আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

পুস্তক পর্যালোচনাঃ তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়


বুদ্ধিমান এবং আধুনিক বিজ্ঞানের জটিলতা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত নন, এমন মানুষদের কাছে মানবজাতির সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বিজ্ঞানকে সরল করার তাগিদে যথাযথভাবে উপস্থাপিত যাঁরা করেন না, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ও জ্যোর্তিপদার্থবিদ্যার অধ্যাপক গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় সেই দলভুক্ত মানুষ নন। তিনি বহুদিন ধরেই “ফেস-বুক” বা আনন-গ্রন্থে বিজ্ঞান-বিজ্ঞানী-সমাজ ও বিজ্ঞানের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে লিখে চলেছেন, তেমনি লিখছেন অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে এবং অবশ্যই ছোট পত্রিকায়। বর্তমান বইটিও একটি ওয়েব ম্যাগাজিন, “জয়ঢাক”-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, যার ছাপ রয়ে গেছে বইটির বিন্যাসেও।

মোট ১১টি অধ্যায়ে বিভক্ত এই বইটির উদ্দিষ্ট পাঠক কিশোর-কিশোরী-তরুণ-তরুণীরা, যদিও পরিণত পড়ুয়াদের বইটির রসাস্বাদনে কোনও বাধা নেই। আধুনিক বিজ্ঞানের যৌবনপ্রাপ্তির পথে প্রায় দেড় শতাব্দী আগে আবিষ্কৃত তেজস্ক্রিয়তা বিরাট ভূমিকা রেখেছিল আর তাকে কেন্দ্র করে সেই সময়ের ইউরোপ-মার্কিনদেশের মহিলা বিজ্ঞানীদের কী বাধার পাহাড়গুলো ডিঙিয়ে মানবজাতির জ্ঞানচর্চার ধারায় নিজেদের অনন্য অবদান রাখতে হয়েছিল, তার এক চমৎকার বিবরণী আর তার পাশাপাশি এই বিশেষ বিভাগের বিজ্ঞানের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে পাঠকদের।

২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর আমাদের, ভারতীয়দের পক্ষে এক স্মরণীয় দিন। আমাদের সৌরমণ্ডলের থেকে ৩৪০ আলোকবর্ষ দূরের তারা, বর্গীকরণের সাম্প্রতিক প্রণালীতে যাকে আমরা চিনি HD 86081 নামে, যার রয়েছে একটি গ্রহ, সেই তারাটির নাম দেওয়া হয়েছে “বিভা”। বিভা নামের উৎস আসলে বাঙালি মহিলা বিজ্ঞানী বিভা চৌধুরী, যাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে গৌতম তাঁর পাঠকদের জানিয়েছেন যে তিনি আমাদের দেশের প্রথম মহিলা, যিনি পদার্থ বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন, যাঁর জন্মশতবর্ষ (২০১৩) কেটে গেলো তাঁকে অবজ্ঞাত রেখে দেওয়ার মধ্য দিয়েই। ১৯৩৬ সালে তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সেই সময়ের জ্ঞানের সীমান্ত পেরোনোর যেসব বিজ্ঞানচর্চা দেশ-বিদেশে মান্যতা পাচ্ছে, মহাজাগতিক রশ্মি সংক্রান্ত গবেষণা তেমনই একটি বিষয় ছিল। গৌতম জানাচ্ছেন, তাঁর আগে কোনও বাঙালি মহিলা এই জাতীয় আধুনিক বিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেননি। বিভা তাঁর শিক্ষক, দেবেন্দ্রমোহন বসুর সঙ্গে “ফোটোগ্রাফিক প্লেট” ব্যবহার করে মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে থেকে তড়িতদাধান যুক্ত বিভিন্ন ভরের কণা শনাক্তকরণের কাজে হাত দেন। তাঁদের হাতে যে ধরণের “প্লেট” ছিলো, সেগুলি দিয়ে খুব সূক্ষ্মতায় এই কাজ করা কার্যত অসম্ভব ছিল, তাই তাঁরা এক যুগান্তকারী পর্যবেক্ষণের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েও মূল আবিষ্কারের কুশীলবের ভূমিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তাঁরা যদি “ফুল-টোন” প্লেট পেতেন, যা ঐ বিশ্বযুদ্ধের মুখে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাজে বরাদ্দ করা হয়েছিল, তাহলে আজকে এই বিজ্ঞানের ইতিহাস কীভাবে লেখা হতো তা কেবল কল্পনার বিষয় হয়েই রইলো!

