আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

পাশপাশি ঘর, কিন্তু প্রতিবেশী নয়

অশোক সরকার


এ'বছর ১৫ই আগস্টের প্রাক্বালে নন্দিতা দাস, রত্না পাঠক শাহ সহ কিছু প্রতিষ্ঠিত সংবেদনশীল মানুষ একটা উদ্যোগ নিয়েছেন যার নাম “আমাদের ঘরে আসুন না”। উদ্দেশ্য আমাদের চেয়ে একদম আলাদা কোন মানুষকে স্বাধীনতা দিবসে বাড়িতে আমন্ত্রণ করা। আলাদা জাতি হতে পারে, আলাদা ধর্ম বা অঞ্চলের ভাষাভাষী মানুষ হতে পারে। উদ্যোগটি নিশ্চয়ই সাধুবাদ পাবার যোগ্য, কিন্তু কেউ বলতেই পারেন এর দরকার হচ্ছে কেন? সে কথা বলতেই এই লেখা।

যদি প্রশ্ন করা হয় ভারতীয়দের কে কার বন্ধু হয়? আমরা যে বলে থাকি ভারত এত ভাষা, ধর্ম, জাতি, অঞ্চল, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দেশ, সেই বৈচিত্র্য কি আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে দেখা যায়? যদি প্রশ্ন করা হয় “তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কে?” সবচেয়ে বেশি উত্তর আসে হিন্দু (৭৩ ভাগ), উচ্চবর্ণ (৬৩ ভাগ), দলিত বা মুসলিম (৫০ ভাগ), খ্রিস্টান বা আদিবাসী বন্ধু অনেক কম। কয়েকটা রাজ্যে এই প্রশ্নের উত্তরে দলিতদের সংখ্যা প্রায় ৬৭ ভাগ হয়ে যায় - পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু তার মধ্যে পড়ে, উত্তরপ্রদেশ বা আসামে এই সংখ্যাটি মাত্র ৩৭-৪০ ভাগ। ভারতের গড় নিলে দেখা যায় উচ্চবর্ণের বা ওবিসি বর্গের মানুষের দলিত বন্ধু মাত্র ৪৮-৫২%-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। হিন্দুদের মুসলমান বন্ধু মাত্র ৪০-৪৪%-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। যে যত বেশি শিক্ষিত তার বন্ধুত্ব্ব ততটাই তার নিজের ধর্মের এবং জাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রায় ৮০ ভাগ উচ্চবর্ণের মধ্যে এই সীমা দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরণের সংখ্যা আরও দেওয়া যায় কিন্তু তাতে বন্ধুত্বের সামাজিক চেহারা খুব একটা বদলায় না।

ভারতীয়দের বন্ধুত্বে বৈচিত্র্য নেই

যদি প্রশ্ন করি “দুজন নেতা সমান দক্ষ, এবং দুজনের কাছেই যেতে কোন বাধা নেই। একজন তোমার জাতির, অন্যজন নয়। তোমার কাজ করানোর জন্য কার কাছে যাবে?” উত্তরপ্রদেশের ৭০ ভাগ মানুষ বলবেন নিজের জাতির লোকের কাছে যাবো, সেই সংখ্যাটি পশ্চিমবঙ্গে হবে ৫২ ভাগ, কেরালাতে মাত্র ২০ ভাগ মানুষ সে কথা বলবেন। তামিলনাড়ুতেও ৪০ ভাগ মানুষ বলবেন নিজের জাতির লোকের কাছে যাবো। আদিবাসীদের বাদ দিলে অন্য সব সামাজিক বর্গের লোকেরা প্রায় একই কথা বলবেন। জাতের বদলে যদি দুই ধর্মের সমান দক্ষ নেতা হয়, তাহলেও উত্তরের ছাঁচটি বদলাবে না, বরং নিজের ধর্মের নেতার কাছে যাওয়ার প্রবণতা একটু বেড়ে যাবে। খ্রিস্টানদের বাদ দিলে বাকি সব ধর্মের মানুষ একই কথা বলবেন। উত্তরদাতার শিক্ষাগত যোগ্যতা এই ছাঁচে খুব একটা বদল ঘটাবে না। এ ব্যাপারেও আরও অনেক সংখ্যা দেওয়া যায়, কিন্তু উত্তরের সামাজিকতাতে চেহারা বদলাবে না। ভারতীয়রা নিজের জাতের বা নিজের ধর্মের মানুষকেই বেশি বিশ্বাস করেন।

