আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে

কণিক পালধি


মোটামুটি আর কেউ বোধহয় বাকি নেই যিনি কাউকে না কাউকে ঠিক খুঁজে পেয়েছেন যিনি ইসরোর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। মজা করে বলা হলেও ভারতের বিজ্ঞান প্রযুক্তির আগ্রহ বাড়ানোর জন্য হয়তো এরকম চন্দ্রযানের মতো একটি ঘটনার দরকার ছিল। ইউটিউবের লাইভ স্ট্রিমিং হবার কোনো এক মুহূর্তে প্রায় সত্তর লক্ষ মানে সাত মিলিয়ন মানুষ একইসঙ্গে চন্দ্রযান-তিন-এর (চযা-৩) অভিযান দেখেছিলেন। ক্রিকেট ছাড়া ভারতে এরকম দর্শক সংখ্যা ঈর্ষণীয়। নিয়মিত কাগজের প্রথম পাতায় চন্দ্রযানের নব নব রূপ উন্মোচিত হবার টাটকা বিবরণ। ইসরোর প্রাক্তনীদের নিয়ে নানারকম সভা এবং বর্তমানে যারা আছেন তাঁদের সংবর্ধনা দেবার পরিকল্পনা - এই নিয়ে চলছে নানারকম ঘটনা। নিয়মিত কাগজে উঠে আসছে আঞ্চলিক কৃতীদের কথা যারা কোনো না কোনোভাবে চন্দ্রযানের সঙ্গে যুক্ত। এই 'কোনো না কোনোভাবে' শব্দবন্ধের মধ্যে লুকিয়ে আছে ইসরোকে একটু ছুঁয়ে দেখার অপরিযাপ্ত বাসনা। আসলে কী হচ্ছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না তাও, নিশ্চয়ই ভালো হচ্ছে- এরকম একটা প্রশান্তি। আজকের এই লেখা তাই চযা-৩-এর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের চেয়ে তার প্রতি মানবিক প্রতিক্রিয়ার সন্ধান করবে।

আমরা শুরু করি, সেই ব্যক্তিগত জায়গা থেকেই। যদি খেয়াল করে থাকেন যে বিজ্ঞানী বা গবেষকরা ইসরোতে কাজ করছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই প্রচলিত অর্থে দ্বিতীয় সারির বা রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। নতুন যোগদানকারীদের মধ্যে আইআইটি-র প্রায় কেউ নেই। এ থেকেই একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আশাব্যঞ্জক অবস্থান নেওয়া যেতে পারে যে এদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকর্মীদের দক্ষতার অভাব নেই। তাদের সুযোগ চাই। তাদের চাই যোগ্য সম্মান। আমাদের দেশে যেভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে 'বসিং' চলে তাতে অনেক সম্ভাবনা বিনাশ হয় অকালেই। অতি সম্প্রতি একটি ভিডিওতে এক ব্যাঙ্কের বয়স্য আধিকারিক তাঁর সহকর্মীদের যে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে যাচ্ছিলেন এবং তা শুনে সহকর্মীদের কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিলো না। যেন এটা একটি সামান্য ঘটনা। ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর ওই গালিবাজ কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও মনে হয়না এর কোনো পরিবর্তন আমাদের সমাজে হয়েছে। ইসরো ছাড়াও আমাদের যত গবেষণাগার আছে সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই কর্মীদের উৎসাহ দেওয়া হলে যে ফলাফল কত ইতিবাচক হতে পারে তার উদাহরণ তো চোখের সামনেই।

হয়তো বর্তমানে ইসরোর ক্ষেত্রে কর্মীদের বিভিন্ন অভিযানমুখী করে তাঁদের মনে এক দৃঢ় প্রত্যয়ের সৃষ্টি করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা দক্ষ কর্মীকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হলে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই কথাটি এই কারণেই বলা যে একসময় পৃথ্বীরাজ চহ্বান যখন মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্বে তখন ইসরো সহ বিভিন্ন সরকারি বৈজ্ঞানিক সংস্থার কর্মীদের পদত্যাগের হার এত বেশি হয়েছিল (প্রায় ৫৩%) যে তা নিয়ে সংসদে চর্চা হয়েছিল। এর মূল কারণ ভাবা হয়েছিল বেতন। সেই কারণেই পরবর্তী পে কমিশনে বেতন বাড়ানোর কথা বলা হয়। তবে বেতন একমাত্র কারণ যে নয় সেটা নিশ্চয়ই এখন সবাই জানেন। ছাত্র-ছাত্রীদের এই বৈজ্ঞানিক সংস্থায় যাবার চেষ্টার অনেক কারণের মধ্যে একটি মূল কারণ নিজেদের বিজ্ঞানী সত্তার বিকাশ। তা ব্যাহত হলে ধাক্কা লাগবেই। এদেশে সরকারি ক্ষেত্রে চাকরির যে স্থায়িত্ব আছে তা পাশ্চাত্যে নেই। তাও ওখানে তুলনামূলক সাফল্যের মান বিজ্ঞানে বেশি কেন? আজ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা শুরু হোক। সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা সবাই করুক। সাফল্য যেন আত্মতুষ্টির কারণ না হয়। ফিনল্যান্ড প্রভৃতি দেশে একজন কর্মীর জীবন সংক্রান্ত নানা বিষয় এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও নানা ব্যবস্থা আছে। এদেশে নানা ঘটনার পর সবাই নড়েচড়ে বসে। প্রথমেই ভেবে নিলে, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ঠিক হলে, হয়তো আরো বড়ো সাফল্য আসবে।

দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে না অথচ আমাদের অনেকের মতে সেটাই বিজ্ঞানকর্মীদের বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য তা হলো এই অভিযানে বিজ্ঞান সংস্থাগুলির সহযোগিতা। এখানে সরকারি ও নিজ সংস্থাও আছে। অন্তত দশ বারোটি সংস্থা যার মধ্যে নাসাও আছে, তাদের ক্রমাগত পরিশ্রমের ফল এই অভিযান। আজ এরা অনেকেই ইসরোর ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে, যেটা আমাদের কাছে একটা সমস্যা। এ বিষয়ে ইসরো চেয়ারম্যান শ্রী সোমনাথ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেও আমাদের দেশে যেন এই সংষ্কৃতি গড়ে ওঠে যাতে আমরা মুক্ত মনে অন্যের সহযোগিতা এবং সাফল্য স্বীকার করতে পারি। এতে আমরা ছোটো হয়ে যাই না বরং ঔৎকর্ষ্যের শিখরে থেকেও ঔদার্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি।

তৃতীয়ত, ইসরোর সাফল্য নিয়ে বিদেশের প্রতিক্রিয়া নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় যেন গালিগালাজের বান এসেছে। এমনকি যারা প্রশংসা করেছেন, তাদেরও যেন একটা হালকা চোখরাঙানি দিয়ে - ''দ্যাখ, কেমোন লাগ্যে'' টাইপের বাঁকা মন্তব্য করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও চাঁদকে মোটামুটি ভারতে ভূখন্ডের বাইরে ভারতেরই একটি মহাজাগতিক দ্বীপ হিসেবে ভাবা শুরু হয়ে গেছে। এই সমস্ত বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে যেকোনো মতামত কাদা ছেটানো ছাড়া আর কিছু করবে বলে মনে হয়না। আতিশয্য আর অতিরঞ্জনের সীমারেখা ছাড়ানো খুব সাধারণ ঘটনা। আশা করি, সময়ের সঙ্গে যত বিজ্ঞানচর্চা বাড়বে এই মন্তব্যেরও অবসান হবে।

ব্রিটেনের এক টিভি সাংবাদিকের মন্তব্য নিয়ে চর্চাটা বেশি হচ্ছে যিনি ভারতে ব্রিটেনের পাঠানো কয়েক মিলিয়ন ডলারের এইড বা ভর্তুকি বন্ধ করতে বলেছেন। এর বিপক্ষে ব্রিটিশদের ট্রিলিয়ন ডলারের লুন্ঠিত সম্পদের উদাহরণ দেওয়াও চলছে। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর জানা উচিত ছিল এই ভর্তুকি একমুখী নয়। দুটি দেশের অনেক কূটনৈতিক সূক্ষ্মতার যোগফল হলো এই অর্থের আদান-প্রদান। ফলে বাজার গরম করা ছাড়া এর প্রতিক্রিয়া দেওয়া নিতান্তই সময় নষ্ট। একটা কথা তাও না বলে পারা যায় না যে, কোথাও যেন বিদেশের এই প্রশংসা না হলে আমাদের চলে না। আরো গভীরে ভাবলে হয়তো বিদেশী হাতে পরাধীনতার ইতিহাসের ফলে কলোনিয়াল হেরো মানসিকতার পরিচয় এটা। আমার কৃতিত্ব বিশ্বসেরা হলে বিশ্বকে স্বীকৃতি জানাতেই হবে - এই আত্মবিশ্বাসের অভাব এখনো আমাদের তাড়া করছে।

