আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২৩ ● ১৬-৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনঃ একটি পর্যালোচনা

সমীরণ সেনগুপ্ত ও সৌম্যদীপ বিশ্বাস


পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে অরাজকতা, হিংসা, ভোট লুঠ, গণনায় কারচুপি এবং মৃত্যুর সাক্ষী থাকলেন রাজ্যবাসী তার প্রধান দায় বর্তায় রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপর। সংবাদমাধ্যমের হিসাবে এই নির্বাচন পর্বে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৬ জন, শুধুমাত্র ভোটের দিনেই হিংসার বলি হয়েছেন ১৮ জন। সমগ্র নির্বাচন পর্বে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন শাসকদলের পক্ষ নিয়ে হয় হিংসায় মদত জুগিয়েছে অথবা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।

নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথেই কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে দেন নির্বাচন কমিশনার। সন্ত্রাস, প্রাণহানি বন্ধ করতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি উলটে জেলা প্রশাসনের উপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব সেরেছেন। হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও মনোনয়ন জমা দেওয়ায় সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পায়নি। মহামান্য হাইকোর্টের রায়কে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভোটের দিন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বহু ক্ষেত্রেই রাস্তায় নামানো হয়নি। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের অধিকারিক সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন যে স্পর্শকাতর বুথের তালিকা তাদের কাছে দেওয়া হয়নি।

ভোট গণনাকে কেন্দ্র করেও ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। একটি মামলার শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছে পঞ্চায়েতের ফলাফল নির্ভর করবে হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ের উপর। রাজ্য নির্বাচন কমিশন বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই কথা শংসাপত্র প্রাপ্ত প্রার্থীদের জানাতে বাধ্য হয়েছে। একদিকে যখন নির্বাচনে জনসাধারণের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করতে বারংবার আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে, অন্যদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই সার্বিক অরাজকতার দায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উপর চাপিয়ে নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার নতুন নজির সৃষ্টি করলেন।

নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল যদিও হাইকোর্টের রায়ের উপর নির্ভরশীল, রাজ্য নির্বাচন কমিশন কিন্তু তাদের ওয়েবসাইটে পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল প্রকাশ করে দিয়েছে। এই ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস পঞ্চায়েত নির্বাচনের তিনটে স্তরেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করেছে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা যে ভোট লুঠ, দেদার ছাপ্পা আর গণনায় কারচুপি দিয়ে অর্জন করা, সেটা সর্বজনবিদিত। প্রকাশিত নির্বাচনী ফলাফলে আসলে দেখার মতন বিষয় হল বিরোধী দলগুলির ফলাফল। এই সন্ত্রাস-হিংসা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলি কি গ্রাম বাংলায় তাদের শক্তি বাড়াতে পেরেছে, আর পেরে থাকলে কতটা?

নির্বাচনী ফলাফল সংক্রান্ত কিছু পর্যবেক্ষণ

পঞ্চায়েত ভোটের ফল জনসমক্ষে প্রকাশ করার দায়িত্ব রাজ্য নির্বাচন কমিশনের। ১১ই জুলাই গণনার দিনের পর পক্ষকাল কেটে গেছে অথচ এখনো তিনস্তরের নির্বাচন কেন্দ্র অনুযায়ী মোট নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা, তার মধ্যে কতজন ভোট দিলেন, কত সংখক ভোট বাতিল হয়েছে এই ধরনের কোনো তথ্যই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়নি। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত ডিসক্লেইমার থেকে এটা স্পষ্ট যে ফলাফল যেটা প্রকাশ করা হয়েছে তা এখনো চূড়ান্ত নয়।

রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে উদ্ধৃত করে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত মোট ভোট এবং ভোট শতাংশের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। যেখানে রাজ্য নির্বাচন কমিশনই এখনো নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশ করতে পারেনি সেখানে সংবাদমাধ্যমে প্রদত্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে জনসমর্থনের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে গণনার কিছুদিন পরেই যেমন রিটার্নিং অফিসারের সই করা বুথ ভিত্তিক ফল কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় (ফর্ম ২০), রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এই ধরনের কোনো উদ্যোগ পঞ্চায়েত বা পৌরসভা ভোটের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়না। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।

