আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ● ১৬-৩১ ভাদ্র, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

চন্দ্রযান-৩: বিজ্ঞান ও রাজনীতি


"চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে, কদমতলায় কে/ হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে, সোনামনির বে"। সাম্প্রতিক চাঁদে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, ইসরোর চাঁদমারি নিয়ে আসমুদ্র হিমাচলের দেশপ্রেমের গদগদ আবেগ আর জাতীয়তাবাদের আস্ফালন দেখলে এই শিশুভোলানো ছড়ার কথাই মনে আসে। আপামর দেশপ্রেমিক নাগরিক কোনো না কোনোভাবে ইসরোর সাথে যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন। সংবাদপত্রে প্রতিদিন ইসরোর বৈজ্ঞানিকদের নিয়ে প্রতিবেদন। ২৩শে আগস্ট পরবর্তী সময়ে ইসরোর সাম্প্রতিক চন্দ্রযান-৩ অভিযানের সাফল্যের পর কেন্দ্রের শাসকদলের নেতা-নেত্রী ও সমর্থকদের সগর্ব বুক ঠোকা দেখে কিঞ্চিৎ ধন্দ লাগে। ২৩শে আগস্টের আগে যাদের কথাবার্তায় বিজ্ঞানের প্রতি ন্যূনতম সম্ভ্রমও প্রকাশ পেত না, আজকে তারাই বিজ্ঞানের জয় বলে ঢক্কানিনাদ শুরু করেছে। যদিও চন্দ্রযান-২ অভিযান আংশিক বিফল হওয়ার পর এদের টিকিটিও দেখা যায়নি। আজকে সাফল্যের আলো গায়ে মাখতে তারা উদগ্রীব। সন্দেহ জাগে বিজ্ঞান নিয়ে রাজনীতির এই আগ্রহ কি নিছক সদিচ্ছা নাকি কোন দূরবর্তী হিসাব নিকাশের ফলাফল?

একথা অনস্বীকার্য যে চন্দ্রযান-৩ প্রকল্প এবং তার সফলতা ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্য অবশ্যই একটি দরকারি এবং সময়োচিত ঘটনা। বিজ্ঞানের চাইতেও এই সাফল্য অনেক বেশী প্রযুক্তির। চাঁদে কোনো যন্ত্র পাঠানোর বিজ্ঞান বহুচর্চিত এবং পরীক্ষিত। কিন্তু ভারতের প্রযুক্তিবিদদের কাছে এটা একটা পরীক্ষা ছিল কীভাবে নিজস্ব উৎক্ষেপণ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এবং যথাসম্ভব স্বল্প খরচে এই গোটা ঘটনাটি সম্পন্ন করা যায়। বলতে বাধা নেই, সেই পরীক্ষায় ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো আজ সসম্মানে উত্তীর্ণ। মাত্র ৬১৫ কোটি টাকা খরচ করে, নিজস্ব উৎক্ষেপণ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই কাজ সংস্থার বিজ্ঞানী ও তাঁদের সহযোগীরা সমাধা করেছেন। অন্যদিকে বিজেপির সাধের উত্তরপ্রদেশে মাত্র ২৯ কিমি দ্বারকা হাইওয়ে বানাতে গিয়ে সরকার প্রতি কিলোমিটারে ২৫০ কোটি টাকা খরচ করে বসে আছে। ফলে অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্ভর করে ইসরোর এই চন্দ্রবিজয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। এই সাফল্যকে অস্বীকার করা, এটার সত্যতাকে প্রশ্ন করা বালখিল্যতা। একদিকে এই ঘটনা যেমন দেশজুড়ে নবীন প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায় মনোনিবেশ করতে, অন্যদিকে বিশ্বের মানচিত্রে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান কেন্দ্র হিসেবে ভারতের গুরুত্ব বাড়বে। আগামীদিনে এই প্রযুক্তির বাণিজ্যিকীকরণ হলে তার থেকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থাও উপকৃত হবে। সর্বোপরি এই গোটা ঘটনার ধাক্কায় আরো একবার দেশজুড়ে যে আবার বিজ্ঞান নিয়ে কথা হচ্ছে তা এক সদর্থক দিক।

কিন্তু এইসব সদর্থকতা সত্ত্বেও এই সাফল্যকে সম্বল করে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের যে গরল গোটা দেশজুড়ে ঘুলিয়ে উঠেছে তা বিলক্ষণ এক চিন্তার বিষয়। অবস্থা এখানেই পৌঁছেছে যে কোনো নাগরিক প্রশংসার বদলে কোনো প্রশ্ন তুললে নেট নাগরিকেরা এসে তাকে সদলবলে ধমকে দিচ্ছেন। বৈজ্ঞানিক সাফল্যের গর্ব থাকতেই পারে, কিন্তু বিজ্ঞামনস্ক মন তো এভাবে প্রশ্নকে নাকচ করতে শেখায় না? হয়ত এটাই নতুন ভারত যা বিজেপির তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে বিগত ১০ বছর ধরে, যেখানে সমালোচনা নিষিদ্ধ। এ কেবল আর শাসকদলের অনুগামীদের নয়, আপামর জনতার মনস্তত্ত্বে ঢুকে গিয়েছে। তাই কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন আজ তুলতেই হবে সমাজের সচেতন, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের।

