আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

গ্রাম সংসদ, গ্রামসভা ও পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত

মৃন্ময় সেনগুপ্ত


আবাস যোজনা নিয়ে চারিদিকে বিক্ষোভ, রাজনৈতিক বিতর্ককে সঙ্গী করে ২০২৩ সালে পা রেখেছিল গ্রাম বাংলা। ডিসেম্বর মাসজুড়ে, বিভিন্ন গ্রামসভায় দেখা গিয়েছিল মানুষের বিক্ষোভ। কোথাও কোথাও আবার বিক্ষোভে গ্রামসভার বৈঠক পর্যন্ত ভন্ডুল হয়েছিল। গ্রামসভার বৈঠকে যে মানুষ তাঁদের মত জানাতে পারেন, কাজের হিসেব বুঝে নিতে পারেন, তৃণমূলের রাজত্বে সেটাই গ্রাম বাংলা ভুলতে বসেছিল। গ্রামসভায় আবাস যোজনা নিয়ে আলোচনার সুযোগে তাই অনেক জায়গায় মানুষ ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন।

আবাস যোজনাকে কেন্দ্র করে চলেছিল, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এবং দুই শাসকদলের রাজনৈতিক তরজা। কেন্দ্রীয় দল, রাজ্য দল, খোদ বিডিও সাহেবের পুলিশ নিয়ে গ্রাম পরিদর্শন, দুই সরকারের আধিকারিকদের তর্জন-গর্জনে মনে হচ্ছিল, কিছু হেস্তনেস্ত এবার বুঝি হবে। দুর্নীতিবাজরা উচিত শিক্ষে পাবে, গরিব মানুষ বাড়ি পাবেন - এই আশায় বুক বেঁধেছিলেন বহু মানুষ। আবাস যোজনার সমীক্ষার কাজ করতে গিয়ে মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন আশা, অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের অসহায় কর্মীরা। আত্মহত্যার মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছিল। এইসব প্রকল্প কর্মীদের এই কাজ করার কথা নয়। তাঁদের জোর করে ঠেলে দেওয়া হয়, মানুষের বিক্ষোভের মুখে। সবই চলেছিল, ক্ষমতার রাজনীতির নিয়ম মেনে। কিন্তু এত তর্জন গর্জনই সার। শেষ পর্যন্ত, গরিবের বাড়ি হল না। আবাস যোজনার কাজই বন্ধ হয়ে গেল।

এখন পঞ্চায়েত নির্বাচনের পালা সাঙ্গ। গত একুশে জুলাইয়ের দলীয় সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন যে, রাজ্য সরকারের অর্থে ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার বাড়ি বানানো হবে। কেন্দ্র আবাস যোজনার অর্থ না দিলে, রাজ্য সরকার নিজের অর্থে করবে। রাজ্যে ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার বাড়ি বানানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় খরচের ৬০ শতাংশ দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। বাকিটা রাজ্য সরকার। অনিয়মের অভিযোগে কেন্দ্র সেই প্রাপ্য অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের খরচেই বাড়ি হবে বলে ঘোষণা করলেন। একই সঙ্গে সেদিনের সমাবেশে তিনি জানিয়ে দেন যে, মনরেগার (একশো দিনের কাজ) অর্থ কেন্দ্র দিচ্ছে না। তাই রাজ্য সরকার ‘খেলা হবে’ নামে নতুন প্রকল্প চালু করবে। মুখ্যমন্ত্রী উবাচ অনুযায়ী, এই প্রকল্পে বছরে অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ দিন কাজ পাওয়া যাবে। বোঝাই যাচ্ছে, লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় বঞ্চনাকে তৃণমূল হাতিয়ার করবে। কেন্দ্রের থেকে রাজ্য সরকারের প্রাপ্য আদায়ের জন্য নানা সরকারি প্রক্রিয়া আছে। আছে কূটনীতির মারপ্যাঁচ। কিন্তু, তৃণমূল সেই পথে না গিয়ে, কেন্দ্রের বঞ্চনার প্রচারকেই হাতিয়ার করছে। পাশাপাশি রাজ্য সরকার নিজের অর্থে এইসব প্রকল্পের কাজ করলে দুর্নীতি ও দলবাজির সুযোগ বাড়বে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তা নিয়ে জবাবদিহিও করতে হবে না।