তিনস্তরের জেতা আসনের যে তথ্য রাজ্য নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করেছে সেখানে কিছু ছোট দলের প্রাপ্ত আসন আলাদা করে দেওয়া হয়েছে আবার বেশ কয়েকটি ছোট দলের প্রাপ্ত আসন একসাথে 'অন্যান্য' ('Others') তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজ্য বিধানসভায় তৃণমূল এবং বিজেপি ব্যতীত একমাত্র দল যার বিধায়ক রয়েছে সেই আইএসএফ-কে ঠেলে দেওয়া হয়েছে অন্যান্যদের তালিকায়, বামফ্রন্ট-এর অন্তর্ভুক্ত সিপিআই বা আরএসপির তথ্যও পৃথকভাবে উল্লেখিত হয়নি অথচ রাজ্য রাজনীতিতে কার্যত অস্তিত্বহীন কিছু দলের ফল আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও পঞ্চায়েত নির্বাচনের তিন স্তরেই এদের জেতা আসন সংখ্যা শূন্য। নির্বাচন কমিশন কেন এইভাবে ফল প্রকাশ করছে তার কোনো ব্যাখ্যাও নেই। একদিকে তথ্যের অসম্পূর্ণতা, অন্যদিকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তথ্য উপস্থাপনার এই পদ্ধতির ফলে ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনার কাজ আরো কঠিন হয়েছে।

নির্বাচনের ফলের বিশ্লেষণ

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস মোট আসনের ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসকদলের জেতা আসনের সংখ্যা ২০২৩ নির্বাচনে ৯ থেকে ১২ শতাংশের মতন। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের জেলযাত্রা, বগটুই হত্যাকান্ড, ছাত্রনেতা আনিস খানের অপমৃত্যু, হাঁসখালি, কালিয়াগঞ্জ সহ অন্যান্য ঘটনাবলীর ফলে সামগ্রিকভাবে তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকারের স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক আচরণ যে গ্রাম বাংলার মানুষ বিশেষ পছন্দ করছেন না সেটা তৃণমূলের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জয়ের আসন সংখ্যা কমে যাওয়ায় খানিকটা প্রতিফলিত হয়েছে। অতীতের তুলনায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আগাম প্রস্তুতির ছবিও এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট।

ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতায় তৃণমূল কংগ্রেস চার রকমভাবে বিরোধী জনমতকে দমিয়ে রেখে দিয়ে নির্বাচনের ফল নিজেদের অনুকূলে আনতে পেরেছে। প্রথমে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রদানে বাধাদান, এরপরে মনোনয়ন তুলে নেওয়ার জন্য নানাবিধ উপায়ে চাপ সৃষ্টি, তারপরে ভোটের দিন বোমাবাজি, সন্ত্রাস এবং শেষ পর্বে গণনায় কারচুপি ও বিজয়ী বিরোধী প্রার্থীদের থেকে শংসাপত্র ছিনতাই ও পরাজিত শাসকদলের প্রার্থীদের অনেককেই জয়ী হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া।

২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে মোট আসন সংখ্যা ৪৮,৬৩৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৩,২২৯। ২০১৮ সালে তৃণমূল জিতেছিল ৩৮,১১৮ গ্রাম পঞ্চায়েত আসন, ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৪,১০৫। অর্থাৎ মোট গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের জেতা আসনের অনুপাত ২০১৮-তে ৭৮ শতাংশ থেকে ২০২৩-এ কমে হয়েছে ৭০ শতাংশ। পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে ২০১৮ সালে তৃণমূল জিতেছিল ৮,০৬২ আসন, ২০২৩-এ জেতা আসন সংখ্যা কমে হয়েছে ৭,৮৫৫ (Table 1 এবং 3 দেখুন)। বিরোধীদের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও তৃণমূলের জনসমর্থন যে হ্রাস পেয়েছে সেটা পরিষ্কার।