প্রথমত কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও তার প্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর কথা না বললেই নয়। ইসরোর নির্মিত চন্দ্রযান-এর সফল অবতরণের সম্প্রচারের শেষলগ্নে কেনই বা প্রধানমন্ত্রী সম্প্রচার পর্দার অর্ধেক দখল নিতে ব্যস্ত হলেন? গোটা দেশের ৭০ লক্ষ মানুষ যে ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়েছিলেন সেখানে সরকারের প্রধানের গুঁতিয়ে ঢুকে পড়া, সাফল্যের মুহূর্তকে আত্মপ্রচারের মঞ্চ করে তোলা কি প্রচারসর্বস্বতার নিকৃষ্ট উদাহরণ নয়? শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে তিনি সেদিন যা বললেন তার নির্যাস হল এই ইসরোর এই কীর্তি এক নতুন ভারতের ঘোষণা। কেন? এ যাবৎ কি ইসরো কোন মাইলফলকই অর্জন করেনি? এই সাফল্য কি ইসরোর জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি সমস্ত সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রসূত ফল নয়? বিজ্ঞানচর্চার সাথে যুক্ত যে কোনো ব্যক্তিই জানেন সাফল্য একদিনে আসেনা। দীর্ঘ অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও সম্মিলিত উদ্যোগের পরে আসে এরকম ঐতিহাসিক সাফল্য। তাহলে এই সাফল্যের কৃতিত্ব কি কেবল বিগত ১০ বছরের হতে পারে? এ সাফল্য তো কেবল ইসরোর একার অর্জিত নয়। দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, প্রযুক্তি গবেষণা, একাধিক সংস্থা, দেশের সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার ফলেই আজকে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ভারতীয় গবেষণা যন্ত্রের নির্ভুল অবতরণ ঘটানো গেছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করার ভিতরেই আসলে লুকিয়ে আছে বিজেপি তথা আরএসএসের রাজনীতির নির্যাস। এক উত্তরসত্য নির্মাণ। যা কিছু ঘটল তা সবটাই তাৎক্ষণিক, এর সাথে আগে পরের কোন যোগ নেই। এই সত্য প্রতিষ্ঠা করা গেলে তবেই 'মোদি বিনে গতি নাই' প্রচার চালানো যাবে। এভাবেই সব সাফল্যের কৃতিত্ব মহামান্য দাবী করে বসে থাকেন।

দ্বিতীয় যে কথাটি ভাবা দরকার তা হল ভারতীয় প্রযুক্তির এই বিপুল সাফল্য কীভাবে উদযাপিত হওয়া উচিত ছিল আর বদলে কী হচ্ছে! যে কোন বৈজ্ঞানিক সাফল্য আসলে সমাজের পশ্চাদপদতার অবসানে কাজে আসে। ভারতের মত দেশে যেখানে ধর্মবিশ্বাসের নামে কুসংস্কার আর বিভেদের কর্ষণ হয় সেখানে কি এই বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে কেন্দ্র করে এই পরিবেশের অবসান ঘটানো যেত না। যে উগ্র মুসলিম বিরোধিতা আজ গোটা দেশে ফল্গুধারার মতো বহমান, তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে এই প্রকল্পে কর্মরত বিজ্ঞানীরা যে তাদের জাতিগত, ধর্মীয় পরিচয় উত্তীর্ণ করে এক যূথবদ্ধ বিজ্ঞানকর্মীর মত কাজ করলেন সেই ঐক্যের ভাবনাকে কি কোথাও তুলে ধরা হল? প্রধানমন্ত্রী কি একবারও তার ভাষণে সেকথা উল্লেখ করলেন? একথা কি তিনি বললেন যে এই বৈজ্ঞানিকদের একটাই পরিচয় যে তারা বিজ্ঞানের ও প্রযুক্তির নিরলস সাধক। বরং উল্টো ঘটনাগুলো ঘটতে লাগল। প্রথমত অভিযান শুরুর আগে ইসরোর অধিকর্তা তার সঙ্গীদের নিয়ে চললেন তিরুপতি মন্দিরে পুজো দিতে। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এক দেশের সংস্থার প্রধান কেন একটি বিশেষ ধর্মের কাছে মাথা নোয়াবেন পদে থেকে, সে প্রশ্ন চাপা পড়ল সাফল্যের আলোয়। একথাও কেউ বললেন না যে তারা মঙ্গলকামনায় অন্য ধর্মের কাছেও মাথা নোয়ালেন না কেন? উপরন্তু চন্দ্রযান অবতরণের আগের দিন গোটা দেশজুড়ে বিজেপির নেতারা বিভিন্ন ধর্মীয় দেবতার পুজোয় মেতে উঠলেন, ভাবখানা এমন যেন তাদের এই ভক্তিতেই সাফল্য এসে পড়বে। একটা আদ্যন্ত বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ডকে ঘিরে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের এই উদযাপন সত্যিই উৎকট। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রযান অবতরণ স্থলের নামকরণ করলেন 'শিবশক্তি'। যুক্তি সহজেই অনুমেয়। আসলে ইসরোর এই সাফল্যকে আত্মসাৎ করে বিজ্ঞানমনস্কতার ঠিক বিপরীত চর্চাই আজ চলছে।

