আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

জি২০, ভারত এবং বিজেপি


আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে/ ঢাক ঢোল ঝাঁঝর বাজে। দিল্লীর আকাশ-বাতাস বিগত ১ বছর এই আওয়াজে মত্ত ছিল। গোটা রাজধানী বিগত এক মাস ঢেকে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখের বড় বড় বিজ্ঞাপনে। চলচ্চিত্রের পর্দা সহসা নেমে এসেছে বাস্তবের মাটিতে। হীরক রাজ্যের মতো দেশের রাজধানীতে গরীবদের পুরে দেওয়া হয়েছে ঘন পর্দার পেছনে। একদা দেশের সরকারের ঘোষণা ছিল দেশ থেকে গরিবী দূর করার। যদিও বিকাশের গুঁতোয় আর ছাপ্পান্ন ইঞ্চির অনুপ্রেরণায় ঘোষণা হয়ে দাঁড়িয়েছে গরীব দূর করো। ফলে রাজধানীর আনাচে কানাচে যত গরীব ছিল হয় তাদের রাতারাতি সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে, আর যেখানে সেটা করার মত উপযুক্ত সময় মেলেনি তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পর্দার ঘেরাটোপে। মহামহীমের কড়া নির্দেশ, তাদের যেন কোনোমতেই রাস্তায় দেখা না যায় এক সপ্তাহ ধরে। বিদেশ থেকে আগত অতিথিদের চোখে যেন কেবল ঝাঁ চকচকে ভারতের ছবি থাকে। বিকাশ আর আচ্ছে দিনের যে প্রচার তিল তিল করে বিগত ১০ বছর ধরে গড়ে তোলা হয়েছে সেই ছবিতে যাতে এতটুকু কালি না লাগে তার জন্য সরকার আর প্রশাসন দিনাতিপাত করে গেছে সমস্ত মানবিকতা এবং লজ্জা ত্যাগ করে। লক্ষ্য একটাই, বিশ্বের সামনে প্রধানমন্ত্রীর মাহাত্ম্য প্রচার। আর এর উপলক্ষ্য ছিল নয়াদিল্লীতে দু'দিন ধরে ১৮তম জি২০ সম্মেলন।

বিগত ১ বছর প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদেরা দেশের দিকে দিকে এই চিৎকৃত ঘোষণা করেছেন যে স্বাধীনতার অমৃত্কালে ভারত এক নতুন শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে কারণ এই দেশ জি২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার সুযোগ পেয়েছে। ভাবখানা এমন যে ভারতের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিপুল উত্থানে বিশ্বের উন্নত ২০টি দেশ ও সঙ্ঘের এই জোট যা জি২০ নামে পরিচিত তারা ভারতকে সভাপতি করে কৃতার্থ হয়েছে। অন্তত শাসকদল বিজেপি ও তার ধামাধারীদের বক্তব্য প্রায় তেমনই। কিন্তু সে প্রচার যে আদ্যন্ত শূন্যগর্ভ তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। এবারের বৈঠকটি ছিল এই গোষ্ঠীর ১৮তম বৈঠক। অর্থাৎ এর আগে এরকম ১৭টি সম্মেলন হয়েছে এই গোষ্ঠীর কোনো না কোনো সদস্য দেশে। আসলে নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি সদস্য দেশ পালা করে একবার এই সম্মেলন আয়োজন করার দায়িত্ব পায় এবং প্রতি ২০-২১ বছর অন্তর সেই সুযোগ আসে। সুতরাং এই সুযোগ ভারতের এমনিই জুটতো, তার জন্য কোন কেরামতির দরকার পড়েনি। কিন্তু মজা হল এই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা নিয়ে বিজেপির নেতাদের এত নাচন কোঁদন কেন? ভারতে কি এরকম বড় মাপের সম্মেলন আগে হয়নি? প্রবীণ মানুষদের মনে থাকবে ১৯৮৩-তে দিল্লীতেই ৭ম এন. এ. এম. সম্মেলন হয়েছিল ৭০-এর বেশী দেশকে নিয়ে যার সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সুতরাং এই জি২০ সম্মেলন কোনোভাবেই ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিশেষ ঘটনা নয়।

তবুও এই সম্মেলন ঘিরে বিগত এক বছর কেন্দ্রের সরকার একটি বিরাট প্রচার চালিয়ে গেল কেন? যা জানা যাচ্ছে এই সম্মেলন আয়োজন করতে সরকার ইতিমধ্যেই বরাদ্দ ৯৯০ কোটির জায়গায় তার ৩০০% বেশী টাকা খরচ করে ফেলেছে। যদিও সরকারের দাবি যে এই খরচ কেবল সম্মেলন নয় বরং তার আয়োজনের জন্য কিছু স্থায়ী সম্পদ তৈরীতে কাজে লেগেছে যা পরবর্তীতে অন্য কাজেও লাগবে। প্রশ্ন হল সেই মহামূল্যের সভাগৃহ বা অন্য সম্পদ দেশের নিরন্ন জনতার কোন উপকারে লাগবে? যে জনতাকে কাপড় চাপা দিয়ে মুখ রক্ষা করতে সরকার উদগ্রীব এই জনতা যে কস্মিনকালেও এই সম্পদের গুড় চেখে দেখতে পাবেন তা বুঝতে পন্ডিত হতে হয় না। তাহলে এই বিপুল অর্থব্যয়ে লাভ কার? বলাই বাহুল্য এই লাভের গুড় শ্রীমান নরেন্দ্র মোদি লোকসভা নির্বাচনে নিজের ঘরে তুলতে চাইছেন। 

