আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩০

প্রবন্ধ

স্বপ্নভঙ্গের যাদবপুর

শুভময় মৈত্র


যাদবপুরে রাগিং সেভাবে খুব নতুন কথা নয়। যাদবপুর হোক, বা দিকশূন্যপুর, বিষয়টি অপরাধমূলক। তবে দেশ বিদেশের অনেক জায়গাতেই এই ধারা ছিল, আছে এবং আমরা সঠিকভাবে সতর্ক না হতে পারলে হয়ত আগামীদিনেও থাকবে। অন্যদিকে সভ্যতা যত এগোবে, তত নজরদারি বাড়লে বিষয়টি কমার দিকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

রাগিং মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারের একটি ধারা বিশেষ। সমাজে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কারণে একটি বা একদল মানুষ আর একটি বা অন্য একদল মানুষের ওপর অত্যাচার করে। এর একটা কারণ বৈষম্য। আবার বৈষম্য মুছে গেলে এ জগতে বৈচিত্র্য কতটা থাকবে, সে প্রশ্নও স্বাভাবিক। অর্থনীতির বিষয়টি ধরা যাক। ভারতের প্রতিটি পরিবারের রোজগার যদি সমান হয়ে যায়, তাহলে সেটা যেমন একদিকে যারা আগে নিম্নবিত্ত ছিলেন তাঁদের সকলের জন্যে সুবিধের বিষয় হবে, অন্যদিকে অসুবিধে হবে যাঁরা ধনী ছিলেন তাঁদের। গোটা অর্থনীতিটা হয়ত এই অবস্থায় একেবারে স্থির হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ জগৎ এতো জটিল যে কোনো সাংসারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিভিন্ন সমস্যায় কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, তা বোঝা কঠিন।

এবার এর মধ্যে কিছু বিষয় আছে যেখানে কোনটা খারাপ তা সহজেই বোঝা যায়। যেমন হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমাবর্ষণ, নাৎসি জার্মানিতে অসহায় মানুষের ওপর অত্যাচার, সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে অশান্তি।

এইখানে কঠিন সমস্যা হল বিশেষভাবে কোনো খারাপ ঘটনা ঘটে গেলে তার দায় কার? যাদবপুরের ক্ষেত্রেও সেই একই প্রশ্ন। ধরা তো পড়বেন কয়েকজন প্রাক্তন বা বর্তমান ছাত্র। কিন্তু এর সামগ্রিক দায় বিচারে আলোচনা বহুদূর পৌঁছে যাবে। সঠিক সমস্যা থেকে সেই আলোচনা বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ঘটনার পরে পরেই যাদবপুর চত্বরে এবং গোটা রাজ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে যে সামাজিক স্পর্শকাতরতার চামড়া কতটা মোটা। সোজা কথায়, সাম্প্রতিক ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে রাগিং সংক্রান্ত যে ঘটনায় এক নিরপরাধ ছাত্রের মৃত্যু হল, সেই ঘটনাটি মর্মান্তিক। কয়েক সপ্তাহ পরে সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি হারিয়ে যাবে। তবে রাগিং সংক্রান্ত আলোচনা খুন-জখমের মতই চিরন্তন। যেকোনো দেশে যেমন অপরাধ থাকবেই, তেমন তা থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেও। ফলে সবসময়েই এই ধরণের সামাজিক সমস্যা ফিরে দেখার একটা দায় থাকে।

