গিনিপিগ বানানোর একটা লাইসেন্সও মিলেছে সেই অবিহিত কালে। কিন্তু, এর জন্য যা দরকার ছিল সেটা হল বাইরে থেকে পাঠানো আর.এন.এ.-কে কোষের কাছে সহনীয় এবং বন্ধু করে তোলা, যা ২০০৫ সালেই পেরেছেন কারিকো ও ওয়াইজম্যান জুটি।

বেস মডিফিকেশন

একটা প্রশ্ন যা উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক তা হল এই যে, স্তন্যপায়ী প্রাণিকোষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ভাষান্তরণের ফলে সৃষ্ট বার্তাবহ আর.এন.এ. (mRNA) যদি স্টেব্‌ল হয়, তা হলে বাইরে থেকে পাঠানো সেই একই আর.এন.এ. কেন আনস্টেব্‌ল হবে? ওঁরা দেখলেন, আসলে কোষের মধ্যে স্বাভাবিক নিয়মে তৈরি হওয়া আর.এন.এ.-তে ভাষান্তরণের পরেও বেসগুলোর কিছু বদল হতে থাকে। নিউক্লিওসাইডের এই বদলগুলো বার্তাবহ আর.এন.এ.-কে কোষের বন্ধু করে তোলে। অপরপক্ষে, ল্যাবরেটারিতে তৈরি করা সনাতনী ভাষান্তর আমাদের রক্তে বহমান এক রকমের জীবাণু-প্রতিরোধী কোষ, ‘ডেনড্রাইটিক’ কোষের কাছে ভয়ংকর অপছন্দের। এই অপছন্দের আর.এন.এ.-র মুখোমুখি হলেই ডেনড্রাইটিক কোষগুলো ধরে নেয় বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঘটেছে এবং সাংঘাতিক রকমের প্রদাহ সূচিত হয় দেহে, জ্বর-জ্বারি, অ্যালার্জি, ফোলা থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা আর.এন.এ.-কে দেহের কাছে সহনীয় করে তোলার জন্য কারিকো এবং ওয়াইজম্যান নিউক্লিওসাইডগুলিকে যতরকমভাবে বদলে দেওয়া যায় দিলেন এবং দেখলেন ল্যাবরেটারিতে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা বার্তাবহ আর.এন.এ.-তেও যদি কিছু কিছু বেস বদলে দেওয়া যায় তাহলে কোষ সেটাকে আর ততটা শত্রু ভাবে না এবং প্রদাহ অনেক কম হয়। যেমন সনাতনী ইউরিডিন (U) নামের নিউক্লিওসাইডটিকে যদি সিউডোইউরোডিন নামক অন্য একটা নিউক্লিওসাইড দিয়ে বদলে দেওয়া যায় তাহলে ডেনড্রাইটিক কোষের প্রতিক্রিয়া মোটামুটি স্বাভাবিক থাকে। এই প্রতিক্রিয়াকে ইমিউনোলজির ভাষা ধার করে বলা যায় ‘ডেনড্রাইটিক সেল সাপ্রেশন’। এটুকু বদল অনেক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল, তবে অবিকৃত অবস্থায় এই অল্টার করা আর.এন.এ.-কে কোষের মধ্যে চালান করা ছিল আর এক সমস্যা। ২০১৫ নাগাদ ওঁরা সাফল্য পেয়ে যান লিপিড ন্যানোপার্টিক্‌ল ব্যবহার করে। সাবানের ফেনার মত অতি ক্ষুদ্র থলির সাহায্যে কৃত্রিম এবং মডিফায়েড আর.এন.এ. অনুকে কোষের মধ্যে চালান করে কাজ করাতে সক্ষম হন তাঁরা এবং mRNA ভ্যাকসিনের প্ল্যাটফর্ম বস্তুত তখনই তৈরি হয়ে যায়।

