আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

আমাদের রূপকথা, তোমাদের রূপকথা

রত্না রায়


আমাদের রূপকথা ছিল পক্ষীরাজ ঘোড়া আর ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর জিম্মায়। 'ঠাকুরমার ঝুলি' থেকে মুঠো মুঠো সোনাদানা মণিমুক্তো তুলে নিয়ে খেলা করেছি ইচ্ছেমতো। খাটের তলায় শুয়ে কত যে দুপুরবেলা কেটেছে 'ক্ষীরের পুতুল', 'লালকমল আর নীলকমল'-কে নিয়ে! একটু বড় হয়ে হাতে পেলাম রাশিয়ান রূপকথার 'ভাসিলিসা', 'ফ্রগ প্রিন্সেস', 'কুড়ুলের জাউ' - বুঁদ হয়ে থাকতাম। 'গ্রিম ভাইদের গল্প' বই হিসেবে হাতে পাইনি। কিন্তু এদিক ওদিক থেকে খুঁটে খুঁটে পড়তাম 'স্নো হোয়াইট', 'সিন্ডারেলা', 'হ্যানসেল অ্যান্ড গ্রেটেল' আরো কত কি যে। রুমু, বোগি, ঝগড়ু আর ভুলো কুকুরটাকে নিয়ে কি গল্পটাই না ফেঁদেছেন লীলা মজুমদার 'হলদে পাখির পালক' বইতে। ভুলো গায়েব হয়ে গেলো, আবার ফিরে এলো। ছেলেমেয়ে দুটোকে কত না কষ্ট দিয়ে। "চাঁদনি রাতে দুঃখী কুকুররা সত্যি ঘুমোয় না, সারারাত চাঁদের দিকে মুখ তুলে হু-হু করে কাঁদে।"... এমন করে কবে কে নেড়িকুকুরের রূপকথা শুনিয়েছেন? আচ্ছা ষাট পেরোনো পড়ন্ত বেলায় তোমাদের রূপকথাকে এত অচেনা লাগে কেন বলতো? সাপের মাথার মণির আলোয় টলটল করতো আমাদের শিশুকাল, তোমাদের ছোটবেলা তো গডজিলার মুখনিঃসৃত 'রে'-তে ঝলসে যায়। এই ঝলসানিতেই কি মুগ্ধ হও তোমরা? কিম্ভূতদর্শন ডানাওয়ালা প্রাণীদের পিঠে চেপে লড়াই করতে বেরোয় ছোট্ট হিরো আরো বিকটদর্শন শত্রুকে নিপাত করতে। আমরা যে বড়ো শ্লথ, এতো ক্ষিপ্রতা এতো কাটাকাটি... এ তো নিতে পারছি না ছোট্ট বন্ধুরা।

যাত্রা শুরু অবন ঠাকুরের 'ক্ষীরের পুতুল' দিয়ে। দুয়োরানীর দুঃখে বুক ফেটে যেত। তবে 'বুড়ো আংলা'র সাথে উড়ে যেতে বড় মজা লাগত। ও তো দুষ্টুমির শাস্তি পেয়েছে, আমার কি! কিন্তু দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের 'ঠাকুরমার ঝুলি' ছিল জিগরি দোস্ত। কত দুপুর যে কাটিয়েছি খাটের তলায় শুয়ে শুয়ে তাকে বুকের ওপর দাঁড় করিয়ে। "আঁই লো মাঁইলো মানুষের গন্ধ পাঁইলো/ ধঁরে ধঁরে খাঁই লো!"... 'সোনার কাঠি রূপার কাঠি', আমাদের বয়সের কোন অভাগা এর ছোঁয়া পায়নি? তবে বড়ো প্রিয় ছিল 'কাঁকনমালা, কাঞ্চনমালা'... সূঁচসুতোর গল্প; "সূতন সূতন সরুলি, কোন দেশে ঘর?/ সুচ রাজার সুচ গিয়ে আপনি পর।" রাজার গায়ের এক লক্ষ সূচ সুতো পরে গা থেকে উঠে গেল, রাজা পেলেন মুক্তি। এমন রোমহর্ষক রূপকথা ক'টা লেখা হয়েছে? আবার 'গ্রিম ভাইদের গল্প' যতবার পড়েছি দিব্য নতুন মনে হয়েছে। সিন্ডারেলার পায়ের জুতো পাছে অন্য কারো পায়ে লেগে যায়, স্নো হোয়াইট-এর গলা থেকে আপেলের টুকরো কতক্ষণে বেরোবে - এসবেই তখন মগজ ব্যস্ত থাকত। যদিও বয়সের হিসেবে কিছু ছোট গ্রিম ভাইদের থেকে কিন্তু আগেই পড়ে ফেলেছি হ্যান্স অ্যান্ডারসনের 'দ্য লিটল মারমেড', 'থাম্বেলিনা', 'রাজার পোশাক' - কি যে অফুরন্ত আনন্দে ভরিয়ে দিত এই গল্পগুলো। শয়নে, স্বপনে জাগরণে মাথায় গল্প নিয়ে ঘুরতাম। বাংলা মাধ্যম স্কুলে তখন লাইব্রেরী ক্লাস থাকত। ষষ্ঠ শ্রেণীতে আমি সোভিয়েত রূপকথার বই বেছে নিলাম। আর আমায় পায় কে? ব্যাং রাজকন্যা, সিস্টার অ্যালিওনুসকা, দ্য লিউটপ্লেয়ার, ভাসিলিসা - এরা আমায় গ্রাস করে নিল। সামোভার, বরফের বল, ব্যালে ডান্স, ফারের কোট, ভাসিলিসার গাউন আমায় উন্মনা করে দিল। নতুন দেশ, নতুন মানুষ, অচেনা প্রকৃতি, নতুন নতুন নাম - আমাদের মনে কোনো অভাব ছিল না ছোট্ট বন্ধুরা।

