আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২৩ ● ১৬-৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

মণিপুর কোন চক্রান্তের শিকার?


৭৯। ৮। ১৪। ৩৬। আপাতদৃষ্টিতে নিছক চারটি নিরীহ সংখ্যা। তবে ভারতের বিশেষতঃ মণিপুর রাজ্যের গত কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহে সংখ্যাগুলি এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। মণিপুরের সাম্প্রতিক অশান্তি শুরু হওয়ার ৭৯ দিন পর সংসদ ভবনের বাইরে সাংবাদিকদের সামনে (সাংবাদিক সম্মেলন নয়) ৮ মিনিটের এক ভাষণে তিনি আচমকা ১৪ সেকেন্ডের জন্য মণিপুরের নাম পরোক্ষভাবে উচ্চারণ করলেন। তিনি জানালেন, "১৪০ কোটি মানুষের জন্য ভয়াবহ লজ্জা।" একই বাক্যে যুক্ত ছিল রাজস্থান ও ছত্রিশগড়ের নারী নির্যাতন সংক্রান্ত দুঃখপ্রকাশ। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। ৪ঠা মে মণিপুরে ঘটে যাওয়া নারী নিগ্রহের ভয়াবহ ঘটনার ৩৬ সেকেন্ডের ভিডিও ১৯শে জুলাই সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে প্রচারিত না হলে এতটুকুও পাওয়া যেত কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রচারমাধ্যমে এই ঘটনার উল্লেখ করে ভারত সরকারের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে।

মে মাসের ৩ তারিখ থেকে মণিপুর অশান্ত। মেইতেই সম্প্রদায়ের জনজাতিকরণ প্রসঙ্গে ২৭শে মার্চ হাইকোর্টের যে নির্দেশ জারি হয়েছিল তার প্রতিবাদে ৩রা মে রাজধানী ইম্ফল শহরে কুকি জনজাতির মিছিল থেকে অশান্তির সূচনা। প্রথমে মেইতেই আর কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের সংঘর্ষ বলে খবর প্রচারিত হল। তারপর প্রায় প্রতিদিন হিংস্রতা-হানাহানি বাড়তে শুরু করে। সংঘাতের কারণ হিসেবে নিত্যনতুন বিষয় যুক্ত হতে থাকে।

জাতি-ধর্ম-ভাষা প্রাথমিক পর্যায়ে সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও ক্রমশঃ তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে অন্যান্য অনেক বহুমাত্রিক অভিযোগ। বিবদমান সব পক্ষ থেকেই নিত্যনতুন অভিযোগ আনা হচ্ছে। কুকিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তারা পপি চাষ বাড়িয়ে চলেছে। পপি ফলের বীজ হল পোস্ত। আর আঠা হল মাদক তৈরির উপকরণ। কুকিরা নাকি এখন ঘরে ঘরে মাদক উৎপাদন করছে। এবং সেই মাদক মায়ানমারে চালান যায়। প্রাক্তন সেনাপ্রধান মন্তব্য করেছেন, ‘‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীকে ধারাবাহিকভাবে মদত দেয় চিন। মণিপুরের সাম্প্রতিক হিংসার নেপথ্যেও চিনা মদতের অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’’ সত্যমিথ্যা কে বিচার করবে?

চূড়ান্ত বিচারে হানাহানি বাড়ছে। ঘরবাড়ি পুড়ছে। প্রাণ বাঁচাতে মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। ইম্ফল নদীর অববাহিকায় অবস্থিত রাজধানী শহর এবং সংলগ্ন সমভূমিতে কুকিদের বসবাস নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে, পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে থাকা জনবসতি থেকে মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ উধাও। কোনো কোনো প্রাজ্ঞ ব্যক্তি এই প্রক্রিয়াকে জাতি নিধন বা 'এথনিক ক্লিনজিং' আখ্যা দিয়েছেন। সবমিলিয়ে মণিপুরের মানুষ-সমাজ আজ দ্বিধাবিভক্ত। দু'-পক্ষই ভীত। সন্ত্রস্ত। এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্যদের বিশ্বাস করে না। মণিপুরের গর্ব এবং ঐতিহ্য 'ইম্মা কেইথেল' বা মায়েদের বাজার আজ মেইতেই কেইথেল হয়ে গেছে। সেখানে কুকি মায়েদের ঠাঁই নেই।

