আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২৩ ● ১৬-৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

শিক্ষাক্ষেত্রের বেনিয়ম

গৌতম হোড়


শিক্ষাক্ষেত্রে বেনিয়মের কথা মনে হলেই একটা বিখ্যাত ছবির কথা মনে পড়ে। উত্তরপ্রদেশের একটা স্কুলের ছবি। পরীক্ষা চলছে। আর স্কুলের বাইরে প্রতিটি ক্লাসঘরের পাশের জানালায় ভিড় করে আছেন কয়েকজন। তারা টুকলি সাপ্লাই করছেন। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত স্কুলের বাইরের অংশে শুধু টুকলি সাপ্লাইকারীরা। শিক্ষার অবস্থা যে কতটা খারাপ, তা সেই বহুবছর আগের ছবি থেকেই স্পষ্ট।

তারপর সময় এগিয়েছে। শিক্ষার অবস্থার বিশেষ রকমফের হয়নি। আর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, পরিস্থিতি কতটা খারাপ। লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে শিক্ষকের চাকরি পেতে হয়। যারা টাকা দেননি, তাদের একটা বড় অংশ চাকরিও পাননি। প্রতিদিন এই কেলেঙ্কারির খবর দেখতে দেখতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মনে হল, ভারতের অন্য রাজ্যের অবস্থাটা একবার দেখে নেওয়া যাক। মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারির কথা আগে থেকেই আমরা শুনেছি। কিন্তু ভারতের অন্য রাজ্যের চেহারাটা কী? সেই ছবিটাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো এই নিবন্ধে।

মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির ঘটনা সামনে আসার পর মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আবার কিছু লেখালিখি হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, ব্যাপমের মতো এতটা ব্যাপক, আপাদমস্তক দুর্নীতিতে মোড়া, অভিনব এবং রাজনীতিক, সরকারি অফিসার ও কর্মী, ব্যবসায়ী, দালাল, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপরাধীদের মেলবন্ধন আগে দেখা যায়নি। ব্যাপম সবাইকে ছাপিয়ে গেছে।

ব্যাপমের উপর দায়িত্ব ছিল, সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে পরীক্ষা নেওয়া এবং মেডিক্যাল বা অন্য ক্ষেত্রে ভর্তির পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। আর সেটা করতে গিয়েই ১৯৯০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত দুর্নীতির বাজার খুলে বসেছিল এই সংস্থা। কীভাবে কাজ হতো?

ধরুন, আপনি মেডিক্যালে ভর্তি হতে চান। কিন্তু পরীক্ষায় বসে সুবিধে করতে পারবেন না। তখন, দালাল ধরলেন। তারা রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মী থেকে শুরু করে সবার থানে যথাযোগ্য প্রণামী রেখে দিল। আপনার জায়গায় একজন ভালো ছাত্র গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবে। আপনি সুযোগ পেয়ে যাবেন। কিছু ক্ষেত্রে আপনিই পরীক্ষা দিতে গেলেন। ভালো ছাত্র মাঝখানে বসে লিখবে। দুই পাশে উপযুক্ত দক্ষিণা দেওয়া দুইজন তা টুকে যাবে। তাতেও না হলে নম্বর বেড়ে যাবে। চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রেও পদ্ধতিটা একই। নম্বর বাড়ানো থাকবে। ইন্টারভিউ বোর্ডকে জানিয়ে রাখা হবে। পয়সা দিয়ে শিক্ষক হয়ে যাবেন।

পশ্চিমবঙ্গে যে মডেলটা দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে ব্যাপমের ব্যাপক মিল আছে। সেই রাজনীতিবিদ, অপরাধী, দালাল, সরকারি কর্মী এবং অযোগ্য প্রার্থীর পয়সা খরচ করে চাকরি পাওয়ার কাহিনি তো একই। মধ্যপ্রদেশের মতোই পশ্চিমবঙ্গে কোটি কোটি টাকার খেলা হয়েছে।