কেন্দ্রীয় সরকারও এই অচলাবস্থার দায় এড়াতে পারে না। প্রকল্পের অর্থ ঠিকমতো ব্যয় করা হচ্ছে কিনা, তা দেখার এক্তিয়ার সরকারের রয়েছে। কিন্তু, অনিয়মের জন্য রাজ্যবাসীকে শাস্তি দেওয়ার নৈতিক অধিকার কেন্দ্রের নেই। আবাস যোজনা, মনরেগা প্রকল্পে অর্থ দেওয়া বন্ধ করে কেন্দ্র সেটাই করছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে মনরেগায় রাজ্যকে অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। দুর্নীতি, অনিয়ম করল তৃণমূল। আর শাস্তিভোগ করছেন রাজ্যবাসী। কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি তাদের ক্ষমতা দেখাতেই ব্যস্ত। মানুষের প্রতি কর্তব্য নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। রাজ্যের বিজেপি নেতাদের প্রচারেও সেই ক্ষমতার দম্ভের পরিচয় উঠে আসছে। দোষীদের শাস্তি দেওয়ার থেকে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়াতেই তাদের বেশি উৎসাহ। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প ঘিরে তৃণমূল ও বিজেপি’র এই তরজা নতুন নয়। প্রকল্পগুলির নাম নিয়ে বিতর্ক তো লেগেই আছে। আবাস যোজনা, সড়ক যোজনা, জল সরবরাহের নানা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম রাজ্য সরকার নিজেদের মতো করে বদলে দিয়েছে। চাপে পড়ে পিছু হটতেও বাধ্য হয়েছে। আবার কেন্দ্রীয় সরকারও আগের ইউপিএ সরকারের নানা প্রকল্পের নাম বদলে, রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চেয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের এই বিষয়ে সুন্দর মিল।

কেবল আবাস যোজনা নয়, মিড ডে মিল সহ নানা প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা দেখতে কেন্দ্রীয় পরিদর্শক দল আসছেন। দুই সরকারের শক্তি প্রদর্শনের এই লড়াইয়ে কিন্তু, ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের অধিকার। আবাস যোজনা, মনরেগা সহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে সরাসরি অংশ নেওয়ার অধিকার সাধারণ মানুষের রয়েছে। পঞ্চায়েত আইন সেই অধিকার দিয়েছে। মনরেগা প্রকল্পের জন্য রয়েছে, মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন। এই কেন্দ্রীয় আইন অনুসারে প্রত্যেক জব কার্ড হোল্ডার পরিবারকে বছরে একশো দিনের কাজ দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য। আবেদন করার পনেরো দিনের মধ্যে কাজ না দিলে, বেকার ভাতা দিতে হবে। মজুরিও বকেয়া রাখা চলবে না। বাস্তবে কী হয়, তা জব কার্ড হোল্ডার পরিবারের সদস্যরা জানেন। সবটাই কর্তাদের ইচ্ছেয় চলে। কর্তা পঞ্চায়েতের মাতব্বর থেকে শুরু করে সরকারি আধিকারিকরা।