মেগালোডন, গিদোরা, গডজিলা-র গল্প এখন প্রায় প্রতিদিনই আমায় নানান ফর্মে ছয় বছরের নাতিকে শোনাতে হয় তারই ফরমাশ অনুযায়ী। এইসব প্রাণীদের আমি চিনি না। আধুনিক রূপকথার গল্পে তরবারি, গদা, তীরধনুক ব্রাত্য। এনাদের মুখনিঃসৃত 'রে' শক্তিশেল-এর কাজ করে। এদের আমি চিনতে চাইনা - হয়ত এমন ধারণা নিয়েই বসে থাকতাম কিন্ত টোলকিয়েন-এর 'হবিট', 'লর্ড অফ দ্য রিংস' কখন যেন আমাকেও জড়িয়ে নিল। ছোটো আকৃতির বিলবো ব্যাগিনস-এর সঙ্গে তেরো জন অসীম সাহসী মানুষ আর যাদুকর গ্যান্ডাল্ফ এক কঠিন অভিযাত্রায় বেড়িয়ে পড়ে বাড়িঘর, হৃত সম্পত্তি উদ্ধার করতে। এই রূপকথার অলিগলিতে আমার মেয়ে আর নাতি আমার পথপ্রদর্শক। হ্যারি পটারের সিনেমা দেখে জে. কে. রাউলিং পড়তে উৎসাহী হলাম। মেয়ে জোগাড় করে দিল বই। অমন রূপকথা-প্রেমিকা আমি জীবনে দেখিনি। আসলে তো তিনটি প্রজন্মের কথাই বলে চলেছি। এই দ্বিতীয় প্রজন্মটি প্রথম আর তৃতীয়ের মাঝে সেতু রচনা করে চলেছে। যাই হোক এদের পাল্লায় পড়ে চেনা হল নাকবিহীন ভিলেন ভল্ডেমর্ট, কথা বলা আশ্চর্য মাকড়সা, হগওয়ার্থের ম্যাজিক শেখানোর স্কুল, ছোট্ট অনাথ যাদুকর হ্যারি আর মাগল সম্প্রদায়কে... 'চেম্বার অফ সিক্রেটস', 'হাফ ব্লাড প্রিন্স' মন জয় করে নিল। 'হ্যারি পটার অ্যান্ড ডেথলি হ্যালোজ'-এ আঠেরো বছরেই হ্যারি মৃত্যুকে জীবনের পরিণতি হিসেবে মেনে নিতে পারে। তার স্থৈর্য, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই, পরিশেষে ভল্ডেমর্টকে পরাস্ত করা তাকে বীর নায়কের মর্যাদা দেয়। বুঝলাম রূপকথারা হারায় না। যা গেছে তা হল বাইরের বল্কল, বহির্বাস খসিয়ে অন্তরে সে একই রয়ে গেছে।

