আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

দায় আমাদেরই

শুভময় মৈত্র


নতুন বছরে কলকাতার নীল-সাদা নিয়ন আর নলেন গুড় ছেড়ে নুর্যে মবার্গ ট্রায়াল নিয়ে আলোচনা কেন, এ প্রশ্ন শুরুতেই উঠবে। এর কারণ তার ঠিক আগে যিশু দিবসে দেখতে যাওয়া নাটক "দায় আমাদেরও"। লেখা সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায় (যাঁর লেখা নাটকের গানের কয়েক কলি দিয়ে শেষ করবো এই বকবকানি), নির্দেশনায় বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতায় গ্রুপ থিয়েটারের উৎকর্ষতা নিয়ে আজকের দিনেও প্রশ্ন তোলার জায়গা নেই। ভালোর মধ্যে আরও ভালো বলতে যা বোঝায় এই নাটকটি সেই মানের। অভিনয় করেছেন প্রথিতযশা শিল্পীরা। সেখানে সুপ্রিয় দত্ত, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব দাস, দেবশঙ্কর হালদার এবং বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামগুলো আর একবার শুনিয়ে রাখা জরুরি। তবে আলোচনা যতটা এই নাটক নিয়ে, ঠিক ততটাই এই নাটকের নাম ভূমিকায়। এর মূল কারণ স্বরবর্ণের দ্বন্দ্ব - 'ও' না 'ই'? দায় আমাদেরও, নাকি আমাদেরই? আমাদের বলতে ইংরিজিতে সিভিল সোসাইটি, আর বাংলায় নাগরিক সমাজ। অর্থাৎ আজকের দিনে যারা সন্ধেয় টিভি চ্যানেলে ঝগড়া চিবোন, আর সেই ঝগড়ুটেদের সঙ্গে দেখা হলেই পরামর্শ দেন এই সমস্ত ঝগড়ায় সময় নষ্ট না করে ভাল কাজে মনোনিবেশ করতে। এই লেখা তাই কোন্দলোত্তর 'ও' এবং 'ই'-এর অনুপ্রাস।

এই লেখা লিখতে বসার আরও একটি কারণ বর্ষশেষে নাট্যকর্মীদের ঠ্যাঙানি খাওয়ার খবর। যীশুর পিঠা উৎসব উপলক্ষে বেলেঘাটায় নাটকের ঘরবাড়ি ভেঙে অল্প মালিশ করে দিয়েছেন আজকের ছয়-প্যাকেরা। ছোটবেলায় কবিতা শুনতাম "যীশু পরম দয়ালু, তাঁহার কৃপায় দাড়ি গজায়, শীতকালে খাই শাঁকালু"। এখন সঙ্গে পিঠে পিঠে ফাউ। পর পর দুটো পিঠে মোটেও ভুলভাল কি-বোর্ড দাবানোর ফল নয়। বরং সমোচ্চারিত শব্দ। বানান-ও একইভাবে বানানো। আসলে পিঠোপিঠি কেন্দ্র এবং রাজ্যের দুই শাসক দলের কৃপায় পরপর দুটি পিঠে লিখলে পারমুটেশন কম্বিনেশনের নিয়মে তার খান কয়েক মানে দাঁড়ায়। আর আমরা দাঁড়াই আয়নার সামনে, বিম্ব সেখানে অসদ। সেই দ্বন্দ্বে যাবো কোনদিকে? নাকতলা না নুর্যে মবার্গ? অন্ধ জাতীয়তাবাদের ভয় বেশি? নাকি চকমিলানো দুর্নীতির? সততার প্রতীকের আলো কি টাকার বান্ডিলে ধাক্কা খেয়ে সরলরেখায় আচ্ছে দিনে ফিরে আসে? বিজেপি বা তৃণমূল নিয়ে কথা বলতে গেলেই কি আগের কংগ্রেস আর সিপিআই(এম) নিয়ে আলোচনা সেরে তবে চায়ে চুমুক দেওয়ার অনুমতি মিলবে? নাকি সরাসরি একেবারে বর্তমানে এসে দাঁড়াবো আমরা? অর্থাৎ সোজা কথায় বিজেপির উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবেন, তাদের কি প্রথমে সূত্রধর সঙ্গে এনে ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থা নিয়ে আড়াই ঘণ্টার বিশ্লেষণ শেষ করে তবে আখলাক মামলায় ফিরতে হবে? তৃণমূলের বাউন্সার বিশ্লেষণে কি শুরুতে মনে রাখতে হবে পশুখামারের না-মানুষদের পাটিগণিত? সহজ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে ইতিহাস মনে রাখতে হবে। আবার খুব বেশি চটকানো হলে ইতিহাস ত্রাহি ত্রাহি রব তোলে। মনে রাখা আর ভুলে যাওয়ার এই সরল দোলগতিই ঠিক করে আজকের সমাজ বনাম রাজনীতির ধারাবৃত্তান্ত।