মধ্যপ্রদেশে এই কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর গত দশ বছরে বেসরকারি হিসাবে একশোর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জেলের ভিতরে বন্দি থাকা অবস্থায়, জেলের বাইরে গাড়ি দুর্ঘটনার নাম করে। ফলে এর সঙ্গে জড়িতরা যে কতটা রাঘব বোয়াল ও শক্তিশালী তা না বললেও চলে। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মা-সহ একশোজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। পরে সুপ্রিম কোর্ট ৬৩৪ জন ডাক্তারের ডিগ্রি বাতিল করে।

ব্যাপম সাড়ে তিন লাখ মানুষকে চাকরি দিয়েছিল। তার মধ্যে মাত্র ২৩৪ জন চাকরি হারিয়েছেন। এই কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী-সহ প্রচুর মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত হয়েছে। সেই তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ব্যাপম যে আকারের কেলেঙ্কারি, তাতে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হলে অনেককেই কারান্তরালে থাকতে হতো বলে মনে করা হচ্ছে।

হরিয়ানার কথা

খবরের কাগজের অফিসে একটা কথা খুবই প্রচলিত, আজ সকালে যে কাগজ প্রকাশ পেল, বিকেলের মধ্যেই তা ঠোঙা হয়ে যায়। পরেরদিনের কাগজ হাতে আসার পর আগের দিনের খবরের কথা অধিকাংশ পাঠকেরই মনে থাকে না। এককথায়, আমাদের স্মৃতি বড় বিশ্বাসঘাতক। আমাদের কতজনের মনে আছে, ভারতের ইতিহাসে একজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর ছেলে ও আমলাদের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল দুর্নীতি করে শিক্ষক নিয়োগ করতে গিয়ে।

এই কেলেঙ্কারির নাম ছিল 'জুনিয়র বেসিক ট্রেনড টিচার্স স্ক্যাম' বা জেবিটি কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারির জেরে তিহার জেলে বন্দি থাকতে হয়েছিল ওমপ্রকাশ চৌতালা, তাঁর ছেলে অজয় চৌতালা ও সরকারি কর্মীদের। অভিযোগ উঠেছিল, ১৯৯৯-২০০০ সালে ৩,২০৮ জন জেবিটি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়। এই দুর্নীতির অভিযোগটা করেছিলেন প্রাথমিক শিক্ষার ডিরেক্টর ও আইএএস অফিসার সঞ্জীব কুমার। তিনি বলেন, মূল তালিকা বদল করে দু-হাজার শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী চৌতালা। তখন শিক্ষা দফতর তাঁর হাতেই ছিল। চৌতালা পাল্টা অভিযোগ করেন, তালিকা বদলেছিলেন সঞ্জীব কুমারই। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত করে এবং চার বছর পরে রিপোর্ট দেয়। তার ভিত্তিতে মামলা চলে। সিবিআই তদন্তের পর বলে, চৌতালা সরকার তিন থেকে চার লাখ টাকা নিয়ে শিক্ষকের চাকরি দিয়েছিল। ওমপ্রকাশ চৌতালা লিখিতভাবে সঞ্জীবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, মূল তালিকা যেন বদল করা হয়। তাতে যারা টাকা দিয়েছিল, তাদের নাম ঢোকানো হয়। নয়াদিল্লির হরিয়ানা ভবন ও চণ্ডীগড়ের একটি গেস্টহাউসে বসে তালিকাটি চূড়ান্ত হয়। সিবিআই বলেছিল, ওমপ্রকাশ ও অজয় চৌতালা জাল নথির ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন।

প্রথমে সিবিআই কোর্ট দশ জনকে শাস্তি দেয়। হাইকোর্ট সেই রায় বহাল রাখে। পরে সুপ্রিম কোর্টও জানিয়ে দেয়, ওমপ্রকাশ ও অজয় চৌতালা-সহ দশ জনকে জেল খাটতে হবে। ২০১৩-র জানুয়ারিতে তাদের হাজতবাস শুরু হয়।

২০২১ সালের ৪ জুন 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' জানাচ্ছে, করোনার কারণে জেলে কয়েদিদের সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তখন ওমপ্রকাশ চৌতালা ও অজয়ের বাকি জেলমেয়াদ মকুব করে দেওয়া হয়। তারা তিহার জেল থেকে মুক্তি পান। জেলে থাকার সময়ই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা পাস করেন ওমপ্রকাশ চৌতালা।

