আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪২৯

সমসাময়িক

বিচারব্যবস্থা বনাম সরকার


ভারতের সংবিধানের একটি মৌলিক স্তম্ভ হল নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা। সংবিধান প্রণেতারা ভারতের শাসনব্যবস্থাকে তিনটি বিভাগে ভাগ করেন - সরকার, আইনসভা এবং বিচার বিভাগ। আইনসভা আইন তৈরি করবে, সরকার তা প্রচলন করবে দেশে এবং বিচার বিভাগ নিরপেক্ষভাবে সেই আইনের বৈধতা যাচাই করবে। এই তিনটি স্তম্ভ দেশ চালানোর ক্ষেত্রে অপরিহার্য এবং এই তিনটি স্তম্ভের মধ্যে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

কিন্তু সংবিধানে লেখা থাকলেও এই কথা মানতেই হয় যে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে একাধিকবার। জরুরি অবস্থার সময় বিচারবিভাগের ভূমিকা, বর্তমান সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিচারব্যবস্থার নিরবতা এই বার্তাই দিয়েছে যে বিচারব্যবস্থা বোধহয় তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ অথবা নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে যে মামলাগুলি সুপ্রিম কোর্টে দাখিল হয়েছে তার শুনানি কার্যত শুরুই হয়নি। অন্যদিকে বাবরি মসজিদের জমি সুপ্রিম কোর্ট তুলে দিয়েছে হিন্দুদের হাতে। যেই প্রধান বিচারপতির আমলে এই রায় দেওয়া হয়, তিনি এখন বিজেপির আশীর্বাদধন্য রাজ্যসভার মনোনীত সাংসদ। অতএব, বিচারব্যবস্থা যে সরকারের দিকে ঢলে পড়ছে বিগত কয়েক বছরে, এই কথা বললে অত্যুক্তি হয় না।

এই প্রবণতার কারণ অনুসন্ধানে না গিয়েও কিছু বিন্দু তুলে ধরা যেতে পারে। সরকার পক্ষের একটি সুবিধা রয়েছে যা বিচারবিভাগের নেই। তা হল এই যে সরকার পক্ষ জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসেন, বিচারবিভাগের পিছনে জনরায় নেই। এতে খারাপ কিছু নেই, এটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু দাম্ভিক সরকার, জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বলীয়ান হয়ে অনেক সময় মনে করে যে বিচারব্যবস্থার দায়িত্ব তাদের কথায় ক্রমাগত সায় দেওয়া। বিগত কিছু বছর ধরে বিচারবিভাগের কিছু সিদ্ধান্ত সরকারের অনুকূলেই গেছে। কিন্তু তবু সরকারের আশ মেটে না।

নতুন প্রধান বিচারপতি হয়ত কিছুটা এই প্রবণতার উপর রাশ টানছেন। শেষ যিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাঁর আমলের কিছু রায় এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতির কিছু বক্তব্য মনে হচ্ছে সরকারের পছন্দ হয়নি। যেমন বিগত প্রধান বিচারপতি এন. ভি. রমন্নার আমলে সুপ্রিম কোর্ট দেশদ্রোহিতার আইনকে স্থগিত করে। এই আইনের আওতায় চলা সমস্ত মামলার উপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। সরকারকে বলা হয় তাদের এই আইন বিষয়ে বক্তব্য কোর্টকে জানাতে। বিজেপি গোটা দেশজুড়ে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বহু মানুষকে জেলে পুরেছে। এই আইনকে ব্যবহার করে তারা বিরোধীদের কন্ঠরোধ করার চেষ্টা করেছে। অতএব, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় তাদের না-পসন্দ হওয়ারই কথা। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড়ের আমলে নির্বাচন কমিশনার যেভাবে নিয়োগ করা হয়েছে তা নিয়ে পদ্ধতিগত প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট। নতুন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে এত তাড়াহুড়ো করা হল কেন এই প্রশ্ন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা তুলেছেন।