এই ব্রহ্মাণ্ডের যেদিক পানেই আমরা আমাদের গবেষণাগার স্থাপন করে কিছু পর্যবেক্ষণ করি, এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র সেই পর্যবেক্ষণের ফল একইভাবে গ্রাহ্য হবে, কেননা কোথায় বসে পর্যবেক্ষণটি করা হলো, তার ওপর পরীক্ষার মূল ফল নির্ভরশীল নয়। বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে হলে আমরা বলি যে প্রকৃতিতে “প্রতিসাম্য” বিরাজ করে। এই রকম এক প্রতিসাম্য হলো ডান-বাম প্রতিসাম্য, যার থেকে বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন বিম্বসমতার সংরক্ষণের সূত্র। দুই চিনা বিজ্ঞানী, ইয়াং এবং লি বলেন যে ক্ষীণ বলের দুনিয়ায় এই বিম্বপ্রতিসাম্য সংরক্ষিত হয় না। আর চিনা মহিলা বিজ্ঞানী চিয়েন শিউং উ একটি অসামান্য পরীক্ষা মারফৎ গত শতকের জ্ঞানের জগতে এক অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ধারণার স্বপক্ষে এক জোরালো পরীক্ষা-লব্ধ এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করেন।

এই বইতে রয়েছে তেজস্ক্রিয়তা গবেষণায় যুক্ত মহিলা বিজ্ঞানীদের কাজের পরিচয়, তাঁদের কাজের প্রাসঙ্গিকতা এবং কেমনভাবে এই পুরুষ-অধ্যুষিত এবং অনেকাংশে পুরুষ-শাসিত বিজ্ঞানীদের মহলে তাঁরা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, তাঁদের অর্জিত প্রাপ্য থেকে কীভাবে বঞ্চিত হয়েছেন তার করুণ কাহিনিও। যেমন মাদাম কুরি, ইরিন কুরি, লিজা মাইটনার প্রমুখ দিকপাল বিজ্ঞানীরা পুরুষ মহলের সদর দরজা ঠেলে সটান তাদের অন্দরে প্রবেশ করে মধ্যমণির স্থান অলঙ্কৃত করেছেন, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শিতার জন্য বিজ্ঞানের দুটি বিভাগে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন, তেমনি মাইটনার-এর মতো কেউ কেউ তাঁর প্রাপ্য পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কেউ যেমন কোনও পরীক্ষার ফল নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেও ব্যাখ্যাকারের প্রাপ্য সম্মান পাননি, কেউ ভুল ব্যাখ্যা করে কেবল পুরুষ বলেই হয়তো বা প্রাপ্যের চেয়ে অনেক বেশি সম্মান পেয়েছেন। আবার কেউ পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানের অন্য বিভাগকে সমৃদ্ধ করে গেছেন, যেমন এলিজাবেথ রোনা, যিনি তেজস্ক্রিয়তা মেপে পাথরের বয়েস নির্ধারণের পদ্ধতির জন্মদাত্রী, যে পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা ভূতাত্ত্বিক বয়স আজও নির্ধারণ করে থাকি।