ভারতীয়দের বিশ্বাসের জগত যথেষ্ট সংকীর্ণ

কোন ধর্মসম্প্রদায় কতটা দেশপ্রেমী? সব ধর্মের মানুষই মনে করে সেই ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষেরা খুবই দেশপ্রেমী, কিন্তু একই কথা অন্য ধর্মসম্প্রদায় সম্পর্কে মনে করে না। এরই মধ্যে ৩০ ভাগ ভারতীয় মনে করেন মুসলমানরা দেশপ্রেমী নয়, ২৮ ভাগ ভারতীয় খ্রিস্টানদের সম্পর্কে একই ধারনা পোষণ করেন। তুলনায় মাত্র ১০ ভাগ ভারতীয় হিন্দু ও শিখদের সম্পর্কে এই ধারণা রাখেন। উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে গেলে এই সংখ্যা ৬০ ভাগ আর ৪০ ভাগ হয়ে যায়। কেরালায় বা আসামে চলে এলে এই সংখ্যা প্রায় সম্পূর্ণ উলটে যায়, সেখানে প্রায় ৬৫ ভাগ মানুষ মনে করেন মুসলমানেরা দেশপ্রেমী। হিন্দুদের মধ্যেই মুসলমানদের সম্পর্কে এই ধারণা সবচেয়ে গভীর - ৩৫ ভাগ হিন্দু মনে করেন মুসলমানেরা দেশপ্রেমী, আর ১৭ ভাগ হিন্দু মনে করেন মুসলমানেরা একেবারেই দেশপ্রেমী নয়। শিখ বা খ্রিস্টানদের মধ্যে কিন্তু মুসলমানদের সম্পর্কে এই ধারণা একেবারেই নেই - মাত্র ৪ ভাগ শিখ আর ৬ ভাগ খ্রিস্টান এই ধারণা পোষণ করেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা এই ধারণায় খুব একটা ফারাক আনে না।

বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের ধারণায় গভীর ফারাক আছে

মেয়েদের নিয়ে প্রশ্ন করলে, অদ্ভুত কিছু উত্তর বেরিয়ে আসে। দেশের প্রায় ৭৩ ভাগ মানুষ মনে করেন, কাকে বিয়ে করবে, তা মেয়েদেরই ঠিক করা উচিত, পাশাপাশি প্রায় ৬৮ ভাগ মানুষ মনে করেন মেয়েদের বাইরের কাজের বদলে গৃহস্থালিতে নজর দেওয়া উচিত। উত্তরপ্রদেশে এই সংখ্যা প্রায় ৭৭ ভাগ, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৬২ ভাগ, এমনকি কেরালাতেও প্রায় ৫৩ ভাগ। ছেলেদের ও মেয়েদের মধ্যে এই ধারণায় কোন তফাত নেই। আবার অন্যদিকে প্রায় ৮৫ ভাগ ছেলে ও মেয়েরা মনে করেন সন্তান প্রতিপালনে মেয়েদের ও ছেলেদের সমান দায়িত্ব হওয়া উচিত। এ'ব্যাপারে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে সংখ্যার কোন ফারাক নেই। কিন্তু ৬৭ ভাগ হিন্দু মহিলা (৬৫ ভাগ হিন্দু পুরুষ) এবং ৮০ ভাগ মুসলিম মহিলা (৭৬ ভাগ মুসলিম পুরুষ) মনে করেন ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করা একেবারেই উচিত নয়।

৩২ ভাগ মানুষ মনে করেন, মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের শিক্ষিত হওয়া বেশি জরুরি, একই সংখ্যক মানুষ মনে করেন মেয়েদের মজুরি ছেলেদের চেয়ে কম হওয়া উচিত। এ'ব্যাপারে তামিলনাড়ু সবচেয়ে উপরে, তার ঠিক নিচে উত্তরপ্রদেশ, তারপরে পশ্চিমবঙ্গ! একই সুরে প্রায় ৫০ ভাগ মহিলা মনে করেন সব চাকরিতে মেয়ের জন্য সংরক্ষণ থাকা উচিত, ৪৭ ভাগ পুরুষ তা মনে করেন না।