নাগরিক সমাজের বেশিরভাগই সেই ট্রেড-অফ এ সামিল। তৃণমূলের বিরোধিতা হবে স্লাইড ক্যালিপার্স কিংবা ভার্নিয়ার স্কেলে মেপে। সেখানে বিরোধীরা পালিত হবেন গণতন্ত্রের উদযাপনে। কটকটে কথা বলা বিরোধীদের ততটাই জায়গা দেওয়া হবে যাতে ভোটবাক্সে ছোঁয়া না লাগে। অন্যদিকে বিজেপির বিরোধিতা হবে তৃণমূলের ঘেরাটোপে। এ রাজ্যের বাইরে কয়েকজন অতিবাম বুদ্ধিজীবী উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করে গারদে দিন কাটাবেন। তার মধ্যে আবার বেশ কয়েকজন অশীতিপর বৃদ্ধ। এ রাজ্যে থাকলে তাঁদের সুরক্ষাবলয় যোগাবে তৃণমূল। সারমর্মে তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে হাতে থাকবে সাত দুগুণে চোদ্দর নীতিবাগীশ বিজেপি, আর বিজেপির সামরিক হিন্দু রাষ্ট্রবাদের প্রতিবাদে সাহস দেবে উদারবাদী তৃণমূল। প্রদত্ত ভোটের আশি শতাংশের বেশি এখানেই নির্ধারিত। এর মধ্যে অন্য যে কোন মাসের মতই আবর্তিত হল রাজ্যের শাসক থেকে বিরোধী হওয়া নেতার ভবিষ্যৎবাণীর ডিসেম্বর। নতুন বছর হয়ত সেই পৌণপৌণিকতারই পথ দেখাবে। ইতিহাসে পেছন ফিরলে একটা বড় সময় ধরে কেন্দ্রের কংগ্রেস আর রাজ্যের সিপিআই(এম)-এর মধ্যে আনুমানিক সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করেছেন মানুষ। নেতার নাম হয়েছে তরমুজ। আজকের দিনে সেরকম কোন তৃণমূল-বিজেপির মধ্যে ক্রমাগত পথ হারানো বরিষ্ঠ নেতাই শোনাচ্ছেন "যাহাই বিজেপি তাহাই তৃণমূল" তত্ত্ব। কেন্দ্র এবং রাজ্যের দুই শাসকের সমীকরণে সন্তর্পণে অবকলিত হচ্ছে নাগরিক সমাজের চলরাশি। সেখানে পেটানি খাওয়া নাট্যকর্মীদের কোন নাট্যকার দেখতেই পাচ্ছেন না, আবার কোন অভিনেতা তার প্রতিবাদে নাট্যশালার ঠিকানা লিখছেন। কিন্তু লড়াইটা সাজানোই থেকে যাচ্ছে কারণ এক নাট্যকার অন্য নাট্যকারের সঙ্গে সম্পর্কের সুতোয় বাঁধা, যেমন এক রাজনীতিবিদ আর এক রাজনীতিবিদের সঙ্গে, টেলিভিশনের এক কুঁদুলে অন্য কুঁদুলের সাথে।

প্রশ্ন হল এই অভিযোজন ঘেঁটে যায় কখন? যখন শাসক নিজেকে অতিক্রম করে সম্পূর্ণ গুলিয়ে ফেলে। জার্মানির মানুষ নিশ্চয় মনে করেছিলেন হিটলার তাঁদের দেশকে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেবেন। সেই যা সামগ্রিক ভাবনা, যাকে আজকে আমরা ভুল বলছি, সেদিন তা কিন্তু ঠিকই ছিল। সেই ঠিক আবার ভুল হয়ে গেল যুদ্ধ শেষে। তখন হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা ফেলা মার্কিন জজসাহেব ন্যুরেমবার্গে বিচার করতে বসলেন হিটলারের চেলাচামুণ্ডাদের। আর ২০২২-২৩শে সেই ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছেন প্রাচ্যের নাট্যকর্মীরা। আমরা দেখলাম সেই অসাধারণ প্রযোজনা। উদাহরণ তাই অদ্ভুতুড়ে। ক্ষমতার গর্বে ইন্দিরা গান্ধি গোটা দেশে জারি করলেন জরুরি অবস্থা। সারা দেশ এক হয়ে গেল তার বিরুদ্ধে। আর আজকে তাঁরই পৌত্র গোটা দেশে হেঁটে বেড়াচ্ছেন উদারবাদী ভাবনার পথিক হয়ে। গোটা দেশ জুড়তে। বসন্তে ফুল ফুটবে কিনা তার জন্যে অবশ্য শীত শেষের অপেক্ষা করতেই হবে। আসলে শাসক যখন মেপে ভুল অঙ্ক কষেন, বিরোধী মতের নেতারা যখন নিজেদের মধ্যে হিসেব করে চলেন, রাষ্ট্রশক্তি যখন নাগরিক সমাজকে একই সঙ্গে গাজরের পুষ্টি আর ভয়ের যষ্টির সুষম সম্পদ বিতরণ করেন, ততদিন আমরা শান্তিতে। কর্পোরেট ব্যবস্থায় আজকের শাসক তাই ঝট করে নন্দীগ্রাম নামিয়ে ফেলেন না। সাম্প্রতিক বঙ্গ রাজনীতিতে নাগরিক সমাজ বিরক্ত হয়, উত্যক্ত হয়, কিন্তু সেটুকু সন্ধেয় মুড়ির সঙ্গে মাখা কাঁচালঙ্কার আরামের ঝালের মত। ২০২৩-এ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত আর ত্রিপুরার বিধানসভায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীর শীতের ফাটা ঠোঁটে শুকনো লঙ্কা ঘষা হবে না, সেই আশাই রাখুক নতুন বছর। ভুলে যাওয়াই ভাল যে "দায় আমাদেরই"। বরং তা "আমাদেরও" বলে নিয়তি কিংবা অন্যের ঘাড়ে বেশিটা চাপিয়ে দেওয়াই মঙ্গল। শুভ নববর্ষ।

"রাস্তা এখানে শেষ
তবু চলা হয়নি ইতি
সেদিকেই চলেছি আমরা
যেদিকে টানছে নিয়তি
"