আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২৩ ● ১৬-৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

সমসাময়িক

উপাচার্য বিভ্রাট


অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে এক বেনজির দড়ি টানাটানি শুরু হয়েছে যা অবশ্যই রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে এক নয়া উপাদান যোগ করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী ছয় দশক ধরে রাজ্য সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ উঠলেও তা কিছু ব্যতিক্রম হিসাবেই ছিল। কিন্তু এভাবে রাজ্য সরকার ও রাজ্যপালের ভেতর পাঞ্জা লড়াই উপাচার্য নিয়োগ ঘিরে হয়েছে বলে কেউই মনে করতে পারেন না। একদিকে রাজভবনে বসে রাজ্যপাল নিজের পছন্দের কিছু ব্যক্তিকে রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করছেন। অন্যদিকে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর সেই ব্যক্তিদের উপাচার্য পদের দায়িত্ব নেওয়া থেকে বিরত থাকার আদেশ জারি করছে। আবার মনোনীত ব্যক্তিরা সেই আদেশকে পাত্তা না দিয়ে উপাচার্যের আসনে বসছেন। পরমুহূর্তেই উচ্চশিক্ষা দপ্তর নির্দেশ জারি করে এদের বেতন বন্ধ করছে। তার ফলশ্রুতিতে আদালতকে হস্তক্ষেপ করে বলতে হচ্ছে এমন আদেশ বেআইনী। বেতন বন্ধ করা যাবে না। সব মিলিয়ে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্র নিয়ে যে কদর্য তামাশা শুরু হয়েছে, হতভাগ্য রাজ্যবাসী বিরস বদনে এই দড়ি টানাটানির খেলায় কার পক্ষ নেওয়া উচিত তা বুঝতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে।

এই গোটা তামাশার সূত্রপাত ২০২২ সালের একটি সরকারি ঘোষণা থেকে। ১৪ই জুন, ২০২২ সালে হঠাৎ করেই রাজ্য সরকার একটি বিল পাশ করে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্য পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির 'আচার্য' ঘোষণা করা হয়। যদিও বিলটি রাজভবনে গিয়ে আটকে থাকে। সেই সময় তদানীন্তন রাজ্যপাল এই বিলে সম্মতি দিতে নারাজ হন। এরপর রাজ্যের প্রায় ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী উপাচার্য দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছিল। সম্প্রতি তার ভেতর একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই রাজ্যপাল বদল হয় এবং নতুন রাজ্যপাল এসে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে বৈঠক শুরু করেন। কিন্তু কেবল আলাপ আলোচনাতেই এই প্রসঙ্গ শেষ হয়না। রাজ্যপাল একতরফা তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পছন্দমত কিছু ব্যক্তিকে উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের জন্য অস্থায়ীভাবে নিয়োগ করেন। এর মধ্যে আবার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় কর্ণাটক হাইকোর্টের একজন প্রাক্তন বিচারপতিকে। পরে আবার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস-কে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরে কাউকে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়ত নতুন নয়, কিন্তু এর আগে যাঁরা এমন দায়িত্ব পেয়েছেন তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু না কিছু অবদান ছিল। কিন্তু এবারে এক নতুন নজির সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে এই উপাচার্যদের নিয়োগ নিয়ে আদালতেও টানাপোড়েন চলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে এমন নজির তৈরির কারণ কি? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। একাধিকবার সেই নিয়মের কিছু পরিবর্তন ঘটলেও এই নিয়মাবলির মধ্যে যে আদর্শটি অন্তর্নিহিত ছিল তা হল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বশাসিত করে তোলার চেষ্টা। সেই কারণেই উপাচার্য নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইন বা স্ট্যাটুট ছিল সর্বোচ্চ। এর মাধ্যমেই উপাচার্য নিয়োগের জন্য অনুসন্ধান কমিটি তৈরি করা হত যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরিচালন সমিতির প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। এর ফলে উপাচার্য নিয়োগে শেষ মতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেরই হবে। এমনটাই ভাবা হয়েছিল। এর ফলে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা হবে এমনটাই আশা ছিল। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরিচালন সমিতি নির্বাচিত হতো ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত অংশের মতের প্রতিফলন ঘটারও একটা সুযোগ থাকত।