রাজ্যে তো বটেই, সারা দেশেই বছরে একশো দিন কাজ পাওয়া যায় না। লকডাউনের সময়ে কাজের চাহিদা ও সরকারি বরাদ্দ বেড়েছিল। তাতেও কাজ মিলেছে অধিকারের তুলনায় অনেক কম। ২০২০-২১ সালে দেশে পরিবার পিছু গড়ে কাজ জুটেছিল ছেচল্লিশ দিন। পশ্চিমবঙ্গে গড়ে পঞ্চাশ দিনের সামান্য বেশি। আইন অনুসারে বাকি দিনগুলির জন্য কতগুলি পরিবার বেকার ভাতা পেয়েছিল জানা নেই। প্রায় দু’বছর একশো দিনের কাজ রাজ্যে বন্ধ, বেকার ভাতা দেওয়ারও উদ্যোগ নেই। মজুরিও বকেয়া পড়ে রয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই কাজের আইনি অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করছে। এখন, সেই আইনি অধিকারকে প্রকল্পের নামে ভিক্ষায় অবনত করার আয়োজন করেছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী শুরুতেই বলেছেন যে, চল্লিশ-পঞ্চাশ দিন কাজ দেওয়া যাবে। অর্থাৎ বছরে অন্তত একশো দিনের কাজের অধিকার থাকবে না। মনরেগার বিকল্প ‘খেলা হবে’ প্রকল্প হতে পারে না। এই প্রকল্পে মানুষকে পঞ্চায়েতের মাতব্বর ও রাজ্যের শাসক দলের অনুগ্রহভাজন হয়ে থাকতে হবে। পঞ্চায়েতের কর্তা, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মাতব্বরিতে এভাবেই অর্জিত অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

অথচ, পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় সাধারণ গ্রামবাসীরই মাতব্বর হওয়ার কথা। ১৯৯২ সালে সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনী হয়েছিল সেই লক্ষ্যে। বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা কেন্দ্রীয় ফিনান্স কমিশনের মাধ্যমে পঞ্চায়েতে আসে। রাজ্য সরকার মনিটর করে এবং কেন্দ্রকে হিসেব দেয়। সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী, সাধারণ মানুষ পঞ্চায়েতের উন্নয়ন পরিকল্পনায় মূল কর্মকর্তা। নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সরকারি কর্তারা কেবল সহযোগী হিসেবে থাকবেন। বামফ্রন্টের আমলে রচিত রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনে সেই অধিকার গ্রামবাসীদের দেওয়া রয়েছে। তৃণমূলের আমলেও তা বহাল আছে। না রেখে উপায় নেই। আইন অনুসারে পাড়া বৈঠক, গ্রাম সংসদ, গ্রামসভা প্রভৃতি গ্রামবাসীর পঞ্চায়েতের কাজে অংশগ্রহণের হাতিয়ার। মনরেগা, আবাস যোজনা, জাতীয় সামাজিক সহায়তা প্রকল্প, মিড-ডে মিল, গণবন্টন ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে সামাজিক নিরীক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষই এই নিরীক্ষার প্রধান পর্যবেক্ষক। তার জন্য পাড়া বৈঠক, জন শুনানি সহ নানা ব্যবস্থার কথা রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনে বলা আছে।

গ্রাম পঞ্চায়েতের একেকটি বুথের ভোটারদের নিয়ে গঠিত হয় গ্রাম সংসদ। আইন অনুসারে, বছরে কমপক্ষে দু’টি গ্রাম সংসদের সভা করতেই হয়। প্রয়োজন হলে 'বিশেষ গ্রাম সংসদ সভা' ডাকার কথা। ষান্মাসিক সভায় পরবর্তী আর্থিক বছরের খসড়া পরিকল্পনা, আগের ছয় মাসের আর্থিক হিসেব, বিভিন্ন প্রকল্পে সুফলভোগীদের তালিকা ইত্যাদি পেশ করে গ্রামবাসীদের এগুলি নিয়ে আলোচনার সুযোগ দিতে হয়। বার্ষিক সভায় আর্থিক বছরের বাজেট, বিগত এক বছরের হিসেব, পঞ্চায়েতের কাজের মূল্যায়ন, বিভিন্ন প্রকল্পে যারা সুবিধা পেয়েছেন তাঁদের তালিকা, চলতি বছরের কাজ ও পরের বছরে কী কী কাজ হবে সেসব আলোচনা করতে হয়।

