আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩০ কার্তিক, ১৪৩০

প্রবন্ধ

অসমীয়া-বাঙালি সম্পর্ক

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


যে কলকাতায় ভূপেন হাজারিকা ঘরের শিল্পীর সম্মান পান, যেখানে প্রায় সারাজীবন কাটিয়েও কবি গৌতম বরুয়া বা নৃত্যশিল্পী দেবযানী চালিহা কখনও ভাষিক বিদ্বেষের মুখোমুখি হন না পথঘাট প্রতিবেশে, যে শহরে দুর্গাপূজায় আসামের বাড়ির আদলে মণ্ডপ তৈরি করে অসমীয়া ভাষায় বোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়, যে শহরের অসমীয়া নাগরিকেরা প্রকাশ্যে মাতৃভাষায় ব্যানার ঝুলিয়েই নিজেদের সাংস্কৃতিক উৎসব পালন করেন, সেই কলকাতা শহরের বঙ্গভাষী মানুষেরা বুঝতে পারেন না কেন বারবার একাংশ অসমীয়াভাষীদের অসহিষ্ণু হামলাবাজীর শিকার হন আসামের বঙ্গভাষীরা। কেনই বা বাংলা ভাষায় লেখা ব্যানার বা কোনো সামগ্রীর নাম চোখে পড়লেই সেই মানুষগুলি এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে যান? একটা বড় অংশের অসমীয়াভাষী মানুষ এই উচ্ছৃঙ্খলতা বা হিংস্র অসহিষ্ণুতাকে সমর্থন না করলেও আসামের বাঙালিরা নিজেদের ভাষা সংস্কৃতির বদলে অসমীয়া ভাষা সংস্কৃতিকেই একমাত্র নিজের করে নিক, এটা প্রায় আসামের সংখ্যাধিক্য অসমীয়াভাষীই হয়ত চান। এটাই বা কেন হয় সেটা বুঝতে পারেন না কিছুতেই পশ্চিমবঙ্গের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বাঙালিরা। একই ঘটনা আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ক্ষেত্রেও। তাঁরাও বিস্মিত হতবাক এটা দেখে যে, যখন বরাক উপত্যকায় সাড়ম্বরে অসমীয়া ভাষায় ব্যানার পোস্টার তোরণ তৈরি করে বিহু উৎসব প্রতি বছর পালিত হয়, যখন সরকারি আইন ভঙ্গ করে অসমীয়া ভাষায় সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি নিয়ে বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ হলেও সরকারি অনুষ্ঠান, মন্ত্রীদের সাংবাদিক সম্মেলন, সরকারি বিলবোর্ডে অসমীয়া ভাষা নির্বিবাদে ব্যবহৃত হয়। এসবকে এতটা আপত্তির চোখে দেখেও না সাধারণভাবে বরাক উপত্যকার সমাজ। তবে উল্টোদিকে বারবার ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙালি ও বাংলা ভাষা বিরোধী অসহিষ্ণু আচরণ দেখা যায় কেন?

আসলে অসমীয়া বা বাংলা কিংবা পশ্চিমবঙ্গ বা আসাম বা ব্রহ্মপুত্র বা বরাক উপত্যকা - সব জায়গাতেই এক পারস্পরিক অজ্ঞানতা শতাব্দী প্রাচীন প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আসামে বাঙালিরা কতটুকু স্থানীয় এবং কতটুকু বহিরাগত এ সম্পর্কে সার্বিকভাবে অসমীয়া সমাজের যেমন রয়েছে প্রবল অজ্ঞানতা, তেমনি আধুনিক আসামে বাংলা ও বাঙালি কবে থেকে এবং কোন ঐতিহাসিক কারণে দু’শো বছর ধরে অসমীয়া সমাজের বিরূপতা ও বিরোধিতার শিকার সেটাও বাঙালিরা, বিশেষ করে বরাক উপত্যকার বাঙালিরা জানেই না। আসলে এই না-জানাকে পেরিয়ে যাওয়ার রাজনীতি বা সংস্কৃতির চর্চা আসামে কখনোই সেই গুরুত্ব লাভ করেনি। বামপন্থী বা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা যে চর্চা বা অধ্যয়ন করেছেন, সেটাও খণ্ডিত। অথচ বাঙালি ও অসমীয়ার পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মান ও ভালোবাসার সাংস্কৃতিক সামাজিক বা রাজনৈতিক সম্পর্ক ব্যতিরেকে আসাম অসম্ভব। কেন এমন হয় বারবার?