এই সমস্ত অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে সরকারের গোঁসা হয়েছে। তাই দেশের আইনমন্ত্রী এবং দেশের উপরাষ্ট্রপতি (যিনি সুপ্রিম কোর্টের উকিল ছিলেন) বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে লাগাতার বিবৃতি দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা লক্ষ্মন রেখা মানছেন না। তারা নাকি সরকারী নীতি তৈরি করার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করছেন। অন্যদিকে সরকার বিচারপতিদের নিয়োগ পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। বিচারপতিদের নিয়োগ করেন বিচারপতি নিজেরাই, যাকে কলেজিয়াম সিস্টেম বলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের সর্বাধিক সিনিয়র বিচারপতিদের নিয়ে কলেজিয়াম গঠিত হয়। এই কলেজিয়াম হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে কাকে বিচারপতি নিয়োগ করা হবে সেই বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ করে। সরকার সাধারণত সেই সুপারিশ মেনে নেয়। কিন্তু অনেক সময় সরকার কলেজিয়ামের সুপারিশ মানতে দেরি করছে অথবা ফাইল ফেরত পাঠাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে। এবং তারা এই কলেজিয়াম ব্যবস্থা তুলে দিয়ে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা নিজের হাতে নেওয়ার কথা ভাবছে।

এর আগে সরকার National Judicial Appointments Commission গঠন করে বিচারপতি নিয়োগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু একটি ঐতিহাসিক রায়ে সুপ্রিম কোর্ট এই কমিশন গঠনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায় দেশের আইন হিসেবেই প্রচলিত। কিন্তু তবু মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টের উপর চাপ বাড়ানোর লক্ষ্যে পুনরায় বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

রাজ্যসভায় আইনমন্ত্রী যদিও বলেছেন নতুন করে National Judicial Appointments Commission-এর মতো কোনো আইন আনার পরিকল্পনা তাদের নেই। কিন্তু তবু তিনি বিচারপতি নিয়োগ পদ্ধতিকে অস্বচ্ছ এবং বস্তুনিষ্ঠতাহীন বলে অভিহিত করেন রাজ্যসভায়। অর্থাৎ বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নাক গলাতে চায়। সুপ্রিম কোর্ট তথা হাই কোর্টের নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে লাগাতার প্রশ্ন তুলে তারা এই নিয়ে জনমত সংগঠিত করছে এবং বিচারপতিদের উপর চাপ তৈরি করছে।

একথা কিছুটা ঠিকই যে কলেজিয়াম পদ্ধতি ত্রুটিমুক্ত নয়। তার উন্নতি করা যেতে পারে, এবং তা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সরকারের সেই বিষয়ে সদিচ্ছা নেই। তারা এই প্রসঙ্গটি লাগাতার তুলে সুপ্রিম কোর্টের অস্বস্তি বাড়াতে চায়।

বর্তমানে দেশে বিজেপি তথা মোদী একটি আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক দল ও নেতায় পরিণত হয়েছে। দেশে বিরোধীদের দুর্বলতার ফলে বিজেপি দল এবং প্রধানমন্ত্রী বিপুল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। মোদী সরকারের যাবতীয় ক্ষমতা যেখানে কেন্দ্রীভূত, নানান নীতি সমূহের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা আরো বাড়ানো হয়েছে। এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা এখনও যেই সাংবিধানিক সংস্থাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করতে পারেনি, তা হল সুপ্রিম কোর্ট তথা দেশের বিচারব্যবস্থা। সুপ্রিম কোর্টের নানা রায় নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তারা যে মোটের উপর নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার প্রতিভূ হিসেবে কাজ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অতএব সরকারের এই নিরপেক্ষতা এবং নানান প্রশ্ন যা সুপ্রিম কোর্ট তুলে ধরছে তা পছন্দ হচ্ছে না। তাই সরকার বিচারপতি নিয়োগে নিজেদের ভূমিকা বাড়ানোর কথা ভাবছে, হয়ত আগামীদিনে তারা বিচারপতি নিয়োগের দায়িত্বটি নিজেদের হাতে নিতে চায়।

এই অভিপ্রায় কখনই যাতে পূর্ণ না হয়, তার জন্য সরকারের বিরোধিতা করার প্রয়োজন রয়েছে। বিচারপতিরা যদি সরকারের বশংবদ ব্যক্তি হয় তাহলে নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ধারণাটির কোনো মানে থাকে না। সরকার তখন তাদের গা-জোয়ারি নীতিগুলিতে তাদের অধীন বিচারপতিদের দিয়ে আইনি ছাপ লাগিয়ে নেবে। গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়বে এবং দেশের সাংবিধানিক কাঠামোয় তীব্র আঘাত লাগবে।

অতএব সোচ্চারে বিরোধীদের বলতে হবে সরকারকে তারা যেন বিচারব্যবস্থার মৌলিক যে নিরপেক্ষ অবস্থান তাকে যেন ধ্বংস করার অভিপ্রায় থেকে বিরত থাকে। দেশের গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থাকে বাঁচাতেই হবে। এই লড়াই তাই সমস্ত প্রগতিশীল শক্তির লড়াই।