কিন্তু ২০১১ সালে রাজ্যের সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরে উচ্চশিক্ষায় প্রথম যে পরিবর্তনটি আনা হয় তা হল এই 'নির্বাচিত পরিচালন সমিতি' উঠিয়ে দিয়ে 'অনুমোদিত পরিচালন সমিতি' তৈরি করা। ফলে প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় যে গণতান্ত্রিক উপাদানটি ছিল তা নষ্ট করা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণের জন্য উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়াকেও আরও রাজনৈতিক প্রভাবান্বিত করা হয়। বর্তমানে সরকারি আইন মোতাবেক উপাচার্য নিয়োগের জন্য অনুসন্ধান কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধির বাইরে একজন সরকারি প্রতিনিধি থাকবেন। এটা করার উদ্দেশ্য হল, যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী আচার্য হতে পারছেন না, ফলে রাজ্যপাল তথা আচার্যের প্রতিনিধির মতকে সংখ্যালঘু করতে একজন পুরোদস্তুর রাজনৈতিক প্রতিনিধি আমদানি করা হয়েছে যার কাজই হল রাজ্য সরকারের মতকে প্রতিষ্ঠা করা।

অন্যদিকে আচার্য তথা রাজ্যপালও যে রাজনৈতিক অভিসন্ধির ঊর্ধ্বে এমনটা নয়। বর্তমানে রাজ্যপাল প্রায় কেন্দ্রীয় শাসকদলের কর্মীর মতনই আচরণ করছেন। অন্যদিকে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি তারাও যে শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থার পক্ষপাতী এমনটা নয়। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তারা যে ব্যবস্থা চালু রেখেছেন তাও সম্পূর্ণই একনায়কতান্ত্রিক। সেখানেও একজন উপাচার্য বা ডিরেক্টর নিয়োগ করে তার অনুমোদিত পরিচালন সমিতি দিয়ে কাজ চালানো হয়। সেখানেও কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচনের রেওয়াজ নেই। ফলে এমন অবস্থায় রাজ্যপাল যে এই গণ্ডগোলের ফায়দা তুলবেন না এমন ভাবা বাতুলতা। রাজ্যের সরকার যেমন তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর তেমনি কেন্দ্রের সরকারের প্রতিভূ রাজ্যপালও ঠিক একই কাজ করছেন। ফলে দুই হাতে তালি বেজেই চলেছে, তামাশা জমে উঠেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল রাজ্য বা কেন্দ্রের সরকার কেন উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে এহেন রাজনৈতিক দখলদারি কায়েম করতে চায়। এর দুটি দিক আছে। একদিকে শিক্ষার প্রসার সমাজে সচেতন জনতার জন্ম দেয়। এই শিক্ষিত জনতা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে। তার আধিপত্যকে দ্বন্দ্বের সামনে দাঁড় করায়। ফলে এদেশে যখন যখন শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, আরও বেশী মানুষ শিক্ষার আঙ্গিনায় ঢুকতে পেরেছে তখনই দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেছে। আর তার রেশ ধরেই উচ্চশিক্ষা পরিচালনাতেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু বর্তমানে রাজ্যের বা কেন্দ্রের শাসক দলগুলি বৃহৎ পুঁজির ধামাধারী। ফলে তাদের স্বার্থে শাসন পরিচালনার জন্য এমন এক ব্যবস্থা চাই যা হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঠিক উলটো, একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যেখানে ব্যক্তিপূজো হবে। আর সেই ব্যক্তির ঈশারাতেই প্রশাসন চলবে। ফলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সেই রাজনৈতিক মনোভাবের প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে দেশের বৃহৎ পুঁজি আজ নয়া শিক্ষানীতির হাত ধরে উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে ঢুকতে চাইছে। পশ্চিমবঙ্গে এই ক্ষেত্র এখনও উম্মুক্ত। ফলে সরকারি পরিকাঠামোকে ব্যক্তিপুঁজির হাতে তুলে দিতেও উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে দরকার নিরঙ্কুশ আধিপত্য। আজকে রাজ্যজুড়ে সেই প্রতিযোগিতাই চলছে। এই দ্বিমুখী লড়াই জিততে হলে রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীদের এক ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন। কিন্তু সে দায়িত্ব পালন করবে কে?