আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২৩ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

অনাস্থা প্রস্তাব ও সংসদীয় বিতর্ক


গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের সমর্থনে নির্বাচিত সরকার এবং জনগণের টাকায় মাইনে করা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীসভা জনসাধারণের অশেষ দুর্গতি এবং দুর্ভোগের বিষয়ে নীতি প্রনয়ণ করবেন এবং কোনো অশান্তি হলে তার কারণ অনুসন্ধান করে তার সমাধান করবেন এটাই দস্তুর। কিন্তু সাধারণ গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিপরীতে ভারতের রাজনীতি বিগত ৯ বছরে উল্কার গতিতে ধেয়ে চলেছে। প্রত্যেক দিনের খবরের কাগজ এই গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অবক্ষয়ের সাক্ষ্য বহন করছে। কিন্তু মণিপুরকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার যেই ঘৃণ্য রাজনীতি করলেন তার তুলনা এমনকি মোদীর ভারতেও বিরল।

মণিপুরে মৈতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিভেদের আগুন জ্বলছে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি শব্দও ব্যয় করেননি। কুকি মহিলাদের নগ্ন করে রাস্তায় লাঞ্ছনা করা হচ্ছে, এই দৃশ্য দেখার পরে তিনি নারী নির্যাতন কতটা খারাপ তা নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন এবং দেশের অন্যান্য প্রান্তেও যে নারী নির্যাতন হয় তার হিসাব পেশ করেছেন। অর্থাৎ সরাসরি মণিপুরে যে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা বিজেপি সরকারের চোখের সামনে হয়ে চলেছে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনো বক্তব্য পেশ করেননি।

সংসদে বিরোধীদলগুলি ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে লাগাতার দাবি জানাতে থাকে যে মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংসদে বিবৃতি দিন, সমস্ত আলোচনা বাতিল করে অন্তত একদিন শুধুমাত্র মণিপুর নিয়ে সংসদে আলোচনা হোক। কিন্তু না! ৫৬ ইঞ্চির ছাতির মালিক প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদের কথা মতো বিবৃতি দিলে হয়ত ছাতির মাপ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তাই কোনো বিবৃতি তিনি দিলেন না। অগত্যা বিরোধীরা তাদের মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করতে বাধ্য হলেন। সরকারের বিরুদ্ধে 'অনাস্থা প্রস্তাব' আনা হল এই কথা ভেবে যে মণিপুর ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা বক্তব্য রাখতে পারবেন এবং প্রধানমন্ত্রীও বাধ্য হবেন এই বিষয়ে সংসদে মুখ খুলতে।

কিন্তু তিনদিন ধরে অনাস্থা প্রস্তাব সংক্রান্ত বিতর্কের পরে দেশের মানুষ কি মণিপুর নিয়ে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পেলেন? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর - না। প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রায় দুই ঘন্টা তেরো মিনিট ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু মণিপুর নিয়ে বলেছেন মাত্র পাঁচ মিনিট। এই চার মিনিটে তাঁর মুখে আপ্তবাক্য শোনা গিয়েছে যে তিনি মণিপুরে শান্তি ফেরাবেন। কিন্তু কেন অশান্তি হল? কেন ডবল ইঞ্জিন সরকার থাকা সত্ত্বেও এত মানুষের প্রাণ চলে গেল? এইসব কঠিন প্রশ্নের একটাই জবাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে রয়েছে! মণিপুরের অশান্তির জন্য দায়ি কংগ্রেস এবং নেহরু। বাকি দুই ঘন্টার বেশি সময় ধরে তিনি বিরোধীদের অপমান করেছেন, অনাস্থা প্রস্তাবকে 'ভারত বিরোধী' বলে অভিহিত করেছেন এবং নিজের তথা সরকারের পিঠ চাপড়েছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী নয়। তাঁর বক্তব্যে বিজেপি নেতার হুঙ্কার শোনা গিয়েছে। দেশের সমস্যা নিয়ে তিনি চিন্তিত অথবা গোটা দেশকে তিনি একসঙ্গে রেখে বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করতে চান, এমন কোনো ইঙ্গিতও তাঁর বক্তব্যে পাওয়া যায়নি। বিরোধী দলগুলি মোদীর লাগাতার কুরুচিপূর্ণ আক্রমণের প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে।