স্বাভাবিক নিয়মে ইস্কুলে অপরাধপ্রবণতা কম। সেটা বাড়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থাৎ একটি সময় পর্যন্ত মানুষের বয়স বাড়লে সাধারণভাবে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে, তারপর আবার একটা বয়সের পরে কমতে থাকে। অর্থাৎ আনুভূমিক অক্ষে যদি মানুষের বয়সকে চলরাশি হিসেবে ধরা হয়, যেমন জন্ম থেকে একশো বছর, সেক্ষেত্রে অপরাধপ্রবণতা বারো তেরো থেকে শুরু হয়ে চল্লিশ পঞ্চাশ পর্যন্ত বাড়াটাই স্বাভাবিক। তারপর ধীরে ধীরে তা কমার দিকেই যাবে। খুব কম ক্ষেত্রেই একজন আশি বছর বয়সী মানুষ কাউকে আঘাত করতে যান। অর্থাৎ পরিসংখ্যানগতভাবে ইস্কুল থেকে কলেজে যাওয়ার সময়ে অপরাধপ্রবণতার ঝোঁক বাড়াটাই স্বাভাবিক। তা রুখতে অবশ্যই সমাজ কিছু ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয়টাও এখানে বুঝে নেওয়া দরকার। কেউ যদি রাস্তায় আমাকে গালাগালি দেয়, আমি এড়িয়ে যেতে পারি। কিন্তু হঠাৎ করে কেউ এসে পেটাতে শুরু করলে সেখানে নিজেকে বাঁচানোটাই স্বাভাবিক। সেই হিসেবে প্রথম বর্ষের কোনো ছাত্র-ছাত্রীর ওপর যদি রাগিং হয়, সেখানে একটি সীমা পর্যন্ত তার ধৈর্য থাকতে পারে নিয়ম মেনে অভিযোগ জানানোর। কিন্তু কোনো সিনিয়র যদি এমন কিছু করে যেখানে জুনিয়রের অসহায়তা প্রকট হচ্ছে, তার গভীর মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করা এবং নিজেকে বাঁচানো অবশ্য কর্তব্য। কোনো কারণে হাতের কাছে মোবাইল নেই, ওয়ার্ডেন বা সুপার দায়িত্বশীল হলেও তাঁকে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, এই অবস্থায় আত্মসমর্পণ না করে রুখে দাঁড়ানো অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। রুখে দাঁড়াতে গিয়েও ক্ষতি হতে পারে। তবু সমাধানের একটি পথ (এক এবং একমাত্র পথ অবশ্যই নয়) হল প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের একত্র থাকা, জোটবদ্ধ থাকা এবং তাদের ওপর নির্যাতন হলে সঙ্গে সঙ্গে দলবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানো। প্রশাসনিক ব্যবস্থা তো থাকবেই। কিন্তু তার দীর্ঘসূত্রীতা আছে। ফলে নিজে মার খাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, ভীষণ বিপদ সামনে এলে, চটজলদি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা তো করতেই হবে। এই অঙ্কটুকু পরিষ্কার থাকাই ভালো। সিনিয়র চুল কাটতে বললে প্রথমেই বুঝিয়ে দিয়ে হবে যে দাদার এই ইচ্ছা পূর্ণ হবে না। প্রশাসনকে জানাতে হবে। প্রশাসন সহায়তা না করলে এবং সেই দাদা বা দিদি জোর করতে এলে উল্টে চেপে ধরে তার চুল ছেঁটে দেওয়াটা যে অপরাধ নয় এটা প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের বুঝতেই হবে। সেক্ষেত্রে দিনের শেষে হয়ত একটু মারামারি হবে। মাথা ফাটবে, দাঁত ভাঙবে, পুলিশে অভিযোগ হবে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন প্রতিবাদ ছাড়া এই বিষয় বাড়তে দিলে কোনো এক পর্যায়ে মৃত্যু, সেই ঘটনা চাপা দেওয়া হচ্ছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত, বিভিন্ন রাজনৈতিক টানাপোড়েন। বুঝতে খুব অসুবিধে হয় না যে দ্বিতীয়টির অভিঘাত অনেক বেশি। সেই কারণেই মনে রাখতে হবে প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিরোধ একটি খুব জরুরি বিষয়, যেটিকে রাগিং বন্ধের অস্ত্র হিসেবে সেভাবে আলোচনা করা হয় না। এমন একটা ভাব যেন প্রথম বর্ষের পড়ুয়া মানেই দুর্বলতর। এই ভাবনাটি একেবারে ভুল। প্রথম দিনেই কোনো মাস্টারমশাই বা দিদিমণি যদি তাদের ডেকে একসঙ্গে করে বুঝিয়ে দেন যে কেউ খোঁচাতে এলে তোমাদেরও কাঠি করার অধিকার বর্তমান, সেক্ষেত্রে এই দুর্বলতার বিষয়টা অনেকটা সামলে নেওয়া যায়। কারণ এই দুর্বলতা একটি ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। একটু খুঁজলেই দেখা যাবে যে মানুষের ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগে 'দাদা' বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বলে গেছিলেন 'কণিকা' কাব্যগ্রন্থে কুটুম্বিতা-বিচার-এর চার লাইনে।

কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই ব'লে ডাক যদি দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!