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে আসে বিজেপি। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাদের ফল আরো ভাল হয়েছে। ২০১৮ সালে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে বিজেপি জয় পেয়েছিল ৫,৭৭৯ আসনে, ২০২৩-এ সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯,৯৯০। পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ স্তরেও তাদের আসন সংখ্যা বেড়েছে (Table 3)। গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ তিনটে স্তরেই বিজেপি অন্যান্য সব বিরোধী প্রার্থীদের থেকে আসন সংখ্যায় অনেক আগিয়ে আছে।



ভোট শতাংশের নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা মোট আসনের মধ্যে জেতা আসনের অনুপাত বা 'স্ট্রাইক রেট'-এর ভিত্তিতে বিভিন্ন দলের ফলাফল দেখানো হয়েছে ১ নম্বর সারণীতে (Table 1)। তৃণমূল কংগ্রেস ৬১ হাজারের বেশি প্রার্থী দিয়ে জিতেছে ৪৪ হাজারের বেশি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন, বিজেপি ৩৮ হাজারের বেশি আসনে প্রার্থী দিয়ে জিতেছে প্রায় ১০ হাজার আসন, সিপিআই(এম) ৩৫ হাজারের বেশি প্রার্থী দিয়ে জিতেছে কেবল ৩ হাজারের কিছু বেশি আসন, কংগ্রেস ১১ হাজারের বেশি আসনে প্রার্থী দিয়ে জিতেছে ২.৬ হাজারের বেশি আসন এবং অন্যান্য + নির্দলরা ২২ হাজারের বেশি প্রার্থী দিয়ে জিতেছে ৩ হাজারের কিছু বেশি আসন। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে প্রধান দলগুলির স্ট্রাইক রেটের হিসেবে তৃণমূল প্রথম, বিজেপি দ্বিতীয়, কংগ্রেস তৃতীয়, সিপিআই(এম) চতুর্থ। পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ স্তরে জেতা আসন এবং স্ট্রাইক রেট দুই হিসেবেই তৃণমূল প্রথম, বিজেপি দ্বিতীয়, কংগ্রেস তৃতীয়, সিপিআই(এম) চতুর্থ।

বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস এই নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে লড়াই করার কথা ঘোষণা করলেও জেলা পরিষদে এই জোট সেভাবে কার্যকর হয়নি। জেলা পরিষদের মোট ৯২৮ আসনের মধ্যে সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্টের অন্যান্য শরিকরা মিলে ৮০০-র বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল, অন্যদিকে কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছিল ৬৪৪ জেলা পরিষদ আসনে। সিপিআই(এম) জেলা পরিষদের ২টি আসন জিততে পেরেছে, সেখানে কংগ্রেস জিতেছে ১৪ আসন। পঞ্চায়েত সমিতি স্তরেও একই চিত্র, সিপিআই(এম)-সহ বামফ্রন্ট অনেক বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে কিন্তু কংগ্রেস আসন পেয়েছে বেশি। এর থেকেই বোঝা যায় যে কংগ্রেসের সাংগঠনিক ব্যাপ্তি পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদ, মালদা এবং উত্তর দিনাজপুরের মতন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলায় সীমিত; কিন্তু যেখানে এখনো কংগ্রেসের সংগঠন আছে, সেখানে তাদের আসন জেতার মতন জনসমর্থনও আছে। অন্যদিকে সিপিআই(এম)-সহ বামফ্রন্টের সংগঠন এখনো কংগ্রেসের তুলনায় রাজ্যের অনেক বেশি জেলায় আছে, কিন্তু তাদের জনসমর্থন এতটাই কমে গেছে যে তারা কংগ্রেসের থেকে অনেক বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও তুলনামূলকভাবে অনেক কম আসন জিতেছে।