একটা ছোট তথ্যঃ ওমপ্রকাশের নাতি ও অজয় চৌতালার ছেলে দুষ্মন্ত চৌতালা এখন হরিয়ানার উপ-মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলের সঙ্গে বিজেপি নির্বাচন পরবর্তী জোট করেছে।

উত্তরপ্রদেশের অবস্থা

উত্তরপ্রদেশের পড়ুয়াদের গণ-টোকাটুকির ছবির কথাটা প্রথমে বলেছি। তারপর রাজনাথ সিং মুখ্যমন্ত্রী হয়ে খুব কড়াহাতে টোকাটুকি বন্ধের চেষ্টা করেছেন। এরপর কল্যাণ সিং, মায়াবতী, মুলায়ম সিং যাদব, অখিলেশ যাদব হয়ে এখন যোগী আদিত্যনাথের শাসন চলছে।

এহেন উত্তরপ্রদেশে শিক্ষক নিয়োগের ছবিটা ভয়ঙ্কর। ২০২২ সালের ২৪ জুন 'দ্য কুইন্ট'-এ একটি দীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তার শিরোনামঃ 'ইউপি রিক্রুটমেন্ট স্ক্যামঃ ২,৪৯৪ জন সরকারি শিক্ষক ভুয়া, এসটিএফ জানিয়েছে, এটা হিমবাহের চূড়ামাত্র'। জালিয়াতি করে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষক চাকরি পেয়েছিলেন। আর বিশেষ তদন্তকারী দল বা এসটিএফের মতে, হিমশৈলের চূড়ার নীচে আছে বিশাল বেনিয়মের কাহিনি। আর এই হিসাবটাও তিন বছরের। এরপর ২,৩৪৭ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে এবং ২,৪৬১ জন শিক্ষকের চাকরি বাতিল করা হয়েছে।

মজাটা হলো, ২০২০ সালে দেখা গেল, বিভিন্ন জেলায় প্রচুর শিক্ষিকার নাম অনামিকা শুক্লা। এরপরই ওই জাল অনামিকা শুক্লাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শিক্ষা দফতর নির্দেশ দেয়, সব শিক্ষকদের নিজেদের দশম শ্রেণী থেকে বিএডের মার্কশিট মানব সম্পদ প্ল্যাটফর্মে আপলোড করতে হবে। এরপরই চাকরি ছেড়ে দেওয়া ও স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। যারা তাদের মার্কশিট আপলোড করেছিলেন, তাদের মধ্যে ওই আড়াই হাজার শিক্ষক ছিলেন, যারা জালিয়াতি করেছিলেন। তারা হয় অন্যের মার্কশিট আপলোড করেছিলেন অথবা জাল মার্কশিট দিয়েছিলেন। এক এসটিএফ কর্তাকে উদ্ধৃত করে 'দ্য কুইন্ট' জানিয়েছে, সব জালিয়াত শিক্ষককে ধরলে সংখ্যাটা এক লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। আসল অনামিকা শুক্লা গোন্ডার বাসিন্দা। তাঁর মার্কশিট জাল করে প্রচুর মহিলা চাকরি পেয়েছিলেন, অথচ তিনি বেকার ছিলেন। এই কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর তিনি চাকরি পান।

২০২০ সালের ৯ জুন 'ইকনমিক টাইমস'-এর রিপোর্ট বলছে, শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে পুলিশ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা লাখ লাখ টাকা নিয়ে জালিয়াতি করে শিক্ষক নিয়োগ করত। এর মধ্যে প্রয়াগরাজের একজন সাবেক পঞ্চায়েত সদস্যও আছে। এই সদস্য প্রচুর বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালায়। তাদের কাছ থেকে ২২ লাখ টাকা এবং দুটি বিলাসবহুবল গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। পরে তাদের সূত্রে যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, তাদের জেরা করে পুলিশ। নিয়োগ পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম হওয়া শিক্ষক ভারতের রাষ্ট্রপতির নাম বলতে পারেননি।

এলাহাবাদ হাইকোর্ট ৬৯ হাজার শিক্ষক নিয়োগের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে দেয়।