দাদাগিরির আপেক্ষিকতাবাদের জন্যে আইনস্টাইন দরকার নেই, রবীন্দ্রনাথই যথেষ্ট। সেই জায়গাতে প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের দুর্বলতর ভাবার যে সামাজিক সংস্কৃতি, তা ভাঙতেই হবে।

দ্বিতীয় একটি বিষয় হল 'স্মার্ট' নামক শব্দ। এর বাংলা আমরা সঠিক জানি না। তবে হ্যাঁ, বঙ্গবাসীর মধ্যে স্মার্টদের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ আছে। গ্রাম বা মফস্বল থেকে আসা ছেলেমেয়ে আর শহুরে পড়ুয়াদের মধ্যে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তথাকথিত স্মার্টনেস বেশি। তেমনই গরীবদের তুলনায় ধনীদের স্মার্টনেস অধিকতর। একটু ইস্তিরি করা ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরলে বেশি স্মার্ট লাগে। ক্লাসে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলে সেই ছাত্র-ছাত্রীকে বেশি স্মার্ট মনে হয়। স্মার্টনেস কোনো বদগুণ নয়। বুদ্ধিমান, ছিমছাম, চটপটে, করিতকর্মা, তীক্ষ্ণ ইত্যাদি বেশকিছু শব্দ স্মার্টনেসের সঙ্গে মেলে ভালো। কিন্তু স্মার্ট হলেই কি অপরাধপ্রবণতা কমে? মোটেই না। বরং স্মার্ট লোকজন যখন অপরাধপ্রবণ হন, তখন মহাবিপদ। বিশেষ করে কোনো স্মার্ট পড়ুয়া যদি 'দাদা' কিংবা 'বাবা' হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত হয়ে যান, তখন তাঁর অপরাধপ্রবণতা নির্ধারণ করা শক্ত। অর্থাৎ দোষ করলেও সে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাবে, তার শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কম। যাদবপুরের প্রেক্ষিতে এই প্রবণতা ধারাবাহিক। তথাকথিত স্মার্ট, কিন্তু নিজেরা পড়াশোনায় খুব সফল নন, এবং দিনের পর দিন হোস্টেলবাসী। এই দাদা কিংবা বাবাদের ইতিহাস যাদবপুরে একেবারেই সুবিধের নয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। তার মধ্যে এক আধজন ব্যতিক্রমী ভালো মানুষ হতেই পারেন। কিন্তু বাকিরা খুব সুবিধের নন, এবং এদেরকে কর্তৃপক্ষ অনেক সময় সমঝে চলেন। অর্থাৎ ভুয়ো স্মার্টনেস ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধপ্রবণতার ধারালো অস্ত্র হয়ে ওঠে। এরা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে অমলকান্তিদের, যাদের রোদ্দুর না হতে দেওয়া অনেক সহজ। সমাজও অনেক সময় ভালোদের 'লালু' বলে চিহ্নিত করে। অর্থাৎ তথাকথিত আনস্মার্ট, কিন্তু সত্যিকারের ভালো এই ছেলেগুলি যে রাগিং প্রিয় দাদার টার্গেট, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এই বছরভর অত্যাচারিত হওয়ার পর ভালোরাও আগামীতে খারাপ হন কিনা, সেই আলোচনা আপাতত মুলতুবী রইল।