এই বইটিতে যে কেবল তেজস্ক্রিয়তা সংক্রান্ত বিজ্ঞান এবং সেই বিজ্ঞানের চর্চায় নিযুক্ত মূলত মহিলা এবং পুরুষ বিজ্ঞানীদের কাজের পরিচয় এবং আমাদের জ্ঞানের জগতে সেই সব বিজ্ঞানীদের অবদানের প্রাসঙ্গিকতা আলোচিত হয়েছে তা-ই নয়, এখানে সমাজ-সংসার-রাষ্ট্রনীতি-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে প্রচুর প্রাসঙ্গিক আলোচনাও রয়েছে। ইউরোপে নাৎসিবাদের উত্থানের সঙ্গে বিজ্ঞানের জগতে কী পরিবর্তন এলো, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে, রুমানিয়া, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশগুলিতে নারী শিক্ষার শোচনীয় অবস্থার বর্ণনা আমাদের আবারও নতুন করে বুঝতে সাহায্য করে আমাদের দেশের আনন্দীবাঈ, আন্না মানি, বিভা চৌধুরীদের সুউচ্চ সামাজিক আর্থিক বাধার শৃঙ্গগুলি অতিক্রম করার দুঃসাহসিক অভিযাত্রাগুলিকে। পাঠকদের চেতনার গভীরে গেঁথে যায় পরাধীন পোল্যান্ডের আহত জাতীয়তাবাদের প্রকাশ হিসেবে মৌলের নামকরণের ক্ষেত্রে “পোলোনিয়াম” নামকে বেছে নেওয়া। পুরুষ বিজ্ঞানী ফের্মি মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী দেশ ইতালি থেকে নিশ্চিন্তে আশ্রয় পান “মুক্ত দুনিয়ায়”, আর ইহুদি পরিবারে জন্মানোর জন্য সারা জীবন নিশ্চিন্তে গবেষণা করবেন বলে এদেশ থেকে ওদেশ ঘুরে কেটে যায় কতো সেরা মহিলা গবেষকের জীবন। আজকের মতো সেকালেরও রক্ত-লাঞ্ছিত ইউক্রেনে জন্মে ক্যাথারিন শ্যামি জেনেভা থেকে ১৯১৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে তাঁর মাতৃভূমি ওদেসা-তে ফিরলেন শান্ত মনে গবেষণার তাগিদে। কিন্তু ১৯১৯ সালের ভয়াবহ জাতিদাঙ্গা তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। নাৎসি জার্মানি অস্ট্রিয়া আগ্রাসন করলে এলিজাবেথ রোনা ফিরে যান হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। কিন্তু সেখানেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভ্রূণ প্রতিষ্ঠায় ভীত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এক রক্তাক্ত প্রতিবিপ্লব সংগঠিত করে। এইসব ঘটনা ব্যক্তি বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত জীবন ও তাঁদের কর্মদ্যোগকে করেছে ছিন্নভিন্ন, তেমনি যে যে দেশে এই মাৎস্যন্যায়ের জন্ম হয়েছে, তাদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যাত্রাপথটি পরিবর্তিত হয়ে গেছে অপ্রত্যাহারযোগ্য মাত্রায়। বিজ্ঞানের পাশাপাশি এই সব বহুমাত্রিক স্তরের আলোচনা তরুণ-তরুণী পড়ুয়াদের অস্তিমান ঘটনাবলী বিশ্লেষণে বহুমাত্রার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করবে।

বইটিতে সম্পূর্ণ পরিহারযোগ্য অক্ষমণীয় কিছু কিছু মুদ্রণপ্রমাদ পীড়াদায়ক। অবশ্য বেশিরভাগ এই জাতীয় প্রমাদের উৎস বোধ করি ছাপাছাপির আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত অবধারিত কিছু ব্যাপারস্যাপার। কিছু কিছু মুদ্রণবিভ্রাটের উৎস নিঃসন্দেহেই বারবার কম্পিউটারকৃত অক্ষরের ধাঁচের এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তনজনিত কারণে। অন্য ক্ষেত্রে প্রকাশক হয়তো মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের চেয়ে নির্বোধ কম্পিউটারের ওপরচালাকির ওপর বেশি নির্ভর করে বসেছিলেন। কিছু কিছু সমঝোতা হয়তো নানান মাত্রার মিতব্যায়িতার কথা ভেবেই করতে হয়েছে। কিন্তু বইটির অতি উৎকৃষ্ট ছাপা, স্পষ্ট ছবি এবং বাঁধাই যে কোনো বনেদি ঘরানার দেশি বিদেশি প্রকাশকের অসূয়ার কারণ হবে। বইটির ছাঁচ দেখে মনে হলো এটি আধুনিক “প্রিন্ট-অন-ডিম্যান্ড” ধাঁচে করা। এই পীড়াদায়ক মুদ্রণপ্রমাদ শুধরে নিয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন সংস্করণের আশা করছি।
___________________________________

তেজস্ক্রিয় ভদ্রমহিলাগণ
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
জয়ঢাক প্রকাশন
প্রথম সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি, ২০২১
মূল্যঃ ২২৫ টাকা
পৃষ্ঠাঃ ১৫৫