মেয়েদের ব্যাপারে বড় সংখ্যক ভারতীয়দের ধারণা এখনো যথেষ্ট রক্ষণশীল

প্রতিবেশী হিসেবে কাকে চাই না, এই প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে ৩৬ ভাগ হিন্দু মুসলমানদের প্রতিবেশী হিসেবে চান না, ১৬ ভাগ মুসলমান হিন্দুদের প্রতিবেশী হিসেবে চান না, এবং ২৫ ভাগ মুসলমান চান না খ্রিস্টানরা প্রতিবেশী হোক। ৩১ ভাগ হিন্দুরাও চান না খ্রিস্টানরা প্রতিবেশী হোক। ২৮ ভাগ হিন্দুও শিখদেরও প্রতিবেশী হিসেবে চান না। এই সংকীর্ণতা জৈনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ৫৪ ভাগ জৈন মুসলমানদের, ৪৭ ভাগ জৈন খ্রিস্টানদের ও ৩৯ ভাগ জৈন শিখদের প্রতিবেশী হিসেবে চান না। সামগ্রিকভাবে দেখলে ৪৫ ভাগ হিন্দু, ৩৬ ভাগ মুসলমান, ২৯ ভাগ খ্রিস্টান, ৪১ ভাগ শিখ অন্য কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রতিবেশী হিসেবে চান না। জৈনরা এ'ব্যাপারে সবচেয়ে পিছিয়ে - ৬১ ভাগ জৈন অন্য কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতিবেশী হিসেবে চান না।

প্রতিবেশী হিসেবে ভারতীয়রা নিজের ধর্মের মানুষকেই চান

তথ্য আরও অনেক আছে, কিন্তু সব মিলিয়ে এই তথ্যগুলি ভারতীয় সমাজের কি চেহারা তুলে ধরে? পরিসংখ্যানের মানে করার দুরকম কায়দা হতে পারে। যেমন “৩৬% হিন্দু মুসলমানদের প্রতিবেশী হিসেবে চান না” - এর দুরকম মানে হতে পারে, ৬৪% হিন্দু মুসলমানদের প্রতিবেশী হিসেবে পেতে রাজি আছেন, অথবা তিন ভাগের এক ভাগ হিন্দু মুসলমানদের প্রতিবেশী হিসেবে পেতে চান না। উপরের প্রতিটা তথ্য সম্পর্কে সে কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ের পরিসংখ্যান একসঙ্গে দেখলে কি হবে? ২০১৯ সালে নেওয়া এইসব তথ্য একসঙ্গে দেখলে সমাজের চেহারা সম্পর্কে কি ইঙ্গিত দেয়?

আমার মনে হয় প্রথম ইঙ্গিত এই যে ভারতের সমাজের সংখ্যাগতভাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখনো বেশ রক্ষণশীল রয়ে গেছে। তার অনেক কারণের মধ্যে একটা কারণ নিশ্চয়ই এই যে ভারতীয়দের নানা জাতি নানা ভাষা নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে কর্মজনিত মেলামেশা থাকলেও সামাজিক মেলামেশা নিতান্তই কম, তাই নানা জাতি নানা ধর্মের মানুষ দেশে থাকলেও, তারা আপন আপন জগতে বাস করে। সমাজতাত্ত্বিকরা এই অবস্থানকে সুন্দরভাবে বলেছেন, “একই সংসারে আলাদাভাবে বাস করা”, “Religious communities in India have lived together separately”. বাংলা সাহিত্যের কথাই ধরুন। যে সাহিত্য পড়ে আমরা বড় হয়েছি, সেই সাহিত্যে মুসলমান মুখ্য চরিত্র নেই বললেই চলে, আদিবাসী মুখ্য চরিত্র, বা দলিত মুখ্য চরিত্রের অবস্থাও একই রকম। ভারতে এত ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ থাকা সত্ত্বেও, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবন কাহিনী, ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, পুরাণ ইত্যাদি সম্পর্কে ভারতীয়রা খুব কমই অবহিত। অংশগ্রহণ করা তো অনেক দূরের কথা।