এবার আসা যাক, কয়েকটিমাত্র বিজ্ঞান প্রযুক্তির সংক্ষিপ্ততম চর্চায়, যেগুলি এ'কদিন সেভাবে বলা হয়নি। চাঁদ যাত্রার উদ্দেশ্য নিয়ে বারে বারে জল পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেই জল নিয়ে আমাদের কি সুবিধা হতে পারে তা নিয়ে কিছু ভাসা ভাসা ধারণার মতো মহাকাশযানের জ্বালানির কথা বলা হচ্ছে। আমরা প্রথমেই জেনে নিই চাঁদে জল কেন মেরু অঞ্চলেই থাকতে পারে। আসলে পৃথিবীর মতো চাঁদেও সূর্যের গতিপথ এমন যে মেরু অঞ্চলের দিকে যত যাওয়া যায় সূর্যের আলো তত হেলে পড়তে থাকে। চাঁদের পিঠে থাকা অসংখ্য গভীর গর্তের মধ্যে সেই কারণেই সূর্যের আলো পড়ে না। ফলে এখানে প্রচন্ড ঠান্ডায় জল জমে থাকার সম্ভাবনা বেশি। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রথম চন্দ্রযানের সময় থেকেই (Chandra's Altitudinal Composition Explorer - CHACE) । পরবর্তীকালের নাসার গবেষণাতেও (Moon Mineralogy Mapper) দ্বিতীয় চন্দ্রযানের অরবাইটার যেটি কক্ষপথে ঘুরছে সেটি থেকেও নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে কোথায় কোথায় জল থাকতে পারে। এসব পরীক্ষার পরেই তৃতীয় চন্দ্রযান কোথায় নামবে তা স্থির করা হয়েছে।

চাঁদে জল এলো কীভাবে তার বেশ কিছু তত্ত্ব আছে। কোনোটাই সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারে না। হয়তো চাঁদে এক সময় 'জল আছে' এরকম জ্যোতির্বস্তু যেমন ধূমকেতু, উল্কা ইত্যাদিরা আছড়ে পড়ে জল এনেছে। এটাও হতে পারে যে চাঁদের প্রায় শূন্য বায়ুমন্ডল মহাজাগতিক রশ্মি আটকাতে পারে না বলে মহাজাগতিক রশ্মি যেমন সৌরঝড়ে উড়ে আসা হাইড্রোজেন চাঁদের পিঠে থাকা অক্সিজেনের সঙ্গে জোট বেঁধে জল তৈরি করে চলেছে।

এই জমে থাকা জল কি অবস্থায় আছে এটাই জানা জরুরি। যদি বরফ অবস্থায় থাকে তাহলে তা তুলনামূলকভাবে সহজেই ব্যবহারের উপযুক্ত করে তোলা যাবে। যদি অবশ্য জলের হাইড্রক্সিল আয়ন অন্য পদার্থের সঙ্গে জোট বেঁধে থেকে থাকে তাহলে জল বদলাতে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হবে। এই বিষয়ে সাহায্য করার জন্য এবার প্রজ্ঞান রোভারে আছে লিবস (Laser Induced Breakdown Spectroscope)। এটি যেকোনো শক্ত পদার্থের ভিতরে কী আছে দেখার জন্য লেজারের সাহায্যে বাইরের খোলসটি ভেঙেও দেখতে সক্ষম। আরো একটি যন্ত্র আছে যার নাম এপিএক্সএস (Alpha Particle X-ray Spectrometer)। সেটিও চাঁদে থাকা বিভিন্ন বস্তুজগতের বিশ্লেষণে পটু।

লেখা শেষ করি, আরো একটি বিষয়ের ওপর কথা বলে। সে বিষয়ে প্রথম চন্দ্রযানের সময়ে যতো হইচই হয়েছিল এখন আর হচ্ছে না। সেটি হলো চাঁদে যদি থাকে লিকুইড হিলিয়াম যা রকেটের জ্বালানির কাজে ব্যবহার হতে পারে। অবশ্য জলও রকেটের জ্বালানির জন্য ব্যবহার হতে পারে। প্রথমে তাকে হাইড্রোজেনে আর অক্সিজেনে ভেঙে আবার জোড়া লাগালে ধোঁয়া হিসেবে জলীয় বাষ্পই বেরোবে। এরকম ব্যবস্থা পৃথিবীতে হলে দূষণ কমবে নিশ্চিত, উপরন্তু বিশ্ব উষ্ণায়ণও কমতে পারে।


তথ্যসূত্রঃ

১) টাইমস্ অব ইন্ডিয়া রিপোর্ট, 'ইসরো সায়েন্টিস্টস লিভ ফর বেটার পে', সেপ্টেম্বর ২০০৭।
https://m.economictimes.com/news/politics-and-nation/isro-scientists-leave-for-better-pay/articleshow/2340863.cms

২) নাসার ওয়েবসাইট, 'নাসা - লুনার প্রসপেক্টর', মে ২০১৫।
NASA - Lunar Prospector". lunar.arc.nasa.gov. Archived from the original on 2016-09-14. Retrieved 2015-05-25.

৩) ইসরো ওয়েবসাইট, isro.gov.in