RNA টিকা

ইতিপূর্বে যেসব টিকা ব্যবহৃত হয়েছে বা হয়ে আসছে সেগুলোর ক্ষেত্রে মূলতঃ সংক্রমণের ক্ষমতা ছেঁটে ফেলা জীবাণু অথবা জীবাণুর নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনকে ব্যবহার করে প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি করার প্রণোদনা সঞ্চার করা হয়েছে মানুষের দেহে। এই শরীরের জন্মগত রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা হল বস্তুতপক্ষে তার রক্তের কেরামতি। রক্তের দু'রকম উপাদান - অ্যান্টিবডি ও টি-লিম্ফোসাইট বহিঃশত্রুর আক্রমণে সক্রিয় হয়ে ওঠে, কিন্তু এই সক্রিয়তার পূর্বশর্ত হল সেই শত্রু তথা জীবাণুকে চিনে উঠতে পারা। জীবাণু যদি কোভিডের মত নভেল হয় তাহলে শরীরের সঙ্গে তার পূর্বপরিচয় হয়ে থাকার কথাই নেই। টিকা যেটা করে সেটা হল অকার্যকরী জীবাণুর সঙ্গে শরীরটাকে পরিচয় করিয়ে দেয় যাতে আক্রমণ যদি যথার্থই ঘটে তখন শরীর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম হয়।

আর.এন.এ. টিকা যেটা করতে পারে খাতায় কলমে তা হল অকার্যকরী জীবাণুটিকে বা তার কোনো দেহাংশকে টোপ হিসেবে ব্যবহার না করে কেবল তার অ্যান্টিজেনধর্মী প্রোটিনটিকে শরীরের অন্দরে তৈরি করার ব্যবস্থা করে দেওয়া। কোভিডের জন্য দায়ী করোনাভাইরাসের অ্যান্টিজেনিক ধর্ম রয়েছে তার স্পাইক প্রোটিনে। স্পাইক প্রোটিনের বার্তাবহ আর.এন.এ. ল্যাবরেটারিতে তৈরি করে ন্যানোপার্টিক্‌লের সাহায্যে রক্তে পৌঁছে দিলে এবং সেগুলোর উপস্থিতিতে কোষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে শুরু করলে সংক্রমণের কোন ভয় নেই (কেবল স্পাইকের এককভাবে কোনো সংক্রমণ ক্ষমতা নেই অথচ অ্যান্টিজেনধর্মিতা রয়েছে) অথচ শরীর সেটাকেই শত্রু ধরে নিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শুরু করে দেয়। ফাইজার/বায়ো-এন-টেক এবং মডার্না - দু’টো ল্যাবরেটারি টিকায় ব্যবহার করেছে কারিকো-ওয়াইজম্যান পথানুসারী মডিফায়েড আর.এন.এ. প্রযুক্তি। এবং আমেরিকা সহ পৃথিবীর ১২৫টা দেশে কোটি কোটি ডোজ আর.এন.এ. টিকা ব্যবহৃত হয়েছে কোভিডকালে, বলা হচ্ছে ৯৪/৯৫ শতাংশ সাফল্যের সঙ্গে। যে কারিকো গবেষক জীবনের প্রথম ৪০ বছরে নামমাত্র একটা পুরস্কারও পাননি তিনি, ওয়াইজম্যানের সঙ্গে জুটি বেঁধে একুশের পর থেকে সেলিব্রিটি হয়ে গিয়েছিলেন। পেয়েছেন তিন মিলিয়ন ডলারের ব্রেকথ্রু এবং ২০২১-এর 'ল্যাস্কার অ্যাওয়ার্ড' যেটা নাকি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বায়োকেমিক্যাল গবেষণার সর্বোচ্চ পুরস্কার।

ভাইরাসঘটিত রোগের জন্য প্রতিরোধী ব্যবস্থা হিসাবে দুর্বল করে দেওয়া অসংক্রামক ভাইরাসই ছিল বিষে বিষে বিষক্ষয়ের জন্য সেই নিদান যার সাহায্যে পোলিও, হাম বা ইয়েলো ফিভার-এর মতো রোগ আর মারাত্মকভাবে প্রাণহানির কারণ হয় না। এটাই সনাতনী পদ্ধতি এবং ম্যাক্স থেইলার ১৯৫১-তে নোবেল পান এই পদ্ধতিতে ইয়েলো ফিভার-এর টিকা আবিষ্কার করে। আশির দশক থেকে মলিকিউলার বায়োলজিতে প্রবলভাবে কিছু দিশা বদলে দেওয়া পরিবর্তন আসে। পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস নয়, তার অ্যান্টিজেনধর্মিতার জন্য দায়ী জেনেটিক কোডবাহকের (ভেক্টর) ঘাড়ে চাপিয়ে টিকা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ইবোলা, হিউম্যান প্যাপিলোমা বা হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের বিরূদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা হিসাবে। যুক্তি এই যে, বাহক সংক্রামক ভাইরাসের মত প্রতিক্রিয়া ঘটাবে না অথচ তার মাধ্যমে চালান করা জেনেটিক কোড দেহের মধ্যে সক্রিয়তা বজায় রেখে সেই অ্যান্টিজেন তৈরি করবে যার বিরুদ্ধে শরীর সফলভাবেই অ্যান্টিবডি নামক প্রতিরোধটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