দ্বিতীয় ইঙ্গিত হল ব্যক্তি ভারতীয়দের বিশ্বাসের এবং সাংস্কৃতিক জগত খুবই ছোট; জাতি, ধর্ম, অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তার প্রতিফলন সমাজের বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায় দেখা যায়, মালিক ও শ্রমিক হয় একই জাতির অথবা গ্রাম দেশের, দক্ষিণ ভারতে তো রেস্তোরাঁ চেন আছে, যেখানে শ্রমিক একই অঞ্চল থেকে নেওয়া হয়। সারা ভারতে রাজ্যস্তরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে এক একটা জাতি সম্প্রদায়ের প্রাধান্য। ভারতের শিল্পের ৯৫ ভাগ অতি ক্ষুদ্র আকারের। তার কারণ হিসেবেও বলা যায় যে ভারতীয় সমাজে social trust-এর গণ্ডি এতই ছোট যে তা বড় শিল্প গড়ে ওঠার পিছনে একটা অন্তরায়।

তৃতীয় ইঙ্গিত হল যে শিক্ষা বা media exposure এই বিষয়ে ভারতীয়দের ধারনাকে খুব একটা বদলাতে পারেনি। উপরের অংশে এই বিষয়ে খুব বেশি তথ্য নেই, কিন্তু যে তথ্যসূত্র থেকে এই কথাগুলি নেওয়া সেখানে যে কেঊ দেখতে পাবেন, শিক্ষা বা media exposure এ'ব্যাপারে সামান্যই তফাত করতে পেরেছে। তার কারণ নিঃসন্দেহে আরও বিশ্লেষণ করা দরকার, তবে একথা হয়ত বলা যায় যে শিক্ষা ও media exposure-এ আমাদের আঞ্চলিক ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের যতটা জয়ধ্বনি হয়েছে, সাংবিধানিকতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমতা ইত্যাদি বিষয়ে ততটা হয়নি, আর রাজনীতি তো নির্বাচনের ওপারে যেতেই পারেনি।

চতুর্থ ইঙ্গিত হল এই সমাজে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবিশ্বাস, সন্দেহ ও ঘৃণার বীজ বপন করা খুব একটা কঠিন নয়, কারণ তার পৃষ্ঠভূমি দিব্যি হাজির আছে। দেশের সামাজিক ও সংখ্যাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা, ব্রাহ্মন্যতন্ত্র এবং সাধারণ রক্ষণশীলতার সেচন আজকে যতটা ব্যাপক ও গভীরভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তার ভিত্তি যে নিশ্চিতভাবে সমাজের এই রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণতা, তাতে কোনো সন্দেহ আছে কি? এই তথ্যসূত্রে রাজ্যভিত্তিক যে তথ্য আছে, তাতে এটাও স্পষ্ট যে রক্ষণশীলতা ও সংকীর্ণতার ব্যাপকতা উত্তর ভারতে তুলনায় যথেষ্ট বেশি, এবং আজকে সাম্প্রদায়িক ও ঘৃণার রাজনীতি সেই উত্তর ভারতেই সবচেয়ে বেশী গেড়ে বসেছে। তুলনায় পূর্ব ও দক্ষিণ ভারত এখনো কিছুটা আলাদা।

এইখানে অন্য একটা প্রশ্ন ওঠে। সমাজ রক্ষণশীল ও সংকীর্ণ হলে সাম্প্রদায়িকতা ও ঘৃণার রাজনীতির বীজ বপন করা যায়, কিন্তু সেই একই সমাজ কি গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতন্ত্র পছন্দ করে? রক্ষণশীলতার সঙ্গে স্বৈরতন্ত্রের কি কোন সম্পর্ক আছে। আপাত1দৃষ্টিতে নেই, তাই দেখা যাক তথ্য কি বলছে।