তৃতীয়ত প্রশ্ন হল আজকের এই সাফল্য নিয়ে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের এই আতিশয্য কেন? চন্দ্রযান-২ প্রকল্প সবকিছু ঠিকঠাক চলেও অবতরণের সময় বিপর্যয় ঘটে। মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলেও এটা কিন্তু নেহাত ফেলনা সাফল্য ছিল না। বরং সেই ব্যর্থতার ফলেই আজকের সাফল্য এসেছে। অথচ তখন কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে দেশবাসীর সামনে ইসরোর সেই প্রচেষ্টাকে তুলে ধরার চেষ্টা করতে দেখা যায়নি। আসলে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদদের চাই কেবল সাফল্য যার আলোয় তারা নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে ঢাকতে পারবে। দেশের মানুষকে ভালো রাখার বদলে তারা চায় কিছু সাফল্যের উচ্চকিত প্রচার যার সাময়িক ধাক্কায় অস্বস্তিকর রাজনৈতিক প্রশ্ন চাপা পড়বে। মোদি সরকার বিজ্ঞান নিয়ে এতই সদর্থক হলে আজকে চন্দ্রযান-৩ প্রকল্পে কর্মরত হিন্দুস্থান ইলেকট্রিক কর্পোরেশন-এর কর্মীদের বেতন বাকি থাকত না। ভারতের মহাকাশ গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ অঙ্কের নিরিখে বাড়লেও মূল্যমানে কমেছে। এই ঘটনা কি প্রমাণ করে কেন্দ্রের সরকার বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে আদৌ উৎসাহী? উল্টে আজ সরকার বলছে গোটা দেশে বিজ্ঞান গবেষণায় বরাদ্দ হবে পণ্য নির্মাণ ও বাজারের চাহিদা মত। আসলে সেখানেও গবেষণাকে কেবল সাফল্যের সাথে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বিজ্ঞান গবেষণা কখনোই কেবল সাফল্যের জন্য হয়না। তা হয় প্রকৃতির নিয়মকে বুঝতে, সেই নিয়মকে করায়ত্ত করে নির্মাণ হয় নতুন প্রযুক্তির। কিন্তু আজকের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবনা ঠিক তার উল্টো মেরুতে। ফলে ইসরোর চন্দ্রাবতরণ নিয়ে যাবতীয় সরকারি উৎসাহ আসলে তাদের নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করারই এক কৌশল। নির্বাচনী বৈতরণী পারের জন্য চাই উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচার। ঘটনাচক্রে তার বাহন আজ হয়েছে চন্দ্রযান। বিজ্ঞানের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকার বা অন্তত সামাজিক জীবনে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোন সৎ প্রচেষ্টা আজকের কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। এই সত্য মানুষ যত দ্রুত অনুধাবন করবেন ততই মঙ্গল।

সর্বশেষ যে কথাটি মনে রাখতে হয় তা হল, এই গোটা সাফল্যকে যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনার ফসল বলে চালানো হচ্ছে তা কি আদৌ ঠিক? দেখা যাচ্ছে এই প্রকল্পে যুক্ত বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই দেশের তথাকথিত দ্বিতীয় সারির প্রতিষ্ঠান থেকে আসা, মূলত রাজ্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আসা। কেন্দ্রের তালিকায় প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান যেমন আইআইটি থেকে তেমন কেউ নেই। এর মানে এই নয় যে মেধাবীরা এই প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই। বরং এটাই প্রমাণিত যে কেন্দ্রীয় অনুগ্রহ বঞ্চিত তথাকথিত দ্বিতীয় সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও সাফল্য আসে। কিন্তু বিগত ১০ বছরে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন্দ্রীয় অনুদান ক্রমেই কমেছে। তেলা মাথায় তেল ঢালার যে দর্শন আজকের বিজেপি সরকার নিয়েছে তা যে কত ভ্রান্ত, এই ঘটনায় প্রমাণিত। ফলে এই সাফল্যের পরিকল্পনার কণামাত্র কৃতিত্ব দাবি করার যোগ্যতা এই কেন্দ্র সরকারের নেই। তাই এই সাফল্যের আলোয় নিজেদের ব্যর্থতা যাতে শাসক না লুকোতে পারে তা নিশ্চিত করাই আজ দেশের সচেতন মানুষদের কর্তব্য।