এই তিনদিন ব্যাপী বিতর্কে মণিপুর নিয়ে সরকারী ভাষ্যটি পেশ করেছেন দেশের গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ। মণিপুর সংক্রান্ত বক্তৃতায় অমিত শাহ বিজেপি-র মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহের প্রশংসা করেন। যেখানে বিজেপির ৩২ জন বিধায়কের মধ্যে ১৫ জন (৭ কুকি এবং ৮ মৈতেই বিধায়ক) বীরেন সিংহের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য রেখে জানিয়েছেন যে সাধারণ মানুষ এই মুখ্যমন্ত্রীকে আর বিশ্বাস করেন না। তবু বিজেপি তথা অমিত শাহ বীরেন সিংহকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। কেন? তার কারণ মণিপুরের এই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা তথা অশান্তিতে অমিত শাহ তথা বিজেপি সরাসরি মৈতেইদের পক্ষে নিজেদের অবস্থান নিয়েছে। যার প্রথম প্রমাণ হল মৈতেই মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহের প্রতি তাদের সমর্থন। দ্বিতীয়ত, তাঁর বক্তব্যে অমিত শাহ সরাসরি জানান যে বর্তমান অশান্তির মূলে রয়েছে মায়ানমার থেকে কুকি উদ্বাস্তুদের মণিপুরে এসে আশ্রয় নেওয়া। তিনি বলেন যে কুকি জাতির উদ্বাস্তুদের মণিপুরের পাহাড়ে আসা মৈতেইদের মনে এই ভীতির জন্ম দেয় যে রাজ্যের জনসংখ্যার ভারসাম্যে পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু দেশের গৃহমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে এই কথা বলার সময় খেয়াল রাখেননি যে সরকারী মতেই মায়ানমার থেকে আগত কুকিদের সংখ্যা মণিপুরে তিন হাজারের নিচে। এই কথা বলে আসলে তিনি মৈতেইদের যে ভাষ্য তাকেই সংসদে মান্যতা দিয়েছেন। ভোটের রাজনীতির হিসেবে মোদী-শাহ-বিজেপি হিন্দু এবং সংখ্যাগুরু মৈতেইদের পক্ষেই যে অবস্থান নেবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু এই রাজনীতি যে মণিপুরের অশান্ত পরিস্থিতি শান্ত করতে ব্যর্থ হবে তার প্রমাণ এই যে অমিত শাহের বিবৃতির পরেই মণিপুরের ১০ জন কুকি বিধায়ক তাঁর বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিবৃতি জারি করে বলেন, যেই কুকিরা অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছে মণিপুরে তাদেরকেই গৃহমন্ত্রী পরোক্ষে অশান্তির জন্য দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছেন। অথচ, গৃহমন্ত্রী সংসদে বললেন না যে বিভিন্ন মৈতেই সংগঠন কুকিদের গায়ে 'বিদেশী' তকমা লাগিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। দুই সম্প্রদায়ের ক্ষতেই প্রলেপ লাগানো জরুরি ছিল। কিন্তু গৃহমন্ত্রীর একপেশে বক্তব্যে সেই ক্ষতে প্রলেপ পড়েনি।

