আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিবাদ যখন শত্রু


একটি শিশু দাঁড়িয়ে আছে। বসে আছেন শিক্ষিকা। একজন একজন করে ছাত্র আসছে আর দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটিকে সজোরে থাপ্পড় মারছে। শিক্ষিকা মহাশয়া বলছেন মুসলমানের ছেলেকে আরো জোরে মারো! না গল্প-উপন্যাস নয়। নয় কোনো ভয়ংকর সিনেমা বা ওটিটি ধারাবাহিক। উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফনগরের একটি স্কুলের ঘটনা এটি। এই ভিডিও দেখে শিউরে উঠেছে আপামর জনসাধারণ। উত্তরপ্রদেশের সরকার স্কুলটি আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে এবং তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এখানেই তারা থেমে থাকেনি। ফেক নিউজ-এর বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করছেন যিনি সেই জুবেইর আহমেদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে ঘটনাটির ভিডিও শেয়ার করার জন্য! অর্থাৎ একটি অপরাধ হল, আপনি সেই অপরাধকারীর বিরুদ্ধে সবাইকে সজাগ করার জন্য যদি ভিডিওটি শেয়ার করেন, তাহলে পুলিশ আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে উদ্যত হবে!

আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটিকে অনেকের তুচ্ছে মনে হতে পারে। যেমনটি মনে হয়েছে সেই শিক্ষিকার। তিনি বলেছেন যে একটি তুচ্ছ ঘটনাকে বড় করে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাটি আদৌ তুচ্ছ নয়। আমাদের দেশে লাগাতার বেশ কিছু বছর ধরে বিজেপি-আরএসএস-এর রাজনৈতিক লাভের জন্য যে পরিমাণ মুসলমান বিদ্বেষী ঘৃণা মানুষের মনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই বিষবৃক্ষ এখন তার ফল দিতে শুরু করেছে। বিগত প্রায় এক দশক ধরে গো-রক্ষার নামে নিরীহ মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বাংলার শ্রমিক আফরাজুলকে ফেসবুক লাইভ করে আগুন জ্বালিয়ে হত্যা করেছে একটি হিন্দুত্ববাদী পাষণ্ড। ট্রেন থেকে নামিয়ে খুন করা হয়েছে কিশোর জুনেইদকে। এই যে ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ অপরাধ হয়ে চলেছে তার সর্বশেষ উদাহরণ একজন পুলিশকর্মী যিনি নিজের বন্দুক দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চলন্ত ট্রেনে তিনজন মুসলমানকে হত্যা করে মোদী-যোগীর নামে স্লোগান দিয়েছে। অন্যদিকে, সংগঠিতভাবে কখনও দিল্লি কখনও নুহ্ বা গুরগাঁওতে মুসলমান বিদ্বেষী দাঙ্গা সংগঠিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেও রামনবমীকে কেন্দ্র করে একাধিকবার দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে। মুজফ্ফরনগরের বাচ্চাটিকে থাপ্পড় মারার ঘটনাকে এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে মুসলমান বিদ্বেষ এবং ঘৃণা এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যেখানে শিক্ষিকা বাচ্চাদের সহপাঠীকে মুসলমান নাম করে মারতে বলছেন। বাচ্চারাও এক এক করে এগিয়ে এসে মারছে!

আসলে আরএসএস-বিজেপি দেশে মুসলমান বিদ্বেষকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। বিজেপি-র টিকিটে নির্বাচিত ৩০৩ জন সাংসদের মধ্যে একজনও মুসলমান নেই। সংসদে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব তলানিতে এসে ঠেকেছে। কিন্তু তাতে বিজেপি-র কোনো রাজনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে না। বরং বিজেপি-র সাংসদদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলেই মুসলমানদের সংখ্যা কমেছে সংসদে। রোজ স্কুল-কলেজ বন্ধুদের বা পারিবারিক হোয়াটস্আ্যাপ গ্রুপে মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে হয় তাচ্ছিল্য অথবা ঘৃণামিশ্রিত পোস্ট আসে। বিভিন্ন মিডিয়া চ্যানেল লাগাতার মুসলমান বিদ্বেষী খবর, বা অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচার করেন। এমনকি টিভি অ্যাঙ্কার সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসার কথা বলছেন এমন ঘটনাও ঘটে আকছার। দেশের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে দিবারাত্র যে বিষোদগার তা সমাজের মধ্যে এতটাই প্রোথিত হয়ে গেছে যে স্কুলের শিক্ষিকাও অনায়াসে একটি মুসলমান শিশুকে তার সহপাঠীদের মাধ্যমে প্রহার করছেন!

কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে আমি তো মুসলমান নই! অতএব মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরএসএস-বিজেপি যদি সত্যিই ঘৃণা ছড়ায় তাতে আমি মানুষ হিসেবে তার সমর্থন করি না, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে এইরকম কোনো কাজ এই হিন্দুত্ববাদীরা করবে না কারণ আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। প্রথমত, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাই কোনো একটি ধর্মের বিরুদ্ধে সরকার তথা রাজনৈতিক দলের ঘৃণা ছড়ানোটা অসাংবিধানিক কাজ। দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিবাদী শক্তি মুসলমান বিরোধিতা থেকে তাদের রাজনীতি ভারতে শুরু করে থাকলেও, একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখা যাবে যে তারা সমস্ত ধরনের গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধেই খড়্গহস্ত। কখনও ‘আরবান নকশাল’ বা কখনও ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’-এর নামে তারা ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবি সমস্ত ধরনের মানুষের উপরে ভয়ংকর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য বা খবর জোগাড় করার জন্য সাংবাদিকদেরও জেলে পাঠানো হয়েছে। তাই মুসলমান বিদ্বেষের প্রশ্নে কোনো নিরপেক্ষ অবস্থানের সম্ভাবনা নেই। আপনি হয় এই প্রশ্নে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে রয়েছেন নয়ত তার বিরুদ্ধে রয়েছেন। আপনি মুসলমান নন বলে আপনাকে রেয়াত করবে এমন যদি আপনি ভাবেন তাহলে তা একমাত্র সম্ভব আপনি যদি হিন্দুত্ববাদী হন তাহলেই। অতএব, এই লড়াইয়ে সবাইকে একটি অবস্থান নিতেই হবে।

আসলে যেকোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি তার রাজনৈতিক পুঁজি তৈরি করে সমাজের ‘অপর’ একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরি করে। যত বেশি সংখ্যক ‘অপর’-এর নির্মাণ করা হবে তত বেশি ফ্যাসিবাদী শক্তির রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তাই মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মোদী বিরোধী সমস্ত জনমতকে হয় দেশদ্রোহী অথবা হিন্দুত্ব বিরোধী হিসেবে প্রচার করার প্রবণতা বেড়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী নিজে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’-কে সন্ত্রাসবাদী শক্তি যেমন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন অথবা ঔপনিবেশিক শক্তি যেমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তুলনা করতে পিছপা হন না। যেখানে দেশের সমস্ত বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধেই এই ধরনের কথা বলা হয়, সেখানে আপনি নিরপেক্ষ থাকার ভান করে সুরক্ষিত থাকবেন এই আশা করা মূর্খামি।

কিন্তু প্রশ্ন তবু থাকে। মোদীর বিরুদ্ধেই না হয় অবস্থান নেওয়া গেল। কিন্তু তাহলেই কি মোদীকে গদিচ্যুত করা যাবে। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং রাজনৈতিক প্রশ্ন। প্রথমত, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যদি মোদীর এই উগ্র সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে তাহলেই মোদীর পতন অবশ্যম্ভাবী হবে। কিন্তু সেই অবস্থান মানুষ কখন নেবে? এখানেই বিরোধী দলগুলি এবং বিশেষত ইন্ডিয়া জোটের ভূমিকা। নিজেদের মধ্যেকার নানান মতভেদ কাটিয়ে বিরোধীদেরকে মানুষের সামনে একটি গ্রহণীয় বিকল্প তৈরি করতে হবে।

রুটি-রুজি-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-উন্নয়ন ইত্যাদি প্রশ্নকে সামনে রেখে মোদীর রাজনীতির বিপ্রতীপে এক বিকল্প আখ্যান তৈরি করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নকে সামনে রেখে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে আরএসএস-বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। মানুষের অধিকারের প্রশ্নকে সামনের সারিতে এনে সাম্প্রদায়িকতা দেশের কী সর্বনাশ করছে এই কথা মানুষকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। একমাত্র এই ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মাধ্যমেই এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় থেকে আলোর দিকে যাত্রা শুরু হবে।