আর.এন.এ. টিকা নীতিগতভাবে একই জাতের কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে অনেকটাই আলাদা। নিষ্ক্রিয় ভাইরাস বা ভাইরাল - অ্যান্টিজেন বা ভেক্টর-এর সবকটিই উৎপাদনে সময় লাগে। মানুষের কোষের মধ্যেই তাদের উৎপাদন করতে হয় কেন না সজীব কোষ ছাড়া ভাইরাস সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় না, জড় পরিবেশে তারা জড়ের মতই আচরন করে থাকে। যে পদ্ধতিতে জীবন্ত মানুষের শরীরের বাইরের, মানুষের সজীব কোষকে ভাইরাস সংগ্রহের আধার হিসাবে ব্যবহার করা যায় তাকে বলে ‘সেল কালচার’ পদ্ধতি। এই পদ্ধতি এড়িয়ে যাবার উপায় এতাবৎ ছিল না যদিও কারিকো-ওয়াইজম্যান জুটির গবেষণার ফলে প্রতীয়মান হচ্ছিল যে ভাইরাসকে এড়িয়ে, ভেক্টরকে এড়িয়ে, সরাসরি আর.এন.এ.-কে টিকারূপে ব্যবহার করলে সময় যেমন বাঁচবে তেমনই বহুগুণ বেশি হারে 'বাল্ক প্রোডাকশন' সম্ভব হবে। কোভিড-১৯ ছিল এই দাবির সত্যতা যাচাইয়ের পরীক্ষা। নোবেল বিচারকরা মনে করেছেন সে পরীক্ষায় তাঁরা সফল এবং তাঁদের অভিমত সারা বিশ্বে কোটি কোটি প্রাণ যে আর.এন.এ. টিকায় রক্ষা পেয়েছে তার পিছনে রয়েছে প্রাগুক্ত কারিকো-ওয়াইজম্যান আর.এন.এ. বেস মডিফিকেশন প্রযুক্তি যা ল্যাবরেটরিতে তৈরি আর.এন.এ.-কে স্বাভাবিক মানব-কোষের (আরো নির্দিষ্ট করে বললে রক্তের ডেনড্রাইটিক কোষের) কাছে ভয়ংকর বৈরি উপাদান থেকে যথাযথ বন্ধু উপাদানে পরিণত করেছে। টিকা হিসাবে এই পরিবর্তিত আর.এন.এ.-র ব্যবহার তাঁদের দেখানো পথেই আজ ঝুঁকিবিহীন।

পরের লক্ষ্য

আর.এন.এ. টিকায় কোভিড সামলানো গেছে বলেই যে নোবেল, এটা নোবেল সাইটেশনে মোটামুটিভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে যদিও কারিকো প্রাথমিকভাবে যে লক্ষ্যে আর.এন.এ. মডিফিকেশনের কাজ শুরু করেছিলেন তা হল এর থেরাপিউটিক বা রোগ নিরাময়কারী সম্ভাবনাগুলো যাচাই করে দেখা। বলেওছেন সেকথা, বলেছেন ড্র্যু-এর সঙ্গে সেই আকস্মিক মোলাকাতটা না হলে টিকার কথা ভাবতেন কিনা সন্দেহ। সেই কারিকো আজ mRNA ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী বিশ্বের প্রথম সংস্থা বায়ো-এন-টেক’র সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট। ৬৫ কোটিরও বেশি ডোজ এই টিকা শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ব্যবহৃত হয়েছে এবং ফাইজার/বায়ো-এন-টেক টিকা বেচেছে আরও ১২৪টি দেশকে। অনুমান করতে পারি সেই সংস্থার সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি যে লভ্যাংশ পেয়ে থাকবেন নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য তার তুলনায় সামান্যই হবে।