এই প্রেক্ষাপটে দাবি উঠেছে যে কুকিদের জন্য পৃথক প্রশাসন চাই। সেই দাবিকে সমর্থন করতে এগিয়ে এসেছে প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরাম। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজধানী আইজল শহরে আয়োজিত হয়েছে বিশাল মিছিল। মিজোদের বক্তব্য অনুযায়ী কুকি-জোমি এবং মিজো নৃতাত্ত্বিকভাবে একই জাতি। সেই সুবাদে গৃহহারা কুকিদের বড়ো অংশ মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে। অঘটনের আশঙ্কায় মিজোরামে কর্মরত মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ইম্ফলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। প্রশাসনের উদ্যোগে সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? অথচ ৩৫ লক্ষ জনসংখ্যার রাজ্যে প্রায় এক লক্ষ আধা-সামরিক ও সামরিক বাহিনীর জওয়ান মোতায়েন রয়েছে।

'ডাবল ইঞ্জিন' সরকারের প্রশস্তিতে পঞ্চমুখ প্রধানমন্ত্রী গত তিন মাসে একবারও মণিপুর যাওয়ার সময় পাননি। অথচ নির্বাচনের প্রচারের সময় একাধিকবার তিনি নিত্যযাত্রীর মতো আহমেদাবাদ-ইম্ফল যাতায়াত করতেন। গত তিন মাসে তিনি নিয়মিত বিদেশ সফর করেছেন। বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের সুখ্যাতি করেছেন। কিন্তু দেশের বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যর প্রশ্নে তিনি নীরব। এমনকী তাঁর অতি প্রিয় 'মন কী বাত' বা 'মনের কথা' শীর্ষক রেডিও-টিভির অনুষ্ঠান, যেখানে তিনি একতরফাভাবে হাজারো-এক বিষয়ে কথা বলতে পারেন সেখানেও বাদ মণিপুরের কথা। অনেকের আশা ছিল যে 'মন কী বাত' অনুষ্ঠানের ১০১, ১০২ অথবা ১০৩ নম্বর সংস্করণে হয়তো মণিপুরের সমস্যা নিয়ে তিনি কোনো মতামত জানাবেন। না, মে, জুন এবং জুলাই মাসের অনুষ্ঠানে যথারীতি মণিপুর অনুচ্চারিত।

নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের বিষয়ে তিনি যত বেশি উৎসাহী সংসদের অধিবেশনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে তিনি ততটাই নৈর্ব্যক্তিক। সংসদে তাঁর বিবৃতি দাবি করে বিরোধী দলের সাংসদরা উত্তাল হলেও তিনি বা শাসকদলের কোনো প্রতিক্রিয়া প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা যায়নি। বিরোধী দলের সাংসদরা মণিপুরের বিষয়ে আলোচনার দাবি করতে না করতেই স্পীকার অধিবেশন মুলতবি করে দিচ্ছেন। এমনটাই এখন দস্তুর।

দেশজুড়ে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। বিদেশি সংবাদমাধ্যমও তীব্র সমালোচনা করে চলেছে। ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। এবং মণিপুরের বিষয়ে ভারত সরকারের কার্যকলাপের নিন্দা করা হয়েছে। বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারপক্ষ আপাতদৃষ্টিতে মণিপুর নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে সম্মতি দিয়েছে। কিন্তু সংসদীয় বিধির কোন ধারায় আলোচনা হবে তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। এই হট্টগোলের মধ্যেই পাশ করানো হচ্ছে একের পর এক বিল। সেগুলি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ নেই। লোকসভায় সংখ্যাধিক্যের সুবাদে ধ্বনিভোটে সেগুলি পাশ করিয়ে নিয়ে নিয়ম মেনে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজ্যসভায়।

সংসদের বাদল অধিবেশনে তড়িঘড়ি পাশ করানো অনেক বিলের মধ্যে অন্ততঃ দু'টির সঙ্গে মণিপুরের সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

১) ফরেস্ট (প্রোটেকশন) অ্যাক্ট, ২০২৩।
২) মাইনস্ অ্যান্ড মিনারেলস্ (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন) অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ২০২৩।

প্রথম বিলটি আইনে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর দেশের অরণ্য সম্পদের অবস্থা কী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানানরকমের আলোচনা চলছে। এই আইন জারি হলে অরণ্যের অধিকার সংরক্ষণ করার দায়িত্ব আর পুরোপুরি সরকারের কাছে থাকবে না। এইখানেই লুকিয়ে আছে মণিপুরের অশান্তির অন্যতম প্রধান কারণ।