বিহারের কাণ্ডকারখানা

বছর পাঁচেক আগে বিহারে জনৈক বিজয় শঙ্কর তিওয়ারিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। সে অন্তত একশোজন শিক্ষককে ভুয়ো নথির ভিত্তিতে চাকরি পাইয়ে দিয়েছিল। 'দৈনিক ভাস্কর'-এর রিপোর্ট অনুসারে, তাকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হতো। তার মধ্যে এক লাখ টাকা সে নিজে রাখত। বাকি চার লাখ বোর্ডের কর্মীদের দিত। এভাবেই কোটি কোটি টাকা কামায় তিওয়ারি। আলিসান বাড়ি তৈরি করে। অভিযোগ, ফেল করা পড়ুয়াদেরও পাস করিয়ে দিত সে।

বিহারে ২০১৫ সালে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ আবেদনকারী টেট পরীক্ষার জাল মার্কশিট দাখিল করেছিল। ২০২২-এর ঘটনা। এক হাজার ৩৭৭ জনকে প্রাথমিক শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়। তারপর দেখা যায়, ৪৪৫ জনের ডিগ্রি ভুয়া।

পরিস্থিতি বোঝাবার জন্য সামান্য কয়েকটি উদাহরণ তুলে দিলাম। হাঁড়িতে চাল সেদ্ধ হয়েছে কিনা, তা বুঝতে কয়েকটা ভাত টেপাই যথেষ্ট। যে হারে মার্কশিট জাল করার ঘটনা ঘটেছে, তাতে ভয় হয়, এই শিক্ষকরা কী পড়াবেন, তাদের কাছে পড়াশুনো করা পড়ুয়ারাই বা কী শিখবেন।

দক্ষিণ ভারতের কাহিনি

শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং অযোগ্যদের শিক্ষকপদে চাকরি করে দেওয়াটা পূর্ব বা উত্তর ভারতেই সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়ে আছে ভারতের সবদিকে। দক্ষিণ ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়।

এক বছর আগের কথা। কর্ণাটকে সিআইডি-র ৩০টি দল ৫১টি জায়গায় তল্লাশি চালায় এবং ৩৮ জন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে। তার আগে তারা গ্রেপ্তার করেছিল ২২ জনকে। এই ৬০ জনই ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫-তে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পেয়েছিলেন। আসলে সিআইডি 'কর্ণাটক টেক্সট বুক সোসাইটি'র এমডি এবং সমগ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর, তিনজন অবসরপ্রাপ্ত জয়েন্ট ডিরেক্টর ও একজন ডেটা অপারেটরকে গ্রেপ্তার করেছিল। তারা ওই শিক্ষকদের ভুয়ো মার্কশিটের ভিত্তিতে চাকরি দিয়েছিলেন। আর জালিয়াতিটা ওই অফিসেই করা হত।

তামিলনাড়ুতে ২০১৭ সালে নিয়োগ দুর্নীতি হয়েছে। পলিটেকনিক কলেজে লেকচারার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি। সেখানে ১৯৯ জনের নম্বর ৫০ থেকে ২০০ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর হইচই হয়, তদন্ত হয়। তারপর ১৯৯ জনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

তামিলনাড়ুর মন্ত্রী বালাজিকে পয়সা দিয়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে ইডি। বিরোধীরা বলছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। আর বিজেপি বলছে, দুর্নীতি খুঁজে বের করা।

একের পর এক রাজ্যের ঘটনা বলে দিচ্ছে, প্রতিটি রাজ্যে শিক্ষা বা চাকরি কেলেঙ্কারির সঙ্গে রাজনীতিক, আমলা, দালাল, চাকরিপ্রার্থীদের একটা চক্র কাজ করে। একজনকে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। তারা সকলে মিলে এই চক্রটা পুরো করেন।