প্রযুক্তির শুরু আর শেষ যদি এতেই হয় তাহলে প্রযুক্তির পত্তন যাঁদের হাতে, তারাই আবার টিকা কোম্পানির শীর্ষে আসীন, এবং সেই টিকাই এমনকি গিনিপিগেও গ্রহণযোগ্যতা ঠিকঠাক প্রমাণিত হবার আগে প্রায় বিশ্বজোড়া মানুষের দেহে ব্যবহারের লাইসেন্স পাওয়া, ৯৫ শতাংশ সাফল্যের দাবিও যে বিতর্কবিহীন নয় পুরোপুরি তাও আমরা জানি, তবু তাঁরা নোবেলে সম্মানিত হলে দশচক্রে ভগবান ভূত বলা তো যেতেই পারে। রোগটা যে কোথা থেকে এলো তা পুরোপুরি বোঝা যায়নি এখনও, কিন্তু রোগ কাদের পকেট ভারি করেছে তা আমরা আজ সবাই জানি। ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনা যদি কেবল অতিমারি মোকাবিলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলেও নোবেল স্বীকৃতি আসতেই পারে তবে আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি মডিফায়েড আর.এন.এ. প্রযুক্তির ভবিষ্যত সম্ভাবনা এর চাইতে আরও অনেক বেশি। মডিফায়েড আর.এন.এ. প্রযুক্তিকে বলা হচ্ছে ‘প্লাগ এন্ড প্লে’ ব্যবস্থা যাতে শরীরের জন্য প্রযোজনীয় প্রোটিনের জন্য কেবল নির্দিষ্ট মেসেঞ্জার আর.এন.এ.-টি কোষে পাঠিয়ে দিলেই চলবে বাকি কাজ যা করার কোষ নিজের মতই করে যাবে। এই প্রযুক্তির মূল সুবিধা হল গতি, সুতরাং ভবিষ্যতে আবার অতিমারির মতো পরিস্থিতি এলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এবারকার মতো ল্যাজে-গোবরে অবস্থা হবে না বলেই অনুমান।

অনুমানের পিছনে ওই প্লাগ এন্ড প্লে টেকনিক, তবে কিনা জীবাণুরা টেকনিকের নিরিখে সব সময়ই মানুষের চেয়ে এক-দুই পা এগিয়ে থাকে, সুতরাং ভবিষ্যত ভবিষ্যতেরই গর্ভে। টিকা প্রযুক্তি যে বদলে যাবে আগামীদিনে কোনো সন্দেহ নেই, মেসেঞ্জার আর.এন.এ. নিয়ে কাজের একটা জোয়ার এসেওছে সারা বিশ্বজুড়ে, কিন্তু কারিকোর স্বপ্ন দেখা থেরাপিউটিক ব্যবহার কতটা সফল হবে ভবিষ্যতে, তার উপরই নির্ভর করছে এই নোবেলকে লোকে কেবল অতিমারির প্রেক্ষিত ছাড়া মনে রাখবে কি না! ড্র্যু ওয়াইজম্যান আপাতত সমস্ত রকম করোনা ভাইরাসের জন্য একটা কমন mRNA ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছেন এবং তাদের লক্ষ্যে রয়েছে এমনকি ক্যান্সারের জন্যও টিকা। যদিও ক্যান্সার ব্যাপারটার জন্য কোনো জীবাণু নেই সার্বজনীনভাবে, বরং এটা ব্যক্তিবিশেষের দেহনির্ভর প্রতিক্রিয়া যার সুনির্দিষ্ট জেনেটিক ভিত্তি আছে। কারিকো এবং ওয়াইজম্যান এই ব্যক্তিবিভিন্নতার মধ্যেও একটা সার্বজনীনতার সন্ধান করছেন। এমন কিছু যদি সত্যিই সম্ভব হয় তাহলে তাঁদের গবেষণা যে কালাতীতে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে তা হলফ করেই বলা যায়।

তথ্যসূত্রঃ

১) https://www.nobelprize.org/prizes/medicine/2023/advanced-information/

২) https://www.nature.com/collections/bieheeeddf/

৩) Katalin Karikó et al (2005). Suppression of RNA recognition by Toll-like receptors: the impact of nucleoside modification and the evolutionary origin of RNA. DOI: 10.1016/j.immuni.2005.06.008

৪) https://www.pennmedicine.org/news/news-releases/2023/october/katalin-kariko-and-drew-weissman-win-2023-nobel-prize-in-medicine