এইখানে অধিকতর সতর্ক থাকার প্রয়োজন শিক্ষক এবং প্রশাসকদের। ভালোদের সুরক্ষিত না রাখতে পারলে সমাজের এনট্রপি বাড়তেই থাকবে, বাড়বে ক্যাওস। তবে এরপর যাদবপুরের বিষয়টি নিয়ে সরাসরি রাজনীতিতে ঢোকার আগে একটু হালকা কথা বলা যাক। বাঙালিদের যে চিরন্তন মজা করে 'পেছনে লাগা', এ কিন্তু খুব বেশি জাতির মধ্যে নেই। রাগিং-এর আলোচনায় অনেক সময় সেই অংশটি সঠিকভাবে বিশ্লেষিত হওয়া মুশকিল। মজা করে বাংলা ভাষায় 'পেছনে লাগা' আর ইংরিজিতে 'বুলি' করার পার্থক্য নিয়ে বিশদ আলোচনায় ঢুকলে এই লেখা মূল প্রেক্ষিত থেকে সরে যেতে পারে। তবু দু-একটি উদাহরণ দিয়ে এই অংশটা শেষ করি। আশির দশকের শেষে যাদবপুরের এক দাদা নতুন ছাত্রদের কাজ দিতেন একটি ক্লাসরুমের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ একখানি সিকি দিয়ে মাপতে। একটি বিরাট বড় আয়তাকার শ্রেণীকক্ষ কিভাবে ছোট্ট গোলাকার সিকি দিয়ে কম পরিশ্রমে আনুমানিকভাবে মাপা সম্ভব, সেটি প্রযুক্তির সমস্যা। আবার কয়েকজন দাদা পাঁচতলার ছাদে তুলে বলতেন কার্নিশে উঠে লাফাতে। নিয়ম অনুযায়ী ভেতরে লাফাতে হয়। কিন্তু দাদারা যেটা ভুলে গেছিলেন, সেটা হচ্ছে কম সম্ভাবনার দুর্ঘটনা অনেক সময় ঘটে যায়। এই দুটি উদাহরণ রাগিং-এর দুটি ভিন্ন ধারা। এগুলি বাধ্য করে করানো হত, এখনও হয়ত চালু আছে। সেইসময় কে কতটা মজা পেয়েছিল সে প্রশ্ন অবান্তর। আজকের দিনেও তাই। অনেকের দুটি ক্ষেত্রেই খারাপ লাগতে পারে। বিশেষ করে দ্বিতীয়টি ভীষণই বিপজ্জনক। এই দ্বিতীয় ধারাতেই আসে সেইসব বিষয় যা ভয়ঙ্কর, এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী। সেইখানেই প্রশাসনের দায়িত্ব সবথেকে বেশি। এক দাদা কোনো নতুন ছেলের মাথায় পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গাঁট্টা মারলে তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দৌড়ে তার বিচার করতে আসবেন না। কিন্তু পাঁচতলার ছাদ, বা বারান্দার কার্নিশ হলে তো নজর রাখতেই হবে। আর সেই দায়িত্ব পালন কোনো কারণে চটজলদি কার্যকরী না হলে আবার ফিরতে হবে পুরনো কথায়। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের। কেউ বিপজ্জনকভাবে মানসিক বা শারীরিক আঘাত করলে বা করতে এলে যে কোনো উপায়ে, এবং প্রয়োজন হলে পাল্টা আঘাতের মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করা আইনি অধিকারের বাইরে থাকার কথা নয়। ভারী ইংরিজিতে একেই বলে 'ডিসএনগেজমেন্ট ট্রেনিং'।

এবার রাজনৈতিক বিষয়ে আসা যাক। এই অংশটি সবথেকে পরিষ্কার। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বেশকিছু রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী এবং তাঁদের অনুগত অধ্যাপকেরা বলতে শুরু করেছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি অভিশাপ। খুব দূরের প্রতিযুক্তি খোঁজার প্রয়োজন নেই। এ রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে হানাহানি হয়েছে, তাতে কেউ বলতেই পারেন যে গোটা রাজ্যেই রাজনীতি এক চরম অভিশাপ। এ রাজ্যে তো ভোট এলেই বুক কাঁপে। একটিও রাজনৈতিক দল নেই যে কিনা রিগিং-এ অদক্ষ। সুযোগ সুবিধে মতো যতরকমের নির্বাচনী বেনিয়ম সম্ভব তার প্রমাণ মেলে এই রাজ্যে, সে ভোট যন্ত্রেই হোক বা ব্যালটে। সেই রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা যাদবপুর বা জেএনইউ-কে কিছুটা অস্বস্তির দৃষ্টিতে দেখেন, কারণ এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা সচেতন। এইখানে বুঝতে হবে যে আইআইটি-র মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খারাপ ঘটনা ঘটলে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া কম। কারণ সরাসরি সেখান থেকে দেশ বা রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে শ্লোগান ওঠে না। ফলে এটা মানতেই হবে যে রাজনীতি সচেতন যাদবপুরে এই রকমের ঘটনা ঘটা গোটা দেশের ছাত্র রাজনীতিকে একটি দুর্বল জায়গায় পৌঁছে দিলো।

এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সামগ্রিকভাবে মার্কসবাদীদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছেন। মার্কস সাহেব রাগিং নিয়ে বিশেষভাবে কিছু বলেননি, আর তাঁর অনুগামীরা গোলমাল পাকালে সেটা মার্কসবাদের দোষ এরকম যুক্তিজাল জটিল এবং গভীর রাজনৈতিক ভাবনার অংশ। তবে তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন খুব স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন এবং প্রচারের পরিকল্পনা করেছে। শুরুতেই যাদবপুরে ঢুকে মার্কসবাদীদের সঙ্গে এক রাউন্ড ধস্তাধস্তি করে এসেছে তারা। যদিও স্বাধীনতা দিবসের আগে-পরে এই লেখা প্রস্তুতির সময় পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে কোনো প্রামাণ্য বিষয় এসএফআই-এর বিরুদ্ধে উঠে আসেনি, এবং তাদের নেতারা এই বিষয়ে নিজেদের রাগিং বিরোধী অবস্থান ঘোষণা করেছেন। এসএফআই-এর মূল অভিযোগ হল এই ঘটনার দায় অতিবাম কিছু ছাত্রগোষ্ঠীর, যারা প্রকাশ্যে নিজেদের স্বাধীন এবং নির্দল বলেন, অথচ তাদের সঙ্গে নাকি তলায় তলায় তৃণমূলের নিবিড় যোগাযোগ।