যদি জিগ্যেস করা হয় গণতন্ত্র না স্বৈরতন্ত্র, কোনটা পছন্দ? দেশের গড়পড়তা ৩০-৩৫ শতাংশ মানুষ স্পষ্ট বলছেন স্বৈরতন্ত্র বেশি পছন্দ। এই সংখ্যা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কেরালা তামিলনাড়ু ও উত্তরপ্রদেশে ৪০ থেকে ৬০ ভাগের কাছাকাছি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রায় কোন রাজ্যেই ২৫ ভাগের নিচে কমছে না। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য ৪৫ ভাগ লোক প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন জাতের ও ধর্মের মানুষের মধ্যে এই সংখ্যায় বিশেষ কোনো তফাত নেই, ৩০-৩৫ ভাগের মধ্যেই থাকছে। কিন্তু ম্যাট্রিক ও কলেজ পাশদের মধ্যে এই সংখ্যা প্রায় ৪০-৪২ ভাগ হয়ে যাচ্ছে, তুলনায় অশিক্ষিত বা প্রাথমিক স্তরের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে এই সংখ্যা ৩০ ভাগ পেরোচ্ছে না।

গণতন্ত্রে কম শিক্ষিতদের আস্থা বেশি!

সমাজের সংখ্যাগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশের স্বৈরতন্ত্রে আপত্তি নেই, এবং একটু খতিয়ে দেখলে দেখব রক্ষণশীলতার সঙ্গে স্বৈরতন্ত্রের যতটুকু সম্পর্ক আছে, শিক্ষার সঙ্গে ততটাই সম্পর্ক আছে। এটা একটু আশ্চর্যের বিষয় যে শিক্ষিত বর্গের কাছে স্বৈরতন্ত্রের আকর্ষণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে অল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের থেকে বেশি। রামমোহন থেকে শুরু করে নেহেরু পর্যন্ত যে শিক্ষিত সমাজের বড়াই আমরা করে থাকি, যে শিক্ষিত সমাজ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ধারণা এই দেশে সেচন করেছিল, সেই শিক্ষিত সমাজ কি তাহলে মরে গেছে অথবা ক্ষীণ হয়ে এসেছে? তার জায়গায় কি জন্ম নিয়েছে অন্য এক শিক্ষিত সমাজ যারা দেশের গণতান্ত্রিক শাসনের ও সামগ্রিক উন্নয়নের রাজনীতির হাল দেখে এতটাই বীতশ্রদ্ধ যে তাঁরা মনে করেন স্বৈরতন্ত্রে এর থেকে আর খারাপ কি হবে? নাকি তাঁরা সমাজের উপর তাঁদের কর্তৃত্ব কায়েম রাখার জন্য মনে করেন স্বৈরতন্ত্রই পছন্দের, কারণ গণতন্ত্রে গরীবের কাছে কিছুটা জবাবদিহি থেকেই যায়।

এসবের পরেও প্রশ্ন ওঠে আজকের রাজনৈতিক ও সমাজ কর্মীদের কাছে আগ্রাধিকারটি কি হবে? ভোটে কি করে জেতা যায়, তার বাইরের অগ্রাধিকারের কথা বলছি। অনেকেই মনে করেন মতাদর্শের রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে, যা কিনা গত ২০ বছরে দলীয় রাজনীতি থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছে। কথাটা একদম ঠিক, শুধু একটু সংশোধন লাগবে বলে মনে হয়। মতাদর্শের রাজনীতির সঙ্গে সমাজ সংস্কারের আজেন্ডাও মেলাতে হবে। সেকুলার গণতান্ত্রিক গরিবমুখী (শুধু জাতিমুখী নয়) রাজনীতি-র প্রয়োজন অনস্বীকার্য, কিন্তু বহু জাতি, ভাষা, শ্রেণী ও ধর্মাবলম্বী ভারতীয়রা সত্যিই পরস্পরের প্রতিবেশী হয়ে উঠতে না পারলে, সমাজ বেশিদূর এগোবে না।


কৃতজ্ঞতাঃ

এই লেখায় ব্যবহৃত সব তথ্যই 'Politics and Society between Elections, 2019' নামক আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা থেকে নেওয়া, শুধু প্রতিবেশী সংক্রান্ত তথ্যগুলি https://www.pewresearch.org/religion/2021/06/29/religion-in-india-tolerance-and-segregation/ নামক লেখাটি থেকে নেওয়া।