২ নম্বর সারণীতে (Table 2) ২০০৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের তিন স্তরে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রাপ্ত আসন সংখ্যা দেওয়া আছে। সিপিআই(এম)-সহ বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের প্রাপ্ত আসন সর্বস্তরেই দুই দশক ধরে ক্রমাগত কমেছে। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের পর শাসকদল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস পঞ্চায়েতের সর্বস্তরে নিজেদের শক্তি বাড়িয়েই গেছে। আর বিরোধী পরিসরে ২০১৮-র নির্বাচনে থেকে সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বিজেপি।

২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্টের সামনে মুখ্য চ্যালেঞ্জ ছিল কংগ্রেস এবং আইএসএফ-এর সাথে জোট বেঁধে তারা বিজেপিকে পিছনে ফেলে প্রধান বিরোধী হিসেবে উঠে আসতে পারবে কিনা। সেই লক্ষ্যে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৮-র তুলনায় গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে সিপিআই(এম)-এর কিছু আসন বৃদ্ধি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিজেপির আসন বৃদ্ধির হার সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্টের তুলনায় অনেক বেশি।



৩ নম্বর সারণীতে (Table 3) ২০২৩ এবং ২০১৮-র জেলা ভিত্তিক গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির জেতা আসনের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে প্রাপ্ত আসনের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে ২০১৮-র তুলনায় মুর্শিদাবাদ, নদীয়া এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তৃণমূলের আসন কমেছে। এই তিনটি জেলাতেই নিজেদের আসন অনেকটাই বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি; পূর্ব মেদিনীপুর এবং নদীয়াতে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে বিজেপির আসন বৃদ্ধি চোখে পড়ার মতন। মুর্শিদাবাদ জেলায় কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম)-এর আসন সংখ্যা অনেকটা বেড়েছে। মুর্শিদাবাদ আর মালদা জেলায় গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে জেতা আসনের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে আছে কংগ্রেস; পূর্ব এবং পশ্চিম বর্ধমানে দ্বিতীয় স্থানে আছে সিপিআই(এম)। বাকি ১৮টি জেলাতেই বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে আছে। তবে হাওড়া, ঝাড়গ্রাম, মালদা এবং পুরুলিয়া, এই চার জেলায় বিজেপির আসন সংখ্যা ২০১৮-র তুলনায় কমেছে।

রাজ্য নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েত নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশ করলে ভোটের শতাংশের ভিত্তিতে জেলা বা ব্লক স্তর পর্যন্ত আরও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। তবে এই ফলাফলের ভিত্তিতে এটা বলা যেতে পারে যে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে লড়াইটা প্রধানত শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধী বিজেপি-র মধ্যেই হতে চলেছে। মালদা বা মুর্শিদাবাদের মতন সংখ্যালঘু-প্রধান জেলা বাদ দিলে এটাই গ্রাম বাংলার অধিকাংশ জেলার বর্তমান চিত্র। এই প্রেক্ষিতে সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচন নিয়ে রাজ্যে কি অবস্থান নেয় তার দিকে সকলেই তাকিয়ে থাকবে।


নোটঃ

1. নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী,

1.1 ২০২৩ সালে ৩টি পঞ্চায়েত সমিতি আসন এবং ৪২টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসন বাতিল করা হয়েছে। ৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে মনোনয়ন বৈধ নয়।

1.2 ২০১৮ সালে জেলা পরিষদে ৮২৫টি আসনের মধ্যে ৮২৪টি, পঞ্চায়েত সমিতিতে ৯,২১৭টি আসনের মধ্যে ৯,২১৪টি, গ্রাম পঞ্চায়েতে ৪৮,৬৩৯টি আসনের মধ্যে ৪৮,৬৩৬টি আসনের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।

1.3 ২০০৮ সালে জেলা পরিষদে ৮,৮০০টি আসনের মধ্যে ৭,৯৯৮টি আসনের ফল প্রকাশিত হয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েতে ১৫টি আসনে ভোট বাতিল করা হয়েছিল, ১১টি আসনে ভোট বয়কট করা হয়েছিল এবং ১টি আসনে পুনরায় নির্বাচন হয়েছিল।

2. বামফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য দলগুলোর প্রাপ্ত আসন ‘OTHERS & IND’-এর মধ্যে ধরা হয়েছে।