এখানে দুটি বিষয় বোঝার প্রয়োজন। যাদবপুরের রাজনৈতিক শক্তিগুলি মোটের ওপর বামপন্থী। ফলে এই ধরণের দাদাদের বোতলে জল ভরে দেওয়া, বা ছোট করে চুল কাটতে বাধ্য হওয়ার মত ঘটনা যে দিনের পর দিন ঘটে চলেছে, এর দায় অতি সরলীকরণে আপাতত বামপন্থীদের ঘাড়েই পড়বে। বামপন্থী আদর্শে সম্পৃক্ত একটি গোষ্ঠী এই কাজ করলে অন্য গোষ্ঠীর বাধা দেওয়া উচিৎ ছিল। বিজেপি বা তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন এখানে একেবারেই শক্তিশালী নয়, এবং তাদের নাম তাই এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে উঠে আসার কারণ নেই। অন্যদিকে রাজ্যের শাসকদল হিসেবে তৃণমূলের পক্ষে পুরো দায় অস্বীকার করা শক্ত। যাদবপুরের ক্যাম্পাসে যদি অসামাজিক কার্যকলাপের কথা তাঁরা এক যুগের রাজত্বকালে জেনেই থাকেন, তাহলে এতদিন সেই অপরাধপ্রবণ মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ ছিল। এক প্রাক্তন এবং পদত্যাগী উপাচার্য টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি বলেছেন ২০১৫ সালে তৃণমূলের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী তাঁকে দূরভাষে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করেছিলেন। সেইসময় পড়ুয়াদের সামনে পেশ করা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যও টিভি চ্যানেলে ধরা আছে। অন্যদিকে এই লেখার সময়কালে রাজ্য-রাজ্যপাল সংঘাতে যাদবপুরে উপাচার্য পদ ফাঁকা, আর সেই ফাঁক দিয়ে দায় অস্বীকারের কিছু যুক্তি খুঁজে পাবে তৃণমূল। সব মিলিয়ে এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় যাদবপুর ধারার বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির একটা সুযোগ যে তৃণমূল বা বিজেপি পেয়ে গেল তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। যাদবপুরের লালমাটি নিয়ে সেখানকার পড়ুয়ারা গর্ব করতেই পারেন। কিন্তু দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিজেপি, তৃণমূল ইত্যাদি সব রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনেরই এখানে উপস্থিতি আইনসংগত। এর আগে বিভিন্ন সময়ে এই দলগুলি তাঁদের ছাত্র সংগঠনকে যাদবপুরে শক্তিশালী করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তা কোন দিকে যায় তা দেখার।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মূলত শিক্ষাঙ্গন। তবে শিক্ষা যেহেতু আজকাল সবথেকে কম গুরুত্বের, তাই সেটা একেবারে শেষেই এলো। প্রযুক্তিবিদ্যা শুধু নয়, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যথেষ্ট নামডাক। তবে সব যে খুব ভালো চলছে এমন নয়। ইউজিসি থেকে অর্থের আগমন ক্রমহ্রস্বমান। রাজ্য সরকারও যে উদারহস্তে যাদবপুরকে সাহায্য করতে চায় এমন মনে হচ্ছে না। সব মিলিয়ে বেশ আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষক এবং কর্মীদের মাইনেটুকু জুটছে, কিন্তু তার বাইরে অন্যান্য বহু পরিষেবা অর্থাভাবে ধুঁকছে। এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ার খরচ ভীষণ কম। ফলে নিম্নবিত্ত মেধাবী পড়ুয়াদের জন্যে যাদবপুর অনেক আশা ভরসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ধরনের রাগিং-এর ঘটনা তার দুর্নাম করবে, অসুবিধে হবে বিভিন্ন সূত্র থেকে বেশি টাকা পেতে, এবং একটি নেতিবাচক বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতেই পারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। বেসরকারি কলেজ-ইউনিভার্সিটি এর থেকে মুনাফা লুটবেই। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষার বেসরকারিকরণের আবদার প্রকট। এইখানেই ভূমিকা দলমত নির্বিশেষে যাদবপুরের প্রাক্তনী আর বর্তমানের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং পড়ুয়াদের। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালোটুকুতে আমরা আলোকিত হই, তার দোষের ভাগটুকু এড়িয়ে গেলে চলবে না। ভীষণ খারাপটাকে এইসময় স্বীকার করতে হবেই সকলকে। সেটাকে ভাগ করে নিতে হবে। আবার বেশি ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে না পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বন্ধ হওয়ার যে বিরুদ্ধ প্রচার তাও রুখতে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের মাধ্যমিকে অঙ্কের গড় নম্বর আমাদের দেশের যে কোন বিধানসভা বা সংসদে উপস্থিত সদস্যদের থেকে অনেকটাই বেশি। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা শংসাপত্র পান, তাঁদের সেইসব কাগজ নিয়ে জনগণ এখনও খুব বেশি সন্দেহ প্রকাশ করেন না। সেই যুক্তিবোধ থেকে স্বপ্ন নিভে যাওয়ার নীতিগত দায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত সকলে নেবেন, মাথা নিচু করে, কোন শর্ত ছাড়াই। অন্যদিকে যাদবপুরের বাইরে জগৎ অনেক বড়ো। সেখানে যারা আরও অসংখ্য স্বপ্ন নিভিয়ে দিচ্ছেন প্রতিদিন, এই সুযোগে তারা মুখোশ চড়িয়ে ভালো সাজবেন। এটাও স্বাভাবিক। তবে মাথায় রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গে যেমন একজন চুরি করলে সব বাঙালিকে চোর বলা যায় না, তেমনই যাদবপুরের স্বপ্নভঙ্গে সেখানকার সবটুকুই নির্বিকল্প সমাধিতে এমন অনুসিদ্ধান্ত অযৌক্তিক।

আপাতত গোটা ঘটনা নিয়ে এই সমাজ আন্দোলিত, শোকস্তব্ধ। ফলে এই লেখাতে বেশ কিছু হাঁটু ঝাঁকানো প্রতিক্রিয়া খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে যত দিনই যাক না কেন, এই ধরনের ক্ষত কখনোই মিলিয়ে যায় না। বহু বছর পরেও যাদবপুরের হোস্টেলে উদভ্রান্তের মত ভাঙা স্বপ্ন খুঁজে বেড়াতে হবে আমাদের, নিজেদের নিরক্ষরতা মেনে নিয়ে নতুন করে শিখতে হবে ভালোবেসে পড়তে আসা বাংলা।