একেকটি গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোটারদের নিয়ে গঠিত হয় গ্রামসভা। আইন অনুসারে, প্রত্যেক বছর ডিসেম্বর মাসে গ্রামসভার বৈঠক হওয়ার কথা। এখানে গ্রাম সংসদের সভার আলোচ্য বিষয়গুলি নিয়ে মানুষ মতামত দিতে পারেন। গ্রামসভার বৈঠকে পরের বছরের পঞ্চায়েতের বাজেট, সার্বিক পরিকল্পনা, অডিট রিপোর্ট, আয়-ব্যয়ের হিসেব, কাজের হিসেব, বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা কারা পেয়েছেন তাঁদের তালিকা গ্রামবাসীদের সামনে অবশ্যই পেশ করতে হয়। আইন অনুযায়ী গ্রামবাসীরা এগুলি নিয়ে মতামত জানাতে পারবেন এবং তাঁদের মতামত লিখে রাখতে পঞ্চায়েত বাধ্য। অর্থাৎ মানুষ যেমন সব আর্থিক হিসেব বুঝে নেওয়ার, বিভিন্ন প্রকল্পে উপকৃত ব্যক্তি বা পরিবারের নাম জানার অধিকারী, তেমনই মতামত জানারও অধিকারী। সামাজিক নিরীক্ষা, গ্রাম সংসদ, গ্রামসভায় মানুষ যদি ঠিকমতো অংশ নিতে পারেন, সব কিছু জানতে ও মতামত দিতে পারেন, তবেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সফল হয়।

আইন যেমন আছে, তেমন তার ফাঁকও রয়েছে। পঞ্চায়েত ও শাসকদলের মাতব্বর, সরকারি কর্তারা সেইসব ফাঁক ভালোভাবে জানেন। খাতায় কলমে সভা হয়। তার খবর অনেক মানুষ জানতে পারেন না। জানলেও শাসকদলের রোষানলে পড়ার ভয়ে অনেকে যান না। গেলেও মত প্রকাশের উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা, অধিকাংশ গ্রামবাসী এসব অধিকারের কথা জানেন না। শাসকদল ও পঞ্চায়েতের ওপর গরিব মানুষকে বেশি নির্ভর করতে হয়। আইন যাই বলুক, বাস্তবে মানুষের কর্মকর্তার ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই। সেটা যদি থাকত তাহলে, আবাস যোজনা নিয়ে, একশো দিনের কাজ নিয়ে এত অনিয়ম হতো না। বাম আমলেও সব ঠিকঠাক চলত না। দলের প্রাধান্য পঞ্চায়েতের কাজে মানুষের অংশগ্রহণের অধিকারকে অনেকখানি খর্ব করেছিল। আর এখন তৃণমূলের আমলে চলছে লুম্পেনগিরি। সরকারি কর্তাদের একাংশও যার অংশীদার।

সরকারি আধিকারিক, আমলার দল পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে কখনই ভালোভাবে নেননি। তৃণমূলের আমলে নানা কৌশলে তাঁদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। একদিকে শাসকদলের সীমাহীন দুর্নীতি, লুঠবাজি। অপরদিকে, তা মোকাবিলার নামে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ক্ষমতা বৃদ্ধি। পঞ্চায়েতের কাজে বেড়েছে সরকারি খবরদারি। সেই খবরদারিতে ক্ষমতার স্বাদ অনেকখানি ফিরে পেয়েছেন সরকারি কর্তারা। প্রকৃতই মানুষের পঞ্চায়েত হলে, সেই ক্ষমতা থাকবে না। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনেক বিডিও, এমনকী এসডিও’র দলদাসের ভূমিকা পালনের অন্যতম কারণ এটাই। দলীয় কর্মীদের থেকেও এবারের ভোট লুঠে তৃণমূল এই সরকারি আধিকারিকদেরই বেশি কাজে লাগিয়েছে। আধিকারিকদের নির্লজ্জ দলবাজির অনুগ্রহে যারা পঞ্চায়েতে প্রধান থেকে শুরু করে নানা পদ পেলেন, তাঁরা অনেকখানি সেই আধিকারিকদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য।