কেরল হলো দেশের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত রাজ্য। সেখানেও নিয়োগে কেলেঙ্কারির অভিযোগ সামনে এসেছে। সেটাও খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের স্ত্রীর নিয়োগ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান আচার্যের ক্ষমতাবলে কুন্নুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিয়োগের উপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। অভিযোগটা হলো, মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের স্ত্রী গীতা ভার্গিস 'অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসর'-এর জন্য শর্টলিস্টেড হন। কিন্তু তিনি গবেষণার ক্ষেত্রে ১৫৬ নম্বর পেয়েছিলেন, আর ইন্টারভিউতে ৩২। তাঁকে তালিকায় প্রথম করা হয়। দ্বিতীয় স্থানে যিনি ছিলেন, তিনি গবেষণায় ৬৫১ নম্বর পান, ইন্টারভিউতে ৩০। তারপর এই নিয়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়। পরে রাজ্যপাল ব্যবস্থা নেন।

অন্ধ্রপ্রদেশ যখন ভাগ হয়নি, তেলেঙ্গানার জন্ম হয়নি, তখন ২০১২ সালে শিক্ষক ও অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির কথা সামনে আসে। যাঁরা যে বিষয়ে পড়েননি, তাঁদের সেই বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। কম নম্বর পেয়েও শিক্ষক হয়ে গেছেন অনেকে। ন্যূনতম যোগ্যতামান পূরণ না করেও চাকরি পেয়েছেন। অর্থাৎ গল্পটা সেই একই। শুধু রাজ্যের নাম বদলে যাচ্ছে।

গুজরাটে যা হয়েছে

২০১৪ সালে গুজরাতে তালাতি কেলেঙ্কারি হয়। দুর্নীতির অভিযোগে দেড় হাজার তালাতির নিয়োগ খারিজ করে দেওয়া হয়। আমেদাবাদে নিশাল শাহকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ, নিশাল এক চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েছিল। তার কাছ থেকে এক কোটি ৪৩ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। সরকার অভিযোগ করে কল্যাণ সিং চম্পাবটই হলেন এই কেলেঙ্কারির নাটের গুরু। তিনি গান্ধীনগরে স্মার্ট কোচিং সেন্টার চালাতেন। চাকরিপ্রার্থীকে প্রথমে এক লাখ টাকা দিতে হতো। তারপর সাত থেকে দশ লাখ দিলে চাকরি পাওয়া যেত।

চম্পাবটের অভিযোগ, মন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিং চুদাসামা এই কেলেঙ্কারির নেপথ্যে ছিলেন। মন্ত্রীর আত্মীয়রা টাকা নিয়ে চাকরি দিত। এভাবেই ৫০ হাজার সরকারি কর্মীর নিয়োগ হয়েছিল বলে তার অভিযোগ। 'অল গুজরাত নিউজ'-এর প্রতিবেদন বলছে, চম্পাবট বলেছেন, মধ্যপ্রদেশের কায়দায় গুজরাতেও এই নিয়োগ-কেলেঙ্কারি হয়েছে।

'অল গুজরাত নিউজ'-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে 'টিচার অ্যাপটিটিউড টেস্ট'-এর প্রশ্নপত্র একদিন আগে ফাঁস হয়ে যায়। তারপর এক বাহুবলী ও তার দলবল একটি হোটেলে বসে সেই প্রশ্নপত্রের উত্তর লেখে। সেই প্রশ্ন ও উত্তর পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। হোটেলে সিসিটিভি-র ফুটেজও নষ্ট করে দেওয়া হয়।

মহারাষ্ট্র কোন পথে

দেশের অধিকাংশ রাজ্য একদিকে হাঁটবে, মহারাষ্ট্র অন্যদিকে যাবে তা তো হয় না। ২০২০ সালে মহারাষ্ট্রে 'টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট' (টেট) পরীক্ষা হয়। আর তাতে ব্যাপক দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ। পুণে পুলিশ জানিয়েছে, ৭ হাজার ৭৭৮ জন সফল পরীক্ষার্থীর খাতা পরীক্ষা করে দেখে তারা জানতে পেরেছেন, তাদের নম্বর বাড়ানো হয়েছিল। এই কেলেঙ্কারির সূত্রে পুলিশ আইএএস অফিসার ও ডেপুটি সেক্রেটারি সুশীল খোদওয়েকরকে গ্রেপ্তার করে।