দিনকাল বড় হতাশার। পর্দা ঢাকা দিল্লীর বস্তির কোনো ক্ষুধার্ত শিশু আজ বেরিয়ে এসে মহামহীমের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে না 'রাজা তোর কাপড় কোথায়?'। যদি তা হতো তাহলে কি এই প্রশ্ন সে করত না যে দু'দিন ব্যাপী এই রাজসূয় যজ্ঞে দেশের আমজনতার কোন উপকারটা সাধিত হল? আজ অবধি ১৭টি জি২০ সম্মেলন হয়েছে। গোড়া থেকেই ভারত এইসব সম্মেলনে সদস্য হিসেবে ছিল, এমনকি বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলেও অন্তত ৬টি সম্মেলন হয়েছে। সেই সম্মেলন থেকে দেশের আমজনতার কি সুরাহার ব্যবস্থা বর্তমান সরকার করতে পেরেছেন? দেশে মুল্যবৃদ্ধি আজ সর্বাধিক, বেকারত্বের হার ইতিহাসের সর্বোচ্চ সীমায়। বাক-স্বাধীনতা ও সম্প্রীতির প্রশ্নে ভারতের সরকারের ভূমিকা গোটা বিশ্বের কাছে সন্দেহজনক। অবস্থা এমনই যে ভারত সরকারের চাপে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারেননি। অন্য দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে তাঁকে সাংবাদিকদের বলতে হচ্ছে যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তিনি সহিষ্ণুতা রক্ষার কথা বলেছিলেন। এহেন লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত আগে দেশের কোন প্রধানমন্ত্রী স্থাপন করেছেন কিনা তা গবেষণার বিষয় বটে।

যদিও বিজেপি মরিয়া নরেন্দ্র মোদীর বিশ্বগুরু ভাবমুর্তি তুলে ধরতে, কারণ ইতিমধ্যেই তার বাকি অবতার সাজা হয়ে গিয়েছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে শুধু 'হিন্দু-হৃদয়-সম্রাট' হলে হবেনা। দেশের অর্থনীতি নিয়ে যতই প্রচার চলুক আমজনতার থেকে মুল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের সমস্যা চাপা দেওয়া যাচ্ছেনা। ফলে দেশের অবিসংবাদী রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও জনমনে ভাবমূর্তি স্থাপন করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় যে কোনো ফ্যাসিস্ট শাসক যা করেন, নরেন্দ্র মোদীও তাই করছেন। নিজের এমন একটি ভাবমূর্তি খাড়া করতে চাইছেন যার প্রমাণ দেশের রাজনীতির আঙিনায় করা মুশকিল। সাধারণ মানুষের ভাবনার সীমাকে অতিক্রম করে যায় এমন এক অবতার তিনি সাজতে চাইছেন। তাই দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে তাদের মুরুব্বি হিসেবে দেখাতে চাইছেন। যদিও সেই ভাবনা ধোপে টেকেনি। চিন এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি সম্মেলনে হাজিরই হননি। ফলে নরেন্দ্র মোদী যে এশিয়ার এক বড় মাপের রাজনীতিক এই প্রচারের ফানুস গোড়াতেই একটু চুপসে যায়। তার বদলে সরকারি প্রচারযন্ত্র বলছে ২০২৩-এর জি২০-এর যৌথ ঘোষণাপত্র নাকি যুগান্তকারী। কেন? কারণ এই সম্মতিপত্রে সব দেশ সই করেছে। যে কথাটি তারা চেপে যাচ্ছেন তা হল সমস্ত বিবদমান দেশগুলি রাজি হয়েছে কারণ ঘোষণাপত্রে কোনো দেশেরই নাম নিয়ে কোনো নিন্দা করা হয়নি বা সরাসরি কোনো ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়নি। একটি ঘোষণা হয়েছে যাতে কোনো দেশেরই বিরাট আপত্তির কারণ ছিলনা। ফলে সভাপতি হিসাবে ভারতের মধ্যস্হতার বিরাট চাতুর্য এতে প্রমাণিত হয়না। 

ফলে দু'দিনের এই যজ্ঞের পর ভারতের জনগণের কোন সমস্যার সমাধান হল সেই প্রশ্ন তুলতেই হবে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচন অবধি এই 'বিশ্বগুরু' ভাবমূর্তির ভজনা চলবে। কিন্তু বিরোধীদের দায়িত্ব এই পরিবেশে জনজীবনের মূল প্রশ্নগুলি বারবার তুলে যাওয়া। দেশের ১৩০ কোটি জনতার স্বার্থ কীভাবে সিদ্ধ হল এই সম্মেলন থেকে বারবার এই প্রশ্ন সরকারকে করে যাওয়া। যে গরীব তার ভিটেছাড়া হল তার হয়ে আওয়াজ তোলা, গরীব মানুষকে আড়াল করে প্রাচুর্যের যে মিথ্যা বার্তা বিদেশী প্রতিনিধির সামনে তুলে ধরা হল তার গনতান্ত্রিক অধিকারের দাবি তোলা। সরকার যখন হীরক রাজার মত আচরণ করছে তাহলে তার পরিণতি যেন সেই রাজার মতই হয় তার দায়ভার আজ ইন্ডিয়ারই ঘাড়ে। ভারত বনাম ইন্ডিয়া নয়। বিরোধীরা সুনিশ্চিত করুন সংবিধানের সেই ঘোষনা - 'ইন্ডিয়া যা হল ভারত'।