মুখ্যমন্ত্রীও সেটাই চান। দলের নিচুতলার নেতৃত্বের থেকেও এখন আমলাদের ওপর তাঁর বেশি ভরসা। খুব তাড়াতাড়ি রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলিতে আসছে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের ১,৬০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৪ হাজার কোটি টাকা এই আর্থিক বছরে আসবে। বশংবদ আধিকারিকদের মাধ্যমে রাজ্য সরকার এই বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সাধারণ মানুষ কর্মকর্তা হওয়া তো দূরের কথা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও ক্ষমতা কার্যক্ষেত্রে অনেকখানি কমাতে চাইছে রাজ্য সরকার। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আসল লক্ষ্য বানচাল করে তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। সদ্য পঞ্চায়েত ভোটে জেতা তৃণমূলের সদস্যদের নাকি দলের কাছে মুচলেকা দিতে হচ্ছে। কাজ ঠিকমতো না করলে তাদের সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া হবে। এ বিষয়ে তাঁদের কোনো আপত্তি বা অভিযোগ আইন আদালতে গ্রাহ্য না হওয়ার জন্যই এই মুচলেকা। আদর্শ গণতন্ত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে প্রয়োজনে ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার জনগণের থাকা উচিৎ। কিন্তু, এই মুচলেকা অনুসারে তৃণমূলের সদস্যদের দায়বদ্ধতা থাকবে দলের নেতৃত্বের কাছে, মানুষের কাছে নয়। মুচলেকার মাধ্যমে তৃণমূল আসলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূলেই কুঠারাঘাত করতে চায়।

একই লক্ষ্য কেন্দ্রীয় সরকারের। তারা চায়, রাজ্যের ক্ষমতা কেড়ে, নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে। বিজেপি সরকার সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করতে চাইছে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে তারা কখনই ভালো চোখে দেখেনি। মনরেগা প্রকল্প নিয়েও নানা সময়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে মনরেগায় বরাদ্দ কমেছে, প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। খাদ্যে ভর্তুকি কমেছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। রেশন ব্যবস্থায় যার প্রভাব পড়বে। মিড-ডে মিলে ভর্তুকি কমেছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আবার বহু ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে প্রয়োজনের থেকে খুব কম। মূল্যবৃদ্ধির হিসেব ধরলে প্রকৃত বরাদ্দ কমেছে। যেমন, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বরাদ্দ মাত্র ৬ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। গ্রাম সড়ক যোজনায় বরাদ্দ একই রাখা হয়েছে। এসব খাতে অর্থ বরাদ্দের সঙ্গে পঞ্চায়েতের কাজ অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।