খোদওয়েকর একজন দাগী ব্যক্তিকে মহারাষ্ট্র 'স্টেট কাউন্সিল অফ এক্সামিনেশন'-এর প্রধান করেছিলেন। তারপর তিনি প্রথমেই সফটওয়ার সংস্থাকে বদলে দেন। নিজের পছন্দসই সংস্থাকে নিয়োগ করেন। তারপর তাদের সাহায্যে যারা টাকা দিয়েছে, তাদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে এই কেলেঙ্কারি নিয়ে হইচই হওয়ার পর ওই ৭ হাজার ৭৭৮ জন সফল পরীক্ষার্থীর নম্বর বাতিল করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের কথা অমৃতসমান

পশ্চিমবঙ্গে কী হয়েছে, তা তো আমাদের সামনেই আছে। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে যুক্ত এক অভিনেত্রীও জেলে। তার বাড়ি থেকে রাশি রাশি নোট উদ্ধার করা হয়েছে। সেই টাকা দেখে প্রাথমিকভাবে মানুষ ধাক্কা খেয়েছেন। আর এক মন্ত্রী ও বিধায়কও জেলে। তারপর বিভিন্ন জায়গা থেকে দালালদের সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা টাকা তুলত।

দেখেশুনে মনে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের মডেলটাও অন্য রাজ্যের থেকে আলাদা কিছু নয়। পয়সা এখানে মূল কথা। পয়সা পেলেই চাকরি। শিক্ষকের চাকরি এভাবে অযোগ্য মানুষদের হাতে তুলে দিতে এই রাজনীতিবিদ, আমলা, দালালচক্রের বিন্দুমাত্র হাত কাঁপে না। কারণ, তারা তো একটা জিনিসই জানেন। কীভাবে টাকা রোজগার করতে হয়।

শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির ফল

এর ফল একটাই। পড়ুয়ারা পিছিয়ে পড়বে। এমনিতেই যাদের সামান্যতম সঙ্গতি আছে, তারা সরকারি স্কুলে এখন বাচ্চাকে পাঠান না। বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠান। কিন্তু দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি বাচ্চা তো পড়ে এইসব সরকারি স্কুলে। সেখানে যদি এই দুর্নীতিপরায়ণ অযোগ্য শিক্ষকরা বিরাজ করেন, তাহলে ওই অগণিত বাচ্চার ভবিষ্যতের কী অবস্থা হবে? তারাও ভুলভাল শিখবে। অথবা কিছু শিখবেই না।

আর দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ-আমলা-দালাল-ব্যবসায়ী-শান্তিরক্ষকদের চক্র যতদিন কাজ করে যাবে, ততদিন এই অভিশাপের হাত থেকে মুক্তি নেই। তাদের শক্তি কতটা তা মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারিই প্রমাণ। পথের কাঁটাদের কীভাবে সরিয়ে দিতে হয় তারা তা জানে।

আবার এই কেলেঙ্কারি যখন সামনে আসে, তদন্ত হয়, আদালতের নির্দেশে হয়, তারপরেও তো নানান প্রশ্ন থাকে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেই দেখুন। হাইকোর্টের বিচারপতিরা বারবার প্রশ্ন তুলছেন, কেন মাথাদের ধরতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থা? শুধু কিছু দালালদের কথাই কেন বলা হচ্ছে? সারদা কেলেঙ্কারির সময়ও একই কথা বলেছিলেন বিচারপতিরা।

যে দেশে শিক্ষা নিয়ে এমন কাণ্ড হতে পারে, যে দেশে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে, সেখানে সবকিছুই সম্ভব। তাই খুব বেশি কিছু আশা না করাই ভালো। যখন রিপোর্ট আসবে, ক্লাস সেভেনের পড়ুয়া, ক্লাস ওয়ানের পড়ার বই পড়তে পারছে না বা অঙ্ক কষতে পারছে না, তখন অবাক হবেন না। দুর্নীতি করে যারা চাকরি পান, তারা কী করে পড়াশোনার উৎসাহ সঞ্চারিত করবেন পড়ুয়াদের মধ্যে? স্কুল থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নিয়েও তো প্রশ্ন কম নেই। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই দিন কাটাবে। ডিগ্রি পাবে হয়ত, কিন্তু অশিক্ষিতই থেকে যাবে।