অনাস্থা প্রস্তাবের বিতর্কে মণিপুরকে কেন্দ্র করে বিজেপি-র বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে যেই বিভাজনের রাজনীতি মণিপুরের সমস্যার জন্ম দিয়েছে দেশের প্রধানমন্ত্রী-গৃহমন্ত্রী এবং সরকার সেই রাজনীতিই আগামীদিনে মণিপুর তথা গোটা দেশে কার্যকর করবেন। তাই একটি জাতি দাঙ্গার পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর অপসারণ, ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ কোনোকিছুই তারা করবেন না। বরং হিন্দু মতাবলম্বী মৈতেইদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তারা এই বার্তাই দিতে চান যে মণিপুরে আসলে সরকারের তরফে কোনো অন্যায় হয়নি। যেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তারা গোটা ভারতে চালাচ্ছেন তারই একটি ভয়ানক সংস্করণ তারা মণিপুরেও চালিয়েছেন।

বিজেপি যে মণিপুর নিয়ে তাদের মৌলিক অবস্থান থেকে পিছু হটবে না তা জানাই ছিল। কিন্তু অনাস্থা প্রস্তাব আনার যেই আসল উদ্দেশ্য গোটা দেশের সামনে বিরোধী রাজনৈতিক স্বরকে তুলে ধরা এবং সরকারের ভ্রান্ত নীতির স্বরূপ দেশের মানুষের সামনে উন্মোচন করা তা কি সফল হয়েছে? এর উত্তরে বলতে হয় বিরোধী রাজনৈতিক দল তথা 'ইন্ডিয়া' জোট যেই সুযোগ পেয়েছিল তার পূর্ণ ব্যবহার তারা করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ হল এই যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতারা যেই ভাষণ দিয়েছেন সংসদে তার থেকে অনেক ভালো ভাষণ এবং রাজনৈতিক আক্রমণ তাদের থেকে প্রত্যাশিত ছিল।

দেশের বিরোধী রাজনীতির মুখ রাহুল গান্ধী দীর্ঘ চার মাস পরে সাংসদ পদ ফেরত পেয়ে সংসদে এসে ভাষণ দিলেন। 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র অভিজ্ঞতা তিনি বর্ণনা করলেন। তাঁর মণিপুর যাত্রার অভিজ্ঞতাও তিনি বললেন। কিন্তু সরকারকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তীক্ষ্ণ প্রশ্ন তিনি করলেন না। তা না করে, তিনি হঠাৎ স্লোগানের মেজাজে বলতে শুরু করলেন যে বিজেপি সরকার মণিপুরে হিন্দুস্থানকে হত্যা করেছে, ভারত মাতাকে হত্যা করেছে। কিন্তু কীভাবে সেই হত্যা হয়েছে, সরকারের কী করার ছিল, কী করেনি, মুখ্যমন্ত্রী, গৃহমন্ত্রীর কী ভূমিকা ছিল, বিভেদের রাজনীতি নিয়ে মণিপুরের মানুষ কী বলছেন, তার কোনো কথা রাহুল গান্ধী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেননি। বিরোধী রাজনীতির মানুষরা যেই প্রত্যাশা নিয়ে রাহুল গান্ধীর বক্তব্য শুনছিলেন, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

তার মানে এই নয় যে বিরোধীদের এই প্রয়াস সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বরং বলা যায় যে প্রথমবার ‘ইন্ডিয়া’ জোট সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যমে সংসদের ভিতরে সরকারকে কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে বাধ্য করেছে। সবাই মিলে একসাথে সরকার পক্ষকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে। মণিপুর, হরিয়ানার মতন ঘটনাকে দেশের মূলধারার রাজনৈতিক বিতর্কে নিয়ে আসার কৃতিত্ব বিরোধীদের প্রাপ্য। কিন্তু এখনও অনেক পথ চলা বাকি রয়েছে। সংসদের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ জনগণের বিষয়কে কেন্দ্র করে আন্দোলন সংগ্রাম তৈরি করতে হবে। এক বিকল্প ভাষ্য নির্মাণ করতে হবে বিজেপিকে পরাস্ত করতে হলে। ২০২৪ সালের মহা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি শুরু করতে হবে অবিলম্বে। হাতে আর খুব বেশি সময় নেই!