পঞ্চায়েতের কাজে সাধারণ মানুষকে কর্মকর্তা হওয়ার কথা বলা হলেও, নানা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থের ওপর তা নির্ভর করে। প্রকল্প রূপায়ণে থাকে নানা শর্ত। তাই, আইন যাই বলুক, বাস্তবে গ্রামসভা বা গ্রাম সংসদে মানুষের স্বাধীনভাবে পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগ কম। সরাসরি নানা খাতে অর্থ বরাদ্দ না করে, প্রকল্প ভিত্তিক অর্থ দেওয়া নয়া উদারনীতির বৈশিষ্ট্য। প্রকল্পগুলি চলে নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শে। অনেকগুলি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থে। সে কারণেই কেন্দ্র বা রাজ্য পরিদর্শক দল গ্রামে গিয়ে পাড়া বৈঠক বা গ্রাম সংসদে বসেন না। প্রয়োজনে জনশুনানিও করতে বলেন না। মানুষের মতামত না নিয়েই নিজেদের দাপট দেখাতে ব্যস্ত থাকেন। মানুষের পঞ্চায়েত এভাবেই আমলাদের পঞ্চায়েতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উন্নয়ন ভাবনা আর নয়া উদারনীতির উন্নয়ন ভাবনার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নয়া উদারনীতির উন্নয়ন, সব কা সাথ সব কা বিকাশের কথা ভাবে না। প্রাকৃতিক সম্পদকে সামাজিক মালিকানা থেকে কর্পোরেট মালিকানায় আনতে চায়। উন্নয়ন পরিকল্পনায় মানুষ কর্মকর্তা হলে তার চলে না। জন শুনানি, গ্রাম সংসদ, গ্রামসভার বৈঠক করে উন্নয়নের কাজ হলে, পুঁজির গতি রুদ্ধ হয়। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুঁজির পথের কাঁটা। মনরেগার আইনি অধিকার মানুষ পেলে সস্তা শ্রম বাহিনীর যোগানে কিছুটা হলেও ঘাটতি পড়ে। ঠিক এই কারণেই নানা উপায়ে বনাধিকার আইনকে লঘু করে দেওয়া হচ্ছে। জন শুনানি, গ্রামসভার গুরুত্বকে অন্যান্য আইন সংশোধন করে লঘু করা হচ্ছে। নয়া উদারনীতির চাই উপযুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সুশাসনের নামে গণতান্ত্রিক, নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষমতা তাই কমানো হয়। আমলাদের ক্ষমতা বাড়ালেই চলে না, নানা পরামর্শদাতা কমিটি গড়ে কর্পোরেটের মনোবাঞ্ছা পূরণ করা হয়। যেখানে উদার গণতন্ত্রকেই নয়া উদারনীতি মানতে পারে না। সেখানে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র তো তার চক্ষুশূল। নিজেদের মধ্যে তরজার আড়ালে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার তাই পঞ্চায়েতের ক্ষমতাকে খর্ব করতে চাইছে।

গ্রামের মানুষের প্রতিদিনিকার জীবনযাত্রায় এখনও একসঙ্গে চলার অভ্যাস রয়ে গেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সামাজিক মালিকানা বোধ রয়েছে। গ্রামের কোনো উন্নয়নের কাজে যৌথভাবে অংশ নেওয়া এখনও গ্রাম বাংলার বৈশিষ্ট্য। নানা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরম্পরাগতভাবে চলা সামাজিক অনুশাসনের অনুশীলন ধ্বংস হয়ে যায়নি। যৌথভাবে চলার এই সামাজিক সংস্কৃতি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু তাকে ব্যবহার করেই অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের অনুশীলন করার সুযোগ রয়েছে। তার জন্য প্রয়োজন এই ব্যবস্থায় থাকা আইনি অধিকারগুলি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।

মানুষের মধ্যে অধিকার বোধ জাগানোর রাজনৈতিক দায়িত্ব বামপন্থীদের। সামাজিক নিরীক্ষা, গ্রাম সংসদ, গ্রামসভা - এসবের আইনি অধিকার নিয়ে চর্চা বাম মহলে প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম হয়। ইস্যুগুলি নিয়ে সভা, মিছিল কম হয় না। কেন্দ্রীয় সেইসব কর্মসূচিতে ভিড়ও হয়। ভাষণে হাততালিও জোটে বিস্তর। কিন্তু, অধিকারগুলি নিয়ে নিচুতলায় মানুষের কাছে যাওয়া, ধারাবাহিকভাবে প্রচার করার কাজটা বিশেষ হয় না। সাধারণ মানুষ তো বটেই, বহু বামকর্মীই এই অধিকারগুলি ভালোভাবে জানেন না। দোষটা তাঁদের নয়। মানুষ অধিকারের কথা জানলে, কী করতে পারে তা তো গ্রামসভার বৈঠকগুলিতে বিক্ষোভ দেখেই টের পাওয়া গিয়েছে। বামেদের ওপরতলা থেকে ঠিক হওয়া কর্মসূচিতে মানুষের মধ্যে অধিকার বোধ জাগিয়ে তোলার কাজে থেকে যাচ্ছে বড় ফাঁক। তার কারণ কি মানুষ জাগলে, দলের প্রভাব কমার ভয়?