এর কারণ অনুসন্ধান একটি ছোট্ট নিবন্ধের পরিসরে ধরা সম্ভব নয়। আধুনিক আসামের ইতিহাস যা শুরু হয়েছিল ১৮২৬ সালে আসামে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা ঘটনা ঘটেছে যার ছায়া বারবারই অন্ধকার করেছে আসামের অসমীয়া ও বাঙালি সমাজের মধ্যকার সম্পর্ককে। প্রকৃতপক্ষে আসামের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি এখনও আচ্ছন্ন হয়ে আছে অতীতের অধ্যায়গুলিতে। সেখান থেকে বেরোনো তো দূরস্থান, ভাষিক সম্পর্কের জটিলতার জায়গাটি ইদানিং জটিলতর হয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রাধান্য বিস্তারকারী সময়ে এসে।

আসাম নিয়ে একটি তর্ক অবিরাম চলে। কারা স্থানীয়, কারা বহিরাগত? আসামে যাদেরকে স্থানীয় বলা হয়, তারাও ইতিহাসের একটি পর্যায়ে দূর দেশ থেকেই আসামে এসেছেন। আবার দু’শো বছর ধরে যারা আসামে বহিরাগতের পরিচয় বহন করছে, তাদের এক বড় অংশ আজকের আসামের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাস করছেন যারা স্থানীয়ের স্বীকৃতি পান তাদের আগমনের বহু আগে থেকে। দ্বিতীয়ত, বহিরাগত কি শুধু মানুষই? ’ইতিহাস আর ভূগোলের দ্বন্দ্বসমাসে’ আসামের মানচিত্র বারবার ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গেছে। ফলে আজকের আসামের মানচিত্রের সাথে ব্রিটিশ শাসিত আসাম মিলবে না। মিলবে না ব্রিটিশ-পূর্ব আসামের মানচিত্রের সাথে আজকের আসামের মানচিত্রও। অথচ মানচিত্রের রাজনীতিও বারবার ছায়া ফেলে অসমীয়া ও বাঙালি সম্পর্কের মধ্যে।

আসামে আধুনিক যুগের সূচনা ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এর আগেকার আসামে তার কোনো অংশেই ইতিহাসের কোন পর্যায়েই আর্যাবর্তের শাসকদের শাসন বিস্তৃত হয়নি। ব্রিটিশ এসেই আসামকে অবশিষ্ট ভারতের সাথে প্রশাসনিক বাঁধনে বেঁধেছে। বর্মীদের উপর্যুপরি আক্রমনে বিপর্যস্ত আসামের আহোম রাজবংশের প্রতিনিধিরা বারবার ব্রিটিশের সাহায্য প্রার্থনা করেছে দেশকে বর্মী অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে। ১৮১৭ থেকে বারবার বর্মীদের আক্রমনে জেরবার আসামে ১৮২১-এ সরাসরি বর্মী রাজার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে সীমাহীন আক্রমণ, লুঠতরাজ, হত্যার ঘটনা শুরু হয়। জনশূন্য হয়ে পড়ে প্রায় আসাম। নির্বিচার হত্যা থেকে বাঁচতে আহোম শাসনাধীন আসামের মানুষ পালিয়ে যায় প্রতিবেশী বাংলাদেশে বা কাছাড়ে। বর্মী আক্রমণের আঁচ তাদের সাম্রাজ্যে এসে পড়লে ব্রিটিশরা বর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৮২৬ সালে ব্রহ্মদেশের ইয়াণ্ডাবু নামের জায়গায় সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী পরাজয় স্বীকার করে আজকের উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে হাত গুটিয়ে নেয় বর্মী রাজা। মনিপুর আবার রাজবংশের অধীনে স্বাধীন রাজ্য হলেও আসামে আহোমদের শাসনভার ফিরিয়ে না দিয়ে সরাসরি ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আহোম রাজবংশ বা আসামের সাধারণ মানুষ ব্রিটিশের হস্তক্ষেপ চেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ব্রিটিশ শাসন চায়নি। ১৮২১ থেকে ১৮২৫ অবধি বর্মী রাজার দখলে থাকার সময়কে আসামে ‘মানর হময়’ বা ‘মানেদের পর্ব’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। অসমীয়া সমাজ এটাকে দেখে একটি বিভীষিকাময় অন্ধকার পর্ব হিসেবে। বর্মীদের অত্যাচার ও দুঃশাসন থেকে মুক্তির আনন্দ ও নিজেদের স্বাধীনতা নতুন এক বহিরাগত শাসকদের হাতে চলে যাওয়ার অসন্তোষ, এমনই এক সামাজিক আবহে আসামে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশরা আসামকে পৃথক না রেখে সঙ্গে সঙ্গেই যুক্ত করে দেয় সাত দশক আগে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া বঙ্গদেশের সাথে।