ডাকযোগে যখন রাস্কিন বন্ড-এর 'দ্য কাশ্মীরী স্টোরিটেলার' হাতে পৌঁছল তখন আমি বিস্ময়ে হতবাক। এ তো আমাদের সময়ের মতো করেই লেখা। চোদ্দ বছরের সামশের জং হাতের এক ঘুঁষিতে চোদ্দ ফুট পুরু লোহার দেওয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে 'থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে' বলে ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল হাততালি দিয়ে উঠল প্রাণমন। এমনকি এ গল্পে আমার নাতিও চনমনে হয়ে উঠল। একপুকুর জল, একবাগান ফল, চোদ্দ বছর ধরে জমানো এক রান্নাঘর খাবার নিমেষে সাবড়ে দিতে পারে যেসব চরিত্রেরা বাচ্চাবুড়ো সকলেই তাদের মাথায় করে রাখবে। রাস্কিন বন্ড যেখানে হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন।

শৈলেন ঘোষ-এর 'অরুণ বরুণ কিরণমালা' এমনই একটি মন ভালো করা রূপকথা যা ছোট বড়ো সবার কাছে বড়ো আদরের। আবার রোয়াল্ড ডাল পড়ে না থাকলে এক আকাশ প্রাপ্তিকে হেলায় হারানো হবে। জন্মসাল অনুসারে টোলকিয়েন-এর পরেই আসেন রোয়াল্ড ডাল। তাঁকে চিনলাম সবশেষে। সে তো আগমন নয় সে যে আবির্ভাব। ঘাড়মোড় ভেঙে পড়লাম, এখনো পড়ছি - 'জেমস অ্যান্ড দ্য জায়ান্ট পিচ', 'চার্লি অ্যান্ড দ্য চকোলেট ফ্যাক্টরি', 'বিগ ফিট জায়ান্ট', 'মাটিল্ডা'। রোয়াল্ড ডাল যেন বড়ো কাছের এক বন্ধু যেমন 'হলদে পাখির পালক'-এর স্রষ্টা লীলা মজুমদার। বিশাল বড়ো পিচফলের মধ্যে সংসার পেতে বসা গঙ্গাফড়িং, একশো পায়ে একশো বুট পরা সেন্টিপেড, গুবরে পোকা আর জোনাকিদের মধ্যে ছোট জেমসকে নিয়ে যে কান্ডকারখানা শুরু হল, বইয়ের পাতা ছেড়ে উঠতে দেবেনা কসম খেয়ে বলতে পারি।

ভাষা নিয়ে কি কম কারিকুরি রয়েছে রূপকথার জগতে। "হুঁম হুঁম খাম - আঁরো খাঁবো/ গুম গুম গাঁম - দেশে যাঁবো" 'নীলকমল আর লালকমল' গল্পে এমনতরো বহু জরিন কারুকাজ ছড়িয়ে রয়েছে। ঠিক যেমনটা পাই রোয়াল্ড ডাল এর লেখায়।তাঁর ভাষার নামও রয়েছে - gobblefunk laguage। Phizzwizards মানে ভালো ভালো স্বপ্ন, Snozzcumber - শসার মত ফল, Frothbungling - অদ্ভূত আর মজাদার কিছু।শুধু গল্প শোনাননি, তা আবার পরিবেশন করেছেন মজাদার শব্দের রাংতায় মুড়িয়ে। এমনই এক যাদুকরী ভাষায় রূপকথা শুনিয়েছেন লীলা মজুমদার - "চাঁদের আলো ফুটফুট করছে, ...সেই চাঁদের আলোয় হাজার হাজার ছাগল চরছে।" ঝগড়ুর ঠাকুরদা যে ছাগলটিকে খুঁজছেন তার নাম সোনালিয়া। এ গল্প তো চিরকালের।

শোনো বাচ্চারা এবার তোমাদের কানে কানে বলি তোমাদের রূপকথাও আমার মন জয় করেছে গো। কেমন করে ভুলি 'বিগ ফ্রেন্ডলি জায়ান্ট' কে? এমন মানুষ থুড়ি জায়ান্টকে যে আজ বড়ো বেশি প্রয়োজন; যে হতাশ শিশুদের মনে আড়াল থেকে নতুন স্বপ্নের চিঠি বিলি করবে আর দুষ্টুদের পাতালে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। শিশু কিশোর মনকে সারিয়ে তোলার বিশল্যকরণীই তো রূপকথার গল্প। রূপকথা তো যা সত্যি আর যা সুন্দর তাকেই খুঁজে ফেরে। সে তোমাদের রূপকথাই হোক বা আমাদের রূপকথা। তাই সুযোগ পেলেই চলো ছোট বড়ো আমরা সবাই শান্ত নিরিবিলি জায়গায় রূপকথার ঝুলি খুলে বসে পড়ি আর পরীর দেশের বন্ধ দরজা হাট করে খুলে দিই।