লোকসভায় সদ্য পাশ করানো অরণ্য বিল অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সীমান্তের ভিতরে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বনাঞ্চলকে সংরক্ষণের আওতার বাইরে রাখা যাবে। কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিক সমীক্ষার পর মণিপুরের বনাঞ্চলকে 'সংরক্ষিত অরণ্য' ঘোষিত করার চেষ্টা হচ্ছে। অরণ্য সম্পদের মালিকানা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০১৯ থেকে গাঁজা আর মারুহুয়ানা চাষকে আইনসম্মত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কোনো এক ভেষজ উৎপাদন সংস্থা যাদের বিজ্ঞাপন সর্বত্র দেখা যায়, তারা নাকি গাঁজা ও মারুহুয়ানায় নিজেদের উৎপাদিত ওষুধের উপকরণ খুঁজে পেয়েছে। জনজাতিদের অরণ্য থেকে উৎখাত করা সম্ভব হলে এইসব জমির মালিকানা হস্তান্তর করা যাবে। সমতলের মেইতেইদের যদি জনজাতি শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তবে জঙ্গল-জমির হাতবদল সম্ভব হবে। এ সবই ভবিষ্যতের সঙ্কেত। কিন্তু এইসব কারণ ঘিরে যা ঘটেছে, তা রাষ্ট্রের মদতে জনজাতি বিতাড়ন।

বছর দুয়েক আগে ২০২১-এর আগস্ট মাসে 'ন্যাশনাল অয়েল মিশন' স্থাপনের ঘোষণা করা হয়। তার কিছুদিন পরেই বাকপটু প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মণিপুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে রাজ্যে ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে পাম গাছের চাষ হবে। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্গত এলাকায় জমি কেনার অধিকার সকলের নেই। কিন্তু নতুন অরণ্য আইন বাস্তবায়ন হয়ে গেলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। আইন পাশ করানো তো দূরের কথা বিল প্রণয়নের আগেই সম্ভবতঃ গোপনে জমি হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে গুয়াহাটিতে আয়োজিত সরকারি সভায় দেশের কৃষিপণ্য বাণিজ্য-বিপণনের এক অগ্রণী সংস্থার প্রতিনিধি জানিয়ে দেন যে মণিপুরের সাতটি এলাকায় পাম গাছ লাগানোর জন্য তাঁরা জমির বন্দোবস্ত করেছেন।

মাইনস্ অ্যান্ড মিনারেলস্ (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেশন) অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ২০২৩ আইনে পরিণত হলে দেশে বেসরকারি সংস্থাগুলিও লিথিয়াম-সহ ছ'টি খনিজ পদার্থ উত্তোলনের সুযোগ পাবে। বাকিগুলি হল বেরিলিয়াম, টাইটেনিয়াম, নিয়োবিয়াম, ট্যান্টালাম ও জির্কোনিয়াম। বর্তমানে ১২টি খনিজ উত্তোলনের অধিকার রয়েছে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির হাতে।

পূর্ব মণিপুরের জেলাগুলিতে সমীক্ষা করে ভারত সরকারের খনি মন্ত্রক ও জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া পেয়েছে বিরাট পরিমাণ খনিজের সন্ধান। লাইমস্টোন, ক্রোমাইট, তামা, নিকেল, ম্যাগনেটাইট, এমনকি প্লাটিনাম গ্রুপের মৌলও। কেবল লাইমস্টোন ও ক্রোমাইটের পরিমাণই আনুমানিক ২৬ মিলিয়ন টন। খনিজ উত্তোলনের জন্য অনেক বেসরকারি সংস্থাকে লিজও দেওয়া হয়েছে সেই খনি। ফলে এবার অরণ্য ও জমি থেকে উৎখাত হবেন জনজাতির মানুষ।

মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ জনজাতির (এসটি) স্বীকৃতি পেয়ে গেলে তারা পেয়ে যাবে সর্বত্র জমি-মাটি কেনা-বেচার আইনী অধিকার। সেই প্রলোভনে মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ আজ হানাহানি-খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েছে। নিজেদের সাবেক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে প্রাচীন সম্প্রীতির পরিসর ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ। আর এই সুযোগে সামাজিক মেরুকরণ ও বিভাজনের কান্ডারিরা পরীক্ষা করে নিতে চাইছে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। দেশের খনিজ-বনজ সম্পদ বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে এবং সামাজিক মেরুকরণ ও বিভাজনের বিরুদ্ধে সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের একযোগে লড়াই শুরু করতে আর কালক্ষয়ের সময় নেই।