বঙ্গদেশে তখন ঔপনিবেশিক প্রশাসন চালাতে সক্ষম একটি বঙ্গভাষী কেরানীকূল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আসামের শাসনকার্য পরিচালনার জন্যে দলে দলে বঙ্গভাষী করণিকদের নিয়ে আসা হল আসামে। সঙ্গে এলো ভাগ্যসন্ধানী উকিল মোক্তার ডাক্তার ব্যবসায়ী সুদখোর মহাজনেরাও। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার মুখ হয়ে গেল এই বঙ্গভাষীরা। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি যে অসন্তোষ জন্মাতো তার লক্ষ্যবস্তুও হয়ে গেল বঙ্গভাষীরা। বাঙালিদের প্রতি অসমীয়া সমাজের বিরূপতার শুরু এই সময়েই। ১৮৩৬ সালে আসামের প্রশাসনিক কাজে ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার প্রবর্তন করে ব্রিটিশ শাসকেরা। সরকারি কাজে মোগল আমলের প্রশাসনিক ভাষা ফার্সি বদলে দিয়ে তখন স্থানীয় ভাষা প্রবর্তিত হয়। কিন্তু আসামে ঘটনাটা ঘটল উল্টো। শাসনকাজে স্থানীয় ভাষা অসমীয়া তুলে দিয়ে চালু করা হল প্রতিবেশী রাজ্যের ভাষা বাংলাকে। এতে অসমীয়া সমাজে প্রবল অসন্তোষ ও বিক্ষোভের জন্ম হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসমীয়া শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ধূমায়িত প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই বলা যায় আধুনিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা আসামে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে আসামের তৎকালীন বাঙালি সমাজের কোনো প্রত্যক্ষ প্ররোচনা বা ভূমিকা ছিল কি? এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। প্রসেনজিৎ চৌধুরীর মত - অসমীয়া বুদ্ধিজীবী নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে বাঙালিদের প্রত্যক্ষ থাকার প্রমাণ পাননি। তাঁর মতে এটা ব্রিটিশ শাসকদের ভ্রান্ত ধারণাজাত। সে যাই হোক না কেন এই ঘটনা অসমীয়াদের মনে বাঙালিদের প্রতি অসন্তোষের চেহারা নেয়। প্রায় ৩৬ বছর এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত থাকার পর ১৮৭২ সালে প্রশাসনিক কাজকর্মের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অসমীয়া ভাষা স্বীকৃতি লাভ করে। ৩৬ বছরের এই দীর্ঘ সময়পর্বকেও অসমীয়া সমাজে 'সাংস্কৃতিক অন্ধকারের পর্ব' হিসেবে অভিহিত করা হয়। এখনও আসামের রাজনীতিতে যেকোনো আলোচনায় বারবার ফিরে আসে সেই পর্বের উল্লেখ। অসমীয়া সমাজের বুকের গভীরে এই আতঙ্ক সতত বিরাজমান, আবার কি ফিরে আসবে ৩৬ বছরের সেই অন্ধকার পর্ব?

১৯৪৭ সাল অবধি ব্রিটিশ শাসকদের নানা সিদ্ধান্ত ক্রমে ক্রমে অসমীয়া সমাজের এক বড় অংশের মধ্যে এই ধারণাকে পুষ্ট করেছে যে আসামে অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় শত্রু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। এর প্রাধান্য বা অস্তিত্বকে খর্ব না করে অসমীয়া জাতি বা তার সংস্কৃতি এগোতে পারবে না। বাঙালিরা যদি তার নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি ত্যাগ না করে নিজের ভাষাকে আঁকড়ে থাকে তবে আসামের নিজস্ব সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব মুছে যাবে। কী ছিল ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তবলী যা এই পরিস্থিতির জন্ম দিল?

১৮৭৪ সালে বাংলা থেকে পৃথক করে স্বতন্ত্র আসাম প্রদেশ গঠন করার পর তৎকালীন আসামের রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর জন্য অবিভক্ত বাংলাদেশের সিলেট গোয়ালপাড়া ও কাছাড়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয় আসামে। বিংশ শতকের শুরু থেকে আসামে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জলাজমিতে চাষ করার জন্যে ময়মনসিংহ ও সন্নিহিত অঞ্চল থেকে বাঙালি মুসলিমদের এনে আসামে বসতি দেওয়া হয়। এতে আসামে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পড়ে। এই সব সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণে বঙ্গভাষীদের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথা ইতিহাসবিদরা না বললেও বাঙালি সংখ্যাধিক্যের আতঙ্ক অসমীয়া সমাজের মধ্যে বাঙালি বিরোধিতাকে বিদ্বেষে পরিণত করেছে। অন্যদিকে, ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দিকে পরিষদীয় রাজনীতিতে দেশীয় জনগনের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত হলে, আসামে অসমীয়া-বাঙালি দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৯৩১ সালের জনগণনার পর অসমীয়াদের ভূমি হারানোর ভয় জন্মায় বাঙালি মুসলিমদের তরফে। এতদিন ছিল ভাষা ও সংস্কৃতি হারানোর ভয় যার উৎস ছিল বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত। এখন জমি হারানোর ভয় এলো বাঙালি মুসলিম কৃষকদের তরফ থেকে।

আসামের জাতীয় রাজনীতি মুসলিম লিগ ও কংগ্রেসের দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ছাপিয়ে বাঙালি অসমীয়া ও হিন্দু মুসলিম প্রশ্ন ঘিরে আবর্তিত হল। দেশের স্বাধীনতা আসন্ন হয়ে উঠলে রাজ্যে অসমীয়াদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কংগ্রেস রাজনীতিতে। মৌলানা ভাসানীর কৃষকদের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম ক্রমে পাকিস্তান প্রাপ্তির সাম্প্রদায়িক রণধ্বনির কবলে চলে যেতে থাকল। অসমীয়া নেতৃবৃন্দ চাইলেন সিলেট কাছাড় সহ বঙ্গভাষী অঞ্চল পাকিস্তানে চলে যাক। বাঙালি হিন্দুরা চাইলেন আসাম ভারতে থাকতে। মুসলিম লিগ প্রথমে গোটা আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েও পরে গণভোটের মাধ্যমে সিলেটের অন্তর্ভুক্তি ও মুসলিম জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে পাশাপাশি কাছাড়, নগাঁও, গোয়ালপাড়াকেও চাইল পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির দাবিও তুলল।

দেশভাগ আটকানোর জন্যে যখন ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের প্রাথমিক সম্মতি পেয়ে গেল, তখন বাংলার সাথে অভিন্ন গ্রুপিং-এ থাকলে আসাম বাংলা ও বাঙালির অধীনত্বে চলে যাবে এই আতঙ্ক থেকে ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদটি করলেন আসামের কংগ্রেস নেতা গোপীনাথ বরদলৈ। দেশভাগ হল, সিলেট পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হল, কিন্তু দেশভাগের বলি হয়ে হাজার হাজার বাঙালি শরণার্থী আসামে আশ্রয় নিলেন। স্বাধীন দেশে প্রথম নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হতেই ১৯৪৮ সালের ২৮ মে সমস্ত জেলা শাসকদের আসামের রাজ্য সরকারের তরফে নির্দেশনা পাঠিয়ে বলা হয় যে যে সমস্ত উদ্বাস্তুরা আসামে আসছেন তারা ‘অস্থায়ী বাসিন্দা’। সুতরাং তাদের নাম যেন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা না হয়। আরেকটি নির্দেশে বলা হয় অসমীয়া ও উপজাতীয় ছাড়া (কাছাড়ের ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষরা ছাড়া) যারা দেশভাগের আগেই জমিজমার মালিক হয়েছে তারা ‘স্থায়ী বাসিন্দা’ হলেও ‘স্থানীয় বাসিন্দা’ নয়। আগামীতে স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়া আর কাউকেই যেন জমির বন্দোবস্ত দেওয়া না হয়। ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০ জনগণনার নির্দেশিকা প্রকাশ করে স্থানীয় বাসিন্দার সংজ্ঞা দেওয়া হয় এই বলে যারা অসমীয়া বা উপজাতীয় ভাষায় কথা বলে এবং কাছাড়ের ক্ষেত্রে যারা স্থানীয় ভাষায় কথা বলে। কাছাড়ের প্রধান ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা যে বাংলা এই সত্যটি এড়িয়ে তাকে স্থানীয় ভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয় যা পরবর্তীতে বরাক উপত্যকার ভাষিক পরিচয় অস্বীকার করা জন্যে ব্যবহৃত হয়।

ব্রিটিশ শাসনাধীন সময়ে যদি প্রশাসনিক নানা সিদ্ধান্তকে বাংলা বা বাঙালিদের আগ্রাসন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে সরকারিভাবেই নীতি হিসেবে অসমীয়া ভাষার একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও বাংলা ভাষার পরিসরকে সংকুচিত করা কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হল। ১৯৫১ সালের জনগণনায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি মুসলিমদের সরকারি উদ্যোগে অসমীয়াভাষী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় যার মাধ্যমে আসামে অসমীয়ারা প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের জনগণনায় ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে আসা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা শ্রমিকদের অসমীয়াভাষী হিসেবে এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর বা পূর্বতন মানভূম অঞ্চল থেকে আসা ভাদু-টুসু-ঝুমুর সংস্কৃতির সন্তান চা শ্রমিকদের হিন্দিভাষী হিসেবে তালিকাভুক্তি করানো হয়। এই সবকিছুই হয়েছে সরকারি উদ্যোগে বা শাসকদলের সাংগঠনিক তৎপরতায়। উদ্দেশ্য ছিল অসমীয়া জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও বাঙালি জনসংখ্যার হ্রাস ঘটাতে। আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে একমাত্র অসমীয়া ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগের বিরুদ্ধে বরাক উপত্যকায় নানা পর্যায়ে ভাষা আন্দোলন হয়। আসামের নানা ভাষাগোষ্ঠীই তখন প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে আজ আসাম ভেঙে একাধিক রাজ্য তৈরি হয়েছে এবং আসামের ভেতরে বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি ভাষা হিসেবে অসমীয়ার পাশাপাশি বাংলা, বড়ো ও ইংরেজি ভাষার স্বীকৃতি হয়েছে।

এই গোটা ইতিহাসের এক একটি পর্ব অসমীয়া ও বাঙালিদের কাছে সাধারণভাবে পরিজ্ঞাত নয়। অসমীয়া সমাজের সিংহভাগ মানুষ জানেনই না যে বরাক উপত্যকার বাংলাভাষী পরিচয়টির সাথে দেশভাগের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্রিটিশ শাসনপূর্ব ডিমাছা রাজাদের সময়ই রাজসভার ভাষা ছিল বাংলা। বাংলা শাক্ত সাহিত্যের নানা সৃষ্টি ডিমাছা রাজসভার আনুকূল্যেই হয়েছিল। দেশভাগ বরাক উপত্যকায় উদ্বাস্তু জনস্রোতকে ডেকে আনলেও ব্রিটিশ আসার আগে থেকেই আজকের বরাক উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরাই। আবার আজকের আসামের গোয়ালপাড়া ও বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ জেলা সুপ্রাচীন সময় থেকেই বাংলার অংশ। অন্যদিকে, বাঙালিদের সিংহভাগ জানেই না ১৮৩৬ থেকে ১৮৭২ পর্যন্ত আসামের ইতিহাস যখন আসামের অসমীয়াভাষীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলা ভাষা। শহীদের রক্তস্নাত বরাক উপত্যকা যেমন তার ভাষিক পরিচয় নিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর, তেমনি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমীয়া সমাজও তার নিজের সংস্কৃতি ও মাতৃভাষা হারানোর আতঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছে বিগত দুশো বছর ধরে। এই স্পর্শকাতরতা, এই আতঙ্ক কতটা অমূলক ও কতটা বাস্তব, তার হিসেব করার চেয়েও জরুরি, এই অবিশ্বাস ও দূরত্বকে পেরিয়ে যাওয়ার রাজনীতির চর্চা। এই চর্চা একমাত্র হতে পারে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির অবারিত অধিকার ও সামগ্রিকভাবে রাজ্যের বহুভাষিক ও বহুসংস্কৃতির পরিচয়কে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। স্মরণাতীত কাল থেকেই আসামের রাজনীতি প্রধানত সাংস্কৃতিক রাজনীতি। সাংস্কৃতিক প্রশ্নে সঠিক অবস্থান গ্রহণ না করলে রাজনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। দক্ষিণপন্থী দলগুলি চিরকালই তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির লোভে উগ্রতার রাজনীতিকে হাতিয়ার করেছে। বামপন্থীদের অতীতের ভূমিকা বহু দুর্বলতা সত্ত্বেও অবিস্মরণীয়। উগ্র জাতীয়তার আগুন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার আত্মহত্যা না করে বামপন্থীদের এই বহুত্বের সাংস্কৃতিক রাজনীতির আরও নিবিড় চর্চা করতে হবে। নতুবা বারবার এই ঘটনাগুলি